Skip to content

হেলা ও অবহেলার বেলা – কবি সুভাষ চন্দ্র দাস

শিরোনাম : হেলা ও অবহেলার বেলা
কলমে : সুভাষ চন্দ্র দাস

জোটন আর জুই এর বিয়ে হয়েছে আনুমানিক তেরো বছর হলো। তাদের দুই ছেলে। দেখতে খুবই সুন্দর তাদের সংসার।

একদিন সকালে জোটন হাত মুখ ধূয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে তো মুখ মুছতেছিলো। হঠাৎ করে জুই হাসি মুখে পেছন থেকে এসে তাকে কোমলভাবে জড়িয়ে ধরলো। জোটন জানে এটা করতে জুই খুব ভালোবাসে। বিয়ের প্রথম দিকে জুই এটা প্রায়ই করতো। তখন তাদের বয়স কম ছিলো। বাচ্চা কাচ্চা ছিলো না। তখন ওসব মানাতো। কিন্তু এখন এই বয়সে কি এসব মানায়?

জোটন বিরক্ত হয়ে বললো,”দুই সন্তানের মা হয়েছো। এখন এসব না করলে হয় না? সব কিছুর একটা বয়স আছে। ভুলে যাও কেনো?”
জুই হাসি মুখ মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেলো। সে জোটনকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। এবং কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে বিষণ্ণ মনে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।

অন্যদিন এক ছুটির দুপুরে জুই গোসল সেরে চুলে গুঁজলো তাজা ফুল। জুই তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা ছিলো। আর জোটন বিছানার ওপর আধ শোয়া হয়ে ছিলো। সে মোবাইলে কী যেনো দেখছিলো। জুই চুলে ফুল দিয়েছে এটা জোটনের চোখেই পড়লো না। একবার আনমনে তাকিয়েছিলো জুই এর দিকে, পরক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়ে মোবাইলে মগ্ন হয়ে গেলো।
জুই বললো,”চুলে ফুল দেয়া তুমি খুব ভালোবাসতে।”
জোটন কোনো কথা না বলে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো। জুই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

আরেকদিন রাতে ঘুমানোর সময় জুই খুব আগ্রহ নিয়ে জোটনকল বললো,”শোনো আজ কী হয়েছে? সকালে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে গিয়েছি। সেখানে আচমকা দেখা আমার স্কুল জীবনের এক বান্ধবীর সাথে। ও আমার ভীষণ কাছের বান্ধবী ছিলো। স্কুল পাশ করার পর ওর সাথে আর যোগাযোগ হয় নি। ওর বাবা বদলি হয়ে অন্য এক জেলায় চলে গিয়েছিলো। ওদের পুরো পরিবারও সেখানে চলে গিয়েছিলো। আজ এতোটা বছর পর আবার দেখা হলো। কী যে ভালো লাগলো! ও ওর বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। এখন থেকে ওর সাথে নিয়মিত দেখা হবে ভাবতেই আনন্দ লাগছে। তারপর এক দারুণ কাণ্ড হলো…”
এই পর্যায়ে জোটন জুইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”এতো কথা বলো কেনো? কম কথা বলার অভ্যাস করো। তোমার কাহিনী শোনার সময় নেই আমার। ঘুমাতে দাও। সকালে অফিস আছে।”
এই বলে সে পাশ ফিরে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো।
আর জুই খোলা চোখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সিলিং এর দিকে। তারপর অজান্তে তার চোখ দুটো ভিজে উঠলো।

এভাবে পেরুতে লাগলো তাদের দিন।

এরপর একদিন দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে বসে জোটন লাঞ্চ করছিলো। পাশের টেবিলে বসেছিলো দুই যুবক। তাদের একজন সুদর্শন।
সুদর্শন যুবকটি অন্য যুবকটিকে বললো,”মহিলার তিনটা সন্তান। বিয়ে হয়েছে চৌদ্দ বছর হলো। ওর সাথে আমার গোপন সম্পর্ক হয়ে গেলো।”
এই কথা জোটনের কানে যাওয়ার সাথে সাথে সে চমকে উঠলো। এবং কান খাড়া করে সে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলো।

