১
.মরে গেলে –
শুয়ে রব মাটির গর্তে
শব্দ ও আলোহীন ঘরে
উত্তর দক্ষিণ হয়ে।
বুকের ওপর জমবে ঘাস —
সবুজ লম্বা ও ধূসর
শিথানে কাঠগোলাপ জেগে থাকবে।
খালি পায়ে কেউ কেউ —
বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে
মাঝেমাঝে কয়েকটি ছাগল —
বুকের ঘাস খাবে
বুকের ওপর হাজারো পিঁপড়ার—
মিছিল যাবে।
আমি কিছুই বলবনা
একদম চুপ করে থাকবো
যেন আমি কিছুই দেখছিনা!
২.
মরে গেলেও আমি রয়ে যাব –
নির্জন দ্বীপে
তোমার অভিশাপে।
মৌন পাহাড়ে
পাতার মর্মরে।
নাফের জলে
শিশুদের কোলাহলে।
পাখির গানে
পাতাঝরা বনে।
বৃক্ষের ডালে
বিলের জলে।
ফুলের সৌরভে
হৃদয়ে নিরবে।
গানের সুরে
নদীর তীরে ।
কবিতার ছন্দে
পাখির আনন্দে।
মায়ের প্রার্থনায়
তোমার অবহেলায়
সন্ধ্যার অন্ধকারে
নক্ষত্রের ভীড়ে।
৩.
মরে গেলে-
উঠানের কুকুরটাও একা হয়ে যাবে
কে দেবে তারে সঙ্গ –
জ্যোৎস্না কিংবা গভীর অন্ধকার রাতে?
ঐ যে চাঁদ
আমি দেখি বলে সে ওঠে!
আমি মরে গেলে
সে কাকে তার রূপ দেখাবে?
মরে গেলে –
যে বিড়ালটি ক্ষুধা পেলে
লেজের গুঁতো দিয়ে পাশে ভিড়ে
তার কী হবে?
চলে যাব একদিন
সুপারি বনের অন্ধকার ছেড়ে
আমার মতো নিশাচর পেঁচার কথা ভুলে।
৪.
মরে গেলে –
আর মরব না
অমর হয়ে রব
নতুন প্রাণে নতুন দেহে
শূন্যে ভেসে যাব।
মরে গেলে –
উড়ে যাব
সাত আসমানে সাঁতরাব
দিগন্তের ওপারে বসে
‘মরে গেলে’ কবিতা লিখব।
মরে গেলে –
চলে যাব
অনন্তের পথে ধাবিত হব
ফেরানো যাবে না আর
নতুন গ্রহে মানিয়ে নেব।
৫.
মরে গেলে-
একদম বিবস্ত্র করা হবে
গরম পানিতে গোসল করানো হবে
সাদা কাফনে মুড়িয়ে কফিনে শুয়ে রাখা হবে।
মরে গেলে –
কেউ কেউ দেখতে আসবে
তারা আমার নাম বেমালুম ভুলে যাবে
সবাই বলবে লাশ কোন ঘরে।
মরে গেলে –
কেউ কেউ বলবে ‘বড় দুর্ভাগা ‘
বন্ধুমহলে আড্ডা জমবে ‘ ভালোই ছিল রে ‘
পরিবার কান্নাকে স্মৃতি বানিয়ে শান্ত হয়ে যাবে।
৬.
মরে গেলে –
বাঁশ বাগানে চাঁদ নিয়ম করে ওঠবে
বন্ধুদের আড্ডায় হাসি হবে,গান হবে।
সবার প্রাত্যহিক জীবনে সব কিছুর উপস্থিতি থাকবে।
থাকব না কেবল আমি।
মরে গেলে –
আমারে মনে রাখিও ‘ মরে গেলে ‘ কবিতায়
রাতের কোন আড্ডায়
ঝাউবনের হাওয়ায়
চাঁদজাগা জানালায়।
মরে গেলে –
ভুলে যেওনা আমায়
ঝাপসা সন্ধ্যায়
গভীর কুয়াশায়
ভোরের আঙিনায়।
মরে গেলে –
রেখে দিও আমায়
স্মৃতির পাতায়
চোখের ইশারায়
মসজিদের খাটিয়ায়।
৭.
মরে গেলে –
অবুঝ বালকের মতো শুয়ে রবো
শান্ত শীতল মাটির বুকে
মনের আয়নায় ভেসে ওঠবে
জিয়ারতরত কিছু মানুষ
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী
আর জায়নামাজে ক্রন্দনরত মায়ের মুখ ।
মরে গেলে –
অবোধ বালকের মতো শুনে থাকবো
‘ আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’
‘কাদ কামাতিস সালাহ’
‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর’।
মরে গেলে –
দুরন্ত বালকের মতো হারিয়ে যাবো অচেনা রাজ্যে
জান্নাত থেকে জাহান্নাম
হাশর থেকে পুলসিরাত
মর্ত্য থেকে আরশে আজিমে।
৮.
মরে গেলে –
আমারে ভুলে যেও না
সন্ধ্যার আধারে শিথানে গিয়ে দাঁড়াইও
জমানো কথা বলে দিও
আমি নীরবে বুঝে নেব।
মরে গেলে –
নীরব থেকো না
সূরা ইখলাস পাঠাইও
দুরুদ পাঠাইও
এক ফোটা জল ফেলিও
আমার বুকে।
মরে গেলে –
একেবারে যাওয়া হয় না
কিছু কিছু যাওয়া –
থেকে যাওয়া হয়
তোমার মোনাজাতে
আমারে রেখে দিও।
৯.
