Skip to content

লিলিয়ান অর্কিড। কোয়েল তালুকদার

# ভ্রমণ গল্প

লিলিয়ান অর্কিড

শিলিগুড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপত্যকার খাঁজে এক রমণীয় শৈল শহর হচ্ছে মংপু। এইখানেই মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিন’ কবিতাটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাটানোর দিনগুলি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী রচনা করেছিলেন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।

মৈত্রেয়ী দেবীর এই বইটি পড়েই আমার মংপু দেখবার সাধ হয়েছিল। আমার ভিতরে লক্ষ্যহীন একটি বাউণ্ডুলে স্বভাব ছিল। ঘুড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করত দেশ থেকে দেশান্তরে। এমনি এক উদাসীন মনের টানে অনেক বছর আগে এক সেপ্টেম্বরে আমি মংপুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে জীপে করে পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে মংপুতে যেয়ে পৌঁছেছিলাম দুপুরের পরেই ।

মংপুতে উঠেছিলাম শহর থেকে দূরে কালিঝোরা নদীর পাশে তিনচুলেতে নিরিবিলি এক ছোট্ট প্রাইভেট বাংলোতে। এখানে সূর্যালোকে ক্ষণে ক্ষণে সাজবদল করে। খুব কাছেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। সনসেরিদাঁড়া ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য নয়নাভিরাম তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। আমি বাংলাতে একটু রেস্ট নিয়ে প্রথমেই রবীন্দ্র স্মারক ভবন দেখতে চলে যাই। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সদনটি। এখানে কবিগুরুর অনেক স্মৃতি চিহ্ন দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

শাল, সেগুন, অর্জুনে ছাওয়া পাহাড় থেকে নেমেছে কালিঝোরা। সেই ঝোরার নামেই জায়গার নাম। পাশে বয়ে চলেছে তিস্তা। এই রকমই এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে আকন্ঠ বুঁদ হয়ে ছিলাম সেদিনের সেই পাহাড়ি অরণ্য সন্ধ্যায়। মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম এই লাইনগুলো- ‘‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে,
শূন্যে আর ধরাতলে,
মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে।
বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী।
মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই নিঃশব্দে দিতেছে করতালি।
আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ।’এই অনিন্দ্য সুন্দর মংপু।

আমি যে বাংলোতে ছিলাম সেটি ছিল সিঙ্গেল কটেজের মত একটি বাড়ি। কালিঝরার পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত হওয়ায়, এখান থেকে নদী, পাহাড়, উপত্যকা আর নীল আকাশ একসাথে দেখা যেত। কটেজের কেয়ারটেকার ছিল মধ্যবয়সি এক নেপালি, নাম ছিল অমল থাপা। ওর একটি গুণ ছিল, সে পুরোদস্তুর বাংলা ও হিন্দি বলতে পারত। প্রয়োজনীয় ইংরেজিও বলত সুন্দর করে। সে বাংলো থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের ঢালে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা একটি বাড়িতে থাকত।

আমি এখানে দুইরাত থাকার জন্য বুকিং দেই। যে দুইদিন থাকব, আমার খাবারের ব্যবস্থা অমলই করে দেবে। দেখলাম, অমল ওর বাসা থেকে খাবার রেঁধে টিফিন বাটিতে করে তা এনে রেখেছে। আমি সন্ধ্যা রাতেই খেয়ে নেই। অমল আমাকে খাওয়ায়ে রেখে চলে যেতে চায়।
আমি ওকে বলি — ‘আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।’ সে তখন একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল — ‘ভয় নেই বাবু এখানে। জ্বীন,পরী, ভূত আসবে না।’ এই কথা বলে অমল চলে গেল।

সন্ধ্যায় কুণ্ডলী পাকিয়ে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকতে দেখেছিলাম মেঘ। তারপর দেখেছিলাম এই অরণ্যে রাত নামতে। আমি বারান্দায় বসে একাকী রাতের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগেছিল তখন। এইরকম কাঠের বাড়ি, এই রকম পরিবেশ, এইরকম সৌন্দর্য শুধু সিনেমাতেই দেখেছিলাম। বাস্তবে তা অনুভব করতে পেরে অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। বাইরে তাপমাত্রা তখন পাঁচ। কেমন যেন জমাট ঠাণ্ডা লাগছিল। হঠাৎ ঘরের বাইরে কিসের যেন খচ খচ শব্দ শুনতে পাই। ভয় হল খুব। এই জনবসতি বিরল আদিম সৌন্দর্যের রাতে, এখানে আবার কে এল? আমি দ্রুত ঘরের মধ্যে চলে যাই। ভিতরে যেয়ে কান পেতে থাকি, কিন্তু সেই শব্দটি আর শুনতে পেলাম না।

ঘরের মধ্যে অসীম নিস্তব্ধতা। বাইরে নিঝুম রাত্রির পাহাড়। বনারণ্যে বুঁনো পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বুক হিম হয়ে আসছিল প্রচন্ডভাবে । এমন জনমানবহীন জনারণ্যে একাকী কোনো মনুষ্য বসবাস করে? একবার মনে হল কেন মরতে এলাম এখানে। আবার পরক্ষনেই মনে হল, ঘরহীন ৰোহেমিয়ানদের জীবনের জন্য এত মায়া করা ঠিক নয়।

রাত দ্রুত বেড়েই চলছে। রুমের ভিতরে বাতি নিভাতে ভয় পাচ্ছিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কাঁচের জানালা দিয়ে দেখ্ছিলাম, বাইরের মংপু। এমন অদ্ভুত আঁধার নামে আকাশের গায়ে! পাহাড়ের ফাঁকে যে আকাশটুকু দেখা যায়, তা ধূসর মেঘে ঢাকা। সেখানে চাঁদও নেই, তারাও নেই।

আমি জানালার কাছ থেকে সরে বিছানার উপর এসে বসি। দূরে বনে বাঁদারে পাখিদের কোনো ডাক নেই। ঝিঁঝিঁ পোকাদের গুঞ্জন নেই। ধবল তুষারপাতের শব্দ নেই। চারদিকে পাহাড় স্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ বাইরে বারান্দায় কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাও আবার আস্তে আস্তে নুপুর পরে হাঁটবার শব্দ। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এত রাতে কার এই নুপুরের নিক্কণ!

