যুবরাজ অভিজিৎ ও রাজকুমার সঞ্জয়ের প্রবেশ |
|
সঞ্জয়। | বুঝতে পারছি নে, যুবরাজ, রাজবাড়ি ছেড়ে কেন বেরিয়ে যাচ্ছ? |
অভিজিৎ। | সব কথা তুমি বুঝবে না। আমার জীবনের স্রোত রাজবাড়ির পাথর ডিঙিয়ে চলে যাবে এই কথাটা কানে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি। |
সঞ্জয়। | কিছু দিন থেকেই তোমাকে উতলা দেখছি। আমাদের সঙ্গে তুমি যে বাঁধনে বাঁধা সেটা তোমার মনের মধ্যে আলগা হয়ে আসছিল। আজ কি সেটা ছিঁড়ল। |
অভিজিৎ। | ওই দেখো সঞ্জয়, গৌরীশিখরের উপর সূর্যাস্তের মূর্তি। কোন্ আগুনের পাখি মেঘের ডানা মেলে রাত্রির দিকে উড়ে চলেছে। আমার এই পথযাত্রার ছবি অস্তসূর্য আকাশে এঁকে দিলে। |
সঞ্জয়। | দেখছ না, যুবরাজ, ওই যন্ত্রের চূড়াটা সূর্যাস্ত-মেঘের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে? যেন উড়ন্ত পাখির বুকে বাণ বিঁধেছে, সে তার ডানা ঝুলিয়ে রাত্রির গহ্বরের দিকে পড়ে যাচ্ছে। আমার এ ভালো লাগছে না। এখন বিশ্রামের সময় এল। চলো, যুবরাজ, রাজবাড়িতে। |
অভিজিৎ। | যেখানে বাধা সেখানে কি বিশ্রাম আছে? |
সঞ্জয়। | রাজবাড়িতে যে তোমার বাধা, এতদিন পরে সে কথা তুমি কি করে বুঝলে। |
অভিজিৎ। | বুঝলুম, যখন শোনা গেল মুক্তধারায় ওরা বাঁধ বেঁধেছে। |
সঞ্জয়। | তোমার এ কথার অর্থ আমি পাই নে। |
অভিজিৎ। | মানুষের ভিতরকার রহস্য বিধাতা বাইরের কোথাও না কোথাও লিখে রেখে দেন; আমার অন্তরের কথা আছে ওই মুক্তধারার মধ্যে। তারই পায়ে ওরা যখন লোহার বেড়ি পরিয়ে দিলে তখন হঠাৎ যেন চমক ভেঙে বুঝতে পারলুম উত্তরকূটের সিংহাসনই আমার জীবন-স্রোতের বাঁধ। পথে বেরিয়েছি তারই পথ খুলে দেবার জন্যে। |
সঞ্জয়। | যুবরাজ, আমাকেও তোমার সঙ্গী করে নাও। |
অভিজিৎ। | না ভাই, নিজের পথ তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার পিছনে যদি চল তাহলে আমিই তোমার পথকে আড়াল করব। |
সঞ্জয়। | তুমি অত কঠোর হ’য়ো না, আমাকে বাজছে। |
অভিজিৎ। | তুমি আমার হৃদয় জান, সেইজন্যে আঘাত পেয়েও তুমি আমাকে বুঝবে। |
সঞ্জয়। | কোথায় তোমার ডাক পড়েছে তুমি চলেছ, তা নিয়ে আমি প্রশ্ন করতে চাই নে। কিন্তু যুবরাজ, এই যে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে,রাজবাড়িতে ওই যে বন্দীরা দিনাবসানের গান ধরলে, এরও কি কোনো ডাক নেই? যা কঠিন তার গৌরব থাকতে পারে, কিন্তু যা মধুর তারও মূল্য আছে। |
অভিজিৎ। | ভাই, তারই মূল্য দেবার জন্যেই কঠিনের সাধনা। |
