Skip to content

মাধু গোয়ালিনী – কোয়েল তালুকদার

মাধু গোয়ালিনী

অনেক বছর আগে আমি একবার পুণ্ড্রনগরীতে গিয়েছিলাম। পুণ্ড্রনগরী তখন পুরোটাই গড়। যেটি মহাস্থানগড় হিসাবে পরিচিত। এই গড়ে একটি প্রাচীন ভিটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম, নাম গোবিন্দ ভিটা।
এই ভিটার পশ্চিম পার্শ্বে একটি ভগ্নস্তুপ মন্দির ছিল । যেটি “করতোয়া মহাত্ন্য’’ মন্দির নামে পরিচিত ছিল । এটিকে গোবিন্দ বা বিষ্ণু মন্দিরও বলা হতো। আমি হাঁটতে হাঁটতে আরও উত্তর দিকে চলে গিয়েছিলাম । করোতোয়ার কূল ঘেষে সেখানে একটি প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখতে পাই। মনে হয়েছিল এই বৃক্ষটি কয়েকশত বছরের পুরনো। এই গাছের তলায় একটি আশ্রম আছে। কয়েকজন সাধু জাতীয় লোক সেখানে বসবাস করত।

আমি সবসময়ই এই সাধু সন্ন্যাসীদের পছন্দ করতাম। আমার একসময় জীবনের লক্ষ্য ছিল সাধু সন্ন্যাসী হওয়া। কিন্তু তা হতে পারিনি। কেন হতে পারিনি, সেই দুঃখের কাহিনী আরেকদিন বলব। আজ এই সন্ন্যাসীকুলদের দেখে খুব ইচ্ছা হল, দুইতিন দিন এদের সাথে এই আশ্রমে থেকে যাব । আশ্রমের সবচেয়ে প্রবীণ সাধুটির নাম ছিল অনুকূল বৈশ্য। আমি তারই শিশ্যত্ব গ্রহণ করি।

আমার এই লেখার যা কিছু তথ্য বা কাহিনী কিংবা উপকাহিনী সবই এই গুরু অনুকূল বৈশ্যের কাছ থেকে শোনা। গোবিন্দ ভিটার উপর দিয়ে আমি হাঁটতাম আর ভাবতাম, — ইতিহাসের এক ধূসর ধূলি পথে আমি কোথায় যেন যাচ্ছি । আজ থেকে হাজার বছর আগের পুণ্ড্রনগরীর ইট বিছানো সেই পথ। যেখানে এখন লাল পোড়া মাটির ধুলো উড়ছে। বৃক্ষ রাজির ছায়াতল দিয়ে চলতে চলতে মনে হলো আমি অনেক বছর আগের এই মন্দিরের একজন গায়েন।

ফ্লাশব্যাক :

আমি মণিশংকর, কীর্তন করি গোবিন্দ ভিটার পার্শ্বে ঐ বিষ্ণু মন্দিরে। আমাদের বাড়ি ছিল বুমানপাড়া অঞ্চলে মাথুরা গ্রামে। গ্রামটির একপাশে দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। আমার বালক বয়স থেকেই গান গাইতাম বাবার গানের দলের হয়ে। এখন আমি যুবা এক পূর্ণ গায়েন। গানের দলের হয়ে বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। পৌষ সংক্রান্তির দিনে হুগলি নদীর তীরে গঙ্গাসাগর মেলা, মাঘে বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে মুড়ি মেলা, শিবরাত্রিতে জলপাইগুড়িতে জল্পেশ্বর মেলা, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসার পূজা উপলক্ষে ঝাঁপান উৎসব। এইসব মেলা পার্বনে সেখানে কীর্তন আর শ্যামা সংগীত গাইতাম।

আমি গান করি এখানে, এই পুণ্ড্রে। কীর্ত্তন আসর মাতিয়ে রাখি। দূর দূড়ান্তের গানের দল থেকে অনুরোধ আসত আমাকে তাদের দলে নেবার । কিন্তু আমি যেতাম না। কী এক মায়ার মোহে এখানেই পড়ে থাকি এই বিষ্ণু মন্দিরে। পৃথিবীর সব মোহ আমি ছাড়তে পারি, গান ছাড়তে পারি, ঠুমরির খুঞ্জরীর শব্দ আর না শুনতে পারি কিন্তু আমি ছাড়তে পারি নাই মাধু গোয়ালিনীকে।

বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামের কার্তিক ঘোষের বউ ছিল মাধু। দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল। দেবী প্রতিমার মতো দেহ বল্লরী তার। কার্তিক দুধ বিক্রি করত দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাটে । মাধু গাভী দেখাশুনা করতো। এক আশ্বিনে কেঞ্জেকুড়া গ্রামে ওলাওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়লে কার্তিক ঘোষ সেই রোগে মারা যায়। মাধু হয় অকাল বিধবা। আমাদের গানের দল গিয়েছিল সেখানকার এক মুড়ি মেলায় গান করতে। মাধু আসত সেখানে গান শুনতে। মেলা শেষ হলে দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাট থেকে খুব প্রত্যুষে যেদিন নৌকা ছেড়েছিল , সেদিন দেখেছিলাম নৌকার ভিতরে মাধু গোয়ালিনীকে। আমাদের গানের দলে আরও দুই জন মেয়ে গায়েন ছিল শিবানী ও দিপালী। ওদের সাথে সেদিন যোগ হয়েছিল এই মাধু গোয়ালিনী।

