Skip to content

২৯- অপ্রকাশিত স্তর – সুপ্রিয় ঘোষ

আপনমনে কুলকুল করে বয়ে চলেছে কোপাই। একদৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে আছে ভুবন। কোপাই নদীতে জল এখন কম। তবুও দেখে মনে হচ্ছে কতই না গভীর। ময়ূরাক্ষীর উপনদী। ওপর থেকে দেখলে অনেক সময়েই যেন ভ্রান্তিটাকেই সঠিক বলে মনেহয়।
অস্তিত্ব যখন সংশয়ে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে ভুবনের মতো মানুষেরা বোধহয় একাকীত্ব খোঁজে। তাই, এখানে মাঝেমধ্যেই চলে আসে ভুবন। নিজেকে খুঁজে পায় এই একাকীত্বের মধ্যে। বিশেষতঃ, যখন বাড়ির বিকারগ্রস্ত অভ্যাসের চোরাবালিতে মনেহয় তলিয়ে যাচ্ছে, ছুটে আসে নিজেকে আবিষ্কার করতে এখানে। বুঝতে পারে, তার বহিরবয়ব পীড়িত হলেও অন্তর্বৃত সত্তা এখনও মুছে যায়নি। গোটা মানুষটা এখনও মানুষই আছে।
আসলে, বড় স্পর্শকাতর এই ভালবাসা নামক অনুভূতিটা। জীবনের মর্মমূলে যদি থাকে ভালবাসা, তাহলে কোন রাতই আর ভিজে স্যাঁৎস্যাতে হতে পারেনা। অতীতের সেই রৌদ্রালোকিত পথ আজ যেন আত্মদহনের বিপ্রতীপ সংলগ্নতায় কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে।
অথচ, খুব বেশি দিনের কথা নয়। ফেলে আসা সেই দিনগুলিকে আজ খুব কাছেই মনেহয়। তখন, পৃথিবীটা যেন এতটা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েনি। নিবিড় স্বপ্ন আর প্রত্যয়ঘন প্রেম – সবকিছু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার দুর্মর উপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছন্দাকে সঙ্গী করে নিয়ে হাঁটা যাবে একই পথে – এই রসায়নের সমীকরণটি সমিত করে ফেলেছিল ভুবনের বিশ্বাস। আর তাতেই প্রেমের পরিণতিতে দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী হয়েছিল দু’জনে।
কিন্তু ছন্দার উচ্চাভিলাষ কখন যে চোরাস্রোত হয়ে ভাঙন ধরাচ্ছিল তাদের সম্পর্কের মাটিতে, ভুবন বুঝতে পারেনি। প্রথম প্রথম তো ভালই লাগত, গর্ব বোধ করত ভুবন। প্রশ্রয়ও দিয়েছে তাই। কিন্তু, ঐ উচ্চভিলাষের অনুষঙ্গ বিষাক্ত অনুভূতির অভ্যাসগুলি, কখন যে তাদের অন্তরাত্মার পাড় ভাঙতে শুরু করল ! আর তাতেই সম্পর্কের সেতুটি নড়বড়ে হয়ে উঠতেই টনক নড়ে ভুবনের। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে।
একপেশে একক প্রয়াস এই অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদকে রুখতে পারে কী ? পারেনা, কখনোই সম্ভব নয়। ভুবনও পারেনি। তবু কখনোই ছন্দার পাশ থেকে সরে যায়নি। ছন্দা তো তার সব, প্রেমিকা থেকে তার দুই ছেলের মা। কী করে ভুলে যাবে, সব দায়কে ? অবহেলায়, অপমানে বুক ভেঙে গেছে, কেটে গেছে বিনিদ্র কত রাত ! জানতে পারেনি কেউই। বিশেষতঃ ছন্দা তো নয়ই। তবুও….
পাড়ে বসেই ভুবন হঠাৎ উচ্চারণ করে ফেলল, কিংকর্তব্য মানুষের এক স্বীকারোক্তি, জীবনানন্দের ভাষায় –
… শুকায়েছে কালস্রোত, কর্দমে মিলে না পাদপীঠ
অতএব পরিত্রাণ নাই
যন্ত্রণাই
জীবনে একান্ত সত্য …..
