Skip to content

প্রতিক্রিয়াশীল – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অন্ধকার পথ ছিলো মন্দিরের পাশে, ঝাঁটি গাছ চেপে ধরে হাত
. কিংবা নিরঙ্কুশ ভয় যা কারো চৈতন্যময় জাগে
এরকম অবস্থায় মধ্যবর্তী হলে পর | আকস্মিকতার কাছে
মানুষের খট্ কা লাগে, তারপরেই স্বাভাবিক হওয়া, যেমন নারীর কাছে
অন্ধকার দেবতার ধূপধুনো পচা পুষ্পগন্ধ – তার কাছে
তবু কিছুকাল গেলে ফেরে স্বাভাবিক – মন্দির মণ্ডপ ছেড়ে

. মন্দিরের পথ গেছে মন্দিরের অত্যন্ত ভিতরে |
সেখানে কি যেতে পারে – ফুলপাতা ? বিরহ ব্যাপক ?
জানি না, দুয়ারে হাত দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে দেখেছি
প্রকৃত পাণ্ডার কন্ঠে কলকাতারই রাজনীতিবিদ
. মানুষের মধ্যে অন্য মানুষকে দোষারোপ করে
যে চায় তৃষ্ণার শান্তি, তাকে যেন জলের নিয়মে দূরে রাখা,
বালি ও পাথর কতো শান্তি দেবে অমল সন্ন্যাসে ?

মৃত্যু ও জীবনে শুধু একটি ঊর্দ্ধে উঠে-আসা মেঘ
কিংবা এক জলজ হিংসা লেজ ঝাপ্ টে লুপ্ত করে নেবে –
গান গাওয়া !
তেমনি প্রসিদ্ধ কোনো কবিতার পংক্তি নষ্ট করাও সহজ
আর থাকে করে থাকে ভার্সিটির নীল গুবরে পোকা—
শিক্ষার গোবরে করে মাখামাখি এবং যা চায়
মৃত মাথা রেখে দেয় স্বরচিত বই-এর বালিশে—
আহম্মক !
মানুষেরই আহাম্মকি মানুষকে ভালুক নাচায়—
. এমন দেখেছি আমি বিবেচনাপ্রসূত মণ্ডপে
সভাস্থলে, কোথা নয় ? এমন কি ময়দানের ধারে—
যেখানে বক্তৃতা চলে : এখনি শুদ্ধতা দিতে পারি
. যদি তুমি ভক্ত থাকো—যদি শ্রুতি না মানে কবিতা
বাংলাদেশ গ্রাম থেকে উঠে আসে উজ্জ্বল দুপুরে
. এবং সন্ধ্যায় ফেরে রিক্ত নিঃস্ব মুখ সারি সারি
যে-মিছিল ভেঙে যায়, বাড়ি ফেরে—তার দুঃখ দেখে
অন্ধকারে কেঁদে ওঠে রেড্ রোড
. গঙ্গার ঢালা জলে—

একদিন, মিছিলের ডগা-মধ্য-লেজে বসে থেকে, অনেক ঘুরেছি আমি
কলকাতা, বিপুল বাংলাদেশ. ..
মানুষের খুব কাছে গিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করেছি—
ভোলানো সহজ তাকে, তার মধ্যে স্বপ্নের করবী
তাকেও ফোটানো সোজা—শুধু তার বীজে শক্ত বিষ
এ-সম্পর্কে কোনো কথা ভালো নয়, এড়ানোই ভালো
একদিন, মিছিলের ডগা-মধ্য-লেজে বসে থেকে, অনেক ঘুরেছি আমি
কলকাতা, বিপুল বাংলাদেশ …
একটি সতর্ক পথ মুড়ো খোলা, লেজে চেপে জাঁতি
. আমার ঘরের কাছে রেখে গেছে |
আকাশের মতো তাকে মনে হয়, কিংবা ফালিকাটা
. দরজির দোকানে টুকরো কাপড়ের মতো ব্যর্থ মুখ
যাকে শুধু রজঃস্বলা দুই ঊরু ঢেকে দিতে পারে
আর কেউ পারে না |