অন্য যুবকটি তখন বললো,”মহিলার স্বামী কি প্রবাসী?”
“না। দেশেই থাকে।”
“মহিলা কি স্বামীর থেকে আলাদা থাকে?”
“না। ওরা এক সাথেই থাকে।”
“এক সাথে থাকলে তোর সঙ্গে সম্পর্ক করার ইচ্ছে মহিলার কেনো হলো? তুই দেখতে সুদর্শন। মহিলার তোর প্রতি আগ্রহী হওয়ার এটাই কি মূল কারণ ছিলো?”
“আরে না। আমার প্রতি আগ্রহী হওয়ার মূল কারণ হলো তার স্বামী।”
“বুঝলাম না।”
“মহিলা স্বামীর কাছ থেকে দিনের পর দিন অবহেলা পেয়ে আসছিলো। এতে মহিলাটি মানসিক ভাবে বেশ হতাশ ছিলো। আর ঠিক সে সময় তার সাথে আমার পরিচয় হয়। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয়। তারপর থেকে ফোনে কথা হতে লাগলো।”
“তোদের মধ্যে কি শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে?”
“না। মহিলা শারীরিক সম্পর্কে আগ্রহী না। সে শুধু কথা বলতে চায়। কথা বলতে পারলেই সে ভীষণ খুশি থাকে।”
“শুধু কথা বলার জন্য তোর সাথে সম্পর্ক করলো?”
“একটা কথা মনে রাখবি, মেয়েরা কখনোই শরীরের জন্য ব্যাকুল থাকে না। আমরা ছেলেরা ব্যাকুল থাকি। ছেলেদের কাছে ভালোবাসা মানে হলো, শুধু শরীর। কিন্তু মেয়েদের কাছে তা নয়। মেয়েরা শরীরের চেয়েও মনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা তাদের প্রেমিক কিংবা স্বামীর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যেটা চায় তা হলো, মনোযোগ। তারা চায় তাদের সঙ্গী মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনুক। এবং ওদের কথা তাদের বলুক। তাদের সময় দিক। মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে ঘুরতে যাক। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটুক। ভালোবাসি কথাটি নানা ভাবে তাদের বলুক। কখনো কখনো ফুল উপহার দিক। এগুলো হলেই মেয়েরা খুশি থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসবের প্রতি ছেলেদের আগ্রহ নেই। ছেলেদের আগ্রহ একটাই তা হলো, শরীর। শরীরের আকর্ষণ যতোদিন থাকে, ছেলেদের ভালোবাসাও ততোদিন থাকে। বিয়ের চৌদ্দ বছর পর স্বামী কখনোই স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভাবে শরীরের টান অনুভব করে না। ফলে স্ত্রীর প্রতি সে উদাসীন হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মেয়েদের ভালোবাসা যেহেতু শরীর কেন্দ্রিক নয়, তাই তাদের ভালোবাসা কখনো কমে না। বরঞ্চ সময়ের সাথে সাথে সেটা বাড়তে থাকে। আর তখনই সৃষ্টি হয় স্বামী স্ত্রীর দূরত্ব। স্ত্রী স্বামীর কাছে চায় মনোযোগ। কিন্তু পায় অবহেলা।”
তারপর বললো,”আমার প্রতি মহিলার মুগ্ধতার মূল কারণ হলো, আমি মহিলাকে মনোযোগ দিচ্ছি। তার সব কথা শুনছি।”
“তার মানে মহিলার স্বামী যদি মহিলাকে মনোযোগ দিতো, সময় দিতো, কিছুটা রোম্যান্টিক হতো, তাহলে তোর দিকে মহিলাটি ঝুঁকতো না?”
“ঠিক তাই। যে স্বামী তার স্ত্রীকে মনোযোগ দেয়, সময় দেয়, সেই স্বামী যদি দেখতে খারাপও হয়, তবু ঐ মেয়েকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন ছেলেও এক তিল নড়াতে পারবে না।”
“বুঝলাম। তা মহিলার মতো তুইও কি শুধু কথা বলতে চাস?”
“মোটেই না। আমার উদ্দেশ্য হলো শরীর। আমি ধীরে ধীরে কৌশলে মহিলাকে সেদিকে নিয়ে যাবো।”