উচ্চারণ করে নিজেই একবার হেসে ফেলে।
তবে, এখন যেন ছন্দার সেই দম্ভের পাহাড় ভাঙতে শুরু করেছে। বেশ ভাল টের পাচ্ছে ভুবন। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আনন্দে যতই দৌড়াও না কেন বাপু, হাঁপাতে তো হবেই একসময়। একটু দাঁড়িয়ে পড়তে হবেই। আর তখনই খেয়াল হবে, তুমি কতটা একা, নিঃসহায়, অসুরক্ষিত। তখন তাকাতেই হবে চারিদিকে, একবার অন্তত পিছনের দিকেও।
আর ভুবন, জনারণ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে সজাগ দৃষ্টি ঠিক রেখেছিল ছন্দার ওপর। না, না, সন্দেহের চোখে নয়, এক বাহুবলী প্রহরীর মতো। সে যে তারই প্রমিকা। সত্যিই সে ছন্দাকে ভালবাসে। তাই তো তার স্বাধীনতাতে সায় দিয়েছিল। নারীরা মেরুদণ্ডহীন লতিকা নয়, সুযোগ পেলে তারা মহীরূহ বৃক্ষও হতে পারে। দিতে পারে ছায়া, আশ্রয়, আর যাপনের সকল অনুপুঙ্খ।
কিন্তু, ভুবন ? সে কী পেল ? স্বতন্ত্র সত্তার ক্রমাগত ক্ষয় ? অবিবেকী স্তূপীকৃত যন্ত্রণা ? পুরুষরা যদি প্রাণ খুলে কাঁদতে পারত, তাহলে বোধহয় ভুবনও একটু হালকা হতে পারত। তবে, ভুলে থাকার ফর্মুলাটা তার একমাত্র বন্ধু বিধানের থেকে পাওয়ার পর, আজ সে টিঁকে আছে। টিঁকে আছে, প্রবাসী ছেলেদের জন্য, তার ছন্দার জন্য।
না হলে, ছন্দার গাড়ি এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে যায় ? সে যে ছন্দার স্বামী, রক্ষাকর্তা। বেশ বুঝতে পারে, ঐ হৃদয়ের এখন ভুবনের হৃদয়টাকেই প্রয়োজন। হাসপাতালে স্ট্রেচারে শোয়া অবচেতন মুখ যে তাকেই চাইছে। বন্ধু বিধানও পাশে ছিল সেদিন। তারপর চলল, যমে-মানুষে টানাটানি। তিনদিন ঘুমায়নি ভুবন, দু’চোখে তখন শুধু জল, ঘুম ধুয়ে গেছে।
বেডের পাশে, তৃতীয় দিনে, যখন চোখ মেলল ছন্দা, দেখতে পেল, চেয়ারে বসে বেডের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ভুবন। চোখের তলায় কালি জমেছে। কাঁপা হাতে ভুবনের মাথার ওপর হাত রাখতে রাখতে অনুভূত হল, এই মানুষটা একমাত্র তারই। তারই মঙ্গল কামনায় ছায়ার মতো ঘিরে রয়েছে তাকে। আর তাকে কতই না যন্ত্রণা পেতে হয়েছে তার জন্য। বাস্তবতার এই সংজ্ঞাটি এখন একমাত্র সত্যি বলে মনে হল ছন্দার। তার সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আজ যেন ভুবনের দায়িত্বজ্ঞানের সাথে পাল্লায় বড় তুচ্ছ, ক্ষীণজীবী হয়ে উঠল। দম্ভ যে কতটা ক্ষতি করে ফেলেছে তাদের সেতুটাকে বুঝতে পারল ছন্দা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ভুবনের, তড়িঘড়ি উঠে বসে ছন্দার চোখে চোখ পড়তেই, জয়ের হাসি ফুটে উঠল ভুবনের চোখে। কোন কিছু হারানোর ভয় দুর হয়ে গেলে, যেরকম আনন্দ ফুটে ওঠে চোখেমুখে, ঠিক সেই রকম, হয়ে উঠল। আনন্দও বৃষ্টি নামাতে পারে। ভুবনের চোখে নেমে এল বৃষ্টির ধারা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছন্দা। কখনো ভুবনকে কাঁদতে দেখেনি। বুদ্ধি ও হৃদয় যখন একসাথে একই কথা বলে, তখনই যাবতীয় প্রয়াস হয় সার্থক। নার্স আসতেই চোখটা মুছে ফেলে ভুবন। আর এক অভিষিক্ত পবিত্র চৈতন্যস্রোতে সিক্ত হতে লাগল ছন্দা। সাতদিনের মাথায় সেরে উঠতেই শালাকে ডেকে জোর করে পাঠিয়ে দেয় ভুবন, তাদের বাড়ি। এটা বোধহয়, তার জমে থাকা অভিমানের প্রথম প্রকাশ। সে কী বোঝাতে চাইল – ছন্দার কাছে সে শুধু প্রয়োজনের, প্রিয়জন নয় ?
