Skip to content

৩৩- ছিন্ন পদাবলী- সুপ্রিয় ঘোষ

প্রতিদিনের মত আজও সে এসেছিল। গায়ে একটা বড় স্যান্ডোগেঞ্জি, কাঁধ থেকে বারবার খসে পড়ছে গেঞ্জির স্ট্র্যাপটা। তার খেয়াল নেই। সেন-বাড়ির বাইরে, পাঁচিলের ওপর রেলিং ধরে একমনে দেখে যাচ্ছে প্রতিমা বানানো।
দশ কি এগারো হবে সেই ছোট্ট ছেলেটির বয়স। চোখ দুটো উজ্জ্বল । আগ্রহ চোখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে। শোনা গেছে, কোন এক বারবনিতার ছেলে সে।
আর ওদিকে, ষাটোর্দ্ধ প্রতিমা শিল্পী, পালবাবু মাটি চাপাচ্ছেন পুরোনো কাঠামোতে, খড়ের ওপর। অন্যান্য প্রথার মতো, এটাও একটা প্রথা, ‘রূপান্তর’ নামধারী সেন বাড়ির, যেখানে ভাসান করার পর, পুরানো কাঠামোকে তুলে আনা হয়, পরেরবারের দূর্গা প্রতিমা বানানোর জন্য।
আজ সকাল থেকেই পালবাবুর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। কেমন যেন অস্থিরতা শরীর জুড়ে। কিন্তু বিশ্রাম নিলে তো চলবে না। আর মাত্র দিন চল্লিশেক বাকী, তার পরেই পুজো। তারমধ্যে বানিয়ে ফেলতে হবে প্রতিমা।
সেনবাড়ির আমন্ত্রিত অতিথিরা বেশিরভাগই বিদেশি। কিছু আত্মীয়-স্বজনও ভারতবর্ষ, এমনকি কলকাতার বাইরে থেকে আসবেন। এ পুজোর ঐতিহ্য ও যশ, বিশাল, তাই গুরুত্বও অনেক বেশি। তাই বিলম্ব করা আর যাবেনা। অথচ শরীরটা সায় দিচ্ছেনা। তিনিই একমাত্র শিল্পী, যে বহুবছর ধরে এখানে প্রতিমা বানিয়ে আসছেন। তাই একপ্রকার এ বাড়ির সদস্যও হয়ে উঠেছেন তিনি।
হঠাৎ, টলতে শুরু করলেন তিনি। তাই দেখে ছেলেটি পলকের মধ্যে রেলিং টপকে চলে এল বৃদ্ধির কাছে, ‘পড়ে গেল, পড়ে গেল’ বলে চিৎকার করতে করতে। ছোট্টদুটো হাতে টুলটাকে ধরে নিল, কিন্তু বৃদ্ধর শরীর চলে ছেলেটির ওপরে।
কত আর শক্তিধরে ঐ শরীর। প্রচণ্ড আঘাত পেল ঘাড়ে আর বুকে। তবু বৃদ্ধকে মাটিতে ছেড়ে দেয়নি। নিজেরবুক ডলতে ডলতে, ‘দাদুভাই, ও দাদুভাই, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে, কোথায় লেগেছে, কথা বলছ না কেন ?’ প্রশ্নের বাণ ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু বৃদ্ধ নিশ্চুপ।
আর এদিকে ছেলেটার চিৎকার শুনে দারোয়ানরাও ছুটে এসেছে। ছুটে এসেছে, বাড়িতে উপস্থিত সদস্যরাও। এসেই ঐ অবস্থা দেখে সবাই একযোগে চিৎকার করে ওঠে, ‘ এ কে ? এই তুই পালবাবুকে কি করেছিস? পালবাবুর এই অবস্থা হলো কেন ?’
