Skip to content

কুয়াশায় – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ছিল টিলা, হয়ে ওঠে মেঘ |
যদি নামি, যদি আমি ভূপৃষ্ঠে দাঁড়াই
তার মানে টিলা থেকে নীচে আছে আকড়া খোয়াই—
মাঠ, আলপথ, জল, আলপথ, জল
মাঝেমধ্যে গম-নাড়া, মাঝেমধ্যে ওঁড়াও বসতি,
তার মধ্যে দিয়ে শুধু যেতে হবে কুয়াশা তাড়িয়ে
কুয়াশার মধ্যে আছে সাদা ছুঁচ, পিতলের মতো
কখন সে পূর্বদিকে উঠে এসে দাঁড়াবে উঠোন |

সে-কথা এখন নয়, এখন শীতের বুড়ো মুখ
দেখে-দেখে ক্লান্ত হয়ে, ক্লান্ত হয়ে মাঠের ভিতরে
দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো.. কখন রক্ত পড়ে !
ভিতরে সবুজ কন্ঠ বলে যায় অন্য ইতিহাস
কন্ঠের ভিতরে আজ বলে যায় অন্য ইতিহাস
ভিতরে কে কড়া নাড়ে, দরজার ওপাশে —
‘কেন আসো, এত ভোরবেলা ?’
‘নিশ্চিত জানি না কেন, চলে আসি, অতি গূঢ় মাঠ
পার হয়ে, টিলা থেকে সমতলে, যখন-যেভাবে
আসতে ইচ্ছে হয়, আসি | উত্তর দেবার
সময় নয়তো এই ভোরবেলা, তুমি কাজ করো
তোমার কী যেন কাজ ছিল সন্ধে-রাতে
তোমার কী কাজ ছিল বিখ্যাত প্রভাতে
তুমি কাজ করো
পাথরে ছিল না জল, আমি এসে গেছি
পাথর মাড়িয়ে, জল ছিল না পাথরে |’

‘দু-হাত ভরেই জল, তাই ঠাণ্ডা লাগো—
দস্তানা তোমার নেই, আমি বুনে দেব |
কিছুতে বলবে না কাউকে, গালে হাত রাখো
যতই জলের হাত, গ্রীষ্মের খরতা
তুমি সঙ্গে নিয়ে এলে, চা, কফি বানাব ?’
‘কিন্তু, তা এখন নয়, উল্টোদিকে বসো
পা দু’খানি স্পষ্ট করো, হাতে রাখো হাত
তুমি কাজ করো |’
‘কাজ করা সম্ভব এখন ?’
‘কেনই বা নয়, কাজ, কাজ ছিল পাথরের নদী
কেমন বহতা শীতে, এত নয় বৃষ্টি সর্বজয়া
গ্রীষ্মের সন্ন্যাস নয়, এত শীতে দু’খানি চরণ
আমার হাতের মধ্যে নিয়ে নেওয়া
পৌষী প্রভাতে |’

অর্জুনের ছাল কারা ছড়িয়ে রেখেছে,
রেশমের গুটি ছেড়ে পালিয়েছে কীট,
বৃষ্টি পড়ে এ-সময়ে শালের জঙ্গলে |
বাঘের মাঘের শীত গায়ে আমাদের
বৃষ্টি পড়ে, এ-সময়ে আমাদের গানে
বৃষ্টি পড়ে, দূরে থাক শালের মঞ্জরী
লুপংগুটু ঝর্ণা নয়, আর্টিজীয় কূপ—
সেই ভোরবেলা উঠে দু’জনে চলেছি
দু’জন একজন হতে পারিনি এখনো |
অর্জুনের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি,
পথে পড়েছিল রোরো, পার হয়ে এসেছি,
হেঁটেছি মাইল দুই, কুয়াশা-কানিতে
সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে এসে পৌঁচেছি কূপের
উনুনের মতো টিলা, সে-টিলা মাড়িয়ে,
অর্জুনের শিরা ছিল তার উপর বসে
একটি হাত দিয়ে ওর কাঁধটি জড়িয়ে
একা একা বসে আছি, দু’প্রান্তে দু’জন—
দু’জন একজন হতে পারিনি এখনো !

ভোরবেলা চুম্বনের শীত ওষ্ঠে লাগে
দুটি করতলে করে সে-মুখ স্থাপন
আবার চুম্বন করি সেই ওষ্ঠাধারে,
তখন উষ্ণতা পাই, শরীরে উন্মুখ
হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়েরা
তখনি শালের
ভিতরে বুকের মধ্যে দুটি হাত রাখি |
ও কিছু বলে না, শুধু অন্ধের মতন
চোখ বুজে স্থির থাকে পাথরের মতো |
‘আমি তো পাথর হতে চাইনি কখনো
কেন যে এমন হয়, কিছুতে বুঝি না !’
‘তুমি বড় ভয় পাও, সেজন্যে ঘরের
বাহিরে এনেছি আজ কিছু পাব বলে—‘
‘এই কি যথেষ্ট পাওয়া, এর বেশি নয় ?’
‘সে-পাওয়া পরের, আমি এর বেশি নয় ?’
‘সে-পাওয়া পরের, আমি তুলে রেখে দেব
যেদিন বিবাহ হবে একসঙ্গে পাব
তোমার সমগ্র’
‘যদি বিবাহ না হয় !’
তাহলেও যা পেয়েছি, তাও তো অনেক
কুয়াশায় যা পেয়েছি তাও তো অনেক
যথেষ্ট, যথেষ্ট ||’

[A]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।