Skip to content

মুক্তধারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ধনঞ্জয়ের প্রবেশ

ধনঞ্জয়। কী বলছিলি রে বোকা? আমারই উপর তোদের বাঁচাবার ভার? তাহলে তো সাতবার মরে ভূত হয়ে রয়েছিস।
গণেশ। উত্তরকূটের ওরা আমাদের শাসিয়ে গেল যে, বিভূতি মুক্তধারার বাঁধ বেঁধেছে।
ধনঞ্জয়। বাঁধ বেঁধেছে বললে?
গণেশ। হাঁ, ঠাকুর।
ধনঞ্জয়। সব কথাটা শুনলি নে বুঝি?
গণেশ। ও কি শোনবার কথা? হেসে উড়িয়ে দিলুম।
ধনঞ্জয়। তোদের সব কানগুলো একা আমারি জিম্মায় রেখেছিস? তোদের সবার শোনা আমাকেই শুনতে হবে?
শি ৩। ওর মধ্যে শোনবার আছে কী, ঠাকুর?
ধনঞ্জয়। বলিস কী রে? যে শক্তি দুরন্ত তাকে বেঁধে ফেলা কি কম কথা? তা সে অন্তরেই হ’ক আর বাইরেই হ’ক।
গণেশ। ঠাকুর, তাই বলে আমাদের পিপাসার জল আটকাবে?
ধনঞ্জয়। সে হল আরএক কথা। ওটা ভৈরব সইবেন না। তোরা ব’স আমি সন্ধান নিয়ে আসি গে। জগৎটা বাণীময় রে,তার যেদিকটাতে শোনা বন্ধ করবি সেইদিক থেকেই মৃত্যুবাণ আসবে।

[ ধনঞ্জয়ের প্রস্থান ]

শিবতরাইয়ের একজন নাগরিকের প্রবেশ

শি ৩। এ কী বিষণ যে। খবর কী?
বিষণ। যুবরাজকে রাজা শিবতরাই থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে, তাকে সেখানে আর রাখবে না।
সকলে। সে হবে না, কিছুতেই হবে না।
বিষণ। কী করবি?
সকলে। ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
বিষণ। কী করে?
সকলে। জোর করে।
বিষণ। রাজার সঙ্গে পারবি?
সকলে। রাজাকে মানি নে।
রণজিৎ। কাকে মানিস নে?
সকলে। প্রণাম।
গণেশ। তোমার কাছে দরবার করতে এসেছি।
রণজিৎ। কিসের দরবার?
সকলে। আমরা যুবরাজকে চাই!
রণজিৎ। বলিস কী?
১। হাঁ, যুবরাজকে শিবতরাইয়ে নিয়ে যাব।
রণজিৎ। আর মনের আনন্দে খাজনা দেবার কাজটা ভূলে যাবি?
সকলে। অন্ন বিনে মরছি যে।
রণজিৎ। তোদের সর্দার কোথায়?
২। (গণেশকে দেখাইয়া) এই-যে আমাদের গণেশ সর্দার।
রনজিৎ। ও নয়, তোদের বৈরাগী।
গণেশ। ওই আসছেন।

ধনঞ্জয়ের প্রবেশ

রণজিৎ। তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
ধনঞ্জয়। খ্যাপাই বই কি, নিজেও খেপি।

গান

আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন্‌ খ্যাপা সে?
ওরে আকাশ জুড়ে মোহন সুরে
কী যে বাজায় কোন্‌ বাতাসে?
গেল রে গেল বেলা,
পাগলের কেমন খেলা?
ডেকে সে আকুল করে, দেয় না ধরা,
তারে কানন গিরি খুঁজে ফিরি
কেঁদে মরি কোন্‌ হুতাশে।

