Skip to content

রহস্যের রঙিলার ঝোপ

জুন, সাল ১৯২২
আষাড়ের বৃষ্টিতে নদীর পানি টইটম্বুর। কালো জলের নদী তিতাসে ছুটে চলছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পুলিশের একটি বড় নৌকা। নৌকায় ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সহ স্থানীয় থানার সকল পুলিশ সদস্য। তাদের গন্তব্য এক আজো পাড়া গা খিদিরপুর। তখন সড়ক ব্যবস্থা ছিল জেলার সাথে জেলার। থানা বা গ্রামের পাকা সড়ক অলীক বস্তু। তাই নদী পথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুসলিম নেতা রশীদ তর্কবাগীশকে ধরতে পুলিশের বিশেষ এই অভিযান। অভিযানের নেতৃত্বে আছেন জেলার স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুবই বিরক্ত। তার অনেক কাজ। সব সমস্যার মুল হোতা লর্ড বেন্টিংক। সে গভর্নর-জেনারেল হিসেবে ভারতে আসার পর পুলিশি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। পুরো জেলার প্রধান হন ম্যাজিস্ট্রেট। এই ব্যবস্থার ফলস্বরূপ কালেক্টর বা ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ইচ্ছে হলো লর্ডকে গালি দিতে। কিন্তু ব্রিটিশদের বিশ্বাস নেই। কে জানে, আরা হয়তো মন খবর জেনে ফেলে।

খিদিরপুরে এক দেশদ্রোহী লুকিয়ে আছে যাকে তথাকথিত এই দেশ প্রেমিকদের ধরে পেশাগত ধর্ম পালন করতে হবে। থানার কনেস্টেবল হারু নৌকার পাশ দিয়ে নদীর জলে কালো বিশাল মাছের মত কিছু একটা সা সা করে চলে যেতে দেখল। যেন বিপদের আগাম সতর্ক সংকেত দিয়ে গেল। হারু তার পাশের আরেক কনস্টেবল মণিশকে দেখালো। মণিশের শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল, তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা কেপে উঠলো। থানার দারেগা রশিদ সাহেবকে জানাতেই বেশ সতর্ক হয়ে গেলেন। তার ধারণা স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা এসব করছে। কিন্তু সব ধারণা উলটে দিয়ে নৌকার চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছিলো কালো কালো মানুষের দল। কিন্তু আর যাই হোক মানুষ তো আর জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আবার আধুনিক মানুষ। তিনি ফায়ার করার হুকুম দিলেন। সৈনিকরা গুলি চালিয়েও কোন কাজ হল না। তাবে গোলাগুলির একপর্যায়ে কালো মানুষের দল মিশে গেল বাতাসে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুশি হলেও পুলিশের কেউ খুশি হলো না। তারা জানে আজ তাদের শেষ দিন। তারপর এক ঝড়ো বাতাসের পাকে পড়ে ম্যাজিস্ট্রেট সহ সকল পুলিশ সদস্য মারা যায়। জায়গাটার নাম ছিল রঙিলার ঝোপ।

পরদিন..