. ঐ ব্যর্থ আকাশের টুকরো দিয়ে কলকাতা আমার
নিচে থেকে কাকচক্ষু ছবির মতন মনে হয় …
পাতালে যে পড়ে আছে, সে দ্যাখে এভাবে দর্শনীয় !
মানুষেই পারে তবু রক্ত দিয়ে সে বুক ভরাতে
এবং যে দেয়, তার উপকারে এক আকর্ষক
তাঁবু ফেলে রাখা হয় কিছুদিন, যা করে পৃথক
দুইজন মানুষের বর্জনীয় রক্তের পিপাসা
যে মারে সে কিছুকাল বাদে গিয়ে বলে, বন্ধু ভালো ?
আমিও তোমার পাশে শুয়ে থাকবো নিরবধিকাল |
এইভাবে
পৃথিবীতে কিছু সত্যিকার ক্লেদ ধুয়ে মুছে যাবে
ভুল হবে রুদ্ধশ্বাস তৃষ্ণা হবে পাথরে সংযমী
আর ছার রাজনীতি ! বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করবে ভোট
এবং যে ভিখারিকে দয়া করে, সে কত নির্মম—
ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে ভিখারির বাচাল ব্যগ্রতা
এইভাবে
পৃথিবীর কিছু সত্যিকার ক্লেদ ধুয়ে মুছে যাবে—
যেভাবে প্রতিমা ধোয়, সেভাবেও ধোবে একদিন
বের হয়ে পড়বে খড়, কাঁচা বাঁশ— সাধ্য ও দালালি |
ভালোবাসাবাসি থাকে মুখোমুখি এবং শত্রুতা
আরেকরকম রোদ বাধা পেয়ে তেরছা হয়ে পড়ে
ছায়া বাঁকাভাবে পড়ে আপন স্বভাবে …
তেমনি মানুষ !
হিংসাপরবশ সড়কি বিঁধে দেয়, লুকোচুরি খেলে
অমাবস্যাময় বনে, তার মুখ থাকে না প্রত্যহ
যেমন সহজ ছিলো, ঠেকে যায় আদর্শে, হিংসায়
অথচ জিজ্ঞাসা এক, সিংহাসন একই, নিরুদ্দেশ
ভাগ্য মন্দ—তাই পড়ে থাকা
উথ্বানক্ষমতাহীন মেরুদণ্ডে এসে লাগে ঝড়
ঝগড়ার শরিকি তাপ এবং এ-দৈনিক ধ্বংসের
আমিও উচ্ছিষ্ট এক, কায়ক্লেশে বুঝি বেঁচে আছি…
. নিরবলম্বনে |

ঐ ঘাস আমাকেও খায় – অর্থাৎ সারল্য, তার কাচপোকা, ছুঁচে
. এবং তল্লাট জুড়ে জীবনের শান্তি, থেকে থাকা
আমার চঞ্চল্য টানে যেন সাপ সরলরেখায়
আকাশ পাতাল আমি কী কারণে উত্তপ্ত হয়েছি ?
বরং নিশ্চিন্তি আনে বোতলের নেশা
দারুণ চপেটাঘাত মধ্যরাতে করে ভগবান –
বাড়ি যা, অবোধ ছেলে — মুখোমুখি দাঁড়া জীবনের-
ভালোবাসাবাসি থাকে মুখোমুখি এবং শত্রুতা |

