Skip to content

মুক্তধারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একজন পথিকের প্রবেশ

পথিক। (চীৎকার করিয়া) ওরে বুধ–ন, শম্ভু–উ, বিপদে ফেললে। আমাকে এগিয়ে দিলে, বললে। চড়াই পথ বেয়ে সোজা এসে আমাকে ধরবে। কারও দেখা নেই। অন্ধকারে ওই কালো যন্ত্রটা ইশারা করছে। ভয় লাগিয়ে দিলে। কে আসে? কে হে? জবাব দাও না কেন? বুধন না কি?
২ পথিক। আমি নিমকু, বাতিওআলা। রাজধানীতে সমস্ত রাত আলো জ্বলবে, বাঁতির দরকার। তুমি কে?
১ পথিক। আমি হুব্বা, যাত্রার দলে গান করি। পথের মধ্যে দেখতে পেলে কি আন্দু অধিকারীর দল?
নিমকু। অনেক মানুষ আসছে, কাকে চিনব?
হুব্বা। অনেক মানুষের মধ্যে তাকে ধ’রো না, আমাদের আন্দু। সে একেবারে আস্ত একখানি মানুষ– ভিড়ের মধ্যে তাকে খুঁটে বের করতে হয় না– সবাইকে ঠেলে দেখা দেয়। দাদা, তোমার ওই ঝুড়িটার মধ্যে বোধ করি বাতি অনেকগুলো আছে, একখানা দাও না। ঘরের লোকের চেয়ে রাস্তার লোকের আলোর দরকার বেশি।
নিমকু। দাম কত দেবে?
হুব্বা। দামই যদি দিতে পারতুম তবে তো তোমার সঙ্গে হেঁকে কথা কইতুম, মিঠে সুর বের করব কেন?
নিমকু। রসিক বট হে।

[ প্রস্থান ]

হুব্বা। বাতি দিলে না, কিন্তু রসিক বলে চিনে নিলে। সেটা কম কথা নয়। রসিকের গুণ এই, ঘোর অন্ধকারেও তাকে চেনা যায়।– উঃ, ঝিঁঝির ডাকে আকাশটার গা ঝিম ঝিম করছে। নাঃ বাতিওআলার সঙ্গে রসিকতা না করে ডাকাতি করলে কাজে লাগত।

আর-একজন পথিকের প্রবেশ

পথিক। হেইয়ো!
হুব্বা। বাবা রে, চমকিয়ে দাও কেন?
পথিক। এখন চলো!
হুব্বা। চলব বলেই তো বেরিয়েছিলুম। দলের লোককে ছাড়িয়ে চলতে গিয়ে কি রকম অচল হয়ে পড়তে হয় সেই তত্ত্বটা মনে মনে হজম করবার চেষ্টা করছি।
পথিক। দলের লোক তৈরি আছে এখন তুমি গিয়ে জুটলেই হবে।
হুব্বা। কথাটা কী বললে? আমরা তিনমোহনার লোক, আমাদের একটা বদ অভ্যেস আছে পষ্ট কথা না হলে বুঝতেই পারি নে। দলের লোক বলছ কাকে?
পথিক। আমরা চবুয়া গাঁয়ের লোক, পষ্ট বোঝাবার বদ অভ্যেসে হাত পাকিয়েছি। (ধাক্কা দিয়া) এইবার বুঝলে তো?
হুব্বা। উঃ বুঝেছি। ওর সোজা মানে হচ্ছে, আমাকে চলতেই হবে মর্জি থাক আর না থাক। কোথায় চলব? এবার একটু মোলায়েম করে জবাব দিয়ো। তোমার আলাপের প্রথম ধাক্কাতেই আমার বুদ্ধি পরিষ্কার হয়ে এসেছে।
পথিক। শিবতরাইয়ে যেতে হবে।
হুব্বা। শিবতরাইয়ে? এই অমাবস্যারাত্রে? সেখানে পালাটা কিসের?
পথিক। নন্দিসংকটের ভাঙা গড় ফিরে গাঁথবার পালা।
হুব্বা। ভাঙা গড় আমাকে দিয়ে গাঁথাবে? দাদা, অন্ধকারে আমার চেহারাটা দেখতে পাচ্ছ না বলেই এত বড়ো শক্ত কথাটা বললে। আমি হচ্ছি–
পথিক। তুমি যেই হও না কেন, দুখানা হাত আছে তো?
হুব্বা। নেহাত না থাকলে নয় বলেই আছে নইলে একে কি–
পথিক। হাতের পরিচয় মুখের কথায় হয় না, যথাস্থানেই হবে,এখন ওঠো।

