Skip to content

৪৪- মানদণ্ড- সুপ্রিয় ঘোষ

জয়া শুনেছিল কোথাও, খুঁতখুঁতে হওয়া ভালো, উন্নতি হয় ওতে। কিন্তু তারও একটা সীমা থাকে। নিখুঁত হওয়ার সংজ্ঞাটি আর নিখুঁত করে বলতে পারেনি কেউই, এখনো। তাই যত খচখচানি মনের মধ্যে। এটা হ’লে ভালো হ’ত বোধহয়, নয়তো ওটা – এই ভাবনাতে এখনো দিন কাটে জয়াদের, মানে জয়ন্তীর আর সমরের।
খুঁত-নিখুঁতের বিচারে সমরের অতীতের ফিচারটাও দুই স্তরের। অতীত আর মধ্য অতীত। তারপর তো জয়ার হাত ধরা, বর্তমান। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই বলবে।
মধ্য- অতীতের সমরের পকেটে সবসময় থাকতো ছ’ঘরা লোডেড পিস্তল, লাইসেন্স ছাড়া। মুখে থাকত গুটকা ও চোলাইয়ের গন্ধের মিশ্রণ। অশ্রাব্য গালিগালাজ পাখির কলতানের মতো বাতাস, পরিবেশ ভরিয়ে রাখতো। বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত।
বাঘা বাঘা দুঁদে পুলিশ অফিসাররাও সমঝে চলতো ওকে। কেন জানেন? ও প্রকৃত অশালীন কাজ, অযৌক্তিক কার্যকলাপ, অন্যায়ের সাথে আপোস, কোনো কিছুতে লুকোচুরি – মানে যে অর্থে লোকে ছলনা বলে : তা’ করতো না বা করতে দিত না। সব চাইতে আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যের বিষয় ছিল- মেয়েদের প্রতি সম্মান। এতোসব কারণেই, অন্যদের সাথে ওর গণ্ডগোল বাঁধতো। রাজনৈতিক নেতাদের নেক নজরে ছিল , কিন্তু ভাড়া করা গুণ্ডাদের কাজ ওকে দিয়ে কেউই করাতে পারেনি। তাতে যে সমরের প্রাণ সংশয় হয়নি তা’ নয়।
তবে জয়া অবাক হয়ে গিয়েছিল, সেদিনের ঘটনায়। টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বেশ কিছু ছেলে ঘিরে ধরেছিল তাকে, খাল পাড়ের গলিটার মোড়ে। আসলে যেহেতু একটু রাত হয়ে গিয়েছিল, জয়া ভেবেছিল, একটু ঝুঁকি নিয়ে ঐ গলিটা দিয়ে গেলে পাঁচ মিনিটে বাড়ি পৌঁছে যাবে , না-হলে প্রায় পঁচিশ মিনিট লেগে যাবে।
ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল জয়া। চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল জয়ার, তার নিখুঁত ভাবনাতে কতো খুঁত। গায়ের ওড়না ধরে টানাটানিও চলছিল। হাঁউহাঁউ করে কাঁদছিল ও। মদের গন্ধতে মাথা ধরে গেছে, গা ঘুলিয়ে উঠেছিল। এক পাশবিক পরিস্থিতি! অজ্ঞান হয়ে পারে ভেবে, আশঙ্কায় বুকের রক্ত যেন এখুনি মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে ! ঢলেও পড়ছিল প্রায়।
হঠাৎ একটা তীব্র আলোর ঝলকানি, একটা তীব্র হুঙ্কার, ” এই কুত্তার বাচ্চা, কারা রে তোরা ? ” আর একটা গুলির শব্দ – এ ছাড়া আর কিছু জানে না সে। ঢলে পড়েছিল রাস্তায়।
