সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
গঙ্গার পাড় জুড়ে বিচিত্র ঘটনা মানুষকে আকৃষ্ট করে প্রতিদিন। কোথাও অভাবজনিত জীবিকার তাড়নায়, কোথাও বা স্বভাবের। সন্ধ্যার পাড়ে, জলের বর্ণময় আলোর নানান রঙের মত তাদের শরীরের আকুতি ও ব্যঞ্জনার রঙিন সব সমারোহ নিয়ে হাজির হয় সবাই।
তাদের কেউ হয়তো নিজেদের উত্তপ্ত শরীর ঠাণ্ডা করে নিচ্ছে বসন্তের মৃদমন্দ হাওয়ায়, আবার কেউবা ভিতরের আগুনটা বাড়িয়ে নিচ্ছে ঐ একই হাওয়াতে। নেই কোন দ্বিধা, নেই কোন ভয়। আসলে প্রয়োজন তো নিয়মের ধার ধারেনা।
ওদিকে, সবার মতো, পাখিদেরও এখন ঘরে ফিরবার সময়। তাদের ডাক ভরে রয়েছে গঙ্গা সংলগ্ন সব গাছে। আর নীচে গাছের আড়ালে চলেছে নীলবাসনার ফিসফিসানি। উঁইঢিবির মত জোড় লাগান শরীর সব।
তবে এস কে-র, মানে সুধাংশু কর-এর এখন একলা কাটানোর সময়। যতই কোলাহল থাকুক, যতই সর্পিল ফিসফিসানি চারিদিকে উত্তাপ ছড়াক, সব কিছুর মধ্যে সে যেন একা। এভাবে থাকতেই সে এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
পাড় থেকে একটু দূরে ঢেউগুলি এসে মিলিয়ে যাচ্ছে জলের সাথেই। ওপাড়ের সার্চলাইট থেকে আলো এসে জলের ওপর পড়ছে যখন, রূপালী আলোর একটা আঁকাবাঁকা স্রোত যেন ধেয়ে আসতে চাইছে, তবে, মাঝের নৌকা চলাচলে বিঘ্নিত হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। ফোনটা বার করে একটা ছবি নিতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল সিগারেটের প্যাকেটটা।
একটা সিগারেট খাওয়া যেতেই পারে এই ভেবে, প্যাকেটটা খুলে দেখে খালি। মুখ তুলে দেখে, কাছেই একটা দোকান আছে।
‘ দাদা এক প্যাকেট গোল্ডফ্লেক দিনতো’, বলে পার্সটা বার করতে যাবে, কাছেই শুনতে পেল, ‘ না, পুরো আটশ টাকা লাগবে। নৌকাতেই নেবে পাঁচশ টাকা। বাকিটা আমার।’ মেয়েলি কণ্ঠস্বর। কিন্তু ভীষণ চেনা।
হঠাৎ রাস্তার একটা জোরালো হেডলাইটের আলো মেয়েটার মুখে পড়তেই, চমকে উঠল সুধাংশু।
চট করে স্বাভাবিক হয়ে গলার স্বরটা একটু চেপে কানের কাছে আস্তে করে বলে, ‘রেট কত ?’
একটু চমকে গেলেও, বলে, পুরোএক হাজার।’
‘ চল,’ বলে মেয়েটাকে এগিয়ে যেতে বলে। মেয়েটা এগিয়ে যায় পাড়ে বাঁধা নৌকার দিকে।
ছইয়ের ভেতর ঢুকে যেতেই, মাঝি নৌকার বাধন খুলে দিল। নৌকা এগিয়ে চলল মাঝগঙ্গায় ভেসে থাকা একটা পরিত্যক্ত জেটির দিকে।
ভেতরে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। আলোর মোহতে এভাবেই হয়তো আগুন জ্বলে নৌকার পাটাতনের ওপর। জলের ঢেউ উঠে আসে বৈঠা বেয়ে।ঐ কামনার আগুন আর ঢেউয়ের সমমেলে নৌকা হয়তো অস্থির হয়ে ওঠে, তখন। কিন্তু সুধাংশুর এ আগুন শরীরে নয়, মাথায় জ্বলছে দাউ দাউ করে। আজকের বৈশাখীর চরিত্রের প্রকৃত পরিচয়, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
সেই পনেরোর বৈশাখী আজ ত্রিশের কোটাতেও যেন অষ্টাদশী। তার প্রতঙ্গের ঢেউয়ের মাত্রাগুলি অনেকটাই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তার শরীরের মানচিত্রে আজ আর কোন মান নেই – একথা স্পষ্ট। একদিন তাকে নিয়ে যা’ স্বপ্ন বুনেছিল গেঁয়ো সুধাংশু, সে স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল তিন বছর পর ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পর। একটা চাকরি পাওয়ার ভালো খবরটাও দেওয়ার ছিল তার।
ফিরে যখন শুনল, অন্য কোন এক লোকের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে। মনটা তার কে যেন বিষিয়ে দিয়েছিল সেদিন।