দ্বিতীয় পথিকের প্রবেশ

২ পথিক। ওই আর-একজন লোককে পেয়েছি কঙ্কর।
কঙ্কর। লোকটা কে?
৩। আমি কেউ না, বাবা, আমি লছমন, উত্তরভৈরবের মন্দিরে ঘন্টা বাজাই।
কঙ্কর। সে তো ভালো কথা, হাতে জোর আছে। চলো শিবতরাই।
লছমন। যাব তো, কিন্তু মন্দিরের ঘন্টা–
কঙ্কর। বাবা ভৈরব নিজের ঘন্টা নিজেই বাজাবেন।
লছমন। দোহাই তোমাদের, আমার স্ত্রী রোগে ভুগছে।
কঙ্কর। তুমি চলে গেলে তার রোগ হয় সারবে, নয় সে মরবে; তুমি থাকলেও ঠিক তাই হত।
হুব্বা। ভাই লছমন, চুপ করে মেনে যাও। কাজটাতে বিপদ আছে বটে, কিন্তু আপত্তিতেও বিপদ কম নেই– আমি একটু আভাস পেয়েছি।
কঙ্কর। ওই যে, নরসিঙের গলা শোনা যাচ্ছে। কী নরসিং, খবর ভালো তো?
নরসিং। এই দেখো, দল জুটিয়ে এনেছি। আরও কয়দল আগেই রওনা হয়েছে।

 

কঙ্কর। তা হলে চলো, পথের মধ্যে আরো কিছু কিছু জুটবে।
দলের একজন। আমি যাব না।
কঙ্কর। কেন যাবে না? কী হয়েছে?
উক্ত ব্যক্তি। কিচ্ছু হয় নি, আমি যাব না।
কঙ্কর। লোকটার নাম কী নরসিং?
নরসিং। ওর নাম বনোয়ারি, পদ্মবীজের মালা তৈরি করে।
কঙ্কর। আচ্ছা, ওর সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করে নিই– কেন যাবে না বলো তো?
বনোয়ারি। প্রবৃত্তি নেই। শিবতরাইয়ের লোকের সঙ্গে আমার ঝগড়া নেই। ওরা আমাদের শত্রু নয়।
কঙ্কর। আচ্ছা, না হয় আমরাই ওদের শত্রু হলুম, তারও তো একটা কর্তব্য আছে?
বনোয়ারি। আমি অন্যায় করতে পারব না।
কঙ্কর। ন্যায় অন্যায় ভাববার স্বাতন্ত্র৻ যেখানে সেইখানেই অন্যায় হচ্ছে অন্যায়। উত্তরকূট বিরাট, তার অংশরূপে যে কাজ তোমার দ্বারা হবে তার কোনো দায়িত্বই তোমার নেই।
বনোয়ারি। উত্তরকূটকে ছাড়িয়ে থাকেন এমন বিরাটও আছেন। উত্তরকূটও তাঁর যেমন অংশ, শিবতরাইও তেমনি।
কঙ্কর। ওহে নরসিং, লোকটা তর্ক করে যে। দেশের পক্ষে ওর বাড়া আপদ আর নেই।
নরসিং। শক্ত কাজে লাগিয়ে দিলেই তর্ক ঝাড়াই হয়ে যায়। তাই ওকে টেনে নিয়ে চলেছি।
বনোয়ারি। তাতে তোমাদের ভার হয়ে থাকব, কোনো কাজে লাগব না।
কঙ্কর। উত্তরকূটের ভার তুমি, তোমাকে বর্জন করবার উপায় খুঁজছি।
হুব্বা। বনোয়ারি খুড়ো, তুমি বিচার করে সব কথা বুঝতে চাও বলেই, যারা বিনা বিচারে বুঝিয়ে থাকে তাদের সঙ্গে তোমার এত ঠোকাঠুকি বাধে। হয় তাদের প্রণালীটা কায়দা করে নাও, নয় নিজের প্রণালীটা ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকো।
বনোয়ারি। তোমার প্রণালীটা কী।
হুব্বা। আমি গান গাই। সেটা এখানে খাটবে না বলেই সুর বের করছি নে–নইলে এতক্ষণে তান লাগিয়ে দিতুম।
কঙ্কর। (বনোয়ারির প্রতি) এখন তোমার অভিপ্রায় কী?
বনোয়ারি। আমি এক পা নড়ব না।
কঙ্কর। তাহলে আমরাই তোমাকে নড়াব। বাঁধো ওকে।
হুব্বা। একটা কথা বলি, কঙ্কর দাদা, রাগ ক’রো না। ওকে বয়ে নিয়ে যেতে যে জোরটা খরচ করবে সেইটে বাঁচাতে পারলে কাজে লাগত।
কঙ্কর। উত্তরকূটের সেবায় যারা অনিচ্ছুক তাদের দমন করা একটা কাজ, সময় থাকতে এই কথাটা বুঝে দেখো।
হুব্বা। এরই মধ্যে বুঝে নিয়েছি।

[ নরসিং ও কঙ্কর ছাড়া আর সকলের প্রস্থান ]

পরবর্তী অংশ পড়ুন 

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।