জ্ঞান ফিরতেই দেখল বাড়িতে মা, বাবা, দাদারা ঘিরে রয়েছে ওকে। ডাক্তার প্রেসক্রিশন লিখে দাদার হাতে তুলে দিয়ে বলছেন,” ভয়ের কিছু নেই। একটা শক পেয়েছেন উনি। কোন দিক থেকে কোন ভয় নেই। ওরা ওনার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। সমর না এসে পড়লে বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত, হয়তো।”
জয়া চমকে উঠল,’ সমর! সেই নামকরা গুণ্ডাটা? ও বাঁচিয়েছে ওকে ?’ সত্যিই সেইদিন খুব অবাক হয়েছিল।
কিছু মানুষ আছে, যাদের বাইরের আচরণের পোশাকটা কতো ধোপ-দুরস্ত থাকে, অথচ মনটা থাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। আর এই মানুষটা, সেইসব অন্তঃসারশূন্য ভদ্রলোকের সমাজের দুষ্কৃতী পরিচয়ে বেড়ে ওঠা, প্রকটমান নোংরা পোশাকি চরিত্রের আড়ালে, প্রকৃত এক দেবদূত। এই দুই পক্ষের পোশাকি রূপের কতো পার্থক্য! প্রথম পক্ষে, নিখুঁত ছলনা, যা’ মানবিকবোধহীন ; দ্বিতীয় পক্ষে, এক নিখুঁত ছল- দৈবিক পবিত্রতা – সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ, নির্ভরতার মানবিক আচ্ছাদন।
সেই মানুষটাকে দেবতাজ্ঞানে দুর থেকেই প্রণাম করে জয়া। এ তো এক হীরার খনি, বাইরে কয়লার কালো ; যতই খনন করো শুধু হীরে আর হীরে।
সেই ঘটনার উপলব্ধ অনুভূতি, দায়িত্ববোধ দুজনকে কাছাকাছি আনতে বেশি সময় নেয়নি। জয়া ও তার বাড়ির লোক অনুভব করতে পেরেছিল, নির্ভরযোগ্যভাবে এ মানুষের হাত ধরে একই পথে জীবনের মোহনা পর্যন্ত হাঁটা যায়, নিশ্চিন্তে।
জয়া ততদিনে জেনে গেছে, অতীতের সমর নামক সোনার খনিটা কীভাবে পরিস্থিতি ও প্রতারক পরিজনের অর্থ-লালসায় অন্দ্ধকার কয়লার খনিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, সেই কয়লার খনিতে হীরের সন্ধান তারা পায়নি বা, পাওয়ার চেষ্টাও করেনি।
ঐ মধ্য-অতীতে সমরের বিবেকও খুঁজছিল স্বস্তির স্থিতি। কিন্তু ভালবাসাহীন জীবন, বারেবারে অভিমানের চাদরে ঢেকে দিচ্ছিল তার বিবেককে। দুঁদে পুলিশ অফিসাররাও পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিল, ইউনিভার্সিটির স্কলারটির বিদ্যা ও জ্ঞানের ধারেকাছে তারাও নেই। কী নেই তাঁর বিদ্যা ও জ্ঞানের ভাণ্ডারে ! সব আইন তার জানা, আইন পাশ না করলেও। চলমান ইংরাজি শব্দকোষ তো কলেজের বন্ধুরাই বলতো। ফরাসী, জার্মানি, রাশিয়ান ভাষা তার রপ্ত : লিখতে, বলতে, পড়তে সে জানে। এমন মানুষ হতে পারে ? জয়া পেয়েছিল সে সন্ধান।
হ্যাঁ, পারে। পারে বলেই বর্তমানের এই সমর-জয়ার একসাথে হাত ধরে পথচলা সম্ভব হয়। জয়াই পেয়েছিল সেই নিঁখুত অমূল্য সম্পদের অধিকারিনী হতে, যে দরজার ভরসার চাবিকাঠিটা সমরও খুঁজছিল এতদিন। খুঁত-নিঁখুতের সম্ভাব্য বিচারের রায়দান তো উপরওয়ালাই দিয়ে রেখেছিলেন, শুধু বিয়ের রেজিস্ট্রারের খাতাটায় সই করাটাই যা’ বাকি ছিল।

@সু

মন্তব্য করুন