Skip to content

৩৮ – মনপবনের নিয়ে- সুপ্রিয় ঘোষ

পিঠে একটা ঢাউস সাদা বস্তা। হাতে একটা লোহার বাঁকানো আঁকশি। ময়লা আবর্জনা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন যে শরীরে বসন্ত ছুঁয়ে গেছে, বুঝতে পারেনি মেয়েটি।
তবে, যেদিন হঠাৎ তার দু’পা বেয়ে রক্তের ধারা নেমে এল, ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, রুমেলা। ওরা তো রক্তকে চেনে ভয়ের দোসর হিসেবেই, অবশ্য অনেকেই সেভাবেই ভাবে। তালিমারা ফ্রকের পিছনে চাপ চাপ রক্তের দাগ দেখে, চিন্তায় আর ভয়ে কুঁচকে গিয়েছিল রুমেলা। কোনওক্রমে বস্তাটা কোমড়ে জড়িয়ে ফিরে আসে ঝুপড়িতে।
আম্মাকে বলতে, প্রথমে তার ভুঁরু কুচকে যায়। তারপর, মুচকি হেসে, বুঝিয়ে দেয় -এই রক্ত তার পূর্ণতা প্রাপ্তির চিহ্ন। এতে ভয়ের কিছু নেই। প্রতিটি মাসেই এ ধারা বয়ে যায় প্রতিটি নারীর জীবনে। সেই ঋতুমতী অবস্থা বসুন্ধরাও হয়। তাতেই তো সমৃদ্ধ হয় প্রাণীকুল।
কিন্তু প্রতিদানে কোন যোগ্য প্রাপ্তি, তাঁর কি জোটে ? উদাহরণ পাওয়ার জন্য অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে খড়ের গাদায় সূঁচ খুঁজতে হবে, তাহলে। পাওয়া হয়তো যাবে নিশ্চয়ই ।
আজ ভ্যাটের ময়লা ঘাঁটতে গিয়ে অনেকগুলো বিদেশী মালের বোতল পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, এক-দুই-তিন করে প্রায় দশ বারোটা বোতল হয়ে গেছে। প্রভুদার দোকানে বিক্রি করে অনেক টাকাই হবে। যা দিয়ে, স্যানিটারি প্যাডটা কেনা যাবে। বাকিটা মাথা ধরার ওষুধ। আর অন্যগুলোর টাকা যাবে আম্মার হাতে, সংসারের আজ, কি বড়জোর কালকের খরচ।
হঠাৎ আঁকশিটা আটকে যায়। হ্যাঁচকা টান মারতেই বেড়িয়ে আসে একটা কালো চামড়ার সরু হ্যান্ডেল। তারপর হাত দিয়ে টেনে এনে পাওয়া যায়, একটা কালো রঙের ব্যাগ, চেন লাগানো। পেটটা বেশ মোটা। তখনও এদিকে তেমন লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি। এদিক ওদিক তাকিয়ে চেনটা খুলে দেখে, অনেক টাকা আর সোনার বেশকিছু গয়না। চেনটা বন্ধ করে তাড়তাড়ি বস্তায় ঢুকিয়ে নেয়। তারপর বোতলগুলো ঢুকিয়ে সোজা হাঁটা দেয় ঝুপড়িতে দিকে। একদিকে আনন্দ, আর একদিকে ভয় – বুকটার মধ্যে যেন অলোকদার দোকানের ডিজে বাজছে- ঢিক-ঢাক, ঢিক-ঢাক, ঢিক-ঢাক।
আজ পাঁচ মিনিটের রাস্তাটাও যেন পাঁচ ঘন্টার রাস্তা হয়েগেছে, ফুরোয় না কিছুতেই। মনে মনে ভাবে , আল্লাহ্ কি মুখ তুলে চাইলো তবে ? নাকি এটা তাঁর একটা পরীক্ষা ? আর কতো যে পরীক্ষা দিতে হবে ?
অন্যদিন, রুমেলা খালি বস্তা নিয়ে ফেরে, কিন্তু আজ ঢাউস বস্তা নিয়ে প্রায় ঊর্ধশ্বাসে ছুটে আসছে কেন ? ফতেমা ঝুপড়ির পাশে, পা ছড়িয়ে লঙ্কা দিয়ে পান্তা খাচ্ছিল। রুমেলার ত্র্যস্ততায় লঙ্কা চিবিয়ে মুখে পান্তা তোলার কথা ভুলে যায়। ওদিকে উদ্বিগ্নতা আর এদিকে লঙ্কার ঝাল- এই দুইয়ের সমন্বয়ে করুন অবস্থা।
‘কী রে ? ওহ্ বাবা ! কী ঝাল ! তুই ? কী হয়েছে? দাঁড়া পানিটা কোথায় গেল ? উফ্ !’ কোনটা ছেড়ে কোন্ কথাটা বলবে ?
দুম করে বস্তাটা রেখে রুমেলা বলে, ‘দাঁড়া আম্মা আসছি।’ বলেই দৌড়ে যায় সুলভ কম্প্লেক্সের দিকে।
ফতেমা ভাবে, যাক বাবা, ভয়ের কিছু নেই। পায়খানা পেয়ে গিয়েছিল বোধহয়। তাই আর দোকানে বিক্রি করার সুযোগ পায়নি।
কিছুক্ষণবাদে ফিরে আসে, রুমেলা। ফতেমা ইয়ার্কি মারতে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ের মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ কাটেনি দেখে চুপ করে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে খুকী, কী হয়েছে ?’