আমাদের নৌকাটি যখন দ্বারকেশ্বর পেরিয়ে কংসাবতী নদীতে এসে পৌঁছে তখন বিকাল হয়ে গিয়েছিল। ছইয়ের উপর আমি একাকী বসেছিলাম। কংসাবতীতে তখন মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমার মনটা খুব ভাল লাগছিল, আবার কেন জানি খারাপও লাগছিল। ভাল লাগছিল এইজন্য যে, মাধুকে আমার খুব ভাললাগত। ওকে প্রথম দেখেছিলাম মেলায় গানের আসরে। হেজাকের আলোর নীচে দেখেছিলাম ওর আনত মুখ। কী মাধুর্যময় সারল্য ছিল ওর মুখখানিতে। সেই অপূর্ব মুখের মেয়েটি এখন আমাদের দলে। এই নৌকায়। কংসাবতীর উচ্ছল জল ছলাৎছল করছিল ৰাতাসের ঢেউ লেগে। আমার মন কেমন যেন ফাগুন দোলায় দুলে উঠছিল। আবার খারাপও লাগছিল এইজন্য যে, আমি তো মাধুকে এই নৌকায় তুলি নাই। আমাকে তো ও কখনও ঐভাবে দেখে নাই, কথাও বলে নাই। আমাকে ওর ভাল লাগারও কথা না। তবে কেন সে এই নৌকায় উঠল? কে তুলল তাকে?

হঠাৎ চেয়ে দেখি শিবানী। এবং ওর পিছনে মাধু গোয়ালিনী দাঁড়িয়ে। শিবানী বলছিল — ‘ কী ভাবছ তুমি। ‘
আমি : কিছু না। দেখছি কংসাবতীর জল।
শিবানী : ( মাধুকে দেখিয়ে) একে চেন?
আমি : না।
শিবানী : ইনি মাধু গোয়ালিনী। জয় শংকর ওকে পছন্দ করে এই নৌকায় তুলেছে। নতুন গায়েন। ওকে নাকি নাচও শেখাবে।’
শিবানী মুচকি হেসে আরও বলছিল — ‘জয় শংকর খুব পছন্দ করেছে ওকে। মাধুও পছন্দ করে। তুমি শুধু আমাকে পছন্দ করো না। কী এখন থেকে করবে না?’
আমি : তোকে না কত বলেছি, তুই আমাকে বিরক্ত করবিনে। যা, ভাগ এখান থেকে।

শিবানী রাগ হয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় মাধুকে হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মাধু যায় নাই। দাঁড়িয়ে ছিল আরও কিছুক্ষণ। দেখছিল কংসাবতীর জল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নিভু নিভু প্রায়। মেঘের নীচে ম্লান হয়ে যাওয়া লাল আভা এসে পড়েছিল মাধুর মুখে। ওর সেই স্বপ্নীল মুখে অস্ফুট করে আমাকে বলেছিল — ‘ জয় শংকরের জন্য নয়। আমি তোমার জন্যই এই নৌকায় উঠেছি। ‘

জয় শংকর আমার বাবা। বিয়ে করেছিল পাহাড়পুর গ্রামের কিশোরী অশ্বিনী ডুমনীকে। আমার মা ছিল ডোম। অনিন্দ্য সুন্দরী হওয়াতে বাবা নাকি জোর করেই তাকে বিবাহ করেছিল। অল্প বয়সেই সে সন্তান সম্ভবা হয়। আমি জন্মিবার সময় আমার মা মারা যায়। তারপর বাবা আবার বিয়ে করে। আমার সেই মা নিঃসন্তান। মাথুরা গ্রামে নিভৃতে সে একাকী বসবাস করে।

আমি জানি বাইরে মেয়েদের সাথে বাবা স্ফূর্তি করে। এই যে শিবানী, যে আমাকে ভালবাসতে চায়, তার সাথেও আছে বাবার অবৈধ সম্পর্ক। কাবেরী, দিপালীও যেন বাবার রক্ষিতা। মাঝে মাঝে মনে হতো, এই গানের দল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু যাই না। যাই না এই জন্য যে, বাবা আমাকে অধিক ভালবাসে। জগতের যত স্নেহ মমতা সে আমাকেই করে। আমি নাকি দেখতে হয়েছি মার মতো। বাবা সুন্দর গান করে। আমিও ঠিক বাবার মতো করে গান গাই।

