Skip to content

৩০ – অলিখিত পাণ্ডুলিপি- সুপ্রিয় ঘোষ

” কী লোকের পাল্লায় পড়লুম রে বাবা! সেই যে বাবা ধরে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল, তারপর থেকে কানা বাদুরের মতো ঝুলেই আছে ? মালাবদলের পর থেকে পালা আর কিছুতেই বদলায় না ! সেই মালা শুকিয়ে তুলসীর কণ্ঠিমালার মতো গলায় চেপে বসেছে যেন। বেদম হয়ে উঠছি,” চিৎকার করতে করতে গিন্নি ছাতুর শরবতটা তৈরী করতে থাকে।
মোহিতলাল ততক্ষণে আন্ডারপ্যান্টটা বার করে দু’পা গলিয়ে দিয়েছে।
” এ কী, এতো টাইট হলো কেন ? কোথায় গেলে তুমি ? রমলা, ও রমলা । তাড়াতাড়ি এসো, আজ আবার অফিসে লেট হয়ে যাবে। কী গো, কোথায় গেলে ?” মোহিতবাবুর তারস্বরে চিৎকার।
বড় কাঁসার গ্লাসে ছাতুর শরবতটা গুলতে গুলতে ছুটে আসে রমলাদেবী, ” কী হোলো ? বাড়িতে ডাকাত পড়ল নাকি ? এতো চিৎকার কেন ?”
এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে বলেন, ” এখন বুঝলাম, ডাকাত না পড়তেই তুমি কাৎ হয়ে গেছো কেন ? বলি, তোমার চোখের মাথাটা কি খেয়েছো? নাকি বোধবুদ্ধি সব চুলোয় গেছে ? তোমার দু’টো পা-ই তো আন্ডারপ্যান্টের একটা পায়েই গলিয়েছো ! তো সে আর উপরে উঠবে কী করে? হা ভগবান, আর কতো জ্বালা আমায় দেবে ?”
মোহিতবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটু মুচকি হেসে, একটা পা বার করতে যাবে, কোমরের গামছার গীটটা যায় খুলে।
“এইইই..”, বলে বসে পড়ে।
রমলা হাতদিয়ে চোখ চেপে বলে, “ছি,ছি,ছি, ছিঃ, কাণ্ড দেখো ! সকাল সকাল কী যে সার্কাস হচ্ছে ! ভাগ্যিস, ঘরে কেউ ছিলনা। এ মানুষ সত্যিই এবার উন্মাদ হয়ে গেছে।”
কিছুই বলার থাকেনা মোহিতলালের। কোনো রকমে গামছা সামলে আন্ডারপ্যান্টটা পড়ে নেয়। এখন আর ভালোভাবে গীটটা দিতে ভুল হলো না তার।
” এই রইল, তোমার শরবত। আমি দেখি, তোমার টিফিন বাক্স আর জলের বোতলটা ঠিকভাবে ব্যাগের মধ্যে রাখা হলো কিনা,” বলে ঠক্ করে গেলাসটা রেখে চলে গেল।
মোহিতবাবু গেলাসের ঢাকনা সরিয়ে চুমুক দেয়। পরক্ষণেই চিৎকার, ” ও গিন্নি, এটা শরবত না সিন্নি ? এতো ঘন করেছো কেন ? গতমাসে দু’কিলো ছাতুর পরে আবার আনতে হয়েছিল। এমাসেও তাই হবে দেখছি। একটু কম করে দিয়ে পাতলা করতে পারো না ?
