Skip to content

৪২ – সম্পর্ক – সুপ্রিয় ঘোষ

এখন বাড়িতে দীপালি একেবারে একা। দু’কামরার ওয়েলফার্নিস্ড ঘরে তার এখন অনন্ত অবসর। ছেলে, মৈনাক এখন স্কুলে আর স্বামী, শশাঙ্ক তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, সকাল থেকে রাত তার ঐ একই ব্যস্ততা ব্যবসা নিয়ে। কোন কিছুরই খামতি নেই ঘরে।
খামতি শুধু সান্নিধ্য, একটু কাছে পাওয়া। অতৃপ্ত বাসনা যে এত দহনকারী হতে পারে, জানা ছিল না দীপুর, এ নামে শশাঙ্কই একমাত্র তাকে ডাকে। একদিন এ ডাকে কত কিছু ছিল, ছিল কত আকর্ষণ।
হ্যাঁ, জীবন তো জীবনেরই সান্নিধ্য আশা করে, যা’ জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গ, সেই তৃপ্তি দিতে অসমর্থ হয়। রবিবারে তো বাড়ির কাজের ব্যস্ততাতেই দিনটা কেটে যায়। কোথাও বেড়াতে যাওয়ারও ফুরসত মেলেনা।
রাত ? রাতের মতোই কেটে যায়। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর শশাঙ্কের, বিছানা ছুঁলেই অবশ হয়ে ঢলে পড়ে ঘুমের কোলে। যদিও দীপালিই উদ্বুদ্ধ করেছিল বিয়ের আগে থেকেই। মনে পড়ে, অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল দু’জনেই মধ্যে। শশাঙ্কের সেই কথাটা এখন বুঝতে পারে, অর্থ-প্রতিপত্তি জীবনের সবটুকু নয়, দীপু।
আজ মানুষটাকেও ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু, এখন সে মানুষ অর্থ-যশ-প্রতিপত্তির সোপান বেয়ে এতটাই উপরে উঠে গেছে যে, দীপুর প্রয়োজনে তাকে আর কাছে পাওয়া যায়না।
এতে যে কতটা শশাঙ্কের অভিমান আছে, টের পায় না দীপালি। শশাঙ্কের পৌরুষ সব কিছু একসাথে চেয়েছিল। অর্থ যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন মানুষের নৈকট্য। এই দুইয়ের ভারসাম্যে যদি অর্থের কোথাও ঘাটতি থাকে, থাকুক না। সামগ্রিকভাবে তাহলে তো প্রাপ্তির পরিমাণ অনেকটাই হয়ে যাবে। অর্থ, প্রতিপত্তি মানুষকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে শেখায়, যেখানে হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায়। একথা বোঝাতে পারেনি দীপুকে। উল্টে তার পৌরষত্বেই ঘা দিয়ে বসে।
বাবার কাছ থেকে শোনা ছোটবেলার সে গল্পটা একদিন বলেছিল শশাঙ্ক তার ছেলেকে, দীপালিকে শুনিয়ে।
লোভী লোকটি একদিন বর পেল, যা’ ধরবে সব সোনা হয়ে যাবে। অনেক ধনী হয়ে গেল বর পেয়ে। আনন্দ আর ধরেনা। অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল ধনী হয়ে উঠল। তারপর একদিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে তৃষ্ণার্ত লোভী লোকটি জল খেতে গেলে জল সোনা হয়ে যায়। এমনকি তার একমাত্র পুত্রকেও ছুঁয়ে ফেললে, সে ছেলেও সোনার মূর্তি হয়ে পড়ে। ভেঙে যায় লোভী মানুষটার মোহ। তবুও…
এখন তার নিজের মানুষটাকে কাছে ফিরে পাওয়ার বাসনায় দীপালী বিহ্বল। কিন্তু ভুবি তো ভোলবার নয়। বড়ো একগুঁয়ে শশাঙ্ক।
তাই দীপালি সিদ্ধান্ত নেয় ডিভোর্সের। তবে শশাঙ্ক এখনো জানেনা। কাল রাতেই অশান্তিটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে – এই যা।
কাল রাতেই দীপালির বান্ধবী, সুচন্দ্রাকে বলে তার উকিল বরের সাথে কথা বলেছে এ ব্যপারে। আজ তার জুনিয়র আসার কথা। ভাবতে ভাবতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো।
দরজা খুলেই যে সুদর্শন মূর্তিকে দেখতে পেল, চমকে উঠল দীপালি। উল্টো দিকে ঐ সুদর্শন যুবকের চোখও ছানাবড়া।
একটু সামলে নিয়ে সে বলল, ‘ ম্যাডাম, আপনিই কি মিসেস দীপালি দত্ত ? ‘
দীপালি পিছন ফিরে, একটু মুচকি হেসে, বলল, ‘হ্যাঁ, ভিতরে আয়, সুমন।’
