Skip to content

আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার
শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
কাগজ আওলারা বললেক,
উঁহু অতটুকন বললে হবেক কেনে
তুমি ইবারকার মাধ্যমিকে পথম
তুমাকে বলতে হবেক আর অ কিছু।
টিভি আওলারা বললেক,
তুমি ক্ষেতমজুরের মেইয়া
তুমি কী করে কামিন খাটে মাধ্যমিকে পথম হলে
সেটা তুমাকে বলতে হবেক খুলে
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান,উপপধান,এম.এল.এ.এম.পি.
সবাই একবারি হামলে পড়ল আমাদে মাটির কুঁড়াঘরে ।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার কন বিহানবেলায়
টিনের আগুড় খুলে
হাঁকে ডাকে ঘুম ভাঙ্গাই
খবরটা যখেন পথম শুনালেক
তখেন মা কে জড়াই শুয়েছিলম আমি,
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুটা অন্ধকারে
হেডমাস্টার কে দেখে
মায়ের পারা আমিও চোখ কচালে হাঁ হয়ে ভালেছিলম
ইকি স্বপুন দেখছি নকি,
সার বললেক ,ইটা স্বপুন লয় সত্যি বঠে।
কথাটা শুনে কাঁদে ভাসাইছিলম আমরা দু মা বিটি
আজ বাপ বাঁচে থাকলে
মানুষটাকে দেখাতে পারথম
আমি দেখাতে পারথম বহুত কিছু
আমার বুকের ভিতরে যে তেজাল সনঝাবাতিটা
জ্বালে দিয়েছিল মানুষটা
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদে কুঁড়াঘরটাকে
আলো করেছে সেটা দেখাতে পারথম ।
আপনারা বলছেন বঠে
কথাটা শুনতে কিন্তুক খুব ভাল অ,
“তুমাদে মতন মেইয়ারা যদি উঠে আসে
তাহালে আমাদে গোটা দেশটাই উঠে আসে”,
কিন্তক উঠে আসার রাস্তাটা যে আখনও তয়ার হয় নাই
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কী জিনিস
বহুত দম লাগে
বহুত তেজ লাগে।

আমি জামবনির শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
যখন থাকে হুঁস হ ইছে তখন থাকে শুনে আসছি
” বিটি না মাটি”,
ঠাকুমা বলথক,
পরের ঘরে হিঁসাল ঠেলবেক তার আবার লেখাপড়া
গাঁয়ের বাবুরা বলথক,
তুই কুঁইরিপাড়ার বিটিছেলা
তোর কামীনখাটা ছাড়া গতি কি ।
বাপ বলথক, দেখ সাঁঝলি
মন খারাপ করলি ত হারে গেলি
শুন যে যা বলছে বলুক
ইসব কথা এক কানে সিমালে
আরেক কানে বার করে দিবি ।

তখেন বাবু পাড়ার কুচিল দেঘরার ঘরে
কামীন খাটতক মা
ক্ষয় রোগের তাড়সে মায়ের গতরটা ভাঙ্গে নাই আতটা
মাঝেমধ্যে জ্বর টর আসত,
জ্বর আল্যে মা চুপচাপ এগনাতে তালাই পাতে
শুয়ে থাকত,
মনে আছে সে ছিল এক জাড়কালের সকাল
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি
ঝিঙাফুলা রোদ,
আমি সে রোদে পিঠ দিয়ে গা দুলাই পড়ছিলম
ইতিহাস
ক্লাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দেঘরা গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক
মায়ের জ্বর
সে তারা শুনতে নাই চায়
আমাদে দিদিবুড়ি তখন বাঁচে
কুলতলায় বসে ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে
বিড়ি ফুঁকছিল বুড়ি
শেষতক বুড়ি সেদিন পড়া থাকে উঠাই
মায়ের কাজটুকুন করতে পাঠাইছিল বাবু ঘরে ।
পুরন অ ফটক ঘেরা উঠান
অতবড় দরদালান
অত বড় বারান্দা
সব ঝাঁটপাট দিয়ে সাফসুতরা করে
আসছিলম চল্যে ,
দেঘরা গিন্নি নাই ছাড়লেক
একগাদা এঁটাকাটা জুঠা বাসন
আমার সামনে আনে ধরে দিলেক।
বললম,তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে নাই পারব।
বাবু গিন্নির সে কী রাগ ,
কী বললি
আরেকবার বল দেখনি
যতটুকুন মু লয় ততবড় কথা
জানিস তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা
সবাই আমাদে জুঠা বাসন ধুইয়ে
আতককাল গুজারে গেল
আর তুই বললি জুঠা বাসন ধুতে লারবি ?
বললম, হ,তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে লারব
তুমরা লোক দেখে লাও গা
আমি চললম।
কথাটা বলে গটগট করে
বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেরাই চল্যে আইছিলম।

