Skip to content

৩৭- দেবীপক্ষ – সুপ্রিয় ঘোষ

মোড়ের মাথায় একটা বড়ো জটলা দেখে থমকে গেলেন দেবাশিসবাবু। তারপর, যা’ দেখলেন তাতে চক্ষু চড়কগাছ!
কাৎ হয়ে পড়ে আছে একটা ছেলে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, তার ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। হাতে পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ। জামা প্যান্ট ধুলো কাদায় মাখামাখি।
কথার গুঞ্জনে বুঝতে পারলেন, সেই যুদ্ধের চালিকা শক্তি এক অপমানিতা রূপবতী নারীর। চার চারটি লুচ্চার, বকে যাওয়া ছেলেদের ঔদ্ধত্যকে সে আঁচড়ে, চাপকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। তারমধ্যে তিনজন পগাড় পাড়। একজন মাটিতে। এই মোড়ের অস্থির পরিস্থিতির মোড় ঘোরানো ব্যক্তিত্বকে দেবাশিস মনে মনে কুর্নিশ জানালো।
অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, এই মোড়ের মাথার যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির কথা।
কিছুক্ষণের মধ্যে চিৎকার করতে করতে চলে এলো অ্যাম্বুলেন্স। মেয়েটি নিজেই আর কয়েকজনের সহায়তায় ছেলেটিকে অ্যাম্বুলেন্স-এ তুলে দিল। তারপর গাড়িটির সাথে নিজের স্কুটি স্টার্ট দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দেবাশিসবাবুর বড়ো কৌতুহল জাগালো পুরো ব্যাপারটা শেষ অবধি দেখার। অন্যান্য লোকেদের সাথে তিনিও ট্যাক্সিতে চললেন হাসপাতালে।
যথারীতি পুলিশ কেস এটা । শুশ্রুষার সাথে সাথে চলল পুলিশি জেরা। আঞ্চলিক প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা অনুসারে, ছেলেটি সামগ্রিক দোষের ভাগিদার। পুলিশ রিপোর্ট নোট করতে গেলে, সেই যুবতীর কথায় মকুব হয়ে গেল, এক মুচলেকা দিয়ে। স্বীকারোক্তিতে থাকল, কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না।
ছেলেটির নাম শুনে ও মুখটা দেখে, দেবাশিসবাবু তাঁর মাস্কটা ঠিক করে ঢেকে নিলেন। কারণ, এই বিজন চ্যাটার্জি তো তাঁরই একমাত্র ছেলে।
ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে, ধীরে ধীরে কেমন জানি বদলে গেল। ইদানিং খুব জেদ, রাগ বেড়ে গিয়েছিল, তার সাথে অবাধ্যতাও। এক পূর্ণবয়স্ক তরুণকে কীভাবে শোধরানো যাবে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না, দেবাশিসবাবু।
তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফিরে গেলেন বাড়িতে। আজ আর অফিসে যাওয়া হল না। এই বছরটাই তো তাঁর কর্মজীবনের শেষ বছর।
বিজন বাড়ি ফেরার দিন চারেক বাদে, বাড়ির গ্রিলের গেটটার সামনে একটা স্কুটি এসে থামল। সেদিন ছিল রবিবার। বিজন তখনও ঘুমোচ্ছে। দেবাশীষবাবু তাঁর সখের ছোট্ট বাগানটায় জল দিচ্ছেন গাছগুলোতে।
সেই বিকেলে, ভোরের ফুল ফোটার মতো এসে হাজির সেই মোড় ঘোরানো ব্যক্তিত্ব। দেবী চন্ডীকার সে মূর্তি, আজ যেন স্বস্তির সাক্ষাত অন্নপূর্ণা। কাছে এসে একটা প্রণাম করল, চৈতি মিত্র। দেবাশীষবাবুর সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল এক পরম স্নিগ্ধতা ও প্রশান্তির বাতাবরণ।
“তুমি কে মা ? কী চাই ?” মাথায় হাত দিয়ে পরমস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
চৈতির চোখে তখন আর চৈত্রশেষের ঝড়ের কোন চিহ্ন নেই। আছে মায়াময় এক পশলা বৃষ্টির আবেশ।
ঐ স্নেহই যে, সে শুধুই খুঁজে চলেছে বাবা-মাকে হারিয়ে। এ যেন তার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
“না মানে, মেসোমশাই, আপনিই তো বীজনবাবুর বাবা ?” আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে চৈতি।
“উনি এখন কেমন আছেন? আসলে, সেদিন আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল, অপমানকর কতগুলো কথায়। এর আগেও শুনতে পেতাম, নানা রকম কথা। নির্যাতন রিক্সাওয়ালাদের ওপর, ঠেলাওয়লাদের ওপর, মেয়েদের ওপর; অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করতো। পুলিশ কেন ওদের টিকি ছুঁতোনা, তাও জানি। কিন্তু ঐ ভাবে মারার পর, আমারও সম্বিত ফেরে। আপনার ছেলেকে আমার বেল্টখুলে খুব মেরেছি সেদিন। পরে ভীষণ অনুতাপ হচ্ছিল, তাই আজ ক্ষমা চাইতে এলাম।” এক দমে বল গেল সেই জগদ্ধাত্রী।