সমস্যাটা বাধে তদন্তের সময়। পানি খেয়ে ফুলে ওঠা সব লাশ ডাঙায় পড়ে ছিল, এক সারিতে সাজানো। প্রত্যেকের শরীরে আঘাতের চিন্হ পাওয়া গেল। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ধরে নিল এটা দেশ বিরোধীদের কাজ। তখনকার কলোনিয়ালরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের চাপ ঠেকাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন পাস করলে, ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলও এই আইন বলবৎ করে। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার মাত্র তিন বছর পর সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ। বিদ্রোহের নেতা ছিলেন তরুণ কংগ্রেস কর্মী আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। পুলিশের সন্দেহ রশীদ সাহেবের সাথে এই গ্রামের লোকেদের আতাত আছে। রাওলাট আইনবলে গ্রামবাসীর উপর দমন-পীড়ন শুরু হল; মামলা হল, ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হল। নুন্যতম প্রমাণ দাখিল ছাড়াই পুলিশরা সাধারণ গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করলো, জেল-জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হল। গ্রাম হলো পুরুষ শুণ্য। কিন্তু ঠিক একই ভাবে মাস খানেক পর দুজন গ্রামবাসীর লাশ রঙিলার ঝোপের ধারে পাওয়া গেল৷ পুলিশের বিদ্রোহীদের প্রতি সন্দেহ ঘুচে গিয়ে নতুন সন্দেহ তৈরি হল। গ্রামবাসীরা মামলা থেকে বেচে গেলেও মামলার সমাধান হলো না। দিনে দিনে রঙিলার ঝোপ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে ভয় বাড়তে থাকল। গ্রাম ছাড়িয়ে পাশের শহর অবধি পৌছে গেল রঙিলার ঝোপ নিয়ে গল্প।

সাল ২০১৭
দাড় বাইতে গিয়ে নদীর জলে ছলাত ছলাত শব্দে ঘুমে ঢলে পড়ছিলেন নৌকার এক মাত্র যাত্রী। গোল ছইয়ে ছাওয়া নৌকাটা যিনি চালাচ্ছেন, ওনার নাম হাশেম মাঝি। আমাদের এই ঘটনায় মাঝির নামটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর, হালকা ঘোলাটে জলের নদীটির নাম তিতাস। হাশেম মাঝি তার নৌকায় থাকা লোকটাকে এখনো চিনে উঠতে পারেন নাই। লোকটা কথা বলে মেপে মেপে, চিন্তা করে তার চেয়ে বেশি। মাঝি ওনার নাম দিয়েছেন শামসুল, পুরো নামটা মাঝির মনে নাই। টিভিতে শামসুল সাহেব পলিটিক্স নিয়ে টকশো করেন। মাঝি লাইজু ভাইয়ের চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে টিভি দেখেন। যদিও লোকটার মুখে হালকা ছোট দাড়ি তার বুদ্ধিবৃত্তিক জীবিকার ধারনাটি মিথ্যে হওয়ার জন্য যথেষ্ট। মাঝি ভাই ওনারে শামসুল নাম দেয়ার কারন, ওনার কথা কম বলার অভ্যাস। মাঝির ধারনা লোকটা বুদ্ধিজীবি টাইপের কেউ, এরা নাকি কথা বেচেই টাকা কামাই করে। তাই মাঝি তাকে আর ঘাটায় না। মাঝি বহুক্ষণ হল নৌকা বাইছে। বিরক্ত হয়ে বলল,
– ভাই যাইবেন কই?
– চলতে থাকেন! গন্তব্য এলে নেমে যাবো।
মাঝি কথা না বাড়িয়ে দাড় বাইতে থাকে। মাঝি যাকে পায় তার সাথেই অতিরিক্ত কথা বলে। অবশ্য অতিরিক্ত কথা বলা দোষের মধ্যে পরে না। কিন্তু মাঝি লোকটার দেখাদেখি নীরব। কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। লোকটা সামনের দিকে চেয়ে আছে। উপরের খোলা আসমানে আলো নিয়ে খেলছে চাঁদ। নিচের নদীপাড়ের ফসলে বইছে বাতাসের স্রোত। নাহ, লোকটার সেদিকে খেয়াল নেই। লোকটার খেয়াল দূরের নদীর বাকটায়। ওখানে কালো আধার জমে থাকা ঝোপের ভেতরে। মাঝি সন্দেহের চোখে তাকায়। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর মাঝি হাক ছাড়ে।
– ও ভাইজান, সামনে রঙিলার ঝোপ, যাওন যাইবো না
– কিন্তু আমার গন্তব্য ওখানেই
– কি কন ভাইজান? পাগল হইয়া গ্যাছেন নাকি?
– দুনিয়ায় যদি কিছু অসাধারণ হয়, তবে সেটা পাগলরাই করে
– ভাইজান এত জটিল কথা বুঝিনা, আমি নৌকা ঘুরামু
– তোমার ছোট্ট ছেলেটাকে তিন মাস আগে এইখানে তো ওরা মেরেছিল না? প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করেনা?
– ভাইজান আপনে কেডা কন তো? এতকিছু জানলেন কেমনে?
– আমি আরো অনেক কিছুই জানি। রঙিলার ঝোপের পঞ্চাশ বছর আগের কবরের ঘটনা, আরও একশো বছর আগের ব্রিটিশদের সৈন্যদের মৃত্যু, সব।
– ভাইজান ছোট বেলায় জিন্দা একজনরে দাফন করতে শুনছিলাম, তয় ব্রিটিশগো ঘটনা জানিনা। কেডা আপনি?