রণজিৎ। পাগলামি করে কথা চাপা দিতে পারবে না। খাজনা দেবে কি না, বলো।
ধনঞ্জয়। না, মহারাজ, দেব না।
রণজিৎ। দেবে না? এত বড়ো আস্পর্ধা?
ধনঞ্জয়। যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারবো না।
রণজিৎ। আমার নয়?
ধনঞ্জয়। আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।
রণজিৎ। তুমিই প্রজাদের বারণ কর খাজনা দিতে?
ধনঞ্জয়। ওরা তো ভয়ে দিয়ে ফেলতে চায়, আমি বারণ করে বলি, প্রাণ দিবি তাঁকেই প্রাণ দিয়েছেন যিনি।
রণজিৎ। তোমার ভরসা চাপা দিয়ে ওদের ভয়টাকে ঢেকে রাখছ বই তো নয়। বাইরের ভরসা একটু ফুটো হলেই ভিতরের ভয় সাতগুণ জোরে বেরিয়ে পড়বে। তখন ওরা মরবে যে। দেখো, বৈরাগী, তোমার কপালে দুঃখ আছে।
ধনঞ্জয়। যে দুঃখ কপালে ছিল সে দুঃখ বুকে তুলে নিয়েছি। দুঃখের উপরওআলা সেইখানে বাস করেন।
রণজিৎ। (প্রজাদের প্রতি) আমি তোদের বলছি, তোরা শিবতরাইয়ে ফিরে যা। বৈরাগী, তুমি এইখানেই রইলে।
সকলে। আমাদের প্রাণ থাকতে সে হবে না।
ধনঞ্জয়।

গান

রইল বলে রাখলে কারে?
হুকুম তোমার ফলবে কবে?
টানাটানি টিকবে না, ভাই,
রবার যেটা সেটাই রবে।

রাজা, টেনে কিছুই রাখতে পারবে না। সহজে রাখবার শক্তি যদি থাকে তবেই রাখা চলবে।

রণজিৎ। মানে কী হল?
ধনঞ্জয়। যিনি সব দেন তিনিই সব রাখেন। লোভ করে যা রাখতে চাইবে সে হল চোরাই মাল, সে টিঁকবে না।

গান

যা-খুশি তাই করতে পার,
গায়ের জোরে রাখ মার,
যাঁর গায়ে তার ব্যথা বাজে
তিনিই যা সন সেটাই সবে।

রাজা, ভুল করছ এই, যে, ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই জগৎ তোমার হল। ছেড়ে রাখলেই যাকে পাও, মুঠোর মধ্যে চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে।

গান

ভাবছ, হবে তুমি যা চাও,
জগৎটাকে তুমিই নাচাও,
দেখবে হঠাৎ নয়ন মেলে
হয় না যেটা সেটাও হবে।

রণজিৎ। মন্ত্রী, বৈরাগীকে এইখানেই ধরে রেখে দাও।
মন্ত্রী। মহারাজ–
রণজিৎ। আদেশটা তোমার মনের মতো হচ্ছে না?
মন্ত্রী। শাসনের ভীষণ যন্ত্র তো তৈরি হয়েছে, তার উপরে ভয় আর চড়াতে গেলে সব যাবে ভেঙে।
প্রজারা। এ আমাদের সহ্য হবে না।
ধনঞ্জয়। যা বলছি, ফিরে যা।
১। ঠাকুর, যুবরাজকেও যে হারিয়েছি, শোন নি বুঝি?
২। তাহলে কাকে নিয়ে মনের জোর পাব?
ধনঞ্জয়। আমার জোরেই কি তোদের জোর? একথা যদি বলিস তাহলে যে আমাকে সুদ্ধ দুর্বল করবি।
গণেশ। ওকথা বলে আজ ফাঁকি দিয়ো না। আমাদের সকলের জোর একা তোমারই মধ্যে।
ধনঞ্জয়। তবে আমার হার হয়েছে। আমাকে সরে দাঁড়াতে হল।
সকলে। কেন ঠাকুর?
ধনঞ্জয়। আমাকে পেয়ে আপনাকে হারাবি? এত বড়ো লোকসান মেটাতে পারি এমন সাধ্য কি আমার আছে? বড়ো লজ্জা পেলুম।
১। সে কী কথা ঠাকুর? আচ্ছা, যা করতে বল তাই করব।
ধনঞ্জয়। আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যা।
২। চলে গিয়ে কী করব? তুমি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে? আমাদের ভালোবাস না?
ধনঞ্জয়। ভালোবেসে তোদের চেপে মারার চেয়ে ভালোবেসে তোদের ছেড়ে থাকাই ভালো। যা, আর কথা নয়, চলে যা।
ধনঞ্জয়। আচ্ছা, ঠাকুর চললুম, কিন্তু–
সকলে। কিন্তু কী রে। একেবারে নিষ্কিন্তু হয়ে যা, উপরে মাথা তুলে।
সকলে। আচ্ছা, তবে চলি।
ধনঞ্জয়। ওকে চলা বলে? জোরে।
গণেশ। চললুম, কিন্তু আমাদের বলবুদ্ধি রইল এইখানে পড়ে।

[ প্রস্থান ]

