Skip to content

“ ভাঙ্গা হৃদয় ” – অথই মিষ্টি

ধূসর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অলসত্বকে লালন করে নিরলস ভাবে প্রধান দরজার শিকল ধরে প্রতি দিনের ন্যায় ।বিকট আওয়াজে গর্জন করে ঘুমন্ত সিংহের ন্যায় জেঁগে উঠে নিজ গতিতে এসে নামলো উড়ো-জাহাজটা ঠিক আমার ধূসর চোখের সামনে এই বিমান বন্দরে ।কী সুন্দর সে জাহাজটা! তাকিয়ে আছি আমি ।কিন্তু নাহ্, তা দেখে আমার এ মরুচারী বেদুইনদের মতো শুষ্ক দু’ঠোটে একবিন্দু হাঁসির নমূনাও নেই ।কেননা ক্ষুধার তাড়নায় বড়ই অসহায় আর নাজেহাল আমার এ শরীর । তবুও অনুভূত হচ্ছে এই বিশাল আকৃতির অসাধারন উড়ো-জাহাজটা দেখে যেনো হৃদয়ের কোনো এক বিন্দু তটে তবুও ভালো লাগা কাজ করছিলো ।তা দেখে এক মুহূর্তের জন্য যেনো ভূলেই গেছিলাম যে, আমার পরনে আমার তুলনাই বড় সাইজের একটা পুরাতন আর ময়লা ধূসর রঙ্গের টি-শার্ট এবং কালো হাফ-পেন্ট ।ভূলেই গেছিলাম যে, আমার মাথার চুলগুলো এলামেলো অগোছালো আর আমার গা থেকে গন্ধ আসছে ।মুহূর্তেই আল্ত ভাবে চমকে উঠে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ধীরগতিতে মাথাটা নিচের দিকে করে নিজের শরীরের দিকে দু’চোখে এক পলক তাকিয়ে বুঝে নিলাম আমার আসল পরিচয়টা ।পুনরা্য় মাথাটা ধীরস্থীর ভাবে সমূখ পানে তুলে সরল রেখায় আবারো তাকিয়ে রইলাম দরজার ওপারে দ্বারিয়ে থাকা জাহাজটার দিকে ।দেখি হঠাৎ উড়ো-জাহাজের পেট বরাবর দরজাটা খুলে গেলো, আর সেই সিড়ি বেয়ে একে একে নেমে আসছে পরিপাটি ও সু-সজ্বিত সুন্দর সুন্দর মানুষ গুলো ।দেখতে দেখতেই সব মানুষেই নেমে চলে যাইতেছে আপন গন্তব্যে ।তার পর আবার সেই জাহাজের উদ্দেশ্যে অন্য মানুষরা যাওয়া আরাম্ভ করতেছে ।আমি তাকিয়েই আছি ঠিক আগের মতো করে হঠাৎ, আমার কাঁধে স্পর্শ অনুভূত হলো ।আমি আল্ত ভাবে ধীরগতিতে আমার দৃষ্টি নিম্নগামি করে পিচন ফিরে তাকালাম ।দেখলাম একজন মধ্য বয়সী মধ্যমাকৃতির নারী সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।আমি তেনার দিকে তাকিয়ে একপলক দৃষ্টি ফেলে পুনরায় আল্ত ভাবে আমার দৃষ্টিকোন সমূখ পানে নিয়ে আসলাম ।আর তাকাতে আরাম্ভ করলাম আবারো সেই উড়ো-জাহাজটার দিকে ।সেই নারী স্নেহের পরশে আবারো আমার কাঁধ স্পর্শ করলেন ।কিন্তু এবার আর আমি তেনার দিকে তাকালাম না । নিজের মতো হয়ে রইলাম যেনো আমার আশে-পাশে কেউই নাই ।দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সেই নারী স্ব-ইচ্ছায় মিষ্টি ভাষায় করুণ সুরে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“নাম কি তোমার?”
আমি এমন ভাবে অসহায় হয়ে দ্বারিয়ে রইলাম নিসঃশব্দে যেনো আমি আমার মতোই আছি, নাহ্ কেউই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছেনা ।আলস্যহীন সেই নারী পুনরায় সজরে আমার উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠলেন,
“তোমার নাম কি?”
এবার আর আমি স্থির থাকতে পারলাম না ।নিজের গতিতে তেনার দিকে ঘুরে দ্বারালাম ।নিসঃশব্দে দুই-এক মুহূর্ত দ্বারিয়ে রইলাম ।তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তবে তেনার দৃষ্টি স্নেহময়ী ।আমার দিকে তাকিয়ে তিনি তেনার চোখের পলক ফেললেন তারপর মায়ামাখা স্নেহমাখা সহানুভূতিপূর্ন মুচকি হাঁসি দিলেন ।তেনার এই মধুমাখা সহানুভূতিপূর্ন মুচকি হাঁসি দেখে যেনো মনে হচ্ছিলো, না আমি অসহায় নই, আমি ক্ষুধার্ত নই, আমি শুন্য নই এই তো আমি পরিপূর্ন, আমি ধন্য, এই তো আমার সব কিছু আছে, মোট কথায় আমার এই মহিয়সী নারী আছে তো আমার আর কি-বা চাই ? নিজের অজান্তেই আমার মুখে হাঁসি চলে এলো ।যেনো আমার ক্ষুধা মিটে গেলো, যেনো পরিপূর্ন আনন্দে মেতে উঠলো আমার হৃদয় ।তিনি আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি নাম তোমার?”