একটা দারোয়ান এসে সপাটে একটা চড়ও লাগিয়ে দিল, ‘তু চোরি করনে কে লিয়ে আয়েথে না? বোল্, চুপ কিঁউ’, বলে আবার হাত তুলতে গিয়েছিল। পিছন থেকে কেউ যেন হাতটা আটকে দেয়।
‘দাঁড়াও, মারছ কেন ওকে ? ও কে মারধর করার সময় নয় এখন। ও চুরি করতে আসেনি।’ একথা বলে বউটি এগিয়ে যায় বৃদ্ধর দিকে। ‘আগে ডাক্তার ডাকুন, মুমূর্ষুকে বাঁচানোর চেষ্টা আগে করুন। কেউ পালাবেনা। ও আমারই ছেলে।’ একথা বলে বৃদ্ধর দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে রমলা, তথাকথিত বারবনীতা।
ভিতরে জাগল ঘৃণার আগুন, একদিনের সেই প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণার তুষের মত ধিকধিক করে জ্বলা আগুনটাকে বাড়িয়ে দিল শতগুণ। তবু অবহেলা করতে পারলনা। বনিতা হলেও, সে তো নারী, মমতা যাদের ছায়াধর্মী। হ্যাঁ, ইনিই তাঁর শ্বশুর হওয়ার কথা ছিল, মানে সায়নের বাবা।
পরম স্নেহে কোলে তুলে নিল মাথাটা। সায়নের সাথে সাথে সবাই অবাক চোখে দেখতে লাগল। দারোয়ানরাও স্তব্ধ হয়ে গেছে।
এমন সময়, ডাক্তার এসে ঢুকল । পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল অনেকক্ষণ ধরে। সেরিব্রাল অ্যাটাক্ট। চলল ইনজেকশন।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে, চোখ মেললেন পালবাবু।
কিন্তু সে দৃষ্টিটায় কেবল শূন্যতা। অন্ধ যেমন চোখ মেলে তাকায়, তাকিয়ে রইল। ডাক্তার অন্যান্য ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার সাথে, স্ক্যান করতেও লিখে দিল।
তারপর, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি অজ্ঞান হওয়ার সময় কি মাটিতে পড়ে গিয়ে ছিলেন?’
সায়ান তড়িঘড়ি জবাব দিল, ‘ না, না, দাদুকে ওরকম টুলের ওপর টলতে দেখে আমি পাঁচিল টপকে দৌড়ে এসে ধরে ফেলি। তবে আমিও সামলাতে পারিনি, আমার ঘাড়ের ওপর পড়ে। তবে দাদুকে ব্যথা লাগতে দিইনি।’
ডাক্তার সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ তাই জন্যই তোমার দাদু এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন হয়তো।’ তারপর, উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই দেবদূতই বাঁচিয়ে দিল ওনাকে। মাটিতে পড়লে মাথায় রক্ত ক্ষরণ আরও বেশি হত, তখন মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল সবচাইতে বেশি। এখন অন্ততঃ মৃত্যুর ভয়টা বেশ কিছুটা কেটে গেছে। তবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পরীক্ষার রিপোর্ট আনার চেষ্টা করুন। তারপর সব ওষুধ চালু করবেন। সম্ভবতঃ, ওনার ডানদিকের শরীরের অংশটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আগে স্ক্যানের রিপোর্ট সংগ্রহ করুন।
সকলের মাথায় হাত। কীভাবে সম্পন্ন হবে দেবী দূর্গার মূর্তি, কীভাবেই বা এত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রথা সম্পূর্ণ হবে। একমাত্র ভরসা যে পালমশাই। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল পালমশাইকে সুস্থ করার জন্য।
হাই প্রেসার। কোলেস্টরলও হাই। সেরিব্রাল অ্যাটাক্। ডানদিকের অঙ্গ অসার পাল বাবুর। বাড়িতে থেকে চলল শুশ্রূষা।
কিন্তু অসার অঙ্গে সার আসে কই। সকলে বলাবলি করতে থাকল, এবারে তাহলে ঐ পুরোনো কাঠামোতেই অন্য কোন মৃৎশিল্পী এনে মূর্তি বানানো হোক। পালমশাই ওখানে বসে থাকবেন।
সেই মতো খোঁজা চলল শিল্পী। পুজোর ব্যস্ততায় কোন শিল্পীই আর যোগাড় হয়ে ওঠে না। বাড়ির বড় ছেলেও চলে এসে এবার আগেভাগে। আর প্রায় কুড়িটি দিন বাকী।
কোন এক আর্ট কলেজের কিছু শিল্পী নিয়ে হাজির সে। যদি এদের দিয়ে কাজ হয়। ওদের সবাইকে নিয়ে দালানে আসতেই চমকে উঠল সকলে। এ কী দেখছে তারা!
