Skip to content

সন্ধ্যা নামার আগে..

সারা রাত্তির বৃষ্টির পর আকাশের গাঁড় কাল রঙ মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে ভোর হল। ঘুম থেকে উঠে সবে মাত্র রান্নাঘরে চুলোয় চা চড়িয়েছি এর মাঝেই দরজায় ঠক ঠাকানি। খুলতেই দেখি ফরেস্ট অফিসার। অফিসারের চোখে তখনো ঘুমের ভাব স্পষ্ট। আমি হাটতে হাটতে বলতে লাগলাম,
– “পুরো রাতটা ঘুমিয়ে ছিলাম কি একটা মোহের ভেতর দিয়ে।ঠিক মোহ বলা চলে না, বলতে পারো নেশা। আচমকা তুমি করে বলছি বলে মনে কিছু নেবেন না নিশ্চয়। নকল ভদ্রতায় আমার পোষায় না তাই এ সম্বোধন।
লোকটা স্বলজ্ব চোখে বলে বসলো, “না না কিছু মনে করিনি”
– ও হ্যা কি যেন বলছিলাম? মনে পড়েছে “নেশা”। বর্ষার রাতে টিনের চাল ওয়ালা ঘরে বৃষ্টির শব্দে ঘুমনোটা এক প্রকার নেশাই বলা চলে। এই রে! চুলোয় চা দিয়ে এসেছি তা পুরলো বোধহয়।
ভদ্র লোক মৃদু হাসলেন। আমি দৌরে রান্না ঘরে গিয়ে চা’টা নামিয়ে নিয়ে এলাম। কাপে চামুচের টুং টাং শব্দে লোকটার ঘুম ঘুম ভাবটা চলে গেল। একটা কাপ লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরেকটা কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকুনিতে চলে এলাম। লোকটা ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। বসার ঘরের পাশেই একটা সবুজ উচু টিলা। বৃষ্টির নতুন পানিতে টিলার সবুজ গাছগুলো আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। টিলার চুড়ার একটা গাছে পাখির কিচির মিচির শোনা যাচ্ছে।অবশ্য আমার দু’রুমের বাংলোটাও একটা টিলার উপর। আমি লেখক মানুষ। নিত্য নতুন কন্সেপ্ট মাথায় আনতে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরি।
ডাইনিঙয়ে যে লোকটা চা খাচ্ছে উনি সুদীপ বিশ্বাস। পদবী বোধহয় আগেই বলেছি ফরেস্ট অফিসার। এই পুরো জঙ্গল মহলের দায়িত্ব ওনার উপর। খাটি বাংলায় যাকে বলে বনকর্তা। সুদীপ তিন মাস হল এসেছেন।

আমি এখানে আছি চার মাস হতে চলল কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন কোন গল্প খুজে পাই নি। উত্তর দিকটায় একটা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা সোজা লোকালয়ের দিকে চলে গেছে। রাস্তাটায় একটা সরকারী জীপের যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছিল। আজ সুদীপ সাহেবের স্ত্রী আসবার কথা। স্টেশনে বহু আগেই উনি জীপটা পাঠিয়ে ছিলেন। ব্যালকুনি থেকে সুদীপ সাহেবকে জীপ আসবার খবরটা জানাতেই উনি বউ বরনে হন্ত দন্ত হয়ে ছুটলেন।আজ থেকে সম্ভবত ভোরবেলায় চা খাওয়ার সঙ্গী হারাচ্ছি। এই নির্জন বনে উনি আমার একমাত্র সঙ্গী তাও ভোরবেলার জন্যে। বাকিটা সময় উনি ওনার কাজে, আমি আমার রাস্তায়। আমার চা টা শেষ করে বাইনোকুলার, ডায়েরি, ক্যামেরা আর চায়ের ফ্লাক্সটা ব্যাগে ভরে বনের দিকে ছুটলাম। আজ আমি বৃষ্টি ভেজা জঙ্গল দেখব। ভেজা সবুজ পাতায় সূর্যের আলো পড়লে কি রকম আলোর খেলা হয়। আমার সাথে ছিল সুশান্ত। ও গানম্যান। সাড়াটা দিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধায় আমার কুটিরে ফিরলাম। পাশের ঝর্না থেকে নিয়া আসা পানি দিয়ে গোসল সেরে পেট পুজো শেষে ডায়েরি নিয়ে বসলাম। লিখলাম রিছাং ঝর্ণার কথা। পাহাড়ি একটা বুনো ফুলের অচেনা গন্ধের কথা। পুরো পাতা ভরে গেলে।

