তখন পাখিরা জেগে উঠছে। দু’একটা ডাক তাই বলে। সুন্দরবনের পুবাকাশ তখনো কালো অন্ধকার। তারওপর সুন্দরী, গড়ানের ভিড়ে আলো ঢুকবার উপায় নেই। এ যেন এখনকার নির্ভীক সাহসী মানুষগুলোর ভাগ্যের মতো। সর্বদাই ছেয়ে প্রতিবন্ধকতার অন্ধকার । ম্যানগ্রোভের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে যে নদী, সেও যেন মাঝে মাঝে উপহাসে মেতে ওঠে।
মনা এসে ডাক দেয়, ও রহমতভাই, কনে আছো ? বেলা বাড়ি গেলে সমস্যা হবেনে। খাজুরদানা যাতি হবে তো ? সে মেলা দূর তো ভাই।
রহমত কোমড়ে লুঙ্গিটা বাঁধতে বাঁধতে বেড়িয়ে আসে।
‘আর বলোনে, মেয়েডা আইজ বড়ো নকাচি করতেসে। কিচুতিই ছাড়েনে। বেজায় বাঁধা দেচ্চে। ‘ বলতে বলতে ভাত-লঙ্কা-নুনের পোঁটলাটা ভালো করে গামছায় বেঁধে নিল।
পুতুল দৌড়ে এসে আবার তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরল। মা মরা মেয়ে, তার আটবছরের জীবনে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে, এই আব্বা আর নানী ছাড়া যে তার দুনিয়ায় আর কেউ নেই। তাই যতো আবদার আব্বার সাথে, সেই-ই তো একাধারে তার আব্বা ও আম্মু। আশয় ও আশ্রয়ের কেন্দ্রস্থল।
অনেক বুঝিয়ে আদর করে, বনবিবির কাছে দোয়া মেগে বেড়িয়ে পড়ল ওরা।
আব্বাস, রহিম চাচা, কুদ্দুস, মিলনভাই, মনা ও রহমত- এই ছ’জন, দু’টি ডিঙি নিয়ে চলল মধু আহরণে।
বর্তমান যখন অভাবের ঘোরে আক্রান্ত, পরিবেশের সৌন্দর্যকে উপভোগ করার অবসর তাদের কোথায়?
অথচ প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার ঘন কালো এলো চুল বেঁধে, অন্ধকারের বুক চিরে আলোর রোশনাই নিয়ে প্রকাশমান হচ্ছেন। তখনকার নদীর বুক আঁচড়ানো দাঁড়ের এই ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বোধহয়, প্রকৃতিরও ভালো লাগে আর নদী তখন থাকে তার অবাধ্য, দুরন্ত, সাহসী সন্তানদের দৌড়াত্যে মগ্ন ও শান্ত।
বুনো হাঁস, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, চিল, শকুন, কাক, চড়াইদের সঙ্গী করে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে আরও অজানা পাখিরা। তবে, এ ডাক রহমতদের কোন উন্মাদনার সৃষ্টি করেনা। এ ভ্রমণ তো তাদের সৌন্দর্য উপভোগের নয়। পেটের টানকে গুরুত্ব দিতে, পানির ভয়ঙ্করতম কুমির, কামোটের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে, বনের দক্ষিণারায়ের হিংস্রতাকে সমঝে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা।
তাই তারা উদাসীন জঙ্গলের অন্যান্য প্রাণীদের থেকেও। শুধু একমাত্র নজর, কীভাবে ওই হিংস্র থাবার আড়ালে থাকা যায়। কীভাবে জীবনকে বাঁচিয়ে আর কতগুলি জীবনকে নাতিশয্যের আনন্দে বাঁচানো যায়।
এখন ভোরের জোয়ারও ঐ মানুষগুলির সহায় হলো। প্রকৃতি তো এভাবেই তার বাধ্য সংবেদনশীল সন্তানের পাশেই থাকে।
খাজুরদানায় পৌঁছাতে তাদের তাই বেশি কষ্ট করতে হলো না। পূর্বনির্দিষ্ট পাড়ে গাছের সাথে বাঁধা হলো ডিঙি দুটোর দড়ি।
পাড়ে উঠে, চারিদিক ভালো করে দেখে, সেদিনের দলের বলিষ্ঠতম দামাল মানুষ, রহমত বিড়ি ধরিয়ে দিল এক সুখটান। তখনও সে জানত না, এই সুখ ও তার মেয়ের জন্য স্বপ্নালু বালির পাহাড়টার স্থায়িত্বকাল কতক্ষণের। নিয়তি তো এইভাবেই অপেক্ষা করে থাকে, মানুষের অসচেতনতায় বলি দিতে।
বনদপ্তরের কাছে দেওয়া আব্বাসের তথ্য অনুযায়ী, সার, আমরা সজাগই ছিলাম। তিনজন মৌচাকের দিকি নজর দিসিলাম আর বাকিরা তাঁর দিকি, ঝাঁপায়ে পড়ার আগে দু’খান করি দিতি।
তিনডা বড়ো মৌচাক কাঁধে নে এক খাল পাড় হইয়ে আগের গোলা পইন্ত চলি গেইসিলাম, রহমত সিলো মাঝে। তখন সুয্যি মাথার উপর। ওই মাঝখানেতেই ওরে ধরিছে। আমরা ঝাঁপানোর আগেই ঘাড়ে কামড় দে তিড়িং কইরে লাফ দে নিই গেসে।
একথা বলেই হাঁউমাউ করে কাঁদতে থাকে আব্বাস, বাড়িডাতে অর মাইয়ডারে কী জবাব দেব বলেন দেহি ? ভাইহারা হয়ে কীভাবে বাড়ি যাবো, কন আপনে ? এখন মনে হতিছে, মাইয়াডার মনে বোধহয় ডাক দিছিল। তাই অমন বায়না ধরিছিল। হায় আল্লা, অর দোষ কী আছে ? অহন কী হবেনে ?
রহিম চাচা এসে জড়িয়ে ধরে আব্বাসকে, থামানো যায় না তার কান্নার রোল।
কাঁদতে কাঁদতে কুদ্দুস বলে, তারপর ওর খোঁজ করতি অনেক দুর গিসিলাম, বন্দ বাঁদার ভিতর। তবে বেলা থাইলে সমস্যা হতোনা। আর সে সময়ে জোয়ার উঠি গেছে। বনের পথে এই পানিই সমস্যা। পানি উঠলি তো আর কড় ( পায়ের ছাপ) দেহা যায়না। ওদিকি রাত্তির হইয়ে গেছে, আমাদেরও তো পরাণের ডর আছে। রাত্তিরে বাতি পেলি কোন অসুবধা হতো না। তাই ফিরি গিসিলাম।
সবাই ফিরে আসে। কিন্তু পুতুলের আব্বা, সে কই ? পুতুলের উদ্বিগ্ন চোখ খুঁজে চলে, তার পরম শান্তির আশ্রয়ের সেই মুখটিকে।
@ সু