এবার হয়তো ভুবনের পালা। বন্ধু বিধানের কথাও শোনেনি। চলে এসেছিল শান্তিনিকেতনে। আর এখন তারই স্মৃতিচারণায় একাকী, সময়কে সঙ্গী করে কোপাইয়ের নিরবচ্ছিন্ন বয়ে চলা দেখতে ব্যস্ত। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাতে মলম লাগাতে কিছুতেই দেবে না সে। কেউ পারবেনা তার সেই ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়কে ছুঁতে।
কিন্তু নিয়তির সেই অতি যত্নে বানানো প্রেমের কয়েনটার অন্যদিকের পিঠে তো ছন্দারই আকুতির ছবি ছাপানো আছে – কী করে জানবে ভুবন? এতদিন একটিই পিঠ দেখে এসেছে সে, যেখানে শুধুই ভুবনের যন্ত্রণার দহনচিহ্ন।
সামনের চায়ের দোকানের ছেলেটা এসে বলে, ‘বাবু, আপনের কাছে, কারা এয়েচেন? ডাকতেচে। পিছন ফিরে তাকায় ভুবন। একটা সাদা অ্যাম্বেসডার।
সামনের দরজা খুলে নেমে এল বিধান। তারপর, পিছনের দরজা খুলে নামাল, এক ছায়ামূর্তিকে। চশমাটা খুলে একবার মুছে নিল ভুবন। এ কাকে দেখছে ? ছন্দা ? ভেতরে আবার মেঘের গর্জন। বৃষ্টি এল বুঝি !
বিধান ইশারায় ডাকলেও দাঁড়িয়ে রইল পিছন ঘুরে। আসলে, চোখের জলটাকে লুকিয়ে বলে। পিছন থেকে এসে জাপটে ধরে, ছন্দার।
‘বিধানদা, আমার বাবুর অভিমান হয়েছে। এখন ঝগড়া ভুলে গেছে দেখ।’
ভুবন আর থাকতে পারলনা। জাপটে ধরে কাঁদতে থাকল হাউহাউ করে।
‘আমায় ক্ষমা করে দাও ভুবন। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার অ্যাক্সিডেন্টাই চোখ খুলে দিয়েছে। হ্যা, তোমার কথাই ঠিক। আমার উচ্চভিলাষ, আত্মঘাতী আবর্তের স্রোতে আমার সবটুকু কেড়ে নিয়েছিল, – জ্ঞান, বুদ্ধি, হৃদয়, প্রেম, সৌন্দর্য । তোমার দেওয়া স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছি প্রতিনিয়ত। সম্পর্কের মর্যাদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমায় ক্ষমা করে দাও। আর একফার সুযোগ দাও।’
ছন্দার শূন্যগর্ভ ফানুসটা একেবারেই চুপসে গেছে তখন। জীবনের স্রোতে তখন এক নব্য জোয়ার ঢেউ তুলেছে। হারিয়ে যাওয়া এক দুরন্ত আবেগে ভাসমান দুই নরনারীকে দেখে পরমবন্ধু বিধানের চোখেও তখন বিজয়ীর হাসি আর আনন্দাশ্রু।

******************************************
@সু

মন্তব্য করুন