Skip to content

৩৯ – পরকীয়া প্রেম – সুপ্রিয় ঘোষ

চারিদিকে অন্ধকার। হাতের লাইটারটা একবার জ্বলছে, আর একবার নিভছে। সারা ঘরে সিগারেটের গন্ধ। অ্যাস্ট্রেটা ভরে আছে সিগারেটের ফিল্টার আর ছাইতে। প্রবালের মন আজ ভীষণ চঞ্চল।
আঠেরোটা বছর কম সময় নয়। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে কতগুলো সময়, ব্যস্ততার অভ্যাসে। যে সময় ধীরে ধীরে আবছা করে দিয়েছিল অতীত স্মৃতিকে। প্রলেপ দিয়েছিল যন্ত্রণার, আজ আবার সেই ক্ষতস্থানেই রক্তপাত ঘটাল।
আজ হঠাৎ সামনে পড়ে গেল নীরার। আগের থেকে সে আরও মোহময়ী, সুন্দরী। বোধহয়, থমকেই গিয়েছিল নীরা, প্রবালকে দেখে। তবে, এখন তাদের চলার পথ বদলে গেছে। কোন এক ঘন কালো মনের অন্ধকারে, হারিয়ে গিয়েছিল সেই একসাথে চলার পথ। এক লহমায় কত কথা মনে পড়ে গেল ওকে দেখে। কিন্তু অফুরন্ত আলোর তীব্রতায় যেমন অস্বস্তি থাকে, ছিটকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হয়, ঠিক তেমনভাবেই এড়িয়ে এসেছিল প্রবাল, ওখান থেকে।
ভীড়ের মধ্যে দেখে, জিজ্ঞাসু চোখে থমকেই গিয়েছিল নীরাও। সত্যিই সে তো ? লক্ষ্য করলেও, প্রবাল কিন্তু আর ফিরে দেখেনি। সোজা চলে এসেছিল হোটেল, সম্রাটে। কাজের সূত্রেই এবারে এই পুরীতে আসা। আরও তিন-চারদিন কাটাতে হবে এখানে। ।সকালের সমুদ্রকে যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, এখন সে আকর্ষণ এক লহমায় মুছে গেছে।
লাইট নিভিয়ে ব্যালকনি থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্যকে নয়, নিজের সাথে কথা বলার জন্য, বসে আছে প্রবাল। আর চোখের সামনে নিরবিচ্ছিন্ন অতীতের অনুসন্ধান করে চলেছে। চলছে, মনের মর্গে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ মৃত অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ।
মৃতরা তো আর কথা বলে না, ওদের হয়ে কথা বলে অপস্রীয়মান সময়ের পল ও ক্ষণ। সময় যেমন ভুলিয়ে দেয়, সময়ই আবার অতীতকে কখনো কখনো সামনে এনে ফেলে।
তবে, এ দেখা না হলেই ভাল ছিল। পুরোনো ক্ষতটাতে অন্ততঃ রক্তক্ষরণটা হতো না আবার। আয়না আর মনের ভাঙা দাগটা মিলিয়ে যায়না কোনদিনই, সেই দাগ নিয়েই তো চলে এসেছিল এতটা পথ। হয়তো অস্পষ্ট হয়েও গিয়েছিল দাগটা। কিন্তু এখন চাপা পড়া আগুনটা আবার গনগনে হয়ে উঠেছে।
কত কথা, কত অপমান, কতটা যন্ত্রণা ছিল – সে একমাত্র প্রবালই জানে। তখন চারিদিকে তীব্র সমালোচনার ঢেউ তার চরিত্র ঘিরে, যে চরিত্র সকলের কাছে একদিন সমীহের, বিশ্বাসের ছিল, তা’ মাটিতে মিশে গিয়েছিল। হবেই তো, একটি মেয়ের জীবনের প্রসঙ্গ বলে কথা ! এতদিনকার ভালবাসা, সে কী ছলনার আশ্রয়ের হতে পারে ? সব মেনে নিয়েছিল প্রবাল। একটুও আড়ালটা সরায়নি। তবুও …
ঘনিষ্ট কেউ কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি, প্রবালের দ্বারা এ কাজ হতে পারে কি না। এই স্বচ্ছ কঠিন অভিব্যক্তি, একজন মেয়েকে ঠকাতে পারে ? কিন্তু অধিকাংশই ছিল নীরার দিকে। এটাই স্বাভাবিক। যারা একদিন ধরেই নিয়েছিল নীরাই প্রবালের জীবন সঙ্গিনী হতে চলেছে। সে কিনা আজ, প্রতারিত।