ছেলে ভালো আছে জানিয়ে, পরম স্নেহে, দেবাশিসবাবু ঘরে নিয়ে যেতে চাইলেন চৈতিকে।
–“চলো মা, তুমি একটু মিষ্টি মুখ করবে চলো।”
— ” না মেসোমশাই, আজ নয়, অন্য একদিন আসবো”
দেবাশিসবাবুর অনুরোধে ফোন নম্বরটা দিয়ে স্কুটি স্টার্ট দিল চৈতি। অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চেয়ে থাকলেন দেবাশীষবাবু।
এরপর কেটে গেছে আরও একমাস। সেদিনটা ছিল বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ। ঈশানী মেঘ ঘনান্ধকার করে ফেলেছিল বিকেলটাকে।
জিমের ড্রেসগুলো ছাদ থেকে আনতে গিয়েছিল চৈতি। দুরের কালো মেঘটা আকাশটায় পুরোপুরি ছেয়ে যায়নি তখনও। একটু জোরে হাওয়া শুরু হয়েছে। চৈতির খোলা চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে হাওয়াটা। টবগুলোতে গাছগুলোও যেন সহমত প্রকাশ করছে ঐ ভালোলাগার পরিস্থিতিটাকে। ওরাও দুলে উঠছে। চৈতি দু’হাত ছড়িয়ে একবার নাচার ভঙ্গিমায় কয়েক পাক ঘুরে নিল ।
কিন্তু কাকিমার ডাকে নেমে আসতে হলো তখনই। নীচে নেমে এসে দেখে, মেশোমশাই, মানে দেবাশীষবাবু। কাপড়গুলো সোফার ওপর রেখে, নমস্কার করে বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করল চৈতি, “মেশোমশাই আপনি ? কী হয়েছে? আপনি বসুন।” পরম সমাদরে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিল। নিজেও পাশে বসে পড়ল।
” মা, তোমার কাছে এলাম, আমার মনের কিছু কথা তোমায় জানাব বলে।”
” হ্যাঁ, বলুন না মেশোমশাই ”
তারপর, যে আলোচনাটা চলল, তার থেকে বোঝা গেল, তার হাতে মার খাওয়ার পর, ওনার ছেলে বেশ কয়েকদিন ধরে একদম, চুপচাপ। অতি প্রয়োজন না থাকলে ঘর থেকে বাইরে একদম যাচ্ছেনা। বন্ধুরা বাড়িতে এসে দেখা করে যাচ্ছে, ওদের সাথে বাইরে যাচ্ছেনা। মারের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে হাত বোলাতে থাকে। আর আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবে অনেকক্ষণ! জিজ্ঞাসা করলে, কিছুই বলেনা।
দু’দিন থেকে জ্বর। যখন একবার একশ চারের ওপর উঠেছিল, ভুল বকতে বকতে, তোমার মারের কথা বলছিল, ” মারুন, আরও মারুন। আপনার মারের মধ্যে মায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন। আবার মারুন। আমি মাকে দেখতে পাচ্ছি, আপনার মধ্যে।”
চশমা খুলে চোখটা মুছে নিল দেবাশীষবাবু। চৈতি চোখের জলটা লুকাতে, উঠে সোফার কাপড় সরাবার ভান করে চোখটা মুছে নিল।
কাপড়গুলো ভাঁজ করতে বলে, “ওনাকে ডাক্তার দেখানো হয় নি ?”
” হ্যাঁ, মা। সব রকম পরীক্ষাও করা হয়েছে। এখনকার ভয়ঙ্কর রোগের পরীক্ষাটার আজকেই রিপোর্ট পাওয়ার কথা বলে, এখনই নিয়ে এলাম। ভয়েতে কুঁকড়ে ছিলাম এই দুই দিন, এখন নিশ্চিন্ত। রিপোর্টে দোষ পায়নি। তোমায় কেন জানিনা, না জানাতে পারলে স্বস্তি হচ্ছিল না। তাই ছুটে এলাম তোমার কাছে।”
চৈতির ভীষণ খারাপ লাগছে দেবাশীষবাবু ও বীজনের জন্য।
কিছু কিছু ঘটনা মানুষের মধ্যেকার দূরত্বকে যেমন বাড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি পারে কমিয়ে দিয়ে একবারে হৃদয়ের অলিন্দটা ছুঁয়ে দিতে। হৃদয়টাকে প্রসারিত করে, মনের সমস্ত দরজা হাট করে খুলে দিতেও পারে।
চৈতির সেই ঝড় যেমন, বীজনের বন্ধ আগল ভেঙে দিয়েছিল, ঠিক তেমনই সেই ঝড়ের স্তিমিত রূপ দেবাশীষবাবুর অভিজ্ঞ চোখের তারারন্ধ্রে ধরা দিয়েছিল স্বস্তির বাতাস হয়ে। মনের আকাশটাতে যে দুশ্চিন্তার জমাটি মেঘটা সরাতে পারছিল না দেবাশীষবাবু শত চেষ্টাতেও, চৈতির ঝড়ের ঝাপটায় যেন সরে যেতে বসেছে সেই মেঘ।
শুধু চৈতির সম্মতির অপেক্ষা। দেবাশীষবাবুর তো বরণডালা সাজানো হ্য়ে গেছে, তাঁর গৃহবধু বরণের জন্যে।

@সু

মন্তব্য করুন