তারপর, একে একে কানে আসতে থাকল নানান কথা। তার শরীরের অনতিক্রম্য আকর্ষণীয় মায়াজালে আবদ্ধ করে কামনাতৃপ্তির রাসলীলা কেমনভাবে চালিয়ে গিয়েছে অবিরত – তার অশ্রাব্য গল্প। এইসব ঘটনাবহুলতা প্রথমে অবিশ্বাস করলেও, ধীরে ধীরে লোকায়ত ধারায়, মনে স্থান পেয়ে গেল সময়সন্ধির সে দূরপনেয় ছায়া। তখনই লাগল ঘৃণার আগুন, সে প্রেমময় মন্দিরে। মুছে গেল সেই সব স্মৃতি।
তারপর, সময় সে আগুন নিভিয়ে দিলেও, চক্রগতিতে সেই পোড়া মন্দিরটায় মাঝে মাঝে জেগে উঠত ভালবাসার বেদীটা। তবে, ভালবাসতে পারেনি আর কখনোই কাউকে আজ অবধি। বেছে নিয়েছিল একাকীত্ব। কল্লোলিনী কলকাতার কোলাহলের মধ্যে থেকেও কলিগদের সাথে সখ্যতা রাখলেও সে নিজেকে রেখেছিল সব আনন্দ, উদ্দীপনা থেকে ব্রাত্য করে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে আজ একা একা থাকা, একা একা ঘোরা, আর সব কিছু।
কিন্তু আজ বৈশাখীকে সামনে পেয়ে যেন ঘুমন্ত ভিসুভিয়াস জেগে উঠেছে মাথার ভেতরে। ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আগুন দপদপ করে জ্বলে উঠেছিল। হাতদুটো নিসপিস করছে ! কী করবে এবার ? গলাটা টিপে ধরবে ? নাকি, কামনার আগুনে ঝলসে দেবে ওকে? শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শুষে নেবে ওর যাবতীয় বাসনাকে ? আঁখের ছিবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে জলে ?
‘কী হল, চুপ করে ভাল ছেলের মতো বসে আছেন যে? যার জন্য এসেছেন, কাজটা শেষ করুন।’ এই বলে বুকের থেকে আঁচলটা নামিয়ে হুঁকটা খুলতে যায় বৈশাখী। একপলক তার পার্বত্য অঞ্চলের সুঠোল সুঠাম শুভ্রমসৃন অংশ উঁকি মারে।
ঠিক তখনই,
‘শাখীঈঈঈ,’ বলে চিৎকার করে ওঠে সুধাংশু। সপাটে একটা চড় নেমে আসে শাখীর গালে।
‘ উফ্, মা গো’ বলে কাঠের পাটাতনের ওপর পড়ে যায় শাখী।
মাঝি জেটির সাথে নৌকা বেঁধে একটু দূরে ওর আর সব বন্ধুদের সাথে বিড়ি টানছিল। ওদের কানে গেলেও, এই শব্দ বহুল পরিচিত বলে ওরা ভ্রূক্ষেপ করল না। শুধু একটু ইঙ্গিতবহ মুচকি হাসি হাসল।
ওদিকে ‘শাখী’ নামটা শুনে ব্যথার মধ্যেও চমকে উঠল। তার সারা গা যেন তখন থরথর করে কাঁপছে।
কাঁপানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ কী, কী নামে ডাকলেন আপনি, শাখী ? কে আপনি ?’ বলতে বলতে বুকের ওপর আঁচলটা তুলে নেয় সে।
‘কেন, মনে পড়ছে না, কে ডাকত এই নামে তোমায় ? আমি সেই সুধাংশু কর, এস কে।’গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় ।
ব্যাথা, ভয় আর লজ্জায় যেন ভেঙে পড়ে বৈশাখী ।
সুধাংশু ডেকে নেয় মাঝিকে। মাঝি তার পান খাওয়া কাল ছোপ পড়া কালো দাঁত বের করে এসে বলে, ‘এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল সব ?’
সুধাংশু কথা বাড়ায় না। বৈশাখীও কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে সময়। অথচ অনেক কথা বলা যেত সে সময়। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলে যেত, সুধাংশুর।
পাড়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে, পার্সের সমস্ত টাকা শাখীর কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও তোমার টাকা, বাকিটা বখশিস’। তারপর একপ্রকার লাফ দিয়েই পাড়ে নেমে, মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে মিশে যায়।
শাখী তখন কোলের ওপর টাকাগুলো নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সুধাংশুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পথের দিকে।
অনেক কথা বলার ছিল তার, বলা আর হলনা। আর বোধহয় হবেও না কোনদিন। আনমনা বৈশাখীকে দেখে মাঝিও অবাক। সদাচঞ্চল হাসিখুশি যে মেয়েটি শরীরে ঝড় তুলতে পারে অনায়াসে, তার কাছেই এত বৃষ্টি জমা ছিল !
ততততততততততততততততততততততততততত
@ সু