তাবাদে সে লিয়ে কী কান্ড কী ঝামালা
বেলা ডুবলে মাহাতোদে ধান কাটে
বাপ ঘরকে আলে
দু পাতা লেখাপড়া করা লাতনীর
ছোট মুখে বড় থুতির কথা
সাতকাহন করে বলেছিল দিদিবুড়ি,
মা কোনো রা কাড়ে নাই
আঘনমাসের সনঝাবেলায় এগনাতে আগুন জ্বালে
গা হাত পা সেঁকছিল মা,
এক মাথা ঝাঁকড়া কালো চুল ঝাঁকানো বাপের
পেটানো পাথরের মুখটা
ঝলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে ।
বাপের অমন চেহারা
আমি কোনোদিন দেখি নাই
বাপ সেদিন মা আর দিদিবুড়ির সমুখে
আমাকে কাছকে ডাকে
মাথায় হাত বুলাই গমগমা গলায় বলেছিল,
যা করেছিস বেশ করেছিস,
শুন , তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা
সবাই করেছে কামীন গিরি
বাবু ঘরে গতর খাটাই খাইছে
তাতে হ ইছে টা কী,
ই কথাটা মনে রাখবি
তুই কিন্তুক কামীন হওয়ার লাগে জন্মাস নাই
যত বড় লাট সাহেব ই হোক কেননে
কারু কাছে মাথা নুয়াই লিজের তেজ বিকাবি নাই
এই তেজ টুকুনের লাগে লেখাপড়া শিখাচ্ছি তোকে
নাহালে আমাদে পারা হাভাতা মানুষের ঘরে
আর আছেটা কি।

আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার
শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
কবেকার সেই ক্লাস সেভেনের কথা ভাবতে যাইয়ে
কাগজ আওলা টিভি আওলাদের সামনে আখন
কী যে বলি
তালপাতার রঁদ দিয়ে ঘেরা গোবুরলাতার এগনা তে লোকে আখন লোকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই জীবগাড়িতে চাপে
আগু পেছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আলেক ছুটে,
কোথায় সাঁঝলি কুঁইরি কোথায়
বলতে বলতে বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে
সোজা আমাদে মাটির কুঁড়াঘরে।
হেড সার বললেক, প্রনাম কর সাঁঝলি প্রণাম কর,
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়ালেক
পিঠ চাপড়াই বললেক,
তুমি কামীন খাটে মাধ্যমিকে প্রথম
তাই তুমাকে দেখতে আলম
সত্যি বড় গরিব অবস্থা
তুমাদে মতন গরিব ঘরের মেয়েরা যাতে উঠে আসে
তার লাগে আমাদের পার্টি
তার লাগে আমাদের সরকার
নাও দশ হাজার টাকার চেক টা আখন নাও
শোনো আমরা তোমাকে আরো টাকা তুলে দেব
ফুল দেব
সম্বর্ধনা দেব
এই টিভির লোক কাগজের লোক কারা আছেন
এদিকে আসুন।

তক্ষুনি ছোট বড় কত রকমের সব
ঝলকে উঠল ক্যামেরা
ঝলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ
না না মন্ত্রী লয়
ঝলকে উঠল আমার বাপের মুখ
গনগনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ
আমি তখুনি বলে উঠলম,
না না ই টাকা আমার নাই লাগবেক
আর আমাকে যে ফুল দিবেন সম্বর্ধনা দিবেন
আর অ দেদার টাকা তুলে দিবেন
তাও আমার নাই লাগবেক।
মন্ত্রী তখন ঢোক গিললেক
গাঁয়ের সেই দেঘরা গিন্নির বড় বেটা
সে আখন পার্টির বড় লেতা
ভিড় ঠেলে সে আসে বললেক,
কেনে কী হ ইছে রে সাঁঝলি
তুই ত আমাদে ঘরে কামীন ছিলি
বল তোর লাগে আমরা কি করতে পারি বল
তোর কি লাগবেক সেটা খুলে বল।

বললম, আমার পারা শয়ে শয়ে আরো অনেক
সাঁঝলি আছে
আরো শিবু কুঁইরির বিটি আছে গাঁ গেরামে
তারা যদ্দিন অন্ধকারে পড়ে থাকবেক
তারা যদ্দিন লেখাপড়ার লাগে কাঁদে বুলবেক
তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া নাই লাগবেক
তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া আমার নাই লাগবেক।

12 thoughts on “তেজ -দেবব্রত সিংহ”

  1. আমি পাঠ করতে চলেছি আগামীকাল আমাদের ব্লকের প্রতিযোগিতায়।আশীর্বাদ প্রার্থনা করি কবির কাছে।কবিতা টি অনবদ্য।আহিরন
    মুর্শিদাবাদ।

  2. এটা পরিবর্তন। সাজলিদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ সাম্প্রদায়িক নপুংশক ও মূর্খদের হাতে গণতন্ত্র।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।