ভৈরবপন্থীর প্রবেশ |
|
গান |
|
তিমির-হৃদবিদারণ |
|
[ প্রস্থান ] |
|
উদ্ধবের প্রবেশ |
|
উদ্ধব। | এ কী? যুবরাজের সঙ্গে দেখা না করেই মহারাজ চলে গেলেন? |
মন্ত্রী। | পাছে মুখ দেখে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয় এই ভয়ে। এতক্ষণ ধরে বৈরাগীর সঙ্গে কথা কচ্ছিলেন মনের মধ্যে এই দ্বিধা নিয়ে। শিবিরের মধ্যেও যেতে পারছিলেন না, শিবির ছেড়ে যেতেও পা উঠছিল না। যাই যুবরাজকে দেখে আমি গে। |
[ প্রস্থান ] |
|
দুইজন স্ত্রীলোকের প্রবেশ |
|
১। | মাসী, ওরা কেন সবাই এমন রেগে উঠেছে? কেন বলছে যুবরাজ অন্যায় করেছেন– আমি এ বুঝতেও পারি নে, সইতেও পারি নে। |
২। | বুঝতে পারিস নে উত্তরকূটের মেয়ে হয়ে? উনি নন্দিসংকটের রাস্তা খুলে দিয়েছেন। |
১। | আমি জানি নে তাতে অপরাধ কী হয়েছে। কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি নে যে যুবরাজ অন্যায় করেছেন। |
২। | তুই ছেলেমানুষ, অনেক দুঃখ পেয়ে তবে একদিন বুঝবি বাইরে থেকে যাদের ভালো বলে বোধ হয় তাদেরই বেশি সন্দেহ করতে হয়। |
১। | কিন্তু যুবরাজকে কী সন্দেহ করছ তোমরা? |
২। | সবাই বলছে যে শিবতরাইয়ের লোকদের বশ করে নিয়ে, উনি এখনই উত্তরকূটের সিংহাসন জয় করতে চান, ওঁর আর তর সইছে না। |
১। | সিংহাসনের কী দরকার ছিল ওঁর। উনি তো সবারই হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। যারা ওঁর নিন্দে করছে তাদেরই বিশ্বাস করব আর যুবরাজকে বিশ্বাস করব না? |
২। | তুই চুপ কর্। একরত্তি মেয়ে, তোর মুখে এ-সব কথা সাজে না। দেশসুদ্ধ লোক যাকে অভিসম্পাত করছে তুই হঠাৎ তার– |
১। | আমি দেশসুদ্ধ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে একথা বলতে পারি যে– |
২। | চুপ চুপ। |
১। | কেন চুপ? আমার চোখ ফেটে জল বেরোতে চায়। যুবরাজকে আমি সবচেয়ে বিশ্বাস করি এই কথাটা প্রকাশ করবার জন্যে আমার যা হয় একটা কিছু করতে ইচ্ছা করছে। আমার এই লম্বা চুল আমি আজ ভৈরবের কাছে মানত করব– বলব, “বাবা, তুমি জানিয়ে দাও যে যুবরাজেরই জয়, যারা নিন্দুক তারা মিথ্যে।” |
২। | চুপ চুপ চুপ। কোথা থেকে কে শুনতে পাবে। মেয়েটা বিপদ ঘটাবে দেখছি। |
[ উভয়ের প্রস্থান ] |
|
উত্তরকূটের একদল নাগরিকের প্রবেশ |
|
১। | কিছুতেই ছাড়ছি নে, চল্ রাজার কাছে যাই। |
২। | ফল কী হবে? যুবরাজ যে রাজার বক্ষের মানিক, তাঁর অপরাধেব বিচার করতে পারবেন না, মাঝের থেকে রাগ করবেন আমাদের ‘পরে। |
১। | করুন রাগ, পষ্ট কথা বলব কপালে যাই থাক। |
৩। | এদিকে যুবরাজ আমাদের এত ভালোবাসা দেখান, ভাব করেন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেড়ে দেবেন, আর তলে তলে তাঁরই এই কীর্তি? হঠাৎ শিবতরাই তাঁর কাছে উত্তরকূটের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠল? |
২। | এমন হলে পৃথিবীতে আর ধর্ম রইল কোথা? বলো তো দাদা? |
৩। | কাউকে চেনবার জো নেই। |
১। | রাজা ওঁকে শাস্তি না দেন তো আমরা দেব। |
২। | কী করবি? |
১। | এদেশে ওঁর ঠাঁই হচ্ছে না। যে পথ কেটেছেন সেই পথ দিয়ে ওঁকেই বেরিয়ে যেতে হবে। |
৩। | কিন্তু ওই তো চবুয়া গাঁয়ের লোক বললে, তিনি শিবতরাইয়ে নেই, এখানে রাজার বাড়িতেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। |
