Skip to content

জঙ্গলের মধ্যে ঘর ঈশ্বর গড়েন – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

বৃষ্টিতে ডুয়ারস খুবই পর্যটনময় !
মেহগনি-বীথি পার হলে পাবে দোতলা বাংলোটি
কাঁটাতার বেড়া-ঘেরা সবুজ চাদরে ঘাস বড়ো উচ্ছৃঙ্খল
এখন, এখানে |
তাকে ঘিরে আছে কিছু রুদ্রাক্ষের গাছ ছাতার মতন
কৃষ্ণের দেহের বর্ণময় ফল পড়ে আছে ঘাসে,
রাতের বাদুড় তার মুখ থেকে খসিয়ে গিয়েছে,
বৃষ্টিপতনের চাপে হয়তো বা | খুঁটিমারি রেনজ
দোতলা বাংলোর ঘর আমাদের দখলে দিয়েছে
দু’ রাতের জন্যে |

জঙ্গলের মধ্যে ঘর ঈশ্বর গড়েন |
মানুষের বসবাস সহজ সহজতর হব ব’লে
ঈশ্বর গড়েন
জঙ্গলের মধ্যে ঘর—শিক্ষানবিশির জন্যে
ঈশ্বর গড়েন
মানুষেও পারে
ঈশ্বরের কাজ হাতে, উত্তরসুরির মতো, নিয়ে নিতে
এবং বাড়াতে,
দুঃখ ও সুখের মধ্যে থাকবে ব’লে, মানুষেই পারে |

এখন জঙ্গল খুব উপদ্রুত নয় |
মানুষের ভয়ে সব পশুপাখি
অধিক অধিকতর জঙ্গলের দিকে সরে গেছে |
মানুষের সাধ্য নয় সে গভীরে যাওয়া
প্রাণভয়,. কুশলতা অপেক্ষাও বড়
ওরা গেছে প্রাণভয়ে নিজেকে জেতাতে নয়, বাঁচার তাগিদে
মানুষের মতো নয়, শিকারীর মতো নয় কোনো |

খুঁটিমারি বাংলো জুড়ে বসে থেকে অবাক হয়েছি !
তেমন নিষিদ্ধ কোনো পাখি নয়., কাক ও শালিখ—
যাদের গৃহস্থ বলে মোটামুটি, তারাই এসেছে
কখনো রেলিং-এ বসে খাদ্যের গন্ধের দিকে
পলক ফেলেছে,
কখনো উঠোনে খুঁটে তুলেছে কেঁচো বা কীট—নিজস্ব তাদের
মানুষের মুখাপেক্ষী থেকে এক উদাসীনতায়
তাদের ফুসফুস ভরে গেছে, শুধু মনটি ভরেনি
মন ও খাদ্যের মধ্যে অপরূপ যোগাযোগ আছে,
আমি জানি |

ছেড়ে চলো খুঁটিমারি, মেহগনি-রুদ্রাক্ষের বন
খাট ও পালঙ্ক, কাচ-ক্রকারিজ, চিরুনি চুল
ছেড়ে চলো সুবাতাস, সোঁদা গন্ধ, কাদা মাটিময়
জঙ্গল, যা পাখিহীন, পশুশূন্য, ছেড়ে চলো তাকে
এভাবেই যেতে হয়, যা তোমাকে পরিত্যাগ করে
তাকে ছেড়ে |
স্মৃতি বেদনার মালা ছিঁড়ে ফেলে, বাগানে ছড়িয়ে
এভাবেই যেতে হয় দ’লে ম’লে অন্ধের মতন |

এবার জঙ্গলে সরাসরি নয়, পথ খুঁড়ে খুঁড়ে
দু’পাশে জঙ্গল রেখে ক্রমাগত ছুটে-দৌড়ে যাওয়া
জঙ্গলের মায়া মেখে, ছায়া মেখে উত্তরের দিকে
ক্রমাগত চলে যাওয়া, পিছনে ব’লেও যাওয়া নয়
শুধু যাওয়া, শুধু চলে যাওয়া |
এবার জঙ্গলে সরাসরি নয়, মেটেলির হাটে
জঙ্গলের কিছু কিছু লোক ছুঁতে যাওয়া |
মেটেলি-চালসার হাটে চলো যাই
ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে
পাহাড় পাকিয়ে উঠে চলো পথ ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে |

কাছে দূরে চা-বাগান, ধোঁয়া ওঠে পাকিয়ে আকাশে—
এখানেও পাকদণ্ডী ! ধোঁয়ার প্রকৃত পাকা পথ
উত্তর বাংলার |
এ-নিসর্গ দ্বিতীয়রহিত
জঙ্গল-পাহাড় নদী মানুষের মুখশ্রী বাড়ায়
ছায়া ফেলে মুখে |
মানুষ এখানে খুব দ্রুতগামী নয়
মাটির মানুষ খরস্রোত নদীর মতন
কিংবা শুধু পাহাড়ের মতো নয় সম্পন্ন সবুজে |
বিপণ্ণতা আছে, ধৃতি, বৃন্ত, পাতা আছে—
শুধু হাহাকার নয়, আনন্দও আছে,
মাদলে-বাদলে বাজে হাতের খঞ্জনী,
পায়ের নূপুর বাজে জলে যেন নুড়ি
ঘোরা গান গেয়ে চলে মহামান্য বুড়ি
তিস্তা |

চাতালে বসেছে হাট | দেখে মনে হবে
শর্করা মণ্ডের পানে ছুটছে মানুষ
সারিবদ্ধ, পিঁপড়ের মতন
বাগানে বল্মীকস্তূপ ভেঙে-ভেঙে ছুটেছে বাল্মীকি—
হাটে যাবে !
সপ্তাহের হাট,
ছদিনের ধান ভেঙে চাল করা আলোর মতন
এই হাট !
বন্দী জানালার মতো হাতছানিময়
খোলা খাঁচা নিয়ে পাখি যেমন বিমূঢ়
মানুষও বিমূঢ় হয় ছ’-ছ’ দিন ভেবে
অতোটুকু মুক্তি পেলে, কীভাবে সামলাবে ?

একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে
মাদলে স্থলিত কাঠি ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে আকাশে-বাতাসে
সন্ধ্যা হয়ে আসে |
বিজয়ী মোরগ বুকে ওঁরাও মরদ হাসে যতো
তারও বেশি কাঁদে
কারণ না জেনে কাঁদে ধুলোয় লুটিয়ে
ছদিনের কান্না যেন একদিনে ফুরোবে
হালকা-বুকে ফিরে যাবে বাগিচা-বস্তিতে—
যাওয়া যায় ?
বাগিচার মধ্যে বস্তি ঈশ্বরই গড়েন ||

[A]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।