কলিং বেলের টুং টাং শব্দে আমার লেখার ঘোরের ইতি ঘটল। দরজা খুলতেই সুদীপ সাহেবের হাস্যজ্জল মুখটা চোখে পড়ল। তখন ঠিক গোধুলির সূর্যটা লাল আভায় ডুবতে শুরু করেছে। পূর্বদিকটায় আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। সুদীপ সাহেব ইশারায় আমার দিকে দেখিয়ে ওনার স্ত্রীকে বললেন
– তোমাকে বলেছিলাম না আমার বাংলোর পাশে একজন বিখ্যাত লেখক থাকেন। উনি সেই মানুষ। পার্থ বোস।
আমি কিছুটা লজ্জিত মুখে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জড়ো করলাম।
– দিন আনি দিন খাই লেখকের নামে এমন প্রশংসা স্বয়ং ঈশ্বরও মার্জনা করবেন না।
বলেই মৃদু হাসলাম। সুদীপ আমার কথাটা মেনে না নেয়ার ভঙি করে বলল
– আরে মশাই আপনি যে কত বড় লেখক তা আমি জানিনে বোধহয়..
– সে হবে হয়তো
কথাটা কিছুটা রহস্য করেই বললাম। হঠাৎ সন্ধার অন্ধকারে ওনার স্ত্রীর মুখের উপর আমার চোখ পড়ায় আমার সলজ্জ মুখে হঠাত বিষাদ নেমে এলে। এযে আমার পরিচিতার থেকেও বেশি কিছু। কিছু না বলে-কয়ে যার থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আড়াই বছর আগে। এযে সেই সন্ধ্যা, সন্ধ্যা বিশ্বাস। গোধূলির গাঁড় অন্ধকারে সন্ধার সাদা মুখটাতে কেমন ক্ষোভে ক্ষোভে লাল হয়ে উঠছে তা আমি ক্ষনে ক্ষনে টের পাচ্ছি। সুদীপ সাহেব সোফায় বসে বক বক করেই চলেছে। সন্ধ্যা দরজায় দাড়িয়ে ছিল, রুমে আসেনি, আসার প্রয়োজন বোধ করে নি বোধহয়। সুদীপ বকবকানি থামালে, রাতের ভোজের নিমন্ত্রন করে ওরা দুজনেই চলে গেল। সন্ধ্যা যাবার সময় একবার গম্ভীর মুখে পেছন ফিরে তাকালো, মনে হলো যেন বছর কয়েক ধরে জমানো অভিমান আর ক্ষোভ ঝেরে গেল।

আমি কিন্তু মনে মনে খুশি’ই হলাম। যাক তবে সন্ধ্যা বেশ একটা ভাল বেতনের বর পেয়েছে। ওর বাবা মানস বিশ্বাসের তেমনটাই ইচ্ছে ছিল। আমি লেখা টেখার টাকা দিয়ে যেটুকু পাই তাদিয়ে অন্তত বউ পোষা অসম্ভব। ঘর বাধতে গেলে যে আমার লেখক আত্মাটাকে বলি চড়িয়ে স্যুট কোর্ট পরা রস কষহীন চাকুরীজীবি হতে হত সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। সন্ধাও সেদিন বাস্তববাদী নারীদের দলে যোগ দিয়ে বলেছিলো,
– এসব কবিতা টবিতা ছাড়ো, একটা ভালো মাইনের চাকুরী খোজো
নিরাশ চোখে আমি বলেছিলাম – দ্যাখো কবিতা শুনেই তো তুমি আমার…
সন্ধ্যা আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল – হ্যা প্রেমে পড়েছিলাম তো, ওটাই ধরে থাকতে হবে? যা দিয়ে চলছে না তা পাল্টাতে হবে
– ধরো আমি পালটে গিয়ে নয়টা পাচটার চাকুরীজীবি হলাম, তুমি পালটে কি হবে?
– আমি পালটে গিয়্র তোমার রাধুনি হবো, সংসার সামলাবো, হয়েছে?
– কিন্তু আমাদের পাহাড়ে ঘর বাধার গল্প, কবিতা..
রেগে গিয়ে সন্ধ্যা উঠে দাঁড়িয়ে বলল – দ্যাখো একদম হেয়ালি করবে না। প্রেম করতে গিয়ে লোকে অনেক কিছুই বলে। এখন যা বলছি, করবে। সময় মোটে পনেরো দিন।
বলেই সন্ধ্যা চলে গিয়েছিল। সন্ধার কথা রাখতে আমি দিন পাচেকের মধ্যে পালটে গিয়ে চাকুরীজীবি সাজলাম। সারাটা দিন অফিসে খাটতাম। সন্ধাও পালটে গিয়ে কেমন নারী হয়ে উঠেছিল। সে টাকার হিসেব করতে লেগে গেল। ছোট্ট এমাউন্টের বেতনে বিয়ের পর সে কিভাবে সংসার চালাবে তাই নিয়ে রাত দিন আমার সাথে ফোনে বকতো। অফিস থেকে ক্লান্তি নিয়ে ফেরা আমি, ফোন কানে নিয়েই নীরবে সব শুনতাম। মাস খানেক পর অফিস শেষে বাড়ি ফিরে একদিন খুব কাদলাম। পুরুষ মানুষ কাদেনা, কাদলেও সবার আড়ালে কাদে। আমার ভেতরে যুদ্ধ চলছিল। অবশেষে নিজের কবি সত্বাকে বাচাতে তাই সেদিন পালিয়েছিলাম।

আজ রাতেও এই জঙল, এই দুই কক্ষের কুটির ছেড়ে আমাকে পালাতে হবে। কারন সন্ধার অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার থেকে পাওনা রয়ে গেছে। সেসব উত্তর আমার জানা নেই। আমি চলে যাচ্ছি সবুজ টিলার ভেতর দিয়ে আকাবাকা রাস্তা ধরে। তখনও লাল রঙা সূর্যটা ডুবতে খানিক বাকি ছিল। সন্ধার নতুন সিদুরের থেকেও সূর্যটা বেশ লাল ছিল, টকটকে লাল।
.
√রচনার সময়কাল: ৫ই জুলাই, ২০১৯ (সম্পাদিতঃ ২৪শে জুলাই ২০২৪)
√গল্পঃ একটি ভোরবেলা
©লেখাঃ সারোওয়ারে জুলফিকার

মন্তব্য করুন