মৃন্ময়ী সেই মূর্তিতে শুধু রঙ করা বাকী। এখনই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই মূর্তি। একটি ছোট্ট ছেলে টুলের ওপর বসে, মায়ের কোমড়ে হাত জড়ানো। বুকের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার সারা অঙ্গে মাটিমাখা। ক্লান্ত শরীর নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছে মায়ের বুকের ওপর।
আবর্ট কলেজের একটি ছেলে পটাপট তার মোবাইলে বন্দী করে নিল সে দৃশ্যপট। আর বলতে লাগল, ‘ এ দৃশ্য আর কোথাও দেখতে পাবেন না এরপর।’
বড় ছেলে, কুন্তল সবাইকে ডেকে দেখায় সেই দৃশ্য। সকলেই হতবাক। পালমশাইকেও আনা হয় সেখানে। উত্তেজনায় পালমশাইয়ের অসাড় হাত কাঁপতে থাকে। অসার পা’ এতটাই কাঁপতে থাকে যেন, দৌড়ে যাবে ওর কাছে।
জড়ানো গলায় চিৎকার করে ওঠে, ‘ কে ওই দেবশিশু? আমায় নিয়ে চল ওর কাছে একবার। ওর পা’টা একবার ছুঁয়ে নিতে দাও। এ মূর্তি আমিও পারতাম না বানাতে। একবার নিয়ে চলনা আমায় কেউ, ওর কাছে।’
কুন্তলই চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে যায় ছেলেটির কাছে। ততক্ষণে সায়নও জেগে উঠেছে। তাকিয়ে অত লোক দেখে ভয় পেয়ে যায়।
‘ আমি কিছু করিনি, কিছু করিনি । দাদু পারবেনা বলে আমিই …..’ কথা শেষ হয়না, সে কাঁদতে থাকে হাউমাউ করে।
আর এদিকে যার ঘরের দুয়ারের মাটি না পেলে এই মূর্তি গড়া সম্ভব নয়, সেই মহিলাও চলে আসে খরিদ্দারদের জন্য সারারাত ব্যস্ত থেকে, সায়নকে দেখতে না পেয়ে।
এসে ভিড় দেখে সেও ঘাবড়ে যায়। কোন রকমে সামনে গিয়ে দেখে, সায়নকে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধ কাঁদছে, আর বলছে, ‘ কে তুমি বাছা, আমার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে অবলীলায়? কে তোমার মা, কে তোমার বাবা ? এত বড় কাজ কে তোমায় শেখালো, এই বয়সে ? তুমি তো ঈশ্বর প্রেরিত দূত।’
গর্বে বুক ভরে গেলেও, অভিমানের আগুন আবার জ্বলে উঠল সেই উপেক্ষিত নারীর বুকে। ছলছল চোখ নিয়ে ছেলের হাত ধরতেই, ছেলে বলল, আমার বাবা নেই। এই আমার মা।’
ঘোমটার আড়াল থেকে মুখটা দেখে চমকে উঠল বৃদ্ধ।
‘শকুন্তলা ? বৌমা তুমি ? এ তো সত্যিই আমার উত্তরাধিকারী, আমার নাতি!’
প্রচণ্ড অভিমান ও রাগে ডুকরে উঠল সে মহিলার মন। ছেলেকে টানতে টানতে চলে গেল সে।
স্বীকৃতি পড়ে রইল মৃন্ময়ী দেবী দূর্গার সারা শরীর জুড়ে। অনেক অজানা প্রশ্ন নিয়ে, সকলে বিস্ময়ে হতবাক তখন।

********************************************
@সু

মন্তব্য করুন