Skip to content

স্বপ্ন দেখে মন

মাঘের প্রায় শেষ ,দুয়ারে আসীন বসন্ত কড়া নাড়ছে ।  ঠিক আগের বসন্তে যে নতুন পাতাগুলো জানান দিয়েছিল প্রাণের স্পন্দন , ভরে উঠেছিল যৌবনের মুখরতায় চারদিক , তাদের‌ই দু-একটা আজ উঁচু মগডালে ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে  , হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই ওরাও চিরনিদ্রায় শায়িত হবে , ফাগুন হাওয়ায় উঠবে ঝরা পাতার মর্মর গান । ওরা ইতিহাস হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে , তারপর মাটিতে মিশে যাওয়া ওদের‌ই অস্থিমজ্জা থেকে প্রাণের রসদ শোষণ করে বেড়ে উঠবে একটা চারাগাছ । হলুদ হয়ে যাওয়া একটা পাতা তার ঝরে যাওয়ার পরে কী হবে সেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল এতোক্ষণ ।
     শুধু গাছের পাতা নয় মানুষ‌ও যতদিন বাঁচে এরকম‌ই স্বপ্ন দেখে , শুধু মাঝে মাঝে এই স্বপ্ন দেখা ভুলে গেলেই জীবনটা তখন বিষন্ন মনে হয় । বিষন্নতা , একাকিত্ব নারকীয় করে তোলে জীবন , বাঁচার আশাটুকু নষ্ট হয়ে যায় ।
   নবনীতা রায়ের বয়স প্রায় পঁচাত্তর বছর গেল , বয়সের ভারে এবং জরা ব্যাধির কোপে শরীর প্রায় ভেঙে গেছে । যৌবনে তার যে রূপ ছিল , হয়তোবা মিস কলকাতা বা মিস ইণ্ডিয়া হতে পারতেন । দীর্ঘদিন কলেজে অধ্যাপনা করছেন , তার হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত । বছর দশেক হলো স্বামী রমাকান্তবাবু গত হয়েছেন । এখন নিজের বলতে কেউ নেই , এক ছেলে এবং মেয়ে ছিল বলাই ভালো কারণ আজ তাঁরা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত , মাঝে মাঝে ফোনালাপ টুকুই হয় । প্রায় নয় বছর হয়ে গেল তাঁরা এদেশে আর আসেনি কোনদিন । দোতলা বাড়ির উপর নীচ মিলিয়ে ,আটটা ঘর ,প্রায় সব গুলোই বন্ধ থাকে । শুধু উপরতলার একটা ঘরে নবনীতাদেবী থাকেন আর নীচের একটা ঘরে থাকেন তার কেয়ারটেকার মানিক । মানিক ও মানিকের ব‌উ‌ই এখন তার সবচেয়ে বড়ো আত্মীয় ,তার আপনজন । মানিকের ব‌উ দুবেলা যত্ন করে রান্না করে দিয়ে যায় , আর মানিক সারাদিন ফুল বাগানে মালির কাজকর্ম করে , নবনীতা দেবীর ফুলের বড়ো শখ । এই শীতে মৌসুমী ফুলের কিছু কিছু এখনো হাসিমুখে বাগানে দাঁড়িয়ে আছে ।
  ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে …….. নবনীতা দেবী সর্দিকাশিতে বেশ কয়েকদিন হলো বেশ ভুগছেন । আজকাল বিছানা ছেড়ে উঠতেও মন চায় না , ফাগুনের উদাসী হাওয়ার মতোই মনটাও যেন আজ বিবাগী হয়ে উঠেছে , দুপুর বেলা সারা বাগান জুড়ে কেমন যেন একটা নিস্তদ্ধতা , একাকিত্ব ঘুরে বেড়ায় । ঠিক একই একাকিত্ব বুক জুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন নবনীতা দেবী ।
মানিকের নাতিটা মাঝে মাঝে আসে , খুব ভালো লাগে । মানিকের ব‌উ ইদানিং একটা কথা বলল , খুব একটা ফেলার নয় এতোবড় বাড়িতে ভাড়াটিয়া বসালে একটু একাকিত্ব তো দূর হয় । নবনীতা দেবী ভাড়াটিয়ার খোঁজ করতে লাগলেন । ঠিক হলো নীচের তলায় দু’টো ঘর ভাড়া দেওয়া হবে কিন্তু ভাড়া দেওয়া হবে শুধুমাত্র পড়াশোনা করতে আসা ছাত্র বা  ছাত্রীদের । অনেকেই এলো থাকার জন্য , কিন্তু বৃদ্ধার শর্তে কেউ রাজী হল না । প্রথম শর্ত কোন বন্ধু বান্ধবীকে নিয়ে আসা যাবে না , রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে , কোনরকম নেশা করা যাবে না এবং শেষ শর্ত বাড়িতে অগোছালো থাকা যাবে না এবং বাড়ির কোনো দ্রব্য ব্যাবহার করলে ঠিক আগের অবস্থানে রাখতে হবে । দেখতে দেখতে প্রায় ছয়মাস কেটে গেল অনেকেই এলো , অনেকেই গেল কিন্তু কেউ থাকতে রাজী হলো না । অবশেষে একদিন শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে , নবনীতা দেবী আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে বসে মেঘেদের হম্বিতম্বি দেখছেন ,এমন সময় ছাতা মাথায় এক শীর্ণকায় যুবক এসে দাঁড়ালো তাঁর সামনে । নবনীতা দেবী কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললেন কাকে দেখছেন বিশ্বাস‌ই হচ্ছে না । নবনীতা দেবী ফিরে গেছেন তাঁর কলেজ জীবনে , রমাকান্ত বাবু অবিকল ঠিক এমনই দেখতে ছিলেন ।কী অলৌকিক মিল এই যুবকের সাথে , কথা বলার ধরন  , চুল , সাজসজ্জা সব ঠিক যেন রমাকান্ত বাবুর মতোই । সম্বিত ফিরল মানিকের ডাকে , মাসিমা এই ছেলেটি ঘর ভাড়ার জন্য এসেছে । বেশ কঠিন হয়ে‌ই জিজ্ঞেস করলেন কী নাম ?
—- আজ্ঞে আমার নাম মৃণাল কান্তি হোড় ।
—- কী করা হয় ?
—- আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি ।
—- আর্ট কলেজে ! কী করবে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে ? সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াবে আর ছবি আঁকবে । নিজে পাগল হবে আর অপরকেও পাগল করবে ।
     মৃণাল ভদ্রমহিলার কথা গুলো শুনলেন কিন্তু কোন প্রশ্ন করলো , মনে একেবারে কোন কৌতুহল হয়নি তা নয় ।
আসলে নবনীতা দেবীর স্বামী রমাকান্ত বাবু একজন শিল্পী ছিলেন । সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেন আর পাগলের মত ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা । নবনীতা দেবীকে সারাজীবন ধরেই উনার অনেক পাগলামী সহ্য করতে হয়েছে । এই ছেলেটিকে দেখে উনার রমাকান্ত বাবুর কথাই মনে হয়েছে বারবার । ছেলেটি জলে ভিজে এসেছিলেন তাই কোন শর্তের কথা না বলে মানিককে একটা ঘর খুলে দিতে বললেন ।
সেদিন রাতে নবনীতা দেবীর তার জীবনের রঙিন মুহূর্তগুলো যেন একেরপর এক ভেসে উঠলো ।
পরদিন সকালে নীচে নেমে দেখলেন ছেলেটি তখনো ঘুমাচ্ছে , ঠিক রমাকান্ত বাবুর মতোই স্বভাব দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা । সারাদিন আর ছেলেটির সাথে দেখা বা কথা কিছুই হয়নি । সন্ধ্যার কিছু পরে মানিক খবর দিল ছেলেটি ফিরেছে । নবনীতা দেবীর পঞ্চ ইন্দ্রিয় হঠাৎ যেন জেগে উঠলো , তার নাকে ভেসে আসছে একটা পুরনো অতি পরিচিত গন্ধ । কীসের গন্ধ ? চিনতে দেরী হলো না , এতো চুরুটের গন্ধ , এই একই ফ্লেভারের চুরুটের ভক্ত ছিলেন রমাকান্ত বাবু । নবনীতা দেবী ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলেন দেখলেন ছেলেটি চুরুট হাতে একটা ক্যানভাসের সামনে বসে । বাড়ি ভাড়া দেওয়ার শর্ত ছিল কোন রকম নেশা করা যাবে না কিন্তু এই ছেলেটিকে কিছুই বললেন না কারণ এই চুরুটের গন্ধ তাঁকে  হারিয়ে যাওয়া জীবনের সেই সুন্দর মুহূর্ত গুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ।