আমি অনেকটা ঠাঁয় বসে থাকি। চুপচাপ কেটে যায় আরও কিছটাু সময়। মনে হলো, নুপুরের নিক্কণ থেমে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। এবং রমণী কণ্ঠে বলছিল — ‘তুমি দরজা খুলে দাও। ‘
আমি : তুমি কে?
রমণী : আমি জেসমিন রিনচেন। তুমি আমাকে চিনবে না। দরজা খোল। তারপর বলছি।

আমি সন্তর্পণে দরজার কাছে যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি, ঝলমলে নাচের পোশাকে তিব্বতি ঘরানার একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। এমন নির্জন আঁধারে, এমন নিস্তব্ধ রাত্রি প্রহরে, এমন বনান্তরে, এমন একটি লাস্যময়ী মেয়ে আমার দরজার সামনে একাকী দাঁড়িয়ে। আমি পরম বিস্ময়ে এই রাত্রি সহচরীকে দেখছিলাম।

জেসমিন : আমাকে ঘরে বসতে দেবে না?
আমি : আসো, বসো।
জেসমিন রিনচেন এসে আমার বিছানায় বসে। আমি ওকে বলি, তুমি এতরাতে এখানে কী জন্য এসেছ? জেসমিন বলছিল —- ‘তুমি এই নির্জনে একাকী রয়েছ। আমি জানি, তুমি খুব ভয় পাচ্ছিলে। তাই তোমার কাছে চলে এলাম।’
আমি : তুমি কোথায় থাক, কী করো?
জেসমিন : আমার জন্ম এই মংপুতেই। বাবা নেপালি। আর আমার মা তিব্বতি। মা ছিল সিছুয়ানের খাংদিং এর একজন ক্যাবার ড্যানসার । সে আর এখন নৃত্য করে না। আমি করি।’
আমি : এত রাতে তুমি একাকী এখানে। আমি পরদেশী। দেখ, আমার বদনামি হবে। তুমি চলে যাও।

জেসমিন : কী বলো তুমি? তুমি আমার গান শুনবে না, নাচ দেখবে না, তাই কী হয়? আমার কাছে, তাওয়াংএর ভেষজ সুরা আছে। যেটি দালাইলামাও খুব পছন্দ করে। তুমি এটা পান করো। ভাল লাগবে তোমার। মনে হবে তুমি স্বর্গে আছো। ‘

আমি : আমার খুব ভয় লাগছে তুমি চলে যাও।
জেসমিন : কী বলো তুমি? এমন মধুময় যামিনীতে তুমি আমাকে এত কাছে পেয়েও দূরে সরিয়ে দিতে চাও? আমি যদি তোমাকে অনেক ভালোবাসতে চাই, তুমি আমাকে ভালবাসবে না?

আমি : না। আমার দেশের একজন মায়াবতীকে আমি খুব ভালোবাসি। তার সাথে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে আছে। আমি তাকেই বিবাহ করব।

জেসমিন ওর ব্যাগ থেকে সোনালি মোড়কে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের করে ছোট্ট একটি রূপালি গ্লাসে করে ঐ সুরা পান করতে দেয় আমাকে । আমি অনেকটা সম্মোহিত হয়েই তা পান করি। প্রথমে জেসমিন গেয়েছিল একটি তিব্বতি গান। অনেকটা মেলোডি সুরে গেয়েছিল গানটি। সেদিনের সেই
পার্বত্য নির্জন রাত্রিতে সেই মায়াবী সুর মংপু র আাকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম সেই গান। তিব্বতি সেই গানটির অর্থ ছিল এইরকম —

‘যদি পথ আরো দীর্ঘ হয়,
তাহলে তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
যদি তুমি আমার মন দেখতে পারো,
তাহলে নিজেকেও খুঁজে পাবে।
আমি তোমার সঙ্গে ঘুমন্ত স্মৃতি নিয়ে
জেগে উঠতে চাই। আমার ভালোবাসা এখন
তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ভালবাসা তোমার সঙ্গে আজীবন থাকবে।’

সকাল গড়িয়ে তখন বেলা হয়ে গেছে। অমল থাপা এসে বাইরে দরজায় নক করছিল । ডাকছিল আমাকে — ‘বাবুজি ওঠেন। ‘ আমি ধুড়মুর করে জেগে উঠি এবং দরজা খুলে দেই। রুমের ভিতরে কোথাও রাতের সেই জেসমিন রিনচেনকে দেখতে পেলাম না। ঘরের দরজা যেমন করে বন্ধ করে শুয়েছিলাম তেমনি আছে। কিন্তু কী আশচর্য! বিছানার উপরে জেসমিনের পায়ের নুপুর, বুকের উপরে বাঁধা তার লাল দোপাট্টা, কয়েকটি চুলের কাঁটা, খোঁপায় লাগানো লিলিয়ান অর্কিড ফুল ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে।

—————————————————-

ডিসক্লেইমার :
জেসমিন রিনচেনের সাথে আমার কথা হয়েছিল হিন্দি আর ইংরেজিতে। আমি ইচ্ছে করে এখানে বাংলা সংলাপ ব্যবহার করেছি।

~ কোয়েল তালুকদার

মন্তব্য করুন