– যারা তোমার ছেলেটাকে মেরেছে, আমি তাদের আজন্মের শত্রু। প্রতিশোধ নিতে চাইলে চলো
– না ভাইজান আমি যামুনা। মানুষের সাথে লড়াই করা যায়, ভুতের সাথে না
– ছেলেটা বরশি দিয়ে মাছ ধরছিল, এটাই দোষ ছিল তার? কাপুরষ!
বলেই লোকটা নৌকা থেকে নেমে গেল। হাশেম মাঝির চোখে স্পষ্ট হয় সেদিনের ছবি। তার আদরের ছোট ছেলে রাজিবের মরা শরীরটা পড়ে ছিল ঝোপের ধারে। বড়শির গোড়াটা পেটে গেথে দেয়া, সুতোয় ঝুলছিল একটা টাকি মাছ। মাঝির চোখটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মাথাটা চক্কর দেয়। ফিসফিসিয়ে বলে আমার রাজীবরে মাইরা দিলি। বলে হাক দিয়ে ওঠে
– ভাইজান নৌকায় উঠেন। আজ আমি শ্যাস দেখুম
– এইতো বীর পুরুষ
লোকটা লাফ দিয়ে নৌকায় ওঠে। নৌকা আবারো চলতে থাকে ভয়ংকর কিছুর ভেতর দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড় ওঠে। নৌকায় হালকা দোলা লাগছিল। লোকটা বলে উঠল
– ভয় পাবেন না মাঝি ভাই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। আমি প্রত্যেকটি কাজের আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ি। আমার নামাজের সময় আপনি একা থাকবেন অনেক কিছু দেখবেন। ভয় পাবেনা। ওদের ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছু করার এখন শক্তি নেই। কারণ এখনো আমরা ওদের জগতে ঢুকি নাই।
হাশেম বুঝে গেল লোকটা আসলে একজন বড় মাপের ফকির। এই জগতে মানুষ ভয় পায়, এমন দুই শ্রেণিকে বেশি সন্মান করে। কাউকে মন থেকে, কাউয় বাইরে থেকে। রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে থেকে, কারণ তারা ভেতরের কথা পড়তে পারেন না, কিন্তু পীর-ফকির শ্রেণির ক্ষেত্রে অনেক সময় মনের কথা পড়ে ফেলার চান্স থাকে, তাই তাদের মন থেকে শ্রদ্ধা করাটাই নিরাপদ মনে করে। তাই তাকে আমরা ও মাঝি ফকির সাহেব বলেই ডাকব।ফকির সাহেব ছইয়ের মধ্যে কাঠের পাটাতনে নামাজে বসে গেলেন। ঝড় আরো বেড়ে গেল। হাশেম ভয় পেল না। কারণ সে মাঝি। নদীতেই তার বাস। বহু বছর যাবত ঝড় দেখে তার জীবন পার করতে হচ্ছে। হঠাৎ হাশেমের পাশ দিয়ে নদীর ভেতর দিয়ে কালো বিশাল মাছের মত কিছু একটা সা সা করে চলে গেল। যেন বিপদের আগাম সতর্ক সংকেত দিয়ে গেল। হাশেমের শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। তবে ভয় কাটাতে অন্য দিকে খেয়াল নিয়ে যায়। নামাজ শেষ হওয়ার পর ফকির সাহেব ছইয়ের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
– মাঝি ভাই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু তার ভিতরের ভয়। আপনার ভয় আপনাকে মেরে ফেলবে আর কাউকে লাগবে না।
– ছেলেটারে ওরা ক্যান মারছে আমি জানবার চাই। ওর তো কোন দোষ ছিল না। গরীব বইলা আমাগো জানের মুল্য নাই?