১। | রাজা তাকে নিশ্চয়ই লুকিয়েছে। |
৩। | লুকিয়েছে? ইস, দেয়াল ভেঙে বের করব। |
১। | ঘরে আগুন লাগিয়ে বের করব। |
৩। | আমাদের ফাঁকি দেবে? মরি মরব, তবু– |
মন্ত্রী। | কী হয়েছে? |
১। | লুকোচুরি চলবে না। বের করো যুবরাজকে। |
মন্ত্রী। | আরে বাপু,আমি বের করবার কে? |
২। | তোমরাই তো মন্ত্রণা দিয়ে তাঁকে– পারবে না কিন্তু, আমরা টেনে বের করব। |
মন্ত্রী। | আচ্ছা, তবে নিজের হাতে রাজত্ব নাও, রাজার গারদ থেকে ছাড়িয়ে আনো। |
৩। | গারদ থেকে? |
মন্ত্রী। | মহারাজ তাকে বন্দী করেছেন। |
সকলে। | জয় মহারাজের, জয় উত্তরকূটের। |
২। | চল্ রে, আমরা গারদে ঢুকব, সেখানে গিয়ে– |
মন্ত্রী। | গিয়ে কী করবি? |
২। | বিভূতির গলায় মালা থেকে ফুল খসিয়ে দড়িগাছটা ওর গলায় ঝুলিয়ে আসব। |
৩। | গলায় কেন, হাতে। বাঁধ বাঁধার সম্মানের উচ্ছিষ্ট দিয়ে পথ- কাটার হাতে দড়ি পড়বে। |
মন্ত্রী। | যুবরাজ পথ ভেঙেছেন বলে অপরাধ, আর তোমরা ব্যবস্থা ভাঙবে, তাতে অপরাধ নেই? |
২। | আহা, ও যে সম্পূর্ণ আলাদা কথা। আচ্ছা বেশ, যদি ব্যবস্থা ভাঙি তো কী হবে? |
মন্ত্রী। | পায়ের তলার মাটি পছন্দ হল না বলে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে। সেটাও পছন্দ হবে না বলে রাখছি। একটা ব্যবস্থা আগে করে তবে অন্য ব্যবস্থাটা ভাঙতে হয়। |
৩। | আচ্ছা, তবে গারদ থাক, রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মহারাজের জয়ধ্বনি করে আসি গে। |
৩। | ও ভাই, ওই দেখ্। সূর্য অস্ত গেছে, আকাশ অন্ধকার হয়ে এল, কিন্তু বিভূতির যন্ত্রের ওই চূড়াটা এখনও জ্বলছে। রোদ্দুরের মদ খেয়ে যেন লাল হয়ে রয়েছে। |
২। | আর ভৈরব-মন্দিরের ত্রিশূলটাকে অস্তসূর্যের আলো আঁকড়ে রয়েছে যেন ডোববার ভয়ে। কী রকম দেখাচ্ছে। |
[ নাগরিকদের প্রস্থান ] |
|
মন্ত্রী। | মহারাজ কেন যে যুবরাজকে এই শিবিরে বন্দী করতে বলেছিলেন এখন বুঝেছি। |
উদ্ধব। | কেন? |
মন্ত্রী। | প্রজাদের হাত থেকে ওঁকে বাঁচাবার জন্যে। কিন্তু ভালো ঠেকছে না। লোকের উত্তেজনা কেবলই বেড়ে উঠছে। |
সঞ্জয়ের প্রবেশ |
|
সঞ্জয়। | মহারাজকে বেশি আগ্রহ দেখাতে সাহস করলুম না, তাতে তাঁর সংকল্প আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। |
মন্ত্রী। | রাজকুমার, শান্ত থাকবেন, উৎপাতকে আরও জটিল করে তুলবেন না। |
সঞ্জয়। | বিদ্রোহ ঘটিয়ে আমিও বন্দী হতে চাই। |
মন্ত্রী। | তার চেয়ে মুক্ত থেকে বন্ধন মোচনের চিন্তা করুন। |
সঞ্জয়। | সেই চেষ্টাতেই প্রজাদের মধ্যে গিয়েছিলুম। জানতুম যুবরাজকে তারা প্রাণের অধিক ভালোবাসে, তাঁর বন্ধন ওরা সইবে না। গিয়ে দেখি নন্দিসংকটের খবর পেয়ে তারা আগুন হয়ে আছে। |
মন্ত্রী। | তবেই বুঝছেন– বন্দিশালাতেই যুবরাজ নিরাপদ। |
সঞ্জয়। | আমি চিরদিন তাঁরই অনুবর্তী, বন্দিশালাতেও আমাকে তাঁর অনুসরণ করতে দাও। |
মন্ত্রী। | কী হবে? |
সঞ্জয়। | পৃথিবীতে কোনো একলা মানুষই এক নয়, সে অর্ধেক। আর-এক জনের সঙ্গে মিল হলে তবেই সে ঐক্য পায়। যুবরাজের সঙ্গে আমার সেই মিল। |
মন্ত্রী। | রাজকুমার, সে কথা মানি। কিন্তু সেই সত্য মিল যেখানে, সেখানে কাছে কাছে থাকবার দরকার হয় না। আকাশের মেঘ আর সমুদ্রের জল অন্তরে একই, তাই বাইরে তারা পৃথক হয়ে ঐক্যটিকে সার্থক করে। যুবরাজ আজ যেখানে নেই, সেইখানেই তিনি তোমার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পান। |