আম্মাকে কিছু না-বলে, বোতলগুলো ধীরে ধীরে নামাতে থাকে। তারপর ছেঁড়া ওড়নাটা জড়িয়ে কালো ব্যাগটা নিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে ঢোকে, পিছু পিছু ফতেমাও।
‘কী রে খুকী, কী ওটা ?’ বলতেই মায়ের মুখটা চেপে বলে, ‘আস্তে, আম্মা আস্তে। সব বলছি।’ তারপর সবিস্তারে ঘটনাটা জানায় আম্মাকে।
হায় রে সম্পদ ! না থাকলেও জ্বালা, আর থাকলেও জ্বালা। এখন কী করা উচিৎ – এই ভাবনার ঝড় ওঠে দু’জনের মধ্যে। আব্বা, রহমত আলিকে বলবে কিনা – এটাও চিন্তার বিষয়। পেলে সে তো মদেই ডুবে থাকবে। একটা চটের বস্তায় মুড়িয়ে রেখে দিল ফতেমা। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখতে হবে। দেশে ফেরার তো উপায় নেই, এখন। সেই সুদূর ঝালকাঠি গ্রাম, বরিশালের। অনেক হ্যাপা, চোরা পথে ওপারে যাওয়ার। আর গিয়েই বা কোথায় উঠবে ?
বুদ্ধিমতী রুমেলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। উপরওয়ালার এটা একটা বড় দান মানুষের জীবনে- পরিস্থিতির সাথে যুঝে নেওয়া।
অন্যদিনের মতো সব কাজ সেরে, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে ঝুপড়িতে ফেরে রুমেলা। আজ টাকার পরিমানটাও যথেষ্টই বেশি। এ দিয়ে প্রায় সপ্তাহটা কাটিয়ে নেওয়া যাবে। তার মানে, পরবর্তী এই সাতদিনের টাকাটা জমে যমে যাবে। বাবার পায়ের ব্যাথার মলমটা কেনা, মায়ের ভাঙা চশমাটা সারানো, নিজের নাইটির শকটাও মেটানো যাবে।
ভাবতে ভাবতে আম্মার বুকে মুখটা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে, রুমেলা।
কষ্টের নোনাজল ফতেমার রুদেলি চোখে বাঁধ মানেনা, এ সময়ে। কী জীবন কাটিয়েছিল তারা একদিন, আর আজ ? তাদের দোষ কোথায় ছিল, আজও জানেনা। মনেও করতে চায় না, সেই যুদ্ধ, মারামারি, কাটাকাটি আর প্রাণ ও সম্মান হারানোর দিনগুলিকে। তবে, এও বোঝে- রাস্তার ধারে পড়ে থাকা এ জীবন তাদের নয়।
পরদিন ইঁট খোলার ফাঁকা মাঠটায় একবার চক্কর মেরে কালীগঙ্গার ব্রীজের ওপারে বাজারটার কাছে ভ্যাটটায় যাবে বলে সবে ব্রীজে উঠেছে, চারটে বাইক ঘিরে ধরে রুমেলাকে। জানতে চায়, কাল সকালে কোন ব্যাগ পেয়েছে কিনা। রাস্তায় কয়েকটি লরি আর কিছু বাইক চলছে তখন।
না বলায়, রুমেলাকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকে। টানাটানিতে কাঁধের থেকে কিছুটা জামা ছিঁড়েও যায়। এতে শরীরের অনাবৃত সুডোল ঢেউ চোখে পড়ে ওদের। ব্যাস, আর যায় কোথায়, জামা ছিঁড়ে কুটিকুটি। ওপরের অংশ তখন অসহায়। লজ্জা বাঁচানোর জন্য তো তার বাসুদেবকে আর কোথায় পাবে ? হাত- পা ছোঁড়া, আর চিৎকার ছাড়া কী বা করার তখন আছে। সব প্রায় শেষ হতে চলেছে, তবুও ধস্তাধস্তি চলেছে। সম্ভ্রম বাঁচানোর শেষ শক্তিটুকুও বোধহয় শেষ হতে চলল।
কিন্তু সেই সময়, পুলিশের জীপ এসে পড়ল নাটকীয় ভাবে। সার্জেন্টকে নামতে দেখে, ওরা দে দৌড়। তাড়াহুড়োতে একটি বাইক পড়ে রইল রাস্তায়। আর ওদিকে, সার্জেন্টকে দেখে স্বস্তিতে রুমেলাও কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকল। তখন তার চারিদিক শুধু অন্ধকার।
যখন চোখে আলো এসে পড়ল, সে দেখলো, তার শরীরে রয়েছে পুলিশের সাদা জামা আর ছেঁড়া ওড়নাটা। আধ শোয়া অবস্থায় জীপেই রয়েছে সে।
অফিসারের গায়ে একটা ফুলস্লিপ সাদা গেঞ্জি।
তার আল্লা তাকে লজ্জার হাত থেকে সসম্মানে আড়াল দিয়েছেন দেখে, দুচোখ ভরে গেল জলে। হয়তো ঐ জল দিয়েই আল্লাহ্-এর পা’দুটোয় গোসল করিয়ে দিল মনে মনে।
তারপর, আবার দুচোখ ভরে দেখে নিল একবার তার আল্লাহ্কে, আর চোখ বন্ধকরে দোয়া করল মানুষটির জন্য।

@সু

মন্তব্য করুন