একদল ছাত্র লইয়া অদূরে গাছের তলায় উত্তরকূটের গুরুমশায় প্রবেশ করিল |
|
গুরু। | খেলে, খেলে, বেত খেলে দেখছি। খুব গলা ছেড়ে বল্, জয় রাজরাজেশ্বর। |
ছাত্রগণ। | জয় রাজরা– |
গুরু। | (হাতের কাছে দুই একটা ছেলেকে থাবড়া মারিয়া)– জেশ্বর। |
ছাত্রগণ। | জেশ্বর। |
গুরু। | শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী– |
ছাত্রগণ। | শ্রী শ্রী শ্রী– |
গুরু। | (ঠেলা মারিয়া) পাঁচবার। |
ছাত্রগণ। | পাঁচবার। |
গুরু। | লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর! বল্ শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী– |
ছাত্রগণ। | শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী– |
গুরু। | উত্তরকূটাধিপতির জয়– |
ছাত্রগণ। | উত্তরকূটা– |
গুরু। | –ধিপতির |
ছাত্রগণ। | ধিপতির |
গুরু। | জয়। |
ছাত্রগণ। | জয়। |
রণজিৎ। | তোমরা কোথায় যাচ্ছ? |
গুরু। | আমাদের যন্ত্ররাজ বিভূতিকে মহারাজ শিরোপা দেবেন তাই ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছি আনন্দ করতে। যাতে উত্তরকূটের গৌরবে এরা শিশুকাল হতেই গৌরব করতে শেখে তার কোনো উপলক্ষ্যই বাদ দিতে চাই নে। |
রণজিৎ। | বিভূতি কী করেছে এরা সবাই জানে তো? |
ছেলেরা। | (লাফাইয়া হাততালি দিয়া) জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন। |
রণজিৎ। | কেন দিয়েছেন? |
ছেলেরা। | (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্যে। |
রণজিৎ। | কেন জব্দ করা? |
ছেলেরা। | ওরা যে খারাপ লোক। |
রণজিৎ। | কেন খারাপ? |
ছেলেরা। | ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে। |
রণজিৎ । | কেন খারাপ তা জান না? |
গুরু। | জানে বই কি, মহারাজ। কী রে, তোরা পড়িস নি– বইয়ে পড়িস নি– ওদের ধর্ম খুব খারাপ– |
ছেলেরা। | হাঁ, হাঁ, ওদের ধর্ম খুব খারাপ। |
গুরু। | আর ওরা আমাদের মতো– কী বল্ না– (নাক দেখাইয়া) |
ছেলেরা। | নাক উঁচু নয়। |
গুরু। | আচ্ছা, আমাদের গণাচার্য কী প্রমাণ করে দিয়েছেন– নাক উঁচু থাকলে কী হয়? |
ছেলেরা। | খুব বড়ো জাত হয়। |
গুরু। | তারা কী করে? বল্ না– পৃথিবীতে– বল্– তারাই সকলের উপর জয়ী হয়, না? |
ছেলেরা। | হাঁ, জয়ী হয়। |
গুরু। | উত্তরকূটের মানুষ কোনোদিন যুদ্ধে হেরেছে জানিস? |
ছেলেরা। | কোনোদিনই না। |
গুরু। | আমাদের পিতামহ-মহারাজ প্রাগ্জিৎ দু-শ তিরেনব্বই জন সৈন্য নিয়ে একত্রিশ হাজার সাড়ে সাত-শ দক্ষিণী বর্বরদের হটিয়ে দিয়েছিলেন না? |
ছেলেরা। | হাঁ দিয়েছিলেন। |
গুরু। | নিশ্চয়ই জানবেন, মহারাজ, উত্তরকূটের বাইরে যে হতভাগারা মাতৃগর্ভে জন্মায়, একদিন এইসব ছেলেরাই তাদের বিভীষিকা হয়ে উঠবে। এ যদি না হয় তবে আমি মিথ্যে গুরু। কতবড়ো দায়িত্ব যে আমাদের সে আমি একদণ্ডও ভুলি নে। আমরাই তো মানুষ তৈরি করে দিই, আপনার অমাত্যরা তাঁদের নিয়ে ব্যবহার করেন। অথচ তাঁরাই বা কী পান আর আমরাই বা কী পাই তুলনা করে দেখবেন। |