সঞ্জয়। | মন্ত্রী, এ তো তোমার নিজের কথা বলে শোনাচ্ছে না, এ যেন যুবরাজের মুখের কথা। |
মন্ত্রী। | তাঁর কথা এখানকার হাওয়ায় ছড়িয়ে আছে, ব্যবহার করি, অথচ ভুলে যাই তাঁর কি আমার। |
সঞ্জয়। | কিন্তু কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছে, দূর থেকে তাঁরই কাজ করব। যাই মহারাজের কাছে। |
মন্ত্রী। | কী করতে? |
সঞ্জয়। | শিবতরাইয়ের শাসনভার প্রার্থনা করব। |
মন্ত্রী। | সময় যে বড়ো সংকটের, এখন কি– |
সঞ্জয়। | সেইজন্যেই এই তো উপযুক্ত সময়। |
[ উভয়ের প্রস্থান ] |
|
বিশ্বজিতের প্রবেশ |
|
বিশ্বজিৎ। | ও কে ও? উদ্ধব বুঝি? |
উদ্ভব। | হাঁ, খুড়া মহারাজ। |
বিশ্বজিৎ। | অন্ধকারের জন্যে অপেক্ষা করছিলুম, আমার চিঠি পেয়েছ তো? |
উদ্ধব। | পেয়েছি। |
বিশ্বজিৎ। | সেই মতো কাজ হয়েছে? |
উদ্ভব। | অল্প পরেই জানতে পারবে। কিন্তু– |
বিশ্বজিৎ। | মনে সংশয় ক’রো না। মহারাজ ওকে নিজে মুক্তি দিতে প্রস্তুত নন, কিন্তু তাঁকে না জানিয়ে কোনো উপায়ে আর কেউ যদি একাজ সাধন করে তাহলে তিনি বেঁচে যাবেন। |
উদ্ধব। | কিন্তু সেই আর-কেউকে কিছুতে ক্ষমা করবেন না। |
বিশ্বজিৎ। | আমার সৈন্য আছে, তারা তোমাকে আর তোমার প্রহরীদের বন্দী করে নিয়ে যাবে। দায় আমারই। |
নেপথ্যে। | আগুন, আগুন। |
উদ্ধব। | ওই হয়েছে। বন্দিশালার সংলগ্ন পাকশালার তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই সুযোগে বন্দী দুটিকে বের করে দিই। |
কিছুক্ষণ পরে অভিজিতের প্রবেশ |
|
অভিজিৎ। | এ কী দাদামশায় যে! |
বিশ্বজিৎ। | তোমাকে বন্দী করতে এসেছি। মোহনগড়ে যেতে হবে। |
অভিজিৎ। | আমাকে আজ কিছুতেই বন্দী করতে পারবে না, না ক্রোধে, না স্নেহে। তোমরা ভাবছ তোমরাই আগুন লাগিয়েছ? না, এ আগুন যেমন করেই হ’ক লাগত। আজ আমার বন্দী থাকবার অবকাশ নেই। |
বিশ্বজিৎ। | কেন, ভাই, কী তোমার কাজ? |
অভিজিৎ। | জন্মকালের ঋণ শোধ করতে হবে। স্রোতের পথ আমার ধাত্রী, তার বন্ধন মোচন করব। |
বিশ্বজিৎ। | তার অনেক সময় আছে, আজ নয়। |
অভিজিৎ। | সময় এখনই এসেছে এই কথাই জানি, কিন্তু সময় আবার আসবে কি না সে কথা কেউ জানি নে। |
বিশ্বজিৎ। | আমরাও তোমার সঙ্গে যোগ দেব। |
অভিজিৎ। | না, সকলের এক কাজ নয়, আমার উপর যে কাজ পড়েছে সে একলা আমারই। |
বিশ্বজিৎ। | তোমার শিবতরাইয়ের ভক্তদল যে তোমার কাজে হাত দেবার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, তাদের ডাকবে না? |
অভিজিৎ। | যে ডাক আমি শুনেছি সেই ডাক যদি তারাও শুনত তবে আমার জন্যে অপেক্ষা করত না। আমার ডাকে তারা পথ ভুলবে। |
বিশ্বজিৎ। | ভাই, অন্ধকার হয়ে এসেছে যে। |
অভিজিৎ। | যেখান থেকে ডাক এসেছে সেইখান থেকে আলোও আসবে। |
বিশ্বজিৎ। | তোমাকে বাধা দিতে পারি এমন শক্তি আমার নেই। অন্ধকারের মধ্যে একলা চলেছ তুবও তোমাকে বিদায় দিয়ে ফিরতে হবে। কেবল একটি আশ্বাসের কথা বলে যাও যে, আবার মিলন ঘটবে। |
অভিজিৎ। | তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হবার নয় এই কথাটি মনে রেখো। |
[ দুই জনের দুই পথে প্রস্থান ] |