Skip to content

২৬ – অন্বেষণ – সুপ্রিয় ঘোষ

রবিবার। ছুটির দিনটিতেও ব্যস্ততার শেষ নেই অনিমেষের। সকাল থেকেই ক্লাবের অনুষ্ঠান শুরু। আগাগোড়া পরিচালনার ভার অনির।

আজ নজরুল জন্মবার্ষিকীতে নানারকম পরিকল্পনা আছে ক্লাবের। সরকার ও স্বাস্থ্য দপ্তরের নানা রকম বিধি রক্ষা করেই সকাল থেকে চলবে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ।রক্তদান শিবির।

খাদ্য বলতে, শুকনো খাবার। চাল, আটা, চিনি, তেল ডাল, আলু, কিছু সব্জি, মশলা গড়ে পরিবার পিছু পনেরো দিনের আপাততঃযোগান। কর্মশূণ্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা। তারপর, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরন। সকল খরচের ভার একা অনির ওপর।

আজ মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী । চিরাচরিত প্রথার বাইরে থেকে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যেই এই পরিকল্পনা। আত্মীয় স্বজনের ভুঁড়িভোঝ আর ব্রাহ্মণ পরিতুষ্ট করাতে তার ঘোরতর আপত্তি। তাই সেই খরচে এই পরিষেবার উদ্যোগ । লকডাউনের পরিস্থিতির পর নিঃস্বার্থভাবে কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নিরলস প্রচেষ্টা।

সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ আজীবনকাল কাল ধরে শুধু নিন্দনীয় সমালোচনাই করে এসেছে। এখানেও তার অন্যথা হয়নি।

‘এতো টাকা কোথা থেকে এলো?’

‘নিশ্চয়ই দু’নম্বরি কাজ কারবার করে।’

‘মালটার তো আর কেউ নেই, বাপের বা মায়ের জমানো টাকায় ফুটানি মারছে।’
……. ইত্যাদি আরও কত কী।

এই সব কথায় এখন অনির কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। শুধু একমাত্র ধ্যান জ্ঞান, কীভাবে পুরো অনুষ্ঠানটা সাফল্যমণ্ডিত করা যায়।

মাইকে বাজছে, কাজী সব্যসাচীর দরাজ গলায় আবৃত্তি –

‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ,
চায় দুটোভাত একটু নুন
……… কচি পেটে তার জ্বলে আগুন……….’

জানা নেই, সে আগুন কিছুটা হলেও নিভবে কিনা!
নাকি সে আগুন তার লেলিহান শিখা বাড়াবে কিনা- তাও জানা নেই। তবে এইটুকু আশা, দিন পনেরো তো নিশ্চিন্ত হবে তাঁরা। পরম তৃপ্তির মুখগুলো ভেসে ওঠে যেন অনির চোখের সামনে।

এদিকে ধীরে ধীরে লোক জমতে শুরু করেছে। তাঁদের নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে নির্ধারিত আসনে বসতে বলা হয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই স্থান সসম্মানে অধিগ্রহণ করানো হচ্ছে।

করিমভাই একজন প্রবীণ সদস্য। তিনি বয়সে বড়ো হলেও যথেষ্ট সমীহ করেন অনিকে, আবার স্নেহও করেন। তিনি একবার মিটিংয়ে বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমকে খবর দিলে হতো না?
সঙ্গে সঙ্গে অনি তার অমত জানিয়েছিল, কেন কাকা, আমি যদি আমার ঘরের মানুষকে আদর আপ্যায়ন করি, সংবাদমাধ্যম সেখানে কি প্রয়োজন ? আমি তো প্রচার করবার জন্য কিছু করছিনা । অভাব অনেক মানুষকে হীনমন্যতা এনে দেয়। আমি এটা চাই না। আমাদের ক্লাবের প্রত্যেক সদস্য আমার সাথে নিশ্চয়ই সহমত প্রকাশ করবেন।
কি ঠিক বললাম কি, সন্দীপন ? রাজু? বিথী ? তোমরা কিছু বল, অনি জিজ্ঞাসা করল।
সবাই তার সাথে একমত।
তাই সংবাদমাধ্যম বন্দ্ধ হল।