চমকে উঠে, সুদর্শন যুবক, সুমন বলে উঠল, ‘তাহলে তুই দীপালি ? কলেজের সেই ছেলেদের বুকে রক্ত ছলকে দেওয়া সেই মেয়ে।’
অপ্রত্যাশিতভাবে, দীপালি আবেগের বশে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমনের বুকে।
‘ হ্যাঁ, আমিই সেই অগ্নিকন্যা, তোর দেওয়া নামের অধিকারিনী। তবে তুই এখন ওকালতি করছিস ? বাহ্ বেশ ভালো। বস এখানে, আমি স্ন্যাকস আর কফি নিয়ে আসছি,’ বলে অদৃশ্য হয়ে যায়।
তারপর, কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেতে দু’কাপ কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে আসে। এসে দেখে, সুমন ড্রইং রুমে অবাক হয়ে চারিদিক দেখছে।
দীপালি দেখে বলে, ‘বাহ্, বেশ সাজিয়েছিস তো ঘরটা। বেশ ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে বল্?’
এবার দীপালি কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো ঘর।’
সুমন বলে, ‘কিন্তু, আমার সিনিয়র বলেছিল, একটা ডিভোর্সের কেন এটা ? তুই কি ডিভোর্স ফাইল করবি নাকি ?’
দীপালি মাথা নেড়ে সায় দিতে, ‘সুমন অবাক হয়ে বলে, কিন্তু কেন ? সমস্যাটা কী ?’
দীপালি আদ্যন্ত সুমনকে বলে। সুমন মিনিট খানেকের মতো চুপ করে যায়, সব শুনে। তারপর, মুখ খোলে, ‘ দ্যাখ্ দীপালি, তুই আমার বান্ধবী বলেই বলছি, না-হলে তুই আমার ক্লায়েন্ট, আমার সাথে তোর এখন প্রফেশনালি সম্পর্ক হওয়ার কথা। তাই বলছি, আইনের সাহায্যে সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া যেতেই পারে, পরে তোর মন মানবে তো ? জিজ্ঞাসা করেছিস মনকে ? আর বাচ্চাটার কথা ভেবেছিস ? তোদের এই বিচ্ছিন্নতা ও মানবে তো ? এতে ওর মানসিক চাপ কতটা বাড়তে পারে একবার ভেবেছিস ? আর তুই চাইলেই, তোর বর মানবে তো?’
দীপালি বলে, ‘ তবে তুই কী বলিস, এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে যেতে। অসম্ভব, আমি হয় পাগল হয়ে যাব, নয়তো মারা যাব। ‘
সুমন থামিয়ে দেয় ওকে,’ আমার একটা অ্যাডভাইস আছে, মানবি কি? তোরা দু’জনে দুদিনের জন্য বেড়িয়ে আয়, একলা।’
‘আর ছেলে ? ও কোথায় থাকবে, কার কাছে থাকবে?’
‘ কেন ? আমাদের বাড়িতে ? শোন্, আমার একটা বাড়ি আছে দীঘায়। ওখানে দু’দিন থাক। তৃতীয় দিনে আমি, তোর বান্ধবী, অপর্ণা, আর তিতলি ওখানে যাব। আরও দুদিন কাটিয়ে সবাই একসাথে ফিরে আসব। আর তোর বরকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমি নিলাম,’ হাসতে হাসতে বলে সুমন। ‘ আর শোন, আমি আর অপর্ণা কাল আসব। কাল তো রবিবার, নিশ্চয়ই তোর বর থাকবে ? একসাথে আড্ডা মারব,
তোর ছেলে আর আমার ছেলের বন্ধুত্বটাও হয়ে যাবে। তারপর, দেখবি আমাদের বাড়িতে ও একলাই যেতে ও থাকতে রাজি হয়ে যাবে। ব্যাস, পরিকল্পনার প্রথম ধাপ শেষ। তারপরটুকু আমার পরিকল্পনা মাফিক হবে। আজ চলি।’ বলে উঠে গেল সুমন।
তারপর, একে একে সবই পরিকল্পনা সার্থক হয়ে উঠল।
দিঘার মনোরম পরিবেশ, সান্নিধ্য – দুজনের দূরত্বকে শুধু কমিয়েই দেয়নি, সত্যের অমোঘ আলোয় সেই নর ও নারী নতুন করে নিজেদের আবিষ্কার করে ফেলল আবার। বাস্তবের রৌদ্রালোকিত দিনে, হারিয়ে গেল মরীচিকার ভ্রান্তি। সকল বাঁধা, আড়াল নির্দ্বিধায় উন্মোচিত হল এক লহমায়।
দু’দিন বাদে সুমনরাও এসে পড়ল সেখানে। সবার মিলনে সে মেলায় উঠল আনন্দের ঢেউ। ভরাট হয়ে গেল বিচ্ছিন্নতার মাটিতে চোরাবালির সকল সম্ভবনা।
আর এই সমস্ত ঘটনাবলির সমীক্ষায় স্বচ্ছ হয়ে উঠল সম্পর্কের প্রকৃত সঃজ্ঞাটি।
********************************************
@সু

মন্তব্য করুন