Skip to content

স্মৃতির স্মরণী – পঙ্কজ রায়

পর্ব (১)

মনিপদ ঢাকি, ভোদলা ঠাকুরের নাচ, চাবিপটকা, ইছামতির ঘাট, মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারিতলা ঘিরে স্মৃতির সরণী
পঙ্কজ রায়
দূর্গা পুজো এলে আমি কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনে পড়ে কতো কথা…। আমার গ্রামের কথা খুব মনে পড়ে। তখন আমি পাঁচ বছরের শিশু। মঙ্গলগঞ্জ প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ি। ইস্কুলে যাওয়া আসার পথে বারোয়ারিতলায় পূজোর এক মাস বাকি থাকতেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হত। পাশের গাঁয়ের কুমোরপাড়া থেকে পালমশাই এসে প্রতিমা তৈরি করতেন। ইস্কুলে যাওয়া আসার পথে দেখতাম প্রতিমা তৈরি, কাঠামো তৈরি, বিচালি বাঁধা, মাটি লেপে দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো। প্রতিদিন একটু একটু করে দেখতাম, প্রতিমার অপরূপ মাতৃরূপ কেমন সুন্দরভাবে ফুটে উঠছে। পূজার সাত দিন আগে সুদুর মুর্শিদাবাদ থেকে মনিপদ ঢাকি ঢাক বাজাতে আসতেন। মনিপদ গ্রামে ঢোকার আধ মাইল দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ তুলতেন। আর আমরা ছোটরা ছুটে গিয়ে ওকে নিয়ে আসতাম। মনিপদ খুব ভালো ঢাক বাজাতেন। ওর চেহারা বেতের মতো মেদহীন, গায়ের রং কালো কুঁচকুচে। ওর সাথে কাঁসি বাজাত কায় না না কায় না না ওর ছোট্ট ছেলে। ওর সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল ওর নাম ছিল শুনু। মনিপদ ঢাকির ছেলে বলে কথা। সে জন্য ওকে খুব খাতির করতাম। মনিপদ ঢাকি ঢাক বাজিয়ে ওর জীবনে সংগৃহীত যত মেডেল পূজোর কটাদিন গায়ে জড়িয়ে রাখতেন। তখন এতো বাজি পটকা ছিল না, আমার মেজদা কামারবাড়ি গিয়ে অনেকের সাথে ” চাবিপটকা” বানিয়ে এনে রাতের অপেক্ষায় থাকতো। চাবিপটকায় বারুদ ভরে শক্ত কাঠের গুঁড়ির উপর আঘাত করলে খুব জোরে শব্দ হতো। আমরা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমাদের পুজোর পোশাক একটাই হতো। একবার আমার বাবা পুজোর আগে বনগাঁ থেকে আমাদের তিন ভায়ের জন্য একই রংয়ের রাজকুমার শার্ট এনে দিলেন। মন আনন্দে ভরে গেল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারোয়ারিতলায় হ্যাজাকের আলোয় দাঁড়িয়ে “ভোঁদলা ঠাকুরের” নেচে নেচে ধুনুচি নাচ দেখতাম। সঙ্গে অভিলাষ মিস্ত্রীর ধুনুচি নাচ। ছোটখাট চেহারার মানুষটি ধুতি গুটিয়ে মাল কোচা মেরে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচত। