Skip to content

২৮ – অপক্ষেমাণ আলো – সুপ্রিয় ঘোষ

সারা ছাদটায় বেলফুল আর কামিনীফুলের গন্ধে ভরে গিয়েছে। কী অদ্ভুত! গন্ধও কেমন অস্তিত্বের জানান দেয়। বর্ষা চলে গিয়েছে কবে, শরতের এই হিমেল প্রকৃতি এই সাদা ছোট্ট ফুলটাকে এখনও ছাড়েনি। শিউলি এসেছে, তবুও ওর ছুটি নেই। প্রকৃত ভালবাসা বুঝি এমনই হয় !
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল্পনা। কিন্তু অমরেন্দ্রকে তো ছেড়ে দিতে হয়েছিল ! জীবনের সবটুকু জুড়ে তো সেই ছিল। সেই যাবার দিনে, নিকিয়ে নিয়ে গেল তার সব রঙ,গন্ধ, রস । সবার মধ্যে থেকেও একা হয়ে গেল কল্পনা। তাকে তো কল্পনা প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসত। অপর্ণাকে ছাদে কাপড় মেলাতে আসতে দেখে, কল্পনা তাড়াতাড়ি চোখটা মুছে ফেলে। চোখ এড়ায়নি অপর্ণার।
আসলে কিছু মানুষের অন্তঃশায়ী তীক্ষ্ম বোধ, শব্দভেদী বাণের মতো ভেদ করতে পারে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য। শত অন্ধকারেও পৌঁছাতে পারে হৃদয়ের অভ্যন্তরে।
‘কী হল মা, চোখে জল কেন ? কী হয়েছে ?’ কাছে এগিয়ে আসে অপর্ণা।
আর এই একটা বউ হয়েছে, কোনকিছুই এড়াতে পারেনা তার কাছ থেকে। কোন রকমে চোখ জ্বালার অজুহাতে এড়িয়ে যায়। অপর্ণার মধ্যে যেন কল্পনা হুবহু নিজেকেই খুঁজে পায়। এটাই তার জীবনের বিশাল প্রাপ্তি। যেদিন থেকে ছেলের বউ হয়ে এ বাড়িতে এলো, ওর সান্নিধ্যে কোনদিন একলা মনে হয়নি কল্পনার। অরিন্দমের শিলিগুড়িতে ট্রান্সফার হওয়ার দিনেও ও যায়নি শিলিগুড়িতে।
কারণ, তো আছেই। নতুন বিয়ে। তার ওপর যদি, …প্রিয়া কি নজরিয়া জাঁদুভরি.. হয়। কিন্তু তার সংযত শালিনী বউয়ের মনোভাব তা নয়। অরিন্দম অবাক হলেও, তার রুচিশীলা গৃহিনীর কথায় মনে মনে ভীষণ খুশিও হয়েছিল।
বলেছিল, ‘তুমি ওখানে গিয়ে সেটেল্ড হও। একটা বাড়ি ভাড়া নাও। তখন, আমি-মা ওখানে গিয়ে থাকব। কল্পনা বাঁধা দিতে গেলে, অপর্ণা শোনেনা।
বলে, মা, তোমার ছেলে এর আগে পড়াশোনার জন্য, ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য, বাইরে কাটিয়েছে। এমনকি দেশের বাইরেও। ও কয়েকটা সপ্তাহ কাটাতে পারবে। তুমি কেন চিন্তা করছ?’
অরিন্দমের ইচ্ছা না থাকলেও, অপর্ণার অভিব্যক্তির কাছে হার মেনেছে তার ইচ্ছা।
আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল, অরিন্দম শিলিগুড়িতে ট্রান্সফার হয়েছে। আপাতত, এক কলিগের বাড়িতে আছে ও। অফিস থেকে একটা বাংলো পাওয়ার কথা শুনছে। তবে সেবক রোড থেকে একটু ভেতরে।
মাকে চা দিতে এসে অপর্ণা বলে, ‘মা, তোমার ছেলে ফোন করেছে, নাও কথা বল। এই তোমার চা রইল। বলে চলে গেল’।
‘ হ্যাঁ, বল্ রাজা, তোর শরীর ঠিক আছে তো ?’
ওপারের গলা মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, হ্যাঁ মা, আমি ঠিক আছি। শোন, আগামী সপ্তাহে, আমি তোমাদের ওখানে ফিরছি। কিন্তু তিন দিনের জন্য..’
কথার মধ্যেই কল্পনা বলে ওঠে,’ মাত্র তিনদিন ?..’
‘হ্যাঁ, শনি-রবি দু’দিন এমনিতেই ছুটি আর সোমবার দিনটা একটা ছুটি নিয়েছি। অপু কই, ওকে বল, সব জামাকাপড় গুছিয়ে রাখতে। শীতের পোশাক নিতে বোলো, এখানে ঠাণ্ডা পড়ছে। আমার আরও কিছু জামাকাপড় লাগবে । শনিবার সকালে পৌঁছাব, আর রবিবার রাতে ট্রেনে উঠব।’
খুশিতে ঝলমল করে উঠল, কল্পনার মুখ, দাঁড়া রাজা, বউমাকে ডাকি। এই অপু, অপুরে। ও বউমা, একবার ছাদে এস, তাড়তাড়ি।
ছুটে এসে হাঁপাতে থাকে, মায়ের হাসি দেখে ওর উদ্বিগ্নতা কেটে যায়। ‘ কী হয়েছে মা? তুমি এমনভাবে চিৎকার করলে না, আমি কোনক্রমে ফ্রাইংপ্যানটা নামিয়েই দৌড়ে এসেছি।’