রণজিৎ। কী বৈরাগী, চুপ করে রইলে যে।
ধনঞ্জয়। ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে, রাজা।
রণজিৎ। কিসের ভাবনা?
ধনঞ্জয়। তোমার চণ্ডপালের দণ্ড লাগিয়েও যা করতে পার নি আমি দেখছি তাই করে বসে আছি। এতদিন ঠাউরেছিলুম আমি ওদের বলবুদ্ধি বাড়াচ্ছি; আজ মুখের উপর বলে গেল আমিই ওদের বলবুদ্ধি হরণ করেছি।
রণজিৎ। এমনটা হয় কী করে?
ধনঞ্জয়। ওদের যতই মাতিয়ে তুলেছি ততই পাকিয়ে তোলা হয় নি আর কি। দেনা যাদের অনেক বাকি, শুধু কেবল দৌড় লাগিয়ে দিয়ে তাদের দেনা শোধ হয় না তো। ওরা ভাবে আমি বিধাতার চেয়ে বড়ো, তাঁর কাছে ওরা যা ধারে আমি যেন তা নামঞ্জুর করে দিতে পারি। তাই চক্ষু বুজে আমাকেই আঁকড়ে থাকে।
রণজিৎ। ওরা যে তোমাকেই দেবতা বলে জেনেছে।
ধনঞ্জয়। তাই আমাতেই এসে ঠেকে গেল, আসল দেবতা পর্যন্ত পৌঁছোল না। ভিতরে থেকে যিনি ওদের চালাতে পারতেন বাইরে থেকে তাঁকে রেখেছি ঠেকিয়ে।
রণজিৎ। রাজার খাজনা যখন ওরা দিতে আসে তখন বাধা দাও, আর দেবতার পুজো যখন তোমার পায়ের কাছে এসে পড়ে তখন তোমার বাজে না?
ধনঞ্জয়। ওরে বাপ রে। বাজে না তো কী। দৌড় মেরে পালাতে পারলে বাঁচি। আমাকে পুজো দিয়ে ওরা অন্তরে অন্তরে দেউলে হতে চলল, সে দেনার দায় যে আমারও ঘাড়ে পড়বে, দেবতা ছাড়বেন না।
রণজিৎ। এখন তোমার কর্তব্য?
ধনঞ্জয়। তফাতে থাকা। আমি যদি পাকা করে ওদের মনের বাঁধ বেঁধে থাকি, তা হলে তোমার বিভূতিকে আর আমাকে ভৈরব যেন এক সঙ্গেই তাড়া লাগান।
রণজিৎ। তবে আর দেরি কেন? সরো না।
ধনঞ্জয়। আমি সরে দাঁড়ালেই ওরা একেবারে তোমার চণ্ডপালের ঘাড়ের উপর গিয়ে চড়াও হবে। তখন যে-দণ্ড আমার পাওনা সেটা পড়বে ওদেরই মাথার খুলির উপরে। এই ভাবনায় সরতে পারি নে।
রণজিৎ। নিজে সরতে না পার আমিই সরিয়ে দিচ্ছি। উদ্ধব, বৈরাগীকে এখন শিবিরে বন্দী করে রাখো।
ধনঞ্জয়।

গান

তোর শিকল আমায় বিকল করবে না।
তোর মারে মরম মরবে না।
তাঁর আপন হাতের ছাড়-চিঠি সেই যে,
আমার মনের ভিতর রয়েছে এই যে,
তোদের ধরা আমায় ধরবে না।
যে-পথ দিয়ে আমার চলাচল
তোর প্রহরী তার খোঁজ পাবে কী বল?
আমি তাঁর দুয়ারে পৌঁছে গেছি রে,
মোরে তোর দুয়ারে ঠেকাবে কী রে?
তোর ডরে পরান ডরবে না।

[ ধনঞ্জয়কে লইয়া উদ্ধবের প্রস্থান ]

রণজিৎ। মন্ত্রী, বন্দিশালায় অভিজিৎকে দেখে এস গে। যদি দেখ সে আপন কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত, তাহলে–
মন্ত্রী। মহারাজ, আপনি স্বয়ং গিয়ে একবার–
রণজিৎ। না, না, সে নিজরাজ্যবিদ্রোহী, যতক্ষণ অপরাধ স্বীকার না করে ততক্ষণ তার মুখদর্শন করব না। আমি রাজধানীতে যাচ্ছি, সেখানে আমাকে সংবাদ দিয়ো।

[ রাজার প্রস্থান ]

পরবর্তী অংশ পড়ুন 

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।