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে জামা প্যান্ট খুলে পাটে পাটে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে আবার পরের দিনের অপেক্ষায় থাকা। গ্রামের ওই একটা পুজোকে ঘিরে কতো আনন্দ। তখন প্রায় প্রত্যেক গ্রামে একজন পুরোহিত, একজন ছুঁতোর মিস্ত্রী, একজন নাপিত, একজন কর্মকার থাকতো আর একজন রাঁধুনি যিনি গ্রামের বিবাহ, অন্যপ্রাশন সহ সমস্ত অনুষ্ঠানে রান্নাবান্না করতেন। আগের রাতে মহা অষ্টমীতে ভোঁদলা ঠাকুরের সন্ধ্যা আরতি দেখেছি। আজ মহা নবমী। মন্ডপের সামনে পাঁঠা বলি হবে। বলি দেবেন ভোঁদলা ঠাকুর। অনেকগুলো পাঁঠা আনা হয়েছে। ভোঁদলা ঠাকুর এসেছেন। সেদিন ওর চেহারার আমূল পরিবর্তন। আগের রাতে সুন্দর ধুনুচি নাচ আর আজ দানবীয় চেহারার কষাই। লাল ধুতি ভাঁজ করে পরা, লম্বা করে সিঁদুর সারা কপাল জোড়া, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,অল্প হওয়ায় উড়ছে আর হাতে বড় একটা রামদা। আমরা ছোটরা খুব ভয় পেতাম। বলি শুরু হল। একে একে ১৭ টি পাঁঠা বলি হলো। রান্নার তোড়জোড় শুরু হল। সারা গাঁয়ের রান্না এক জায়গায়। ভোগেদার (ভগিরথ) মা রাঁধুনি রাতে মহানবমী পুজো দিয়ে মায়ের পূজো শেষ হল। ইছামতির ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো, দুটো নৌকা জুড়ে প্রতিমা তোলা হতো….মনিপদ ঢাকি নৌকোয় উঠে যেত। আশেপাশের গ্রামের সব প্রতিমা এক জায়গায় জড়ো হত। ঢাক বাজানোর লড়াই শুরু হল। গ্রামের মোড়ল নিরাপদবাবু ছিলেন বিচারক। বিচারে জয়ী আবার সেই “মনিপদ ঢাকি”। প্রতিমাও বিসর্জন হয়ে গেল। আবার প্রতীক্ষা…। লোকমুখে একটাই কথা– আসছে বছর আবার হবে…

পর্ব (২)

দুর্গা পূজো শেষ হলো। গ্রামের মানুষের মধ্যে বিষাদ ছেয়ে আছে। খুব শীঘ্রই আমাদের ইস্কুল খুলবে সাথে সাথেই পরীক্ষা। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর দিন কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো।, গায়ের প্রতি বাড়িতেই পুজো।
এদিকে ভোদলা ঠাকুর আজ খুব ব্যস্ত। ভোরে ইছামতিতে স্নান সেরে প্রথমে গাঁয়ের সব থেকে ধনি প্রফুল্লবাবুর বাড়িতে পুজো করবে।
তার পর বাকি প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ঘরে পুজো ।হত দরিদ্র গ্রাম। পুজোর আগে অর্থকরী ফসল বলতে পাট। কিছু চাষী মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ধার কজ্জ করে চাষ করেছিলেন। তখন পাট চাষের আগেই চাষী মহাজনের খপ্পরে পড়ে যেত। পাট বোনার আগেই উৎপাদিত পাটের দাম ঠিক হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষী অভাবী বিক্রির বলি হয়ে যেত। তবুও উৎসব! বাড়ির সকলের বিশেষ করে বাচ্চাদের নতুন জামা দিতে হতো সেটাও পাট বিক্রির টাকায়। আজ আবার কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো। খুব গরিব বাড়িতে সামান্য আয়োজন, চিড়ে,মুড়ি, মুড়কি, খই, আখ, বাতাবী লেবু আর বাতাসা। আমরা ছোটরা প্রফুল্লবাবুর বাড়িতে ভিড় করতাম ( ওটা ছিল বাবুর বাড়ি) সকলের কাছেই বাবু। আগের দিন রাতে বাবুর বাড়িতে ভিয়েন বসেছে, গঞ্জ থেকে ময়রা এসেছে। লক্ষ্মী পুজো আর বিজয়া দশমীর বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টি তৈরি হবে। ভোদলা ঠাকুর খুব ভোরে এসে গিয়েছে। নিষ্ঠাভরে এই পুজো করেই ওকে অন্য বাড়িতে যেতে হবে।
ভোদলার বাবুর বাড়িতে পাব্বনিটাও খুব ভালো হয়।
