দগদগে ঘা-এর মতো এখনো ক্ষতটা রয়ে গেছে মনের কুঠরিটায়। তাই লকলকে আগুন দেখলে, এখনো মনটা অস্থির হয়ে ওঠে চিন্ময়ের। যন্ত্রণা আর ভয়ের মিশ্রণে কেমন যেন একটা দলাপাকানো কষ্ট গলাটা চেপে ধরে। দম বন্ধ হয়ে আসে।
ঠিক ছেলেবেলা নয়, তখন একটু তো বড়ো বটেই। আঠারো কি ঊনিশের হবে, চিন্ময়। গোঁফের রেখাটা স্পষ্ট হয়েছে তখন, থুতনি আর গালে, অবিন্যস্ত দাঁড়ি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়, একজন পুরুষ অপেক্ষা করছে অনুভূতির দরজাটায়।
সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছিল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার, বেশ ঘন। বাড়ীতে সেই মুহূর্তে কেউ নেই। টেপরের্কডটায় আমজাদ আলি খাঁ-এর ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে, শর্টপ্যান্ট পড়া অবস্থায় গা’টা এলিয়ে দিল বিছানায়।
সরোদের ঝাঁপতালটা শরীর ও মনের সব ক্লেদ ও ক্লান্তিকে ধুয়েদিচ্ছে যেন। চিন্ময়ের সরোদ আর সেতার ভীষণ ভালো লাগে।
আলাদা আলাদা কম্পাঙ্কের তারগুলি আঙুলের সুবিন্যস্ত নড়াচড়ায় কী অপূর্ব শ্রুতিমধুর স্বস্তির পরিবেশ গড়ে তোলে !
মানুষও তো সেইরকম বিভিন্ন অনুভূতির তরঙ্গে অনুকম্পিত হয়। তবে পরিচালনার সুবিন্যস্ত আঙুলগুলো আর নেই ! তাই বেসুরে বাজে, সংসারের, সমাজের, সংগঠনের সরোদটা। কখনো কখনো তারটাও ছিঁড়ে যায়। বেতালা হয়ে যায় সব সম্পর্ক।
হঠাৎ একটা তীব্র গোঙানির স্বর ঘোরটাকে কেটে দিল। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে, দেখতে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখতে পেল, প্রায় লাগোয়া পাশের বাড়ির খোলা জানালাটার ভিতর দাউদাউ করে আগুনের আভা।
সেই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা চিন্ময়ের। আর্তচিৎকার, ‘বাঁচাও, বাঁচাও’। আর ভাববার সময় নেই। ঝাঁপিয়ে পড়ল পাঁচিলের ওপর। এক লাফে ওই দিকে, এক ছুটে ঘরের ভিতরে।
একটি জলন্ত আগুন এদিক ওদিক চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে, আর একটা উলঙ্গ শরীর ধরতে চাইছে আগুনটাকে। এক ঝটকায় সেই শরীরটাকে সরিয়ে, বিছানার তোষক দিয়ে জরিয়ে ধরল আগুনটাকে। উপুড় হয়ে পড়ল আগুনটা মেঝের ওপর। উলঙ্গ পুরুষ শরীরটাও চেপে ধরেছে আগুনটাকে। চিন্ময় একটা গামছা পেয়ে জড়িয়ে দিল উলঙ্গ শরীরটা। চাপটা আলগা হতেই উঠে দাঁড়াল নারী শরীরটা। চুলের একপাশ পুড়ে ঝরে পড়ল। মুখের একপাশ ঝলসে কালো চাপ চাপ হয়ে রয়েছে। বুকদুটো ঝলসে ছাল উঠে গেছে। তলপেট অবধি ঝলসানো। অবিরত যন্ত্রণার কান্না।
আর দাঁড়াতে পারেনি চিন্ময়। অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে লোকজন আসা শুরু করে দিয়েছে। বাড়ীতে ফিরেই জামাকাপড় পরে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে চিন্ময়।
বন্ধুর ডিস্পেন্সারিতে এসে সব জানিয়ে বলে, ‘একটা ঘুমের ওষুধ দে, অন্ততঃ আজ রাতের মতো।’
ওষুধটা নিয়ে সোজা কালীমন্দির। সবার শান্তি কামনায় মগ্ন হয়ে যায় সে।
মানুষের অতৃপ্তি কেন যে এভাবে আত্মহননের দিকে নিয়ে যায়! কতটা আত্মাভিমান থাকলে মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু অবলীলায় আত্মস্থ করতে পারে ! অবাক হয়ে ভাবে চিন্ময়।
পরদিন ভোরে পাশের বাড়ির কাকুর কান্নার কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারে অগ্নিদগ্ধ মানুষটির পরিণতি কী হয়েছিল। যদিও তার শেষ জবানবন্দি বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে তার ভালবাসার সোহরকে। কোনো এক কষ্টের অবিমিশ্র অভিমানে সে সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে সবার থেকে, তার খবর আজও আর কেউ রাখেনি। শুধু চিন্ময়ের স্মৃতি অস্থির হয়, কোনো আহুত আগুনের লেলিহান দর্শনে, এখনো।
@সু