হাত বাড়িয়ে ফোনটা দিয়ে বলে, ‘রাজা কী বলছে দেখ।’
ফোনটা কানে দিতেই বেরিয়ে এল, ‘ তাই,..?’
শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,’ মা নীচে এস, গরম গরম লুচি ভাজছি, খেতে এস।’
নীচে নামতে নামতে, কল্পনার কানে এল অপর্ণার স্বর, ‘ অসভ্য কোথাকার। তুমি কিল খাবে কিন্তু ! কেন, আসছ তো ? তর সইছে না বুঝি?’
মুচকি হেঁসে আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে একতলায় নামতে থাকে কল্পনা।
কিন্তু রোজনামচা সবসময় এক হয়না। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া জীবনের সাথে সাথে সময়েরও চরিত্র যে এক। ওরা থামতে দেয়না, বিস্তীর্ণ দু’পাড় ভাসিয়ে, কখনো ভেঙে, কখনো গড়ে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সংসারের ঢালে গড়াতে গড়াতে মোহনার দিকে গন্তব্য হলেও মাঝের ঠোক্করগুলো কতই না রক্তাক্ত করে দেয়। যেমন রক্তপাত ঘটেছিল অপর্ণারও।
শিলিগুড়িতে সুদৃশ্য বাংলোতে অসাধারণ পাহাড়ি পরিবেশে হঠাৎই ভুলে যাওয়া স্মৃতির কোলাহল থেকে বেড়িয়ে আসে প্রণবেশ, বর্তমানে অরিন্দমের কলিগ।
বাগানের লনে বাহাদুরকে নিয়ে চা দিতে এসেই থমকে গিয়েছিল, অপর্ণা। এ কে, কাকে দেখছে সে ?
তার জীবনের টার্মিনাল পয়েন্টে হারিয়ে যাওয়া সেই ঘৃণিত মুখটি ?
যে মুখ, তার সারল্যের দুর্বলতার সুযোগে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল তার ফুলেল দলমণ্ডলকে, একদিন। সেই পাষণ্ডের সাথে আবার মুখোমুখি হতে হবে- একথা ভাবতে পারেনি অপর্ণা।
কোন রকমে সৌজন্যের হাসি হেসে পরিচয় পর্ব সেরে ফিরে এসেছিল সে। পরে আর মুখোমুখি আর হয়নি সেদিন। অপর্ণার এই আপাত অস্থিরতার অভিব্যক্তি, কল্পনার চোখ এড়ায়নি।
তারপর থেকে অপর্ণার আকাশ আর তেমন স্বচ্ছ দেখা যেত না। শরীরী বিগ্রহেও মৌনতার কালো মেঘ, অন্যমনস্কতার বাতাবরণ। বড়ো অচেনা হয়ে উঠছিল অপু। কেমন জানি কল্পনাও বড়ো একা হয়ে উঠছিল।
একদিন, চেপে ধরল কল্পনা। অভিজ্ঞ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল অপর্ণাকে, ছেলের বৌ হিসেবে নয়, মেয়ে হিসেবে। তার দার্শনিক সূক্ষ্মবোধের কাছে অপর্ণা সত্যিই শিশু। ভেঙে পড়ল সে।
শাশুড়িমাকে সমস্ত নিগ্রহের লজ্জাজনক সব ঘটনা জানাল, কীভাবে তার শরীর লুণ্ঠন করা হয়েছিল প্রতারণার সাহায্যে, কীভাবে আত্মলীন গ্লানি এগিয়ে দিয়েছিল তাকে আত্মহননের পথে।
কল্পনা সেদিন জানাল যে সে সব জানে। তার মা তাকে সবিস্তারে সব জানিয়েছিল বিয়ের আগেই। সে কথা শুধু অপর্ণার মা আর কল্পনাই জানে। না ওরা অরিন্দমদের একদমই ঠকায়নি।
এ ঘটনা সবাই দুঃস্বপ্নের মতোই ভুলে গেছে। শুধু অরিন্দম জানেনা। শাশুড়ির মতে, ওকে জানানোর প্রয়োজনও নেই। তবে ঐ প্রণবেশ প্রথম আশার দিনটিতেই কল্পনার যে খটকা লেগেছিল – একথা বলতেও ভোলেনি কল্পনা।
পরম স্নেহে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলতে থাকে, ‘ আমার এমন ফুলের মতো মেয়ের কোন দোষ থাকতে পারে, আমি কোনদিনই বিশ্বাস করিনা, করবও না। তুমি নিশ্চিন্তে থাক। সরিয়ে দাও তোমার মেঘ।’
শাশুড়িমায়ের বুকে মুখ ঢুকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে অপর্ণা। আর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কল্পনা অপেক্ষা করে অপর্ণার মনের কালিমা ধুয়ে মুছে, স্বচ্ছ আকাশ দেখার জন্য।
ততক্ষণ না হয় কাঁদুক অপর্ণা।
卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐
@সু

মন্তব্য করুন