আর সবই তো গরিব গুর্বো
যা হোক সব বাড়িতেই পুজো শেষ হলো। আমাদের কিন্তু বাবুর বাড়ির খাস্তা গজা,লবঙ্গ লতিকা, জিলিপি,পান্তোয়া খাওয়ার লোভ পেয়ে বসেছে। সন্ধেবেলা দুর্গা পুজোয় পাওয়া একটি মাত্র পোষাক পরে সকলের সাথে বাবুর বাড়িতে গেলাম। সে রাতে বাবুর বাড়িতে সারা গায়ের লোক এসেছে।আপ্পায়নেরও কোন ত্রুটি ছিল না।
জিভে জল আনা বিভিন্ন রকমের মিষ্টি খেলাম।
দুপুর থেকেই দল বেঁধে আমরা ছোটরা গাঁয়ের সব বাড়িতে গিয়েছি প্রসাদও খেয়েছি।
এ ভাবেই সেদিনটা কেটে গেলো। পরদিন সকালে পাশের গায়ের সর্দ্দারপাড়া থেকে দল বেঁধে সাওতাল মেয়েরা কোলে কাঁখে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সুর করে গাইছে……ছেলে কানচে মেয়ে কানচে লক্ষ্মী পুজোর ভুজো দে মা……
আঁচল পেতে যে যা দিচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে।একটু পরেই সে গুলো ব্যাগে ভরছে।কয়েক দিন পর বাবুর ঠাকুর দালান সংলগ্ন মাঠে যাত্রা পালা হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্সাল হচ্ছে। পালার নাম “সীতা হরণ” প্রফুল্লবাবু রাবণের ভূমিকায় আর টেকো দুলাল ” রাম”। প্রফুল্লবাবু অট্টহাসি হাসতে পারতেন না। …..হা.আ..হা হা….
আমরা ছোটরা লুকিয়ে লুকিয়ে রিহার্সাল দেখতাম খুউ-ব মজা পেতাম।
সীতার অভিনয়ে, পাশের গাঁয়ের একটা ছেলে ওর নাম “নেদু”, মেয়েলি চেহারা, গড়ণ ও গলার স্বর মেয়েদের মতো। রিহার্সাল পর্ব শেষ।আজ সন্ধ্যা ৬ টায় যাত্রাপালা
“সীতাহরণ”। একটা ছেলের হাতে চোঙা ধরিয়ে বলে দেওয়া হল, আশপাশের গাঁয়ে চোঙা ফুকে যাত্রাপালার প্রচার করতে। ছেলেটা চোঙা ফুকতে বেরিয়ে পড়লো
….. বিছেস ঘোছনা…
আজ ছন্দে ৬ ঘতিকায় কপাসাতির পপুল্লবাবুর থাকুর দালানের ছামনের মাঠে যাত্রা পালা হবে। পালার নাম… ছিতাহরণ ..আপনাদের ছক্কলের আমন্ত্রণ রইলো।
ছব্বাই আছুন। (পাঠক গণ, ঘোষকের উচ্চারণের খামতি আছে দয়া করে মানিয়ে নেবেন)। চারদিক খোলা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। উপরে সামিয়ানা। হ্যাজাগ লাইট, আর দে লাইটের আলো।
বাজনদাররাও বসে গিয়েছে। বাজনা বলতে ঢোলক, হারমোনিয়াম, তার সানাই আর করতাল,……ঘন্টা বাজলো “ঢং” যাত্রা পালা শুরু হলো। …প্যা প্যা প্যার পা..একটা পর্বে দেখলাম লক্ষণ সীতাকে গণ্ডি কেটে
দিল আর মুখে বললো এই গণ্ডির বাইরে না যেতে।
সীতা লক্ষণকে অনুরোধ করলো ওই সোনার হরিণটা ধরে দিতেই হবে। হরিণটা গণ্ডির পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল
লক্ষণ ছুটলো হরিণের পিছে পিছে হরিণ ধরতে। ঠিক ওই সময় রাবণ ভিখারির ছদ্মবেশ ধারণ করে সীতার কাছে ভিক্ষা চাইলো। সীতা মুহূর্তের ভুলে ভিক্ষা দিতে এগিয়ে গেলো গণ্ডির বাইরে।
হটাৎ ৭০ উর্ধ মহিলা চেঁচিয়ে বলে উঠলো।…..ও …সিতে তুই গণ্ডির বাইরে যাসনি ও রাবণ, তোকে হরণ করতে এইয়েচে। হাসির রোল উঠলো। ভালো মন্দ মিশিয়ে
…সীতাহরণ পালা শেষ হয়ে গেলো..