দেখতে দেখতে প্রায় পাঁচমাস কেটে গেছে , ছেলেটির সাথে বেশ একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে । ছেলেটি বেশ ভালো , একটু অগোছালো নেশা বলতে চুরুটের নেশাটাই আছে , বেশ সুন্দর আঁকে । রমাকান্ত বাবুর মতোই তার হাতে কেমন যেন একটা জাদু আছে , প্রতিটা ছবি যেন জীবন্ত ফসিল , অনেক অবলা কথা যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে । নবনীতা দেবী মৃণালকে রমাকান্ত বাবুর কথা বলেছেন , উনার আঁকা ছবিগুলো দেখিয়েছে মৃণালকে । এতোদিন এই ছবিগুলোর প্রতি যে মানুষটা কোনদিন হয়তো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি আজ সেই ছবিগুলোর কাছে তার মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায়। এর কৃতিত্ব একমাত্র ঐ ছেলেটি ,মৃণালের কারণ ওই ছেলেটি রমাকান্ত বাবুর ছবিগুলোকে বুকে আঁকড়ে ধরেছে সশ্রদ্ধ চিত্তে । প্রতিটা ছবিই তার জীবনের এক একটা শ্রেষ্ঠ উপহার । মৃণাল নবনীতা দেবীর কাছে প্রতিটা ছবি নিয়ে সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরেছে । আজ নবনীতা দেবীর মনে হয়েছে রমাকান্ত বাবু সত্যিই একজন শিল্পী ছিলেন ,আজ তার মৃত্যুর এতোদিন পরেও তার আঁকা ছবিগুলো প্রাণবন্ত ।
নবনীতা দেবী অনেকদিন বাগানে যাননি , আজ একটু বাগানে গেলেন । কতোদিন পর যে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটলেন ,সত্যিই বিস্ময়কর , পাশে হাঁটছে মৃণাল ।আজ যেন হাঁটুর ব্যাথাটুকু প্রায় নেই , মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছেন । বসন্তের বাতাস বইছে মৃদুমন্দ তালে , কৃষ্ণচূড়া , পলাশের শাখায় রঙ লেগেছে । নবনীতা দেবী গান গাইতেন , অনেকদিন পর গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন ——
ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌,   লাগল যে দোল।
          স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
                   দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
          রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
          রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
                   নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
                                      দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
আজ নতুন করে বাঁচার আশা , স্বপ্নেরা যেন বাধা মেলে দিল । প্রশ্ন করলেন — ” আচ্ছা মৃণাল তোকে এতো ভালোবাসি কেন বলতো ? ”
—- আমি তোমায় দিলাম বলে ডাকি তাই কী ?
নবনীতা দেবী একটা ছবি পুরাতন এলবাম খুলে মেলে ধরলেন — ” দেখতো চিনতে পারিস কিনা ? ”
মৃণাল অবাক হয়ে গেল একেবারে অবিকল তার মতোই দেখতে একটা সাদাকালো একটা ছবি ।
—- এটা কী দাদায়ের ছবি দিদা ?
—- হাঁ রে এইটা আমার হিরোর যৌবনের ছবি , ঠিক তোর বয়সের‌ই হবে তখন ।
—- দিদা তুমি কী আবার আমার সাথে প্রেম করবে ?
—- নবনীতা দেবী হৈ হৈ করে হেসে উঠলেন — ” তুইতো আমার রঙিন হিরো রে ।”
তারপর মৃণালকে বললেন ——- ” আচ্ছা তোর দাদাভাইয়ের ছবিগুলোর একটা প্রর্দশনী করলে কেমন হয় ? সাথে তোমার ও দুএকটা ছবি ওখানে থাকবে । ”
মৃণাল হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল , নবনীতা দেবীর
বয়সের প্রতীক শিরা উপশিরা উঁকি দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরলো ।

মন্তব্য করুন