সঞ্জয়। | সকালে যে আসনে তুমি পূজায় বস, মনে আছে তো সেদিন তার সামনে একটি শ্বেত পদ্ম দেখে তুমি অবাক হয়েছিলে? তুমি জাগবার আগেই কোন্ ভোরে ওই পদ্মটি লুকিয়ে কে তুলে এনেছে, জানতে দেয় নি সে কে– কিন্তু এইটুকুর মধ্যে কত সুধাই আছে সে কথা কি আজ মনে করবার নেই? সেই ভীরু, যে আপনাকে গোপন করেছে, কিন্তু আপনার পূজা গোপন করতে পারে নি, তার মুখ তোমার মনে পড়ছে না? |
অভিজিৎ। | পড়ছে বই কি। সেইজন্যেই সইতে পারছি নে ওই বীভৎসটাকে যা এই ধরণীর সংগীত রোধ করে দিয়ে আকাশে লোহার দাঁত মেলে অট্টহাস্য করছে। স্বর্গকে ভালো লেগেছে বলেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে দ্বিধা করি নে। |
সঞ্জয়। | গোধূলির আলোটি ওই নীল পাহাড়ের উপরে মূর্ছিত হয়ে রয়েছে এর মধ্যে দিয়ে একটা কান্নার মূর্তি তোমার হৃদয়ে এসে পৌঁছচ্ছে না? |
অভিজিৎ। | হাঁ, পৌঁছচ্ছে। আমারও বুক কান্নায় ভরে রয়েছে। আমি কঠোরতার অভিমান রাখি নে। চেয়ে দেখো ওই পাখি দেবদারু-গাছের চূড়ার ডালটির উপর একলা বসে আছে; ও কি নীড়ে যাবে, না, অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দূর প্রবাসের অরণ্যে যাত্রা করবে জানি নে, কিন্তু ও যে এই সূর্যাস্তের আকাশের দিকে চুপ করে চেয়ে আছে সেই চেয়ে থাকার সুরটি আমার হৃদয়ে এসে বাজছে, সুন্দর এই পৃথিবী। যা কিছু আমার জীবনকে মধুময় করেছে সে সমস্তকেই আজ আমি নমস্কার করি। |
বটুর প্রবেশ |
|
বটু। | যেতে দিলে না, মেরে ফিরিয়ে দিলে। |
অভিজিৎ। | কী হয়েছে, বটু, তোমার কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে যে! |
বটু। | আমি সকলকে সাবধান করতে বেরিয়েছিলুম, বলছিলুম, “যেয়ো না ও পথে, ফিরে যাও।’ |
অভিজিৎ। | কেন, কী হয়েছে? |
বটু। | জান না, যুবরাজ? ওরা যে আজ যন্ত্রবেদীর উপর তৃষ্ণারাক্ষসীর প্রতিষ্ঠা করবে। মানুষ-বলি চায়। |
সঞ্জয়। | সে কী কথা? |
বটু। | সেই বেদী গাঁথবার সময় আমার দুই নাতির রক্ত ঢেলে দিয়েছে। মনে করেছিলুম পাপের বেদী আপনি ভেঙে পড়ে যাবে। কিন্তু এখনও তো ভাঙল না, ভৈরব তো জাগলেন না। |
অভিজিৎ। | ভাঙবে। সময় এসেছে। |
বটু। | (কাছে আসিয়া চুপে চুপে) তবে শুনেছ বুঝি? ভৈরবের আহ্বান শুনেছ? |
অভিজিৎ। | শুনেছি। |
বটু। | সর্বনাশ! তবে তো তোমার নিষ্কৃতি নেই। |
অভিজিৎ। | না, নেই। |
বটু। | এই দেখছ না, আমার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে, সর্বাঙ্গে ধুলো। সইতে পারবে কি,যুবরাজ,যখন বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যাবে! |
অভিজিৎ। | ভৈরবের প্রসাদে সইতে পারব। |
বটু। | চারিদিকে সবাই যখন শত্রু হবে? আপন লোক যখন ধিক্কার দেবে? |
