Skip to content

২৭ – অপভ্রংশ সত্ত্বাধিকার – সুপ্রিয় ঘোষ

মোহনের চায়ের দোকানটা এখন একটু বেশিই ভিড় থাকে। যাদবপুর থানার লাগোয়া ফুটপাথ ধরে কিছুটা এগোলেই, বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের জন্য ছাউনিটার লাগোয়া দোকানটি। বহুপুরনো।
যাদবপুর কলেজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে একটু চায়ের আড্ডা সেরে, তারপর বাড়ির পথ।
গাড়ি থাকলেও, প্রফেসর চৌধুরি, মানে তপন চৌধুরি, বাসেই বাড়ি ফেরেন।
আসলে, গরিবের লড়াইটাতেই তিনি অভ্যস্ত। অভাবের এই আগুনটাকে তিনি সবসময় আগলে রাখেন বুকের কাছে। মায়ের ওমের স্পর্শ পান কখনো, আবার কখনো পান বাবার ঘামের গন্ধ।
মোহনের ছেলেটা এক আকাশ হাসি হেসে চা নিয়ে আসে, ‘স্যার, এখানে বসুন’। একটা টুল এগিয়ে দেয়।
মোহনের এই ছেলেটা, সৌরভ, তপনের এক অভাবনীয় আবিষ্কার, ঠিক তাঁর চমকদার থিসিসের মতোই।
ক্লাশ টেনে পড়ে তখন। এখানে এই লাইটপোস্টের আলোতেই পড়ছিল। সেই মহামানবের আদর্শের ছায়াটি যেন নড়েচড়ে উঠেছিল সৌরভের ফুটাপাতে পড়া ছায়ার সাথে। আসলে প্রয়োজন তো নিয়ম মানেনা কখনো।

তারপর, মাধ্যমিকে সাতটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেটের যন্ত্রণার দাগগুলোকে কিছুটা হলেও মুছে দিতে পেরেছিল। সেদিন মোহনের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু আর মুখে ছিল কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য।
তারপর যোধপুর বয়েজ এবং সেখান থেকে যাদবপুর কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরে স্বর্ণপদক প্রাপ্তি। এই নব্য কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের, না-না, সৌরভের সারথি ছিল তপন ও তার ছোটবেলার বন্ধু অরুণ। তপন আর অরুণের আভাতেই সুরভিত সৌরভে ভরে গেছে চারিদিক। অসাধারণ অমায়িক বাস্তব চেতনাধারী ছেলেটি মাটির সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে, থাকে বাবার পাশেই। এভাবেই স্বপ্নের উড়ানে চেপে, পেরোচ্ছে এক একটি করে অগ্রগতির মাইল ফলক।
ভাবতে ভাবতে, চায়ের কাউন্টারে রাখা একটা কাগজের দিকে চোখ গেল তপনের। সুন্দরের সাথে আকর্ষণের সম্পর্ক তো চিরকালের। উঠে দাঁড়িয়ে কাগজটা হতে তুলে নেয় তপন।
হাতের লেখাটা খুবই চেনা। হ্যাঁ ঠিকই তো ! এ হাতের লেখা তারই। কিন্তু এখানে …..
মন দিয়ে পড়তে লাগল লেখাটি। একটি চিঠির অংশ বিশেষ। পড়তে পড়তে ঘামে ভিজে উঠছে পিঠ। এটাই ছিল তপনের শেষ চিঠি, সীমাকে লেখা।
পুরোটা নেই, চিঠিটির অংশ বিশেষ….
…. কেন ফিরিয়ে দিলে, জানিনা। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, সেদিনকার অপমানের আঁচড়গুলো তোমার নিজের নয়। কার বা কেন-র এ প্রশ্ন আর করবনা। চেতনার বীজে যখন প্রতিশ্রুতির ভ্রুণটিই বিশ্বাসের অভাবে মারা গেছে, সেখানে অহেতুক আস্থার জল সিঞ্চন করার কি কোন প্রয়োজন আছে ? প্রেমের কৌমুদিতে নাহয় শব্দরূপ, বিচ্ছেদের ধাতব শব্দ হয়েই থাক। বাজুক ছুটির ঘন্টা তাতে…..
চশমাটা ঝাপসা হতেই লুকিয়ে চোখটা মুছে নেয়।
মোহন এগিয়ে আসে। তপনকে বলে, ‘জানেন স্যার,
এটা আমার বৌয়ের ঝাঁপি ঘাঁটা চিহ্ন। এ নিয়ে আর কী করব আমি ?
ওকে তুলে এনেছিলাম বাঘাযতীন রেললাইনের ধার থেকে, প্রায় অচৈতন্য তখন। ওকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে দৌড়ালাম। ভর্তি করার সময়ে আমাকেই স্বামী হতে হল।
যমে মানুষে লড়াইতে জিতে, ফুটফুটে ছেলে কোলে ফিরে এলো আমার ঘরে। কিন্তু মাত্র এক মাসের অতিথি হয়ে। রক্তের পরীক্ষায় ধরা পড়েছিল কর্কট রোগ। এক মাসের ছেলের দায়িত্ব দিয়ে হারিয়ে গেল সে। তাকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পাইনি এ ছেলে কার। চেষ্টাও করিনি কোনদিন।
তার ঐ স্মৃতি চিহ্ন তাকে কষ্ট দিত বলে সরিয়ে রেখেছিল এতদিন। একটা ঘর বাড়াবো বলে পরিস্কার করতে গিয়ে এগুলো পেলাম। পড়লাম। জানলাম। যাকে সে ভালোবাসত, নিজের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর, মিথ্যা অভিনয়ে তাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে, পাছে সে কষ্টপায়। শেষ দিনগুলিতে প্রায় সবকটি কথা জানতে পারি। যাবার বেলায় দিয়ে গেল তার প্রেমের পবিত্র ফসল, একরত্তি ছেলের দায়িত্ব।
সেই সৌরভ আজ, বাবা বলে ডাকলে, গর্বে আমার বুক ভরে যায়।’
তপনের কাছে আজ, সব ছবি একসাথে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঘটনার অপভ্রংশে মনের ভূমিগর্ভে মৈথিলি পাথরের রং কেমন যেন অদ্ভূত বেরঙা আজ। যে পদাবলী সে মেয়ে রচনা করে গেছে, তাতে কোথাও প্রকটিত নয় তপনের দীপ্ত আলো, শুধু প্রচ্ছন্নের কামনারা এঁকে রেখেছে এক অভাবনীয় সৃষ্টির কুসুমকে, তার সৌরভে আজ মুগ্ধ সবাই।
শুধু তপনের বুক জুড়ে হাহাকার। সৌরভকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে জনসমক্ষে জানাতে ইচ্ছে করছে চিরযুবক তপনের, ‘ ওরে আমিই তোর হতভাগ্য বাবা……’

@সু

মন্তব্য করুন