চরের প্রবেশ |
|
চর। | শিবতরাই থেকে হাজার হাজার লোক চলে আসছে। |
বিভূতি। | সে কী কথা? আমরা হঠাৎ গিয়ে তাদের নিরস্ত্র করব এই তো ঠিক ছিল। নিশ্চয় তোমাদের কোনো বিশ্বাসঘাতক তাদের খবর দিয়েছে। কঙ্কর, তোমরা কয়জন ছাড়া ভিতরের কথা কেউ তো জানে না। তাহলে কী করে– |
কঙ্কর। | কী বিভূতি! আমাদেরও সন্দেহ কর না কি? |
বিভূতি। | সন্দেহ করার সীমা কোথাও নেই। |
কঙ্কর। | তাহলে আমরাও তোমাকে সন্দেহ করি। |
বিভূতি। | সে অধিকার তোমাদের আছে। যাই হ’ক, সময় হলে এর একটা বোঝা-পড়া করতে হবে। |
রণজিৎ। | (চরের প্রতি) তারা কী অভিপ্রায়ে আসছে তুমি জান? |
চর। | তারা শুনেছে– যুবরাজ বন্দী হয়েছেন, তাই পণ করেছে তাঁকে খুঁজে বের করবে। এখান থেকে মুক্ত করে তাঁকে ওরা শিবতরাইয়ের রাজা করতে চায়। |
বিভূতি। | আমরাও খুঁজছি যুবরাজকে, আর ওরাও খুঁজছে, দেখি কার হাতে পড়েন। |
ধনঞ্জয়। | তোমাদের দুই দলেরই হাতে পড়বেন, তাঁর মনে পক্ষপাত নেই। |
চর। | ওই যে আসছে শিবতরাইয়ের গণেশ সর্দার। |
গণেশ। | (ধনঞ্জয়ের প্রতি) ঠাকুর, পাব তো তাঁকে? |
ধনঞ্জয়। | হাঁ রে, পাবি। |
গণেশ। | নিশ্চয় করে বলো। |
ধনঞ্জয়। | পাবি রে। |
রণজিৎ। | কাকে খুঁজছিস? |
গণেশ। | এই যে রাজা, ছেড়ে দিতে হবে। |
রণজিৎ। | কাকে রে? |
গণেশ। | আমাদের যুবরাজকে। তোমরা তাকে চাও না, আমরা তাকে চাই। আমাদের সবই তোমরা আটক করে রাখবে? ওকেও? |
ধনঞ্জয়। | মানুষ চিনলি নে, বোকা? ওকে আটক করে এমন সাধ্য আছে কার? |
গণেশ। | ওকে আমাদের রাজা করে রাখব। |
ধনঞ্জয়। | রাখবি বই কি। ও রাজবেশ পরে আসবে। |
ভৈরবপন্থীর প্রবেশ |
|
গান |
|
তিমির-হৃদ্বিদারণ জ্বলদগ্নি-নিদারুণ, মরুশ্মশান-সঞ্চর, শংকর, শংকর। ব্রজ্রঘোষ-বাণী, রুদ্র, শূলপাণি, মৃত্যুসিন্ধু-সন্তর, শংকর, শংকর। |
|
[ প্রস্থান ] |
|
নেপথ্যে। | মা ডাকে, মা ডাকে। ফিরে আয়, সুমন ফিরে আয়। |
বিভূতি। | ও কী শুনি? ও কিসের শব্দ? |
ধনঞ্জয়। | অন্ধকারের বুকের ভিতর খিল খিল করে হেসে উঠল যে। |
বিভূতি। | আঃ থামো না, শব্দটা কোন্ দিকে বলো তো? |
নেপথ্যে। | জয় হ’ক, ভৈরব। |
বিভূতি। | এ তো স্পষ্টই জলস্রোতের শব্দ। |
ধনঞ্জয়। | নাচ আরম্ভের প্রথম ডমরুধ্বনি। |
বিভূতি। | শব্দ বেড়ে উঠছে যে, বেড়ে উঠছে। |
কঙ্কর। | এ যেন– |
নরসিং। | বোধ হচ্ছে যেন– |
বিভূতি। | হাঁ, হাঁ, সন্দেহ নেই। মুক্তধারা ছুটেছে। বাঁধ কে ভাঙলে? কে ভাঙলে?– তার নিস্তার নেই। |
[ কঙ্কর নরসিং ও বিভূতির দ্রুত প্রস্থান ] |
|
রণজিৎ। | মন্ত্রী, এ কী কাণ্ড? |
ধনঞ্জয়। | বাঁধ-ভাঙার উৎসবে ডাক পড়েছে।
গান বাজে রে বাজে ডমরু বাজে |
মন্ত্রী। | মহারাজ এ যেন– |
রণজিৎ। | হাঁ, এ যেন তাঁরই– |
মন্ত্রী। | তিনি ছাড়া আর তো কারও– |
রণজিৎ। | এমন সাহস আর কার? |
ধনঞ্জয়।। |
গান নাচে রে নাচে চরণ নাচে, |
রণজিৎ। | শাস্তি দিতে হয় আমি শাস্তি দেব। কিন্তু এইসব উন্মত্ত প্রজাদের হাত থেকে– আমার অভিজিৎ দেবতার প্রিয়, দেবতারা তাকে রক্ষা করুন। |
গণেশ। | প্রভু, ব্যাপার কী হল কিছু তো বুঝতে পারছি নে। |
ধনঞ্জয়। |
গান প্রহর জাগে, প্রহরী জাগে, |
রণজিৎ। | ওই পায়ের শব্দ শুনছি যেন। অভিজিৎ, অভিজিৎ। |
মন্ত্রী। | ওই যেন আসছেন। |
ধনঞ্জয়। |
গান মরমে মরমে বেদনা ফুটে, |
সঞ্জয়ের প্রবেশ |
|
রণজিৎ। | এ যে সঞ্জয়। অভিজিৎ কোথায়? |
সঞ্জয়। | মুক্তধারার স্রোত তাঁকে নিয়ে গেল, আমরা তাঁকে পেলুম না। |
রণজিৎ। | কী বলছ, কুমার। |
সঞ্জয়। | যুবরাজ মুক্তধারার বাঁধ ভেঙেছেন। |
রণজিৎ। | বুঝেছি, সেই মুক্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সঞ্জয়, তোমাকে কি তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন? |
সঞ্জয়। | না, কিন্তু আমি মনে বুঝেছিলুম তিনি ওইখানেই যাবেন, আমি গিয়ে অন্ধকারে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিলুম, কিন্তু ওই পর্যন্ত– বাধা দিলেন, আমাকে শেষ পর্যন্ত যেতে দিলেন না। |
রণজিৎ। | কী হল আর-একটু বলো। |
সঞ্জয়। | ওই বাঁধের একটা ত্রুটির সন্ধান কী করে তিনি জেনেছিলেন। সেইখানে যন্ত্রাসুরকে তিনি আঘাত করলেন, যন্ত্রাসুর তাঁকে সেই আঘাত ফিরিয়ে দিলে। তখন মুক্তধারা তাঁর সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল। |
গণেশ। | যুবরাজকে আমরা যে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম, তাহলে তাঁকে কি আর পাব না। |
ধনঞ্জয়। | চিরকালের মতো পেয়ে গেলি। |
ভৈরবপন্থীর প্রবেশ |
|
গান |
|
জয় ভৈরব, জয় শংকর, |
পৌষসংক্রান্তি, ১৩২৮ শান্তিনিকেতন