শেষ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জোটনের বুক ধক করে উঠলো। সে তখন আতংক নিয়ে ভাবলো, আমিও তো জুইকে দিনের পর দিন অবহেলা করে আসছি। এখন যদি তার সাথেও এই যুবকের মতো কারো সম্পর্ক গড়ে ওঠে?
সে আর ভাবতে পারলো না। তৎক্ষনাৎ খাওয়া বন্ধ করে হাত ধুয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে একটু নির্জনে গেলো। যেখানে মানুষজন কম। তারপর ফোন করলো জুইকে।

জুই ফোন ধরতেই জোটন তড়িঘড়ি করে বললো,”জুই, কেমন আছো?”
বিয়ের প্রথম দিকে বছর খানিক জোটন অফিস থেকে ফোন করে লাবণির খোঁজ নিতো। এরপর থেকে ফোন দেয়া বন্ধ করে দিলো। বিয়ের এতোটা বছর পর হঠাৎ করে জোটন ফোন করে সে কেমন আছে জানতে চাইছে? তাই অবাক হয়ে গেলো জুই।

সে কোনো রকমে বললো,”হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“জুই, পেছন থেকে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরতে তুমি খুব ভালোবাসো। এখন থেকে ইচ্ছে মতো আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমিও হুটহাট পেছন থেকে তোমাকে জড়িয়ে ধরবো।”
“কী বলো তুমি এসব?”
“জুই, চুলে ফুল দিলে দারুণ লাগে তোমাকে। আজ থেকে প্রতিদিন তোমার জন্য ফুল নিয়ে আসবো। বারান্দায় তোমার জন্য ফুলের বাগান করে দেবো।”
“তোমার কী হয়েছে?”
“জুই, তোমার যখন যা বলতে মন চাইবে আমাকে বলবে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনবো। একটুও বিরক্ত হবো না। আমিও আমার সব কথা তোমাকে বলবো।”
“তুমি অস্বাভাবিক আচরণ করছো।”
“জুই, প্রতি সপ্তাহে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো। হাতে হাত রেখে হাঁটবো।”
“জোটন, তুমি ঠিক আছো?”
“জুই, তুমি কোনো অপরিচিত যুবকের সাথে কথা বলো না। কথা দিচ্ছি, কাল থেকে আমি জিমে ভর্তি হবো। আগের মতো সুদর্শন হয়ে যাবো।”
“প্লিজ তুমি থামো?”
“এতোকাল থেমে ছিলাম। আর থামা যাবে না। জুই, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ ভীষণ….।”

অফিস ছুটির পর জোটন ছুটলো ফুলের দোকানে। সেখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর ফুলগুলোর একটা তোড়া কিনে সে লাফিয়ে উঠলো রিকশাতে।
তারপর রিকশাচালকে বললো,”ভাই, জলদি চালান। যতো জলদি আপনি পারেন। টাকা বাড়িয়ে দেবো।”

হাওয়ার বেগে রিকশা চলতে শুরু করলো। দুহাতে ফুল ধরে জোটন অস্থির অপেক্ষা করছে জুইকে দেখার জন্য। তার সাথে কথা বলার জন্য। অসাধারণ মেয়েটাকে সে হারাতে চায় না। সে আর কোনোদিন জুইকে অবহেলা করবে না। কোনোদিন না।

মন্তব্য করুন