বড়ো ভালো লাগে এই পৃথিবীর মূঢ়তার দ্যোতক ইস্কুলে
. ছুটি-লেগে-থাকা ঘর, হাইবেঞ্চ, পেটা ঘন্টাধ্বনি
বড়ো ভালো ভাঁটফুল, তীব্র গন্ধে বৃষ্টিতে মুখর
ভাঙা সাতমহল ঐ বড়োমানুষ বোসবাবুদের
. ঝিল, তার পানফুল, আমলকি ও অর্বুদ বকুল
হাটের ধুলোয়
বড়ো ভালো সব ঐ যাতে হিম ন্যাপ্ থল মাখানো |
ডেকে আনো
যেখানে ও যাকে পাও ডেকে আনো, হিসেবনবিশ
আমার মাথার ধারে এসে গেছে, রোগীর ডাক্তার…
কিংবা মজাতৃষ্ণা নিয়ে যেভাবে মন্থর পশু গেরস্তের
. সেভাবে এসেছে
বাহুল্যবর্জিত, তবু দ্রুত নয়, শিক্ষিত ভ্রমণে
এখন প্রকাশ্যে, মনে মনে, শুধু তোমাকেই চাই, তুমি
. কাছে এসো, ভেঙে দাও ভুল
আমার শিমূল আমারই ঘরের পাশে ফুটে আছে
ফেটে তার তুলো
আমার বাগানে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে বকুলও
ছেলেবেলা থেকে তার ধুলোমাখা উচ্ছন্ন প্রকৃতি
. আমাকে করেছে বটে অনায়ত্ত, আলস্যমদির
কিন্তু জানি, যুক্তি কাকে বলে
জানি কাকে বলে এক খরশান্ জীবনযাপন
জানি কার নাম ক্রোধ, খাদ্য যার তুঁষ ও কর্পূর
জানি দেবার্চনা, যদি দেবতাও প্রচ্ছন্ন পাথরে ?
‘যশো দেহি’বলে আমি কোনোদিন করিনি প্রার্থনা
শুধু এই
. পঙ্গুর অলঙ্ঘ্য শৃঙ্গে করি আমি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত
কবিতা, কল্পনালতা
এবং হে ভঙ্গুর বিধাতা
তোমার বিখ্যাত ভালো, তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাই !

এক তিক্ত, নষ্ট ফলে তবু থাকে প্রত্যাশা মধুর—
কিন্তু, কেন এ-আড়াল ? মাঝা ভেঙে ন্যাংটো হয়ে বলি :
তিক্ত ও বিরক্ত আমি, নিজভূমে দীর্ঘ পরবাসী
ওদের প্রবাসবোধ আমাদের থেকে আধুনিক
এমনি তো মনে হয়, যখনি সঠিক কথা বলে
যেন পেটকাপড়ে ঢেকে নিয়ে যায় ঝিউড়ির মতন
কিছু বা গূঢ় ও গুহ্য ; মন্ত্র নাকি ? পাবে না সকলে |
সেই পুরোহিততন্ত্র ! অসম্ভব বিংশশতাব্দীতে
এবং যা কিছু খাঁটি তার জন্য সংহিতা, পোস্টার
সর্বজনগ্রাহ্য ঘূণ চরিত্রের ঝাঁঝ্ রা করোটিতে
. ব্যাগ্ পাইপ বাজায়
হায়, হায়, কাকে বলে জন্মপরবাসী !
চলো, গিয়ে দেখে আসি
দেশ আমার, দেশ আমার, মা- –
. অর্থাৎ এক মুঠো ধুলো, অন্য মুঠে ছাইমাখা কেশ
. মুঠিভরা নুটি

এবং অনন্ত এক সহ্যের প্রতিমা,
চলো, গিয়ে দেখে আসি
. দেশ আমার, দেশ আমার, মা
এবং তাকেও চাই, জীবনের সার্থক খেলায়
. যে তোমার সঙ্গে যাবে, কোনদিন পিছনে ফিরবে না
সঙ্গে যাবে মেঠোঘর, গঙ্গাজল, তুলসীর মতো
আমিষ গন্ধের মতো বর্ম ঘিরে বাঁচাবে তোমাকে
. এবং দেখাবে মন্ত্র প্রতিচ্ছবি তোমারই বালকে—
আধুনিকতার পাপ – একটি রোগের কাছে তুমি নও ভ্রষ্ট ও পাতক
. সাধারণ কবি তুমি
ঘুরে ফিরে, নর্তনে-কুর্দনে, সঞ্চয়বিহীন, তুমি মন্দ তুমি মূঢ়মতি
. এ যুগে প্রজড়
তোমার রক্তের চাকা, তুমি নও অর্জুন অর্জুন
তুমি আত্মরক্তপ্রিয়, এ-শতাব্দে কবির মতন নও
. গৃঢ় ও তামাটে—
মমতাপিয়াসীমাত্রে স্তন্য দাও নারীর মতন—
. প্রতিক্রিয়াশীল |
ঘৃণ্য এক সড়ককুক্কুর তুমি, গ্লানি ক্লেদে, প্রগতিবর্জিত
. হেঁটোয় ওপরে কাঁটা জীবন্ত সমাধি দিতে চাই
তোমাকে, আমার মতো যারা কবি, নিতান্ত কানীন !

[A]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।