– ওদের স্বার্থে আঘাত লাগলে ওরা দোষ নির্দোষ মানে না। ওদের কাছে জীবনের কোন মুল্য নেই। এই দুটি পুটলি রাখুন। এর মধ্যে একটাতে বালু আরেকটাতে ভুট্টার দানা আছে৷ দুটোই আল্লাহর কালাম দিয়ে ফু দেয়া। বিপদের পড়লে বিপদের দিকে বালু ছুড়বেন, আর জান যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে একটা করে ভুট্টার দানা ছুড়বেন। সতর্ক থাকবেন জানের রিক্স না হলে ভুট্টার দানা ছুড়ে অপ্রয়োজনে কারো জান নিবেন না।
হাশেম পুটলি দুটি পেয়ে নিজের ভেতর পুত্র হারানোয় অদৃশ্য শত্রুদের প্রতি রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। সে বলে,
– জীবনের মুল্য আজইকা ওদের বুঝামু
– খবরদার মাঝি, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। মাথা ঠান্ডা করে কাজ করবেন
– আচ্ছা আপনি জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের কথা শোনা উচিত। কিন্তু ওইখানে আমার কাজটা কি?
– আপনার কাজ আগে নিজেকে বাচানো, সব কিছু ওলট পালট হলেও আপনি ঝোপের ভেতরে যাবেন। একটা মণি পাবেন। ছুইড়া নদীতে ফেলবেন।
– শুনছি মণি রত্ন মুল্যবান জিনিস।
– দুনিয়ার সব মুল্যবান জিনিসই যে উপকারী,এ কথা ঠিক না
নৌকাটা ঝোপের কাছাকাছি আসতেই মনে হলে এক জগৎ ছেড়ে অন্য জগতে ঢুকে গেল। একটা ঠান্ডা বাতাসের স্তর থেকে দ্রুত গরম বাতাসের স্তরে ঢুকে যাওয়া। মুহুর্তেই বাতাস, পরিবেশ সব কিছু নিশ্চুপ হয়ে গেল। দূর থেকে ঘন ঘন কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।
– মাঝি ভাই সাবধান! এবার আমরা ওদের জগতে ঢুকে গেলাম। ওরা যা খুশি তাই করতে পারবে।
হঠাৎ হাশেম খেয়াল করল হাজারে হাজারে কালো মাছের মত কিছু, পানির উপর চোখ উচিয়ে ওদের দিকে গোল হয়ে এগিয়ে আসছে। যেন আক্রমণ করে এক সাথে গিলে খাবে। ফকির সাহেব সেদিকে না তাকিয়ে লাফিয়ে পাড়ে নামল। এবার মাঝির পালা। মাঝি নামতেই ফকির সাহেব, নদীর পাড়, আশেপাশের প্রকৃতি মুহুর্তেই ভ্যানিশ হয়ে গেল। তার বদলে চোখের সামনে ভাসল দিগন্ত বিস্তৃত খা খা মরুভূমি। মাঝির হঠাৎ এই পরিবর্তন বিশ্বাস হয় না।হাতে লাল এইরকম মরুভূমি সে টেলিভিশনে দেখেছে। রোদ লেগে চক চক করা মরুভূমির বালি হাতে নিয়ে দেখল মাঝি। সে চরের বালি দেখেছে, এ বালি চরের নয় একেবারে আলাদা। অবাক করা ব্যাপার হল বিশাল মরুভূমির মাঝখানে দেখা যাচ্ছিল সেই ভয়ংকর রঙিলার ঝোপ। ঝোপের ভেতর থেকে কিছু একটার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফকির সাহেব কই গেল? না তার চিন্তা করার সময় নেই। হাশেম মাঝি সাহস করে ঝোপের দিকে এগুতে থাকল। কিছুক্ষণ তারপর বহুক্ষণ হাটল। হাটতে হাটতে পায়ের শক্তি কমে এলো। কিছুদুর যাওয়ার পর হাশের দেখল ফকির সাহেব বিশাল দেহি কিছু দৈত্যের মত সাথে লড়াই করছে। ফকির সাহেবের হাতে বিশাল হাত পচিশেক লম্বা চিক তরবারি। তিনি সেই তরবারি মাথার উপরে তুলে চক্রাকারে ঘুরাচ্ছিলেন। দৈত্যে’র মত প্রাণিগুলো কাছে যেতেই টুকরো হয়ে দূরে পড়ছে। অথচ নৌকায় ফকির সাহেবের কাছে ছোট একটা ব্যাগ ছাড়া আর কিছু ছিল না। এ যেন আরব্য রজনীর রাত, ফকির সাহেব যেন সেই রাতের সিনবাদ। এতো ভাবার সময় কই? হাশেম ফকির সাহেবকে পাশ কাটিয়ে ঝোপের কাছে যেতে লাগলেন। তার কাজ যে মণি