গ্রাম্য মেঠো যাত্রার কুশিলবরাও খুব খুশি।

পর্ব (৩)
(মনছুররা আর ফিরে আসেনি)

আজ ইস্কুল খুলবে। প্রধান শিক্ষক নিশীকান্তবাবু, আর দুজন শিক্ষক একজন “গয়াবর পাল” আর একজন “নিকুঞ্জ বিহারী দুবে”।একটা বড় হল ঘর চাচের বেড়ার পার্টিশন করা ক্লাস রুম।
একফালি বারান্দা ঘিরে মাস্টার মশাইদের বসার ঘর।
গয়াবর স্যার অংক করতে দিয়েছেন। যোগ অংক, স্লেটে অংক করে স্যারের টেবিলে জমা দিয়েছি বৃদ্ধ মাস্টার মশায় বিড়ি টানতে টানতে ঘুমিয়ে গিয়েছেন। আমরা সমস্বরে চিৎকার করে ডাকলাম স্যার অংক দিয়েছি।
উনি হকচকিয়ে উঠে অংক দেখা শুরু করলেন।
একজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বললো স্যার আপনার হাতে ওটা তো বিড়ি। উনি ভ্যবাচ্যাঁকা খেয়ে পেন্সিল দিয়েই অংক দেখা শুরু করলেন। উনি বিড়ি টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
আমাদের ক্লাসের সব থেকে দুষ্টু ছিল অখিল ও পকেটে করে আমলকি নিয়ে এসেছে।
গয়াবরবাবু কে মারবে। ক্লাস করতে করতে উনি একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। অখিল পকেট থেকে আমলকি বের করেই আমলকি ছুড়ে মারলো গয়াবরবাবুর টাকে। শাস্তি পাওয়ার ভয়ে অখিল ছুটে ইস্কুল পালালো।আর ইস্কুলে আসেনি।
মনছুর আমার বন্ধু, ওরা পাশের গায়ে থাকে।ওর বাবা ইসলাম।আমার মামার বন্ধু।
মাঝে মধ্যে ওদের বাড়ি যেতাম মনছুরের নানি
বলতো ও ভাই আজ কাঁচা খাবি না পাকা খাবি?
(কাঁচা মানে চিড়ে মুড়ি মুড়কি আর পাকা মানে রান্না করে যা খাওয়া হয়। আমি বলতাম দিদা আমি পাকা খাবো।
মুরগি রান্না হতো।এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা প্রায়ই ঘটতো। আমার বাবা কমিউনিস্ট ছিলেন।
একবার আমার বাবা সারা রাত জেগে গ্রামের প্রতিটা বাড়ির খড়ের চালে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়েছিলেন।
সারা গ্রাম লালে লাল হয়ে গিয়েছিল। বিচারের আবেদন নিয়ে কিছু লোক দাদুর দ্বারস্থ হলো। দাদু (মোড়ল) বাবাকে তিরস্কার করলেন এবং ওই পতাকা খুলে নিতে বাধ্য করলেন।
আমাদের ইস্কুল বিল্ডিং- এর উপরে থাকতো। প্রায় শত খানেক বাচ্চা খুব হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান।ওদের বাবা, মা দারিদ্রতাকে যুঝতে না পেরে এখানে রেখে গিয়েছেন। ওরাও এই মঙ্গল গঞ্জ ইস্কুলে পড়তো।
জমিদার মঙ্গল চন্দ্র আশ যার নামে (মঙ্গলগঞ্জ)উনি মারা
গেলে উনার সহধর্মিনী সাবিত্রী আশ সমস্ত সম্পত্তির দায়িত্ব পান।পরবর্তীতে উনি ইস্কুল , পোস্ট অফিস, অনাথ ছাত্রাবাস (সেফ দি চিলড্রেন কমিটি)-কে দান করে দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেলো। ১৯৬৪ সালের ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলো। সে সময়ের দাঙ্গার বীভৎসতা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ধর্ম ও জাতের জন্য এতো ঘৃণা এতো বিদ্ব। কাল যখন হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি বসবাস করেছে আজ উভয় উভয়ের শত্রু।
কাল যখন একে অন্যের উৎসবে গিয়েছে আনন্দ করেছে
তখন তো ওরা কোন জাতের কোন ধর্মের মনে করে নি।