গিন্নিও উপস্থিত, উগ্রমূর্তি হয়ে, ” না গো, পারিনা, কিপটে বুড়ো।”
” ওই দেখো, আবার কিপটে বুড়ো বলে ! দু’পয়সা সাশ্রয় হলে , কার থাকবে শুনি ?” মোহিতবাবুর এই কথায় গিন্নি আরও ক্ষেপে আগুন।
একচুমুকে শরবতটা শেষ করে যখন গ্লাসটা নামায় মোহিতবাবু, তখন ঠোঁটের ওপর গোঁফশূন্য অংশটায় ছাতুর গোঁফ বানিয়ে ফেলেছেন। রাতে দুধ খেলেও, ঐ একই রকম দৃশ্য।
ফুলশয্যার রাতে তো দুধটা মুছতেই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। তখন অর্ধপরিচিতা নববধুর সে কী হাসি! যুবক মোহিত তখন বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝে উঠবার পর, বেশ লজ্জা পেয়েছিলেন। তারপর থেকে রমলাদেবী চুমুক দেওয়া শিখিয়ে দিলেও, সে অভ্যাস ছাড়তে পারেননি মোহিতবাবু। আর এতেই বিরক্তি থেকে ক্ষোভ এসে জন্মায় রমলার মনে।
সাশ্রয়ের কথায় আর এই দৃশ্যে, যেন আগুন ঝরতে থাকে রমলার চোখ ও মুখ থেকে। মুখ বেঁকিয়ে বলে, ” দেখো, দেখো, পাগলের কাণ্ড দেখো ! গোঁফশূন্য মাকাল ফলের মতো মুখটায় ছাতুর গোঁফ বানিয়ে কেমন সঙ সেজেছেন উনি ? ঠিক হনুমানের মতো দেখতে লাগছে। নাও, এখন ঐ বেল্টটা কোমরে না বেঁধে, পিছনে ঝুলিয়ে নাও। তাহলেই হনুমান সাজার সখ ষোলোকলা পূর্ণ হবে।”
গামছাটায় মোহিতবাবু মুখটা মুছে নিতেই আবার চিৎকার রমলার, ” আরে আরে, ধেঁড়ের কাণ্ড দেখো, ঐ ছাতু গামছায় লেগে গেল তো, শুকিয়ে শক্ত হয়ে শিরীষ কাগজ হয়ে থাকবে। পরে মুখ মুছতে গেলে গালের ছালটুকুও তুলে ফেলবে। তখন আর চিৎকার করোনা যেন।”
মোহিতবাবু বুঝতে পারেন, বুঝতে পারেন রমলা ঠিক কথাই বলেছে। তাই এবার কোন শব্দবান আর বেরোল না।
এবার মোজা পড়ার পালা। মোজা পড়ার পর – গেঞ্জি, জামা, প্যান্ট ও বেল্ট। কারণ, প্যান্ট পড়ার পর মোজা পড়তে গেলে, কোমর টাইট হয়ে যায়, কষ্ট হয় খুব। একবার তো প্যান্টের বোতাম আর হুঁক , দুটোই ছিঁড়ে গিয়েছিল পেটের চাপে। ভাগ্যিস আন্ডারপ্যান্ট পড়েছিল। তারওপর সেই সময়ে বিমলা, মানে ছোট বোন আর রজতাভ, বিমলার স্বামী সোফায় বসা। নতুন বিয়ের পর প্রথম ওরা আসাম থেকে এখানে ক’দিন থাকবে বলে এসেছে। বিমলার সাথে নাহয় ইয়ার্কির সম্পর্ক, কিন্তু রজতাভ তো এই ‘মাথা মোটা গণ্ডারটার ‘ হাবেভাবে অভ্যস্ত নয়।
ওরা তো তখন, হাসিতে সোফায় গড়াগড়ি। রমলার লজ্জায় মাথা কাটা যাক যেন।
যাই হোক, সবকিছু কার্যকলাপের পর অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো দৌড়তে দৌড়তে বিশ্ব জয় করতে বেরোলেন মোহিতবাবু।
উনি বেরোতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। নিশ্চয়ই কিছু ভুলে ফেলে গেছেন। দরজা খুলে দেখে, বিমলা আর রজতাভ, একটা মেডিক্যাল চেক আপ করতে এখানে এসেছে। খুব আনন্দ রমলার মনে। অনেকদিন বাদে বোনটাকে আবার কাছে পাওয়া গেল।
” তোরা বিশ্রাম নে, আমি মাংসটা বসিয়ে আসছি,” একথা বলে রমলা রান্নাঘরে চলেগেল।
আরও কিছুক্ষণ বাদেই, আবার কলিংবেলটা পাগলের মতো বেজে উঠল। মাংসটা কসানো শেষ হয়নি তখনো। কোন রকমে দৌড়ে এসে দরজাটা খোলে রমলা। দরজায় পাড়ার ছেলেদের দেখে, বিরক্ত হয়ে পড়েন।
“কিরে, এভাবে দমকলের মতো পাগলা ঘন্টা বাজাচ্ছিস কেন ? এখানে তো আগুন লাগেনি ?”