“পুঁনু” (মুচকি হাঁসি হেসে )
“পুঁনু!বাহ্, অনেক সুন্দর নাম তো তোমার ।বাসা কোথায়?” ( হাঁস্য উজ্জল মুখে )
“বাসা!” ( কিছুটা অবাক সুরে)
“বুঝলে না তো? তোমার ঘর কোথায়? তুমি থাকো কোথায়?”
“আ আ আমার ঘর … ( অবাক হয়ে তোতলিয়ে বললাম )
“হ্যাঁ বল?”
“ঐ যে দেখছেন মেইন সরকের পাশে বিশাল আকৃতির ছাঁয়াময়ী গাছ । তার নিছেই এই পুঁনুর বাস।”
“আরে!তুমি এতো সুন্দর করে কথা বলো কিভাবে?”
তেনার এ কথা শুনে আমি পুরোপুরি হা হয়ে গেলাম ।আমি আসলে বুঝে উঠতে পারলাম না যে, আমি কি পূর্ব থেকেই সুন্দর করে কথা বলি! না-কি আজ প্রথম সুন্দর করে কথা বলা আরাম্ভ করলাম ! আচ্ছা আমি যদি আগ থেকে সুন্দর করে কথা বলে থাকি তবে কারো দৃষ্টিতে তা পড়েনি কেনো এতো দিন? এ সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি সেই মহিয়সী নারীর দিকে বড় বড় চোখে হা করে শুধু চেয়ে রইলাম অবাক হয়ে ।আমি কিছু বলে ওঠার আগেই তিনি আবারো বললেন,
“তোমার কি ক্ষুধা পেয়েছে?” (মুচকি হেঁসে নিজের সন্তানের মতো করে জিজ্ঞাসা করলেন)
মুহূর্তেই যেনো আমি হতোভম্ভ হয়ে গেলাম ।আর পূর্বের সেই ক্ষুধার্থ ও অসহায়ত্বের অবস্থানে ফিরে গেলাম এতক্ষনে যা ভূলেই গেছিলাম ।বুঝতে পারলাম এটাই বুঝি মায়ের মাতৃত্ব, এটাই মায়ের মাহাত্ব । যে কি-না সন্তানের সকল বিসয়ে অবগত ।মনে হলো তিনি যেনো আমার মনের কথা বলে উঠলেন ।যেনো বুঝে গেলেন তিনি আমার পুরো অবস্থা ।আমার দিকে তাকিয়ে তিনি তেনার ব্যাগ থেকে কিছু খাবার বের করে আমাকে দিলেন ।আবারো অবাক হয়ে গেলাম আমি ।বুঝেতে পারলাম না এ পৃথিবীর আসল রূপ কি? এতো দিন পেটের ক্ষুধায় যখন আমি মানুষের কাছে কিছু খাবার চেয়েছি গুটি কয়েক মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে মাত্র বাকিরা সব তারিয়ে দিয়েছে । কিন্তু আজ কেন এই মহিয়সী নারী আমাকে নিজে থেকে খাবার দিতেছে!তেনার হাতে খাবার দেখে না চাইতেও আমার দু’চোখ ভিজে গেলো পানিতে ।সেই খাবারের দিকে একবার, তেনার মায়াময় মুখের দিকে একবার তাকাইতেছি করুন দৃষ্টিতে ।মুহূর্তেই যেনো তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন ।তিনি নিজ থেকে আমার হাতটা টেনে খাবারটা ধরিয়ে দিলেন ।এর প্রতিদানে এই শুন্য আমি তেনাকে দিলাম শুধু মাত্র কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ন দু’আঁখির দু’পোটা জল ।তিনি আমার চোখের জল মুঁছিয়ে দিয়ে হাঁটু গেরে অসহায় এই আমাকে তেনার মায়াময় স্নেহপূর্ন বুকে জরিয়ে ধরলেন । আর বললেন,
“তুমি আমার রাঁজপুত্র হবে? যাবে আমার সাথে? আমার সংসারে একমাত্র রাঁজকুমার হয়ে রাজ করতে?”
তেনার এ প্রশ্নত্তরে আমি দিলাম কৃতজ্ঞতা মূলক দু’পোটা চোখের জলে ভেঁজা অপ্রত্যাশিত মুচকি হাঁসি ।তিনি বুঝে নিলেন আমার মনের কথা যে, আমি প্রস্তুত ।তিনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে, ঐ উড়ো-জাহাজের দিকে যেতে আরাম্ভ করলেন আর বলতে লাগলেন,
“তবে চলো পুঁনু যাওয়া যাক।”
তেনার হাত ধরে মেইন দরজা পার হতে না হতেই, হঠাৎ আমার পাজরে ভিষণ ব্যাথা অনুভব হচ্ছিলো আর আমার কানে জোরে জোরে আওয়াজ আসছিলো, ‘‘ঐ ফকিন্নির পুত ওঠ এইখান থেকে।আমার চাকরি টা কি খাবি? ওঠ বলতেছি ।’’
চোখ খুলেই দেখি, আমি বিমান বন্দরের মেইন দরজার নিচে সুয়ে আছি । আর আমার দু’চোখ ভেজা পানি ।এখানকার গার্ড আমার সামনে দ্বারিয়ে । তেনার হাতে লাঠি বুঝলাম তিনিই আমার পাজরে আঘাত করছিলেন ।তেনার লাঠির আঘাতে আমার শরীরের তো কিছু হয়নি, মনে হচ্ছিলো যেনো এ হৃদয় ভেঙ্গে খন্ড খন্ড হয়ে গেলো মুহূর্তেই …

অথই মিষ্টি ,এইসএসসি পরিক্ষার্থী
বদরগঞ্জ মহিলা কলেজ , রংপুর ।

মন্তব্য করুন