সে দিন দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল আশেপাশের অনেক গুলো গ্রামে।
যেমন …মথুরা,দিয়ারা, মাকড়া,মালিপোতা, পাঁচপোতা এই গ্রাম গুলো অধিকাংশ মুসলিম প্রধান।
আমার বাবা বেশিরভাগ দিন বনগাঁতে থাকতেন।যখন দাঙ্গা শুরু হলো তখন বাবা গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন দুই সম্পদায়কে রক্ষা করার জন্য। আমাদের হিন্দুদের এক বিশেষ সম্প্রদায় সেবার ওই বিভৎস দাঙ্গা বাধিয়েছিল।
সারাদিন বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে দাঙ্গার বিরুদ্ধে কিছু গ্রাম্য যুবককে একত্রিত করে প্রচার করতেন।আমরা বাড়ির সকলেই প্রবল উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাতাম।বাবাকে মৃত্যু ভয় দেখিয়ে অনেক হুমকি ও এসেছে।তখন বিদ্যুতের আলো ছিল না। গ্রামে পাকা বাড়ি ছিল না। সবই খড়ের চালা। লালমোহন বিশ্বাস- এর পাকা দোতলা বাড়ি। আর গায়ের জ্যোতদার প্রফুল্লবাবুর দোতলা বাড়ি গ্রামের অন্য প্রান্তে।সন্ধ্যা হলেই আশেপাশের গ্রামে আগুন জ্বলতো।আগুনের লেলিহান শিখা অনেক দূর থেকে দেখা যেতো। দাঙ্গা ও লুট যারা করতো ওরা দিনের বেলা গ্রামে এসে বলে যেত সন্ধ্যা হলেই শাখ বাজাতে। না হলে চিনতে ভুল হয়ে যাবে হিন্দু বাড়ি না মুসলমান বাড়ি।
সন্ধ্যা হলেই আমরা লাল মোহন বিশ্বাসের দোতলায় উঠে দেখতাম দিয়ারা, মথরো, মাকড়া জ্বলছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই দৃশ্য গ্রাম জুড়ে কান্নার রোল উঠতো।
দিনের বেলা শান্ত কিন্তু রাতের বেলায়? কারোর স্বজন হারানোর আর্ত চিৎকার এখনও চোখ বুজলেই মনে পড়ে।পাশের গ্রামের মনছুরের জন্য মনটা উথালপাথাল করতো। ও ইস্কুলে একদিন বলেছিল বন্ধু আমাদের মনে হয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।আমি বলেছিলাম কোথায় যাবি?… আব্বা বলছিল পাকিস্তানে।মনছুরকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এদিকে দাঙ্গা থামার কোন লক্ষন নেই। বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, গোয়ালের গরু ছিনিয়ে নেওয়া, টাকা পয়সা সোনাদানা বাড়ির আসবাবপত্র লুট চলতেই থাকলো। একদিন বাবা বনগাঁ থেকে পুলিশ নিয়ে গেলেন। ভয়ে গ্রামের কেউ ক্যাম্প করার জায়গা দিল না।অগত্যা আমাদের বাড়িতেই ক্যাম্প বসলো।গ্রামের অন্যদের সাথে দল বেঁধে দেখতাম মানুদের আমবাগানের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে
কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে। কারোর হাত ভাঙা। কারোর হাতে কোপ লেগেছে।
এ এক নিদারুণ অমানবিক দৃশ্য। হঠাৎ দেখি ইসলাম মামার কাঁধে “মনছুর”।ওকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। ও অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনছুরের ওই ভয়ার্ত মুখ মনে পড়লেই খুব শূন্যতা অনুভব করি।কিছুদিন পর দাঙ্গা শেষ হলো কিছু লোক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলো।
রাতারাতি কিছু লোকের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন
হলো। যারা পাকিস্তানে যায়নি কিছু মুসলিম পরিবার।সবকিছু হারিয়ে সর্বশান্ত হল।
মনছুররা আর ফিরে আসেনি…

মন্তব্য করুন