অভিজিৎ। | সইতেই হবে। |
বটু। | তাহলে ভয় নেই? |
অভিজিৎ। | না ভয় নেই। |
বটু। | বেশ বেশ। তাহলে বটুকে মনে রেখো। আমিও ওই পথে। ভৈরব আমার কপালে এই যে রক্ততিলক এঁকে দিয়েছেন তার থেকে অন্ধকারেও আমাকে চিনতে পারবে। |
[ বটুর প্রস্থান ] |
|
রাজপ্রহরী উদ্ধবের প্রবেশ |
|
উদ্ধব। | নন্দিসংকটের পথ কেন খুলে দিলে যুবরাজ? |
অভিজিৎ। | শিবতরাইয়ের লোকেদের নিত্যদুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাবার জন্যে। |
উদ্ধব। | মহারাজ তো তাদের সাহায্যের জন্যে প্রস্তুত, তাঁর তো দায়মায়া আছে। |
অভিজিৎ। | ডান-হাতের কার্পণ্য দিয়ে পথ বন্ধ করে বাঁ-হাতের বদান্যতায় বাঁচানো যায় না। তাই ওদের অন্ন-চলাচলের পথ খুলে দিয়েছি। দয়ার উপর নির্ভর করার দীনতা আমি দেখতে পারি নে। |
উদ্ধব। | মহারাজ বলেন, নন্দিসংকটের গড় ভেঙে দিয়ে তুমি উত্তরকূটের ভোজনপাত্রের তলা খসিয়ে দিয়েছ। |
অভিজিৎ। | চিরদিন শিবতরাইয়ের অন্নজীবী হয়ে থাকবার দুর্গতি থেকে উত্তরকূটকে মুক্তি দিয়েছি। |
উদ্ধব। | দুঃসাহসের কাজ করেছ। মহারাজ খবর পেয়েছেন এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না। যদি পার তো এখনই চলে যাও। পথে দাঁড়িয়ে তোমার সঙ্গে কথা কওয়াও নিরাপদ নয়। |
[ উদ্ধবের প্রস্থান ] |
|
অম্বার প্রবেশ |
|
অম্বা। | সুমন! বাবা সুমন! যে পথ দিয়ে তাকে নিয়ে গেল সে পথ দিয়ে তোমরা কি কেউ যাও নি? |
অভিজিৎ। | তোমার ছেলেকে নিয়ে গেছে? |
অম্বা। | হাঁ, ওই পশ্চিমে, যেখানে সূয্যি ডোবে, যেখানে দিন ফুরোয়। |
অভিজিৎ। | ওই পথেই আমি যাব। |
অম্বা। | তাহলে দুঃখিনীর একটা কথা রেখো– যখন তার দেখা পাবে, ব’লো মা তার জন্যে পথ চেয়ে আছে। |
অভিজিৎ। | বলব। |
অম্বা। | বাবা, তুমি চিরজীবী হও। সুমন, আমার সুমন! |
[ প্রস্থান ] |
|
গান |
|
জয় ভৈরব, জয় শংকর, জয় জয় জয় প্রলয়ংকর। জয় সংশয়-ভেদন, জয় বন্ধন-ছেদন জয় সংকট-সংহর, শংকর, শংকর। |
|
[ প্রস্থান ] |
|
সেনাপতি বিজয়পালের প্রবেশ |
|
বিজয়পাল।। | যুবরাজ, রাজকুমার, আমার বিনীত অভিবাদন গ্রহণ করুন। মহারাজের কাছ থেকে আসছি। |
অভিজিৎ। | কী তাঁর আদেশ? |
বিজয়পাল। | গোপনে বলব। |
সঞ্জয়। | (অভিজিতের হাত চাপিয়া ধরিয়া) গোপনে কেন? আমার কাছেও গোপন? |
বিজয়পাল। | সেই তো আদেশ। যুবরাজ একবার রাজশিবিরে পদার্পণ করুন। |
সঞ্জয়। | আমিও সঙ্গে যাব। |
বিজয়পাল। | মহারাজ তা ইচ্ছা করেন না। |
সঞ্জয়। | আমি তবে এই পথেই অপেক্ষা করব। |
[ অভিজিৎকে লইয়া বিজয়পাল শিবিরের দিকে প্রস্থান করিল ] |