করিম কাকা, অসীম কাকা, নিলীমাদি, রহমত চাচা সবাই এক এক করে বক্তব্য রাখলেন। করিম কাকার অনুরোধে অনিকে বক্তব্য রাখতে হলো –

দেখুন আমি সুচারু বক্তা নই। তাই আমার ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। আর আজ বক্তব্য রাখা বা শোনার দিন নয়। আজ একদিকে বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন, আবার গতবছর ঠিক এই দিনটিতে আমার শ্রদ্ধেয়া মা আমাকে একলা করে স্বরগুলোকে চলে গিয়েছেন। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অনুপ্রেরণায়, তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা পরিপূর্ণতা দেওয়ার একটা চেষ্টা করেছি মাত্র। এখানে উপস্থিত যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনো না কোনো সূত্র ধরে আমার একান্ত আপনজন। তাই কখনোই ভাববেন না, কোনো বড়ো কিছু কাজ হচ্ছে। এই কাজে আমাদের ক্লাবের প্রত্যেক সদস্যের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এনারা সকলে আমার পাশে না থাকলে , এই কাজে এগোনো সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে যদি কোনো ভূল ত্রুটি থেকে যায়, বাড়ির ছেলের মতোই দাবি নিয়ে আমায় নির্দ্বিধায় জানবেন। নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করে নেব।
এখন ক্লাবের সদস্যরা প্রথমে আপনাদের কে সাহায্য করবেন হাত পা খুব ভালোভাবে ধুয়ে ফেলার জন্য। তারপর শুরু হবে বিতরন। বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আপনারা কিছু খেয়ে নেবেন, অল্প কিছু টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তারপর আপনাদের কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে ও সেই মতো ঔষধের বিলি ব্যবস্থা আছে। দুপুর বেলা খাবার খেয়ে তবে যে যার বাড়ী যাবেন।
আশীর্বাদ করুন এমনভাবে যেন পরবর্তী ইচ্ছেগুলোও যেন সফলতা পায়। নমস্কার।

বেশ কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চোখের জল মুছতে মুছতে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করতে থাকল।

বাতাসে ভাসছে-

‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়……’

সব ঠিকঠাকই চলছিল।
হঠাৎ চিৎকারে, ‘গেল গেল’রব।

রাস্তায় সবাই দৌড়ে গেল। অনিও দৌড়ে গেল। কিন্তু দৃশ্য দেখে আর্তনাদ করে উঠল, তারপর অনিও গোঙাতে লাগলো।

মর্মান্তিক দৃশ্যতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একটি শিশু, তিন কি চার বছর বয়সী। পরনের কাপড় নেই বললেই চলে। কোমরের ওপর দিয়ে গাড়ীটা ……

হাত দুটোর মুঠিতে চাল তখনো ধরা। রক্তে চার পাশ ভেসে গিয়েছে। একটি অঙ্কুরের বিনষ্ট হওয়ার মর্মান্তিক দৃশ্য।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক জীর্ণ শরীর মহিলা পাগলের মতো ছুটে এসে আছড়ে পড়ল ।

‘মনুরে, ও মনু তুই কোথায় গেলি? কত ডাকলাম তোকে, তুই শুনলি নে। চাল আনতিছি মা, তুই আর আমি আজ ভাত খাব। কেলাবে চাল আর খাবার দিতিছে মা। তোর তো শরীল খারাপ মা, আমি নে আসতিছি। ই কতা বলিই ছুইট্টে চলি এল- শেষ খাবার খেতি। তুই তো মুক্তি পেলি রে। আমি এখন কি করপো বল্ দিকিনি ?’

জ্ঞান ফিরতেই অনির খেয়াল হলো, সে হাসপাতালে শুয়ে। তখনও পুরো সার আসেনি।
তবু যেন কানে ভেসে আসছে,

……..ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ
চায় দুটোভাত একটু নুন ………..’ ।

@সু

মন্তব্য করুন