কিন্তু প্রবাল তার মনের কাছে একটুও দ্বিধান্বিত নয়। যে মানুষটা, তাকে ভালবাসার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করতে করতে তার সম্পদে পরিণত করে ফেলে, শুধু তার অধিকারকেই প্রকাশ করে – সে আর যাই হোক আগামীতে সে তার সঠিক গৃহিণী হতে পারে না। সব সময় সন্দেহ আর সন্দেহ- এতে ক্রমাগত জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে দু’জনেরই।
প্রবাল এও জানতো, অন্ধ ভালবাসার চরিত্র এমনই হয়। সব সময় এক হারিয়ে ফেলার ভয়ে অসুরক্ষিত মন এভাবেই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। নানান ভাবে তাই, নীরাকে বোঝাবার চেষ্টা কম করেনি প্রবাল, এতে ঝগড়ার প্রবণতাও বাড়ছিল।
প্রবাল কোনদিনই দাঁড়ের পাখি হতে জানেনা। সে উন্মুক্ত আকাশের পাখি, তবে পরিযায়ী নয়। তার কাজের পরিধি বৃহৎ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তার কর্মীবৃন্দকে ঘিরে তার কর্মের চক্রব্যুহ। সেখানে এই সন্দেহ প্রবালের চরিত্রের উপর যেমন আঁচড়ে রক্তাক্ত করত, তেমনি ভবিষ্যতের সোপানটাও নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নারী সঙ্গে থাকলেই যে পরকীয়ার নৌকা ভাসাতে হবে- একথা সে যতটা অবিশ্বাস করে, ঠিক ততটাই আশঙ্কা করত নীরা। আর পারা যায়নি, প্রবালের।
তাই অনেক সময় নিয়ে, অনেক ভেবে, নিজের সঙ্গে অজস্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে, সেই বিচ্ছেদের ব্যবস্থাকেই শ্রেয় মনে করেছিল। সে জানতো, এর ফলে, কোথায় কী কী হতে পারে। কিন্তু সে ছিল সংকল্পে অনড়। যদিও নীরার কোন দোষকে কোনদিনই কোনভাবেই প্রকাশ করেনি। সব দোষ তার চওড়া কাঁধে নিয়ে, মুখ বুঁজে ছিল।
এর ফলে যেমন হারিয়ে গেল নীরা, তেমনই হারিয়ে গিয়েছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব-পাড়া প্রতিবেশীর অধিকাংশই দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রবালের সাথে।
একা একা চলতে হয়েছিল লোকারণ্যের ভিড়ে। তবুও থমকে যায়নি প্রবাল।
শুনেছিল, নিরা ভালো আছে। আর প্রবাল তার পরিচিত জগৎ থেকে নিজেকে আড়াল করে, চলে গিয়েছিল কর্নাটকে কাজের সূত্রে। সবাই বলেছিল, দুশ্চরিত্র, লম্পট পালিয়েছে।
তারপর, তার সময়কে ধীরে ধীরে রাঙিয়ে দিয়ে এক সনামধন্য ব্যবসায়ী হয়ে ফিরেছিল সেই পূর্বপরিচিত জায়গায়।
অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি আর সময় তাকে বসিয়ে দিয়েছে সম্ভ্রমের আসনে। সোনার আংটি বাঁকা হলেও নাকি একই দাম থাকে !
কিন্তু আজ আবার এই দেখা যেন, তোলপাড় করে দিচ্ছে তার যত আড়ালকে, সব সংবেদী সংস্কৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। পুরীর সমুদ্রের ঢেউগুলি যেন আছড়ে পড়ছে তার বুকের ওপর। সব অহং যেন গলে গলে পড়ছে দু’গাল বেয়ে।
বুঝতে পারছেনা কেন এমন হচ্ছে! সেই নষ্ট প্রেমের কোহলসন্ধানে যেন তীব্র নেশা আজ। চিন্তা করে চলেছে প্রবাল- এখন এই অনুভূতির কি কোন নাম হয় ? নাকি এর নামই পরকীয়া প্রেম ?

卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐
@সু

মন্তব্য করুন