মরে গেলে –
আমারে কবর দিও
শীতল মাটির বুকে
গোরস্তানের মাঝখানে
মসজিদের সামনে
যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে
দুধের মতো সাদা কাঠগোলাপ
তাকে সঙ্গ দেব বলে।
মরে গেলে –
আমারে নিয়ে যাইও
ধীর পায়ে
যেন ব্যথা না পাই,
এমন করে কাফনে ঢেকে দিও
সে যেন না দেখে আমায়!
মরে গেলে –
কবর খুঁড়িও
খুব যতনে
মাটি যেন কষ্ট না পায়,
তার বুকে শুয়ে থাকলে
যেন চাপ না দেয় আমায়!
১০.
মরে গেলেও স্বাভাবিক থাকবে-
নির্জন দুপুর
ক্লান্ত পুকুর
গোরস্থান
মৃত প্রাণ
পেয়ারা গাছ
লেবুর সুবাস
বাঁকা পথ
গরু-রথ
কুমড়ো লতা
সবুজ পাতা
লাউয়ের শাখা
আঁকাবাকা
কাঠ গোলাপ
তোমার অভিশাপ ।
১১.
মরে গেলে –
কলাপাতার শিশির ঝরে পড়বে ইঁদুরের গায়ে
কাঁঠাল পাতার ভাঁজে ভাঁজে জমবে কুয়াশার জল
ঝিঙার মাচার নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে একটি বিড়াল
ডুমুরের খোলে গল্প করবে এক জোড়া পাখি।
মরে গেলে –
সুপারি বনের অন্ধকার আরো গাঢ় হবে
অশ্বত্থের ডালে ঘুঘু ডাকবে
আমগাছের তলায় বসে কুকুরগুলো আকাশের দিকে চেয়ে থাকবে ।
মরে গেলে –
এদিক সেদিক তাকাব না সোজা কবরের দিকে চলে যাব
আর ফিরে আসবনা পেয়ারা গাছের তলায়
আর লেখা হবেনা “মরে গেলে” কবিতা সিরিজ ।
১২.
মরে গেলে –
বিবাগী মেঘমালা কাবার উপরে গিয়ে থেমে যাবে
মায়ের জায়নামাজ চোখের জলে প্লাবিত হবে
ঘরের বিড়ালটি কাঁটা খোঁজা বন্ধ করে দিবে
উঠানের বারমাসি পেয়ারা গাছটা তিনমাসি হয়ে যাবে ।
মরে গেলে –
শান্ত নদী অশান্ত হয়ে ওঠবে
পাহাড়ের ঝরনা স্বাভাবিক গতি হারাবে
আঙিনার দোয়েল নাচানাচি বন্ধ করে স্থির হয়ে যাবে
অসময়ে ডাকা কোকিলটি ডালে বসে ঝিমাবে।
মরে গেলে –
গহীন বনের ব্যাঙটি উপুড় হয়ে থাকবে
আমের মুকুল সহসা ঝরে পড়বে
বৃক্ষের সবুজ পাতা হলদে হয়ে ওঠবে
বিলের ধারের ঝিঁঝি পোকা সুর হারাবে।
মরে গেলে –
মানুষ তাড়াহুড়ো করে করব খুড়তে যাবে
গোসল করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে
“লাশের দাফনে দেরি করতে নেই ” বলে কেউ কেউ গলা বাড়াবে
জানাজায় কয়েক মিনিট দেরি হচ্ছে বলে কেউ কেউ বিরক্তবোধ করবে
দাফনের আগেই অনেকে পথে হাঁটা ধরবে
কাঠগোলাপকে আমার সঙ্গী বানিয়ে সবাই নিজের জীবনের প্রতি আরো মনোযোগী হয়ে পড়বে।
১৩.
মরে গেলে-
মরে যাওয়া নদীর বুকে দীর্ঘশ্বাস জেগে ওঠবে
কাশফুলের নরম শরীরে বকেরা বসে ঝিমাবে
গরুগুলো সবুজ ঘাসের খোঁজে এসে চরে শুয়ে রবে
রাখাল তার বাঁশির সুরে ঝরা পাতায় বিষণ্নতার সুর তুলবে।
মরে গেলে –
তেপান্তরের মাঠে হাওয়ারা এসে ভীড় করবে
সোনালী ধানক্ষেতে হাওয়ার নৃত্য ঢেউ তুলবে
সুদূর পাহাড়ের উপত্যকা মাঠের সাথে একাকার হয়ে যাবে
কাঠুরিয়া তেপান্তরের গাছের ছায়ায় এসে হাওয়া খাবে।
মরে গেলে –
তেপান্তরের আকাশে দু’টো চিল স্থির হয়ে থাকবে
বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের জলে পুঁটিমাছ গা ভাসিয়ে রাখবে
পানকৌড়ি জলে ডুব দিয়ে কোথাও হারিয়ে যাবে
পাতা কুড়ানি মেয়েটা আকাশের দিকে অপলক চাহনীতে চেয়ে থাকবে।
১৪.
মরে গেলে –
মা লাউ গাছে পানি দিতে গিয়ে থেমে যাবে
মিষ্টিকুমড়ো ফুল ঝরে যাবে
সজনেডাঁটা ভেঙে পড়বে।
উঠানে পেয়ারা গাছের ছায়া স্থির থাকবে
লেবু পাতার সুগন্ধ বাতাস ভারি করে তুলবে
শিমুল গাছ থেকে শিমুল ফুল ঝরে পড়বে।
বৈদ্যুতিক তারে বসে পেঁচা বিষণ্ণতার গান গাইবে
দিগন্ত রেখায় নক্ষত্র ঝরে পড়বে
বাঁশঝাড়ে চন্দ্র হারিয়ে যাবে।