প্রত্যুত্তরে যা শুনলেন, রক্ত হিম হয়ে গেল। হৃদপিণ্ডটায় যেন পাড়ভাঙা জলোচ্ছ্বাসের মতো রক্তের চাপ অনুভব করলেন। মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না। টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, রজতাভ না ধরলে, বিপদ আরও বাড়তো।
বিমলা সব কথা শুনলেন ঠাণ্ডা ভাবে। রজতাভ তো ভ্যাবাচাকা খেয়ে, হাইপাওয়ারের চশমার ওপাশের চোখদুটো একেবারে রাজভোগ বানিয়ে ফেলেছে।
ঘটনাটা হল এইরকম, তাড়াহুড়ো করে রিক্সায় উঠতে গিয়ে মোহিতবাবুর প্যান্ট খোঁচা লেগে ছিঁড়ে যায়। রাগ তুঙ্গে ওঠে। মুখ দিয়ে আধা বাংলা, আধা হিন্দির খিচুড়ি বের হতে গিয়ে খিচুনি ওঠে। আর তাতেই রিক্সা ওপর কাৎ হয়ে পড়েন। জ্ঞানশূন্য মোহিতবাবুকে নিয়ে পাড়ার ছেলের একদল চোটে হাসপাতাল, আর এক দল এই বাড়িতে খবর দিতে।
হাঁউহাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে, মাংসটা নামিয়ে রেখে কোন রকমে পৌঁছায় হাসপাতালে। তখনও পুরোপুরি জ্ঞান ফেরেনি।
তবে ডাক্তাররা বললেন, ” আটচল্লিশ ঘন্টা না কাটলে কিছুই বলা যাবে না। মনে হচ্ছে, একটা মাইনর হার্ট এটাক্ট হয়েছে। তবে ঘোরের মধ্যেও রমলা, রমলা বলে ডেকেছিল।”
বিমলা তখন তার জামাইবাবুর জন্য হাঁউহাঁউ করে কাঁদছে। রমলার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে। এক ঘন কালো অন্ধকার বিভীষিকার আকার ধারণ করে ঘিরে ধরেছে তাকে।
বিগত দিনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আচরণগুলোতে প্রেমের যে এতটা আবেশ ছিল, এ কথা রমলা নিজেই বুঝতে উঠতে পারে নি। আজ এ সঙ্কট বুঝিয়ে দিয়েছে। একথা সত্যি, হারাবার কালে বা হারাবার পরে, মানুষের গুরুত্ব বোধের উদয় হয়। মূল্যবোধের অভাবের জন্য তখন আফশোস করে।
রমলা, তার ভিতরের এক মনকে দেখতে পাচ্ছে, যে অপরাধীর মতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, মোহিতবাবুর কেবিনের বাইরে। দেখতে পাচ্ছে, এক মর্মান্তিক শাস্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের গরাদগুলো। অনুভব করতে পারছে, একাকীত্বের দহন যন্ত্রণা।
” হা ঈশ্বর, আমার ভাবনাগুলো যেন সত্যি না হয়। এই যন্ত্রণা দুঃস্বপ্নের মতো মুছে যাক, জীবন থেকে। ওকে ফিরিয়ে দিও ঠাকুর আমার কাছে”।
এইরকম শঙ্কাময় সময় কীভাবে যে দু’দিন কাটিয়ে দিল !
ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল, রজতাভ। আসাবার সময় দেখা গেল, তার মুখে স্বস্তির হাসি।
আর তর সইল না রমলার। কিশোরী তন্বীর মতো ছুটে গেল কেবিনের দিকে। দরজা খুলতেই দেখল, মোহিতলালের মুখ, ফিকফিক করে হাসছে। এই হাসিই তো দেখতে চেয়েছিল, রমলা।
ততক্ষণে, মনের আকাশে সে শঙ্কার মেঘ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। দেখা দিয়েছে, আনন্দের রামধনু। দুঃখ, অভিমান, রাগ, আনন্দের মিশ্রিত রসায়নের বৃষ্টিটা হয়তো এখনই নামবে।
@সু

মন্তব্য করুন