মন্ত্রী। | কিন্তু ওই ছাত্ররাই যে তোমাদের পুরস্কার। |
গুরু। | বড়ো সুন্দর বলেছেন, মন্ত্রীমশায়, ছাত্ররাই আমাদের পুরস্কার। আহা, কিন্তু খাদ্যসামগ্রী বড়ো দুর্মূল্য– এই দেখেন না কেন, গব্যঘৃত, যেটা ছিল– |
মন্ত্রী। | আচ্ছা বেশ, তোমার এই গব্যঘৃতের কথাটা চিন্তা করব। এখন যাও, পূজার সময় নিকট হল। |
[ জয়ধ্বনি করাইয়া ছাত্রদের লইয়া গুরুমশায় প্রস্থান করিল ] |
|
রণজিৎ। | তোমার এই গুরুর মাথার খুলির মধ্যে অন্য কোনো ঘৃত নেই, গব্যঘৃতই আছে। |
মন্ত্রী। | পঞ্চগব্যের একটা কিছু আছেই। কিন্তু, মহারাজ, এইসব মানুষই কাজে লাগে। ওকে যেমনটি বলে দেওয়া গেছে, দিনের পর দিন ও ঠিক তেমনিটি করে চলেছে। বুদ্ধি বেশি থাকলে কাজ কলের মতো চলে না। |
রণজিৎ । | মন্ত্রী, ওটা কী আকাশে? |
মন্ত্রী। | মহারাজ, ভুলে যাচ্ছেন, ওটাই তো বিভূতির সেই যন্ত্রের চূড়া। |
রণজিৎ। | এমন স্পষ্ট তো কোনোদিন দেখা যায় না। |
মন্ত্রী। | আজ সকালে ঝড় হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, তাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। |
রণজিৎ। | দেখেছ, ওর পিছন থেকে সূর্য যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। আর ওটাকে দানবের উদ্যত মুষ্টির মতো দেখাচ্ছে। অতটা বেশি উঁচু করে তোলা ভালো হয় নি। |
মন্ত্রী। | আমাদের আকাশের বুকে যেন শেল বিঁধে রয়েছে মনে হচ্ছে। |
রণজিৎ। | এখন মন্দিরে যাবার সময় হল। |
[ উভয়ের প্রস্থান ] |
|
উত্তরকূটের দ্বিতীয়দল নাগরিকের প্রবেশ |
|
১। | দেখলি তো, আজকাল বিভূতি আমাদের কী রকম এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। ও যে আমাদের মধ্যেই মানুষ সে কথাটাকে চামড়ার থেকে ঘষে ফেলতে চায়। একদিন বুঝতে পারবেন খাপের চেয়ে তলোয়ার বড়ো হয়ে উঠলে ভালো হয় না। |
২। | তা যা বলিস, ভাই, বিভূতি উত্তরকূটের নাম রেখেছে বটে। |
১। | আরে রেখে দে, তোরা ওকে নিয়ে বড়ো বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছিস। ওই যে বাঁধটি বাঁধতে ওর জিব বেরিয়ে পড়েছে, ওটা কিছু না হবে তো দশবার ভেঙেছে। |
৩। | আবার যে ভাঙবে না তাই বা কে জানে? |
১। | দেখেছিস তো বাঁধের উত্তর দিকের সেই ঢিবিটা? |
২। | কেন,কেন, কী হয়েছে? |
১। | কী হয়েছে? এটা জানিস নে? যে দেখছে সেই তো বলছে– |
২। | কী বলছে ভাই? |
১। | কী বলছে? ন্যাকা নাকি রে? এও আবার জিগ্গেস করতে হয় নাকি? আগাগোড়াই– সে আর কী বলব। |
২। | তবু ব্যাপারটা কী একটু বুঝিয়ে বল্ না– |
১। | রঞ্জন, তুই অবাক করলি। একটু সবুর কর্ না, পষ্ট বুঝবি হঠাৎ যখন একেবারে– |
২। | সর্বনাশ! বলিস কী দাদা? হঠাৎ একেবারে? |