কাছাকাছি যাওয়ার পর পেছন ফিরে দেখল, ফকির সাহেব চোরা বালিতে ডুবে যাচ্ছিল। আর তার শরীরে কিছু দৈত্যের মত কিছু প্রাণী লাঠির মত কিছু একটা দিয়ে প্রাণি খোচাচ্ছিল যাতে উনি ভিতরে ঢুকে যান। সব কিছুই যেন অচেনা। হাশেম ফকির সাহেবকে বাচাতে যায়। ফকির সাহেব চিতকার করে হাশেমকে বলে
– আমার জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শয়তানের মণি ধ্বংস করা। মণির দিকে এগোয়
হাশেম মণিটার দিকে দৌড়ে যায়। কিন্তু শত শত কালো শরীর তার পা টেনে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। হাশেম মুটোয় থাকা বালি ছুড়ে মারে জীনগুলোর দিকে। জীনগুলো চিতাকার দিয়ে লাফ দিয়ে ভ্যানিশ হয়। হাশেম যতই হাটছিল ঝোপটা ততই দূরে যাচ্ছিল। এবার শত সহস্র হাত হাশেমের গলা চেপে ধরল। হাশেমের নিশ্বাস বন্ধ হতে ধরল। মুঠোয় থাকা ভুট্টার দানা ছুড়ে মারতেই চিতকার দিয়ে ওরা মাটিতে ঝড়ে পড়তে লাগল। তারপর ছোট হয়ে মরা কাকের শরীরে রুপ নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকল। হাশেম আর কোন দিকে না দেখে লাফিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে পড়ল। হাশেম আলো ছড়ানো মণিটা কাঠের উপর থেকে নিয়ে আল্লহু আকবর বলে গায়ে সব শক্তি দিয়ে মণিটা নদীতে ছুড়ে মারতেই সব কিছু আগের মত হয়ে গেল।
– ভাইজান মণির কাহিনিটা আসলে কি?
– জ্বীনেরা এটাকে চেনে শয়তানের মুকুটের মণি হিসেবে। আসলে শয়তানের এটা একটা ফাদ। সে তার শক্তি ব্যবহার করে একটা মণিকে আলো ছড়ানো মণি বানিয়ে জ্বীনেদের মধ্যে প্রচার করেছে এটা শয়তানের মুকুটের মণি। যেদিন একটি মানুষের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকবে না সেদিন শয়তানের মুকুটের মণি মুকুটে বসিয়ে শয়তান অধিপতি সাজবে। এই মিথ্যে গল্প বলে শয়তান তার অনুসারী লোভী জ্বীন আর মানুষের মধ্যে শয়তানের ভবিষ্যতে অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে থাকে। বোকা বিশ্বাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে এই মণি সুরক্ষা করে আসছে এই আশায় যে শয়তান কোন এক সময় অধিপতি হলে তারা অনেক শক্তিশালী হবে। কিন্তু তাকদীর বা ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে মানুষ সৃষ্টির আগেই। সেটা পালটানো যায় না। শয়তান চায় আলাহর সৃষ্টির মধ্যে বিবাদ। সেটা হোক মানুষ অথবা জীন। ইহকালের জীবনে মানুষের বড় যুদ্ধ হল শয়তানের বিরুদ্ধে। বলেই নৌকার ছইয়ের মধ্যে থেকে লোকটা সালাম দেয়। হাশেম লোকটার আর কোন কথা শুনতে পায় না। কিছুক্ষণ পর হাশেম লোকটাকে আর খুজে পায় না। অথচ নৌকা নদীর মাঝে। লোকটা মানুষ নাকি জীন সেই চিন্তায় পড়ে যায়। এতো কিছু ঘটার পরেও সে ভয় পায় নি। কিন্তু এবার সে ভয় পায়। নৌকা নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে যায়।
.
©ভয়ের গল্প: রহস্যের রঙিলার ঝোপ
©সারোওয়ারে জুলফিকার কতৃক রচিত। গল্পে ব্যবহৃত সকল চরিত্রই কাল্পনিক।

মন্তব্য করুন