Skip to content

৪১- একটু আলোর জন্য – সুপ্রিয় ঘোষ

অন্ধকারের স্তর যেন একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। আলোর আবেগ নিয়ে জেগে উঠছে সকাল। তবুও, আজ রমলার ভালবাসার সারা আকাশটায় ছেয়ে আছে এক গাঢ় মেঘ, আপাত-বিচ্ছেদের। আর অঝোর ধারায় ঝড়ে পড়ছে জল। এ শ্রাবণ এখন, রমলার বাইরে ও ভিতরে অস্তিত্বের বিপন্ন বেদনাকে প্রকাশ করে চলেছে, একটানা।
চলে যেতে হবেই সুরজিতকে। কমান্ডান্ট বলে কথা। কথার নড়চড় একেবারেই হয়না ওঁদের। সামনে অবধারিত মৃত্যু দেখেও পিছপা হন না, ওঁনারা।
ব্যক্তিগত কোন আবেগের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, দেশাত্মবোধের আবেগ। তবে এ কথা একেবারেই মিথ্যে নয় – মা বাবা, পরিজনকে ছেড়ে, সুন্দরী তরুণী সহধর্মিণী ও তিন মাসের ছেলে, রনিকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। এই দ্বীমাত্রিক উভমুখী টানের যন্ত্রণা বড়োই বেদনাদায়ক। তার চাইতে গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে যুদ্ধ করে যাওয়া- অনেক কম যন্ত্রণার।
তবু তো যেতে হবেই। চলেও গেল সুরজিত, রমলাকে সময়গ্রন্থিতে বেঁধে অপেক্ষার পথে রেখে।
আর ওদিকে প্রেম-আরক্ত নবীনা গুনে চলল সময়। গৃহস্থের কাজের মধ্যে, ছেলের দায়িত্বের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকল, একটু একটু করে। শুধু দুপুর ও রাতের কর্মহীনতায় একাকীত্ব ঘিরে ধরে রমলাকে। বেষ্টনীটা যেন কোথাও আলগা হয়ে, ফাঁকা হয়ে যায় চারিদিক।
ঠিক ছয় মাস এভাবেই বয়ে গেল। ছেলের এখন একবছর বয়স। রনির অভিব্যক্তিগুলো বাৎসল্যের আকৃতিতেই ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়ে উঠছে। বোল ফুটছে মুখে একটু আধটু। তবে, বাবার সান্নিধ্যের অনুভূতিটুকু এখনও অধরা। হবেই তো।
একটা সংবাদ এলো হঠাৎ। ফিরে আসছে সুরজিত। ছুটি নিয়ে। রমলার আকাশ ভরে উঠল আলোর ছটায়। মনের ছায়াম্লান ধূসরতাকে কাটিয়ে, পূর্ণতা ও তৃপ্তির বোধ, সোনা ঝরা আনন্দের আলোতে ঝলমল করে দিল রমলার ঘর ও বাহির।
কিন্তু এ কী ! ওরা কারা ? ওদের কাঁধেই বা ওটা কী ? একটা ঢাউস বাক্স ? পিছনে অতো লোকজনই বা কেন ? সে কই ? তাকে দেখা যাচ্ছেনা।
সামনে এসে নামার হল বাক্সটা। খোলা হল ঢাকনা। আকাশ ভেঙে পড়ল রমলার মাথায়। এই তো সুরজিত! সত্যভ্রমের কুহকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল রমলার অনুভূতি। সে তো চিরকালের ছুটি নিয়ে নিয়েছে ! রমলার অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে থাকল একটু একটু করে। স্থবির, মূক, বধির একটি নারীমূর্তির মতন, এখন সে।
সহমর্মী সহকর্মী বন্ধুরাও বাকরূদ্ধ। একজন বলে উঠল, ‘ওঁনাকে কাঁদাও। নাহলে ওনাকেও রাখা যাবেনা। হার্ট ব্লকড হয়ে যাবে। সহকর্মী বন্ধুরা সুরজিত যাবতীয় গুনাবলী, অবদান, কৃতিত্বের ডালি খুলে বসল। রমলা এক মূর্ত প্রতিমা যেন।
গ্রাম্য প্রতিবেশী মহিলারা কাঁদতে কাঁদতে রমলাকে ধরে ঝাঁকাতে থাকল, ‘বৌমা, সুরজিত আর নেই। তুমি কিছু বলবেনা ?’
শাশুড়ি প্রাণফাটা আকুতিতে জড়িয়ে ধরল রমলাকে। রমলা নিশ্চুপ। স্ত্রীসত্তাকে হারিয়ে সে যেন সংজ্ঞাহীন, জড়। চারিদিকের কান্নার রোলের মধ্যে পড়ে আছে এক বালিয়াড়ি স্তূপ যেন। শুষে নিচ্ছে সব নোনা জল। হারিয়ে যাচ্ছে কান্নার নদীগুলো।
রমলাকে কাঁদাবার সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এলো এক নবতী বৃদ্ধা। হাতে একটি লাঠি, শরীর প্রায় নুব্জ। হাত কাঁপছে তাঁর, কিন্তু জীবনবোধের প্রত্যয়ে দৃঢ়তার বিশ্বাসী পদক্ষেপ।
ইশারায় ডেকে নিল সুরজিতের এক মিলিটারি সহকর্মীকে। তাঁর নির্দেশে, অনভ্যস্ত ভীড়ের ভয়ে কান্নারত ছোট্ট রনিকে। বসিয়ে দিল রমলার কোলে।
ব্যস, মাতৃত্বের অনুভূতিতে এক লহমায় ভেঙে গেল বাঁধ। ‘আ-হা-হা-হা’ করে কানফাটা আর্ত চিৎকারে, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আছড়ে ভেঙে পড়ল সে স্থবির বাঁধ। সুরজিতের সে প্রেমের একটুকরো রৌদ্রকণা যে এই রনিই, সে তো আছে সুরজিতের প্রতীক হয়ে।
মানবিক স্তরবিন্যাসে মাতৃত্বের গভীরতম আলোড়ন, সদ্য হারানো স্ত্রীসত্তাকে হারিয়ে কীভাবে বাঁচাতে পারে – দেখিয়ে দিল নব্বইটা বছরের জীবন দর্শনের অভিজ্ঞ, সে নবতী বৃদ্ধা।
ওদিকে সবাই জলভরা ঝাপসা চোখ নিয়ে শুনল, সেই হাহাকার, ‘ এই তো আমি রনি, আমি আছি তো। কোন ভয় নেই তোমার।’

卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐
(উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ- কবিতা : ‘হোম দে ব্রট হার ওয়ারিঅর ডেথ’ অবলম্বনে)

@সু

মন্তব্য করুন