১। | হাঁ ভাই, ঝগড়ুর কাছে শুনে নিস। সে নিজে মেপে জুখে দেখে এসেছে। |
২। | ঝগড়ুর ওই গুণটি আছে, ওর মাথা ঠাণ্ডা। সবাই যখন বাহবা দিতে থাকে,ও তখন কোথা থেকে মাপকাটি বের করে বসে। |
৩। | আচ্ছা ভাই, কেউ কেউ যে বলে বিভূতির যা কিছু বিদ্যে সব– |
১। | আমি নিজে জানি বেঙ্কটবর্মার কাছ থেকে চুরি। হাঁ, সে ছিল বটে গুণীর মতো গুণী– কত বড়ো মাথা– ওরে বাস রে! অথচ বিভূতি পায় শিরোপা, আর সে গরিব না খেতে পেয়েই মারা গেল। |
৩। | শুধুই কি না খেতে পেয়ে? |
১। | আরে না খেতে পেয়ে কি কার হাতের দেওয়া কী খেতে পেয়ে সে কথায় কাজ কী? আবার কে কোন্ দিক থেকে– নিন্দুকের তো অভাব নেই। এ দেশের মানুষ যে কেউ কারও ভালো সইতে পারে না। |
২। | তা তোরা যাই বলিস লোকটা কিন্তু– |
১। | আহা, তা হবে না কেন? কোন্ মাটিতে ওর জন্ম, বুঝে দেখ্ ওই চবুয়া গাঁয়ে আমার বুড়ো দাদা ছিল, তার নাম শুনেছিস তো? |
২। | আরে বাস রে! তাঁর নাম উত্তরকূটের কে না জানে? তিনি তো সেই– ঐ যে কী বলে– |
১। | হাঁ, হাঁ, ভাস্কর। নস্যি তৈরি করার এত বড়ো ওস্তাদ এ মুল্লুকে হয় নি। তাঁর হাতের নস্যি না হলে রাজা শত্রুজিতের একদিনও চলত না। |
৩। | সে সব কথা হবে, এখন মন্দিরে চল্। আমরা হলুম বিভূতির এক গাঁয়ের লোক– আমাদের হাতের মালা আগে নিয়ে তবে অন্য কথা। আর আমরাই তো বসব তার ডাইনে। |
নেপথ্যে। | যেয়ো না ভাই, যেয়ো না, ফিরে যাও। |
২। | ওই শোনো বটুক বুড়ো বেরিয়েছে। |
বটুকের প্রবেশ গায়ে ছেঁড়া কম্বল, হাতে বাঁকা ডালের লাঠি, চুল উস্কোখুস্কো |
|
১। | কী বটু, যাচ্ছ কোথায়? |
বটু। | সাবধান, বাবা, সাবধান। যেয়ো না ও পথে, সময় থাকতে ফিরে যাও। |
২। | কেন বলো তো? |
বটু। | বলি দেবে, নরবলি। আমার দুই জোয়ান নাতিকে জোর করে নিয়ে গেল, আর তারা ফিরল না। |
৩। | বলি কার কাছে দেবে খুড়ো? |
বটু। | তৃষ্ণা, তৃষ্ণা দানবীর কাছে। |
২। | সে আবার কে? |
বটু। | সে যত খায় তত চায়– তার শুষ্ক রসনা ঘি-খাওয়া আগুনের শিখার মতো কেবলই বেড়ে চলে। |
১। | পাগলা! আমরা তো যাচ্ছি উত্তরভৈরবের মন্দিরে, সেখানে তৃষ্ণা দানবী কোথায়? |
বটু। | খবর পাও নি? ভৈরবকে যে আজ ওরা মন্দির থেকে বিদায় করতে চলেছে। তৃষ্ণা বসবে বেদীতে। |
২। | চুপ চুপ পাগলা। এ-সব কথা শুনলে উত্তরকূটের মানুষ তোকে কুটে ফেলবে। |
বটু। | তারা তো আমার গায়ে ধুলো দিচ্ছে, ছেলেরা মারছে ঢেলা। সবাই বলে তোর নাতি দুটো প্রাণ দিয়েছে সে তাদের সৌভাগ্য। |
১। | তারা তো মিথ্যে বলে না। |
বটু। | বলে না মিথ্যে? প্রাণের বদলে প্রাণ যদি না মেলে, মৃত্যু দিয়ে যদি মৃত্যুকেই ডাকা হয়, তবে ভৈরব এত বড়ো ক্ষতি সইবেন কেন? সাবধান, বাবা, সাবধান, যেয়ো না ও পথে। |
[ প্রস্থান ] |
|
২। | দেখো, দাদা, আমার গায়ে কিন্তু কাঁটা দিয়ে উঠছে। |
১। | রঞ্জু, তুই বেজায় ভীতু। চল্ চল্। |
[ সকলের প্রস্থান ] |