সেই বার এই পুণ্ড্রে, এই করতোয়া নদীর তীরে, এই অশ্বত্থ গাছের তলে মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে মেলা বসেছিল। কত মানুষ, কত সাধু, কত সন্ন্যাসী, কত যোগিনী, কত বোষ্টুমী এসেছিল সেই মেলায়। গান আর নাচের উৎসব হয়েছিল মন্দিরের অদূরে অশ্বত্থ তলায়। সেদিন ছিল, শুক্লা দ্বাদশীর রাত। আমি মাধুকে সকালবেলাই বলে রেখেছিলাম, তুমি দেখা করবে পাহাড়পুর জঙ্গলে। আমি ওখানে নাগলিঙ্গম বৃক্ষতলে অপেক্ষা করব। আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাব এই লোকালয় থেকে অন্যত্র।

শুক্লা দ্বাদশীর সেই রাতে মাধু যায়নি গড়ের সেই জঙ্গলে। আমি রাত দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম বৃক্ষতলে। ত্রয়োদশীতে মাধুকে আবার বলি — ‘ তুমি আজ অবশ্যই যাবে। আজও অপেক্ষা করবো জঙ্গলের ঐ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে। ‘ মাধু আমাকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলেছিল — ‘যাব’। আমি সেদিনও মাঝ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম মাধুর জন্য। কিন্তু মাধু সে রাতেও আসেনি।

সেদিন ছিল মাঘী পূর্ণিমা। সকালবেলা মন খারাপ করে বসে আছি। মাধুর সাথে আমি কথা বলছিলাম না। মাধু নিজেই কাছে এসে আমাকে বলে — ‘আজ রাতে অবশ্যই আমি পাহাড়পুর জঙ্গলে যাইব। তুমি থাকিও। ‘

সন্ধ্যায় মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। মহাস্থান গড়ের আকাশে চতুর্দশী পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দিল। গানে গানে মন্দির প্রাঙ্গণ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল। মঞ্চে আমরা গান করছিলাম। গান গেয়েছিল শিবানী, দিপালী, বাবা এবং আমি। মধ্য রাত পর্যন্ত গানের উৎসব চলে। আমার গানের সাথে মাধু ক্ষণে ক্ষণে নাচ্ছিলও। তারপর একসময় ঢাকের বারি থেমে যায়। হারমোনিয়ামের সুর বন্ধ হয়ে যায়, ঘুঙুর আর খুঞ্জরীর শব্দও থেমে যায়। একে একে খালি হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ। আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চুপিসারে চলে যাই পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে।

সেদিন পাহাড়পুর জঙ্গলে আলোর ৰান ডেকেছিল। থৈথৈ জ্যোৎস্না ঢলে পড়েছিল বনে বনে, গাছে গাছে, বৃক্ষে বৃক্ষে, পল্লবে পল্লবে। আমি একাকী নির্জনে বসে থাকি নাগলিঙ্গম তলে। চাঁদ ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দেখলাম মাধু আসছে গানের পোশাক পরেই। পায়ের ঘুঙুরও সে খোলে নাই। তার পদধ্বনির সাথে নুপুরের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

মাধু : বের হতে পারছিলাম না। জয়শংকর কে ব্যবস্থা করে তারপর আসতে হলো।
আমি : কী ব্যবস্থা করেছ?
মাধু : পরে বলব।
আমি : চল, আমারা আগে মন্দিরে যাই। পুরোহিতকে বলে রেখেছি। আজ রাতেই আমি তোমাকে বিবাহ করব। কাকে করব, সে কথা পুরোহিতকে বলি নাই। চল আর দেরি করব না।
মাধু : না, আমি তোমাকে বিবাহ করব না।
আমি : কেন করবে না।
মাধু: তুমি এখন ধর্মত আমার ছেলে হয়ে গেছ। আমাকে তোমার বাবা জয় শংকর প্রতিদিন আমাকে ভোগ করে। আমি তার রক্ষিতা। আমাকে সে বিবাহ করে নাই ঠিকই। কিন্তু আমি তাকে আমার স্বামীর মতো দেখি। ধর্মত আমি এখন তার বউ।
আমি : কিন্তু, তুমি যে আমাকে ভালবাসতে।
মাধু: হ্যাঁ, আমি তোমাকে এখনও ভালবাসি।

মাধুকে আমি অনেকটা জোর করেই বুকের ভিতর টেনে নেই। মাঘী পূর্ণিমার সকল জ্যোৎস্না মেখে আমি তাকে পাগলের মতো আদর করতে থাকি। হয়ত সে রাতে স্বর্গ নেমে এসেছিল বনতলে। কতক্ষণ আমরা জড়িয়ে থেকেছিলাম, সে কথা কী কোনো মৃত মানুষ বলতে পারে?

শেষ এপিসোড :

মাধুকে না পেয়ে জয় শংকর সেই রাতে পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মণি শংকর আর মাধু গোয়ালিনী দুজনে আদিম ক্রীড়ায় রত…

তারপর কী হলো?

তারপর একসময় মন্দিরে ভোরের শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। জয় শংকরের সারা শরীরে রক্তের দাগ! বনের নীচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যের রশ্মি ভেদ করে জয় শংকর কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!

পিছনে নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে পড়ে রইল দুইটি নিথর মৃত দেহ। সে দেহে পত্র পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছিল।

~ কোয়েল তালুকদার

মন্তব্য করুন