Skip to content

বোধ -রমেন মজুমদার

বোধ
(ছোটগল্প)
-রমেন মজুমদার
২৯/০৭/২৩
নয়ছয় করে কি আর জীবন চলে (?) জীবন চালাতে হলে চাই পয়সা।
এই পয়সা লাগে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি।
টাউটারী-বাটপারি করা সবার মানয় না। আঁতে ঘা লাগে।
বোধের হয় সর্বনাশ! ভিখারির মতো জীবন ধারা হলেও লজ্জা-ঘৃণা বলতে কথা থাকে।
অনাহারে মরতে রাজি,কিন্তু প্রবৃত্তির চৌকষ ঘরে বোধকে নষ্ট করতে নেই; তাই চুরি-ছেসরামী আর বাটপারি না করে দু’পয়সা কামাই করতে ফুটপাতে ব্যবসা করাই ভাল।
—-
যখন দেখলাম নুন আনতে পান্তা শেষ হয়, একদিকে টানলে অন্যদিকে ঘাটতি থাকে। দশহাত কাপড় টানলে ছিঁড়বে, বাড়বে না।
জীবনের অভাবী ভাঁটায় কেবল দিনদিন আয়ু ক্ষীণ হয়,সতেজ হয় না।
যখন দেখলাম গর্ভধারিনীর চোখের জলধারা নিত্য মাটিতেই শুষে নেয়, তখন নিজেকে অপাঙতেও মনে হয়। হায়রে অভাব, তুইতো মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছিস !
তোর আঘাতে আঘাতে বোধের খুঁটি দুর্বল হতে লাগল। বিবেকের পর্দার জৌলুস দিনদিন ক্ষীণ হয়ে মরা নদীর মতোই শুকনো হতে থাকল।
বোধ আর বিবেকরা বলল,এই যে বৎস;
লজ্জা ধুঁয়ে কী জল খাবি ?- রাস্তার নাম।
বাণিজ্যের তল্পীতল্পা জোগাড় কর, শুরু কর ব্যবসা। নইলে পেট শুকাবে।
দাহর পথে এগুতে হবে শেষে ।

নিদ্রাদেবী পালিয়েছে। রাতে ঘুম হলো না।
পেটের ক্ষুধায় কি আর ঘুম আসে ?
রাত ভোর হলো। বেরিয়ে পড়লাম পয়সার ধান্ধায়।
পয়সা কী ভাবে আসবে,বুদ্ধি টাইট করতে কেটে গেল দুঘণ্টা।
ওপাড়ায় হরেন বাঁশ ফেঁড়ে চালন,কুলা,খালুই ইত্যাদি নিজে হাতে বানিয়ে বিক্রি করে হাটে।
কুট্টিবেলা থেকে মাথায় খালি সাতপাঁচ ঘুরত, বদমাশের হাড্ডি ছিলাম।মায় কইত
ছেমরা দুইডা পয়সা কামাইর ধান্ধা কর,নইলে মাইনসের খেতে ধান ঝরা বইল টোকাইয়া আন, হেয়াতেও একদিনের খাওন হয়।
এমন কথা শুনলে কার না বুকের তন্ত্রী টন টন করে ?– আমারও করল।
হরেনরে কইলাম,হরেন আমারে একটা চালন দে।
— কি করবি ?
–সেইদিন এক ছেমরাকে দেখলাম চালনে দড়ি বাইন্ধা গলায় ঝুলাইয়া হাটে হাটে ভাঁজা বাদাম বিক্রি করতে। আমিও করব।
যেই কথা,সেই কাজ।
হরেন কইল,পেলান ভালো করছস।
–আমি কইলাম,দাম কত?
–দুই পয়সা।
–বাকীতে বিক্রি করবি ?
–হ করমু, তুই নিলে তোরে বাকীতেই দিব।
–তাইলে দে। ভালো দেখে একটি চালন নিলাম শক্ত দেখে চাইর পয়সার মধ্যে।
শুনছিলাম বাকীতে নাকি সম্পর্ক নষ্ট হয়।
তয়, দোস্ত তোর পয়সার মাইর যাবেনা।
—-
হরেনের চালন, মায়ের পুরান শাড়ির পাইড় ছিঁড়ে চালনের দুই কান্দায় বাইন্ধা গলায় ঝুলাইয়া দেখলাম,বুকের কাছে চালন থাকলে তার ভিতরে মালসামানা সাজিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রিকরা যাবে।
মনে মনে ভাবলাম,ফন্দিটা মন্দ না।
সোমবার হাট বসে গঞ্জে। গঞ্জের হাট দুইদিন মিলে।সোমবার আর শুক্রবার।
গঞ্জের হাটে একটা বেকারি আছে,ওরা পাউরুটি বানায়।পাইকারি বিক্রি করে।
আমি গেলাম হাটবার বেকারির দোকানে।
বললাম, বোধকে ঘরে রেখে রাস্তায় নেমেছি।পেটে ক্ষুধা,কি করব?
এইযে চালন দেখছেন,আপনি পাউরুটি বাকি দিলে হাট ঘুরে বিক্রি করে সন্ধ্যায় পয়সা দিব।
বেকারির মালিক চেনাজানা বলেই বাকি দিল কিছু মাল।
— সে বলল, অল্প অল্প নিয়ে বিক্রি করে আয়। চালন ফাঁকা হলে আবার মাল নিবি পয়সায় দিবি। এমনি করে ব্যবসা চালু কর দেখি ।
সেও বুদ্ধি ভালো দিল।
শুরু হলো প্রথম ব্যবসা।
অনেক দূর দূর থেকে মানুষ হাট করতে আসে। তাদের ক্ষিধে পায়।
একপিছ পাউরুটি কিনে খেয়ে জল খেলে ক্ষিধা নিবারণ হয়।
সকাল থেকেই হাট বসে,শেষ হয় হারিকেন জ্বালিয়ে রাত আট-টা, পর্যন্ত।
প্রথম হাটেই বিক্রি করলাম পাঁচটাকা
বেকারির টাকা পরিশোধ করে আমার থাকল চার আনা।
পাঠক হাসবেন না চার আনার কথা শুনে।
তখন সেই চার আনাতে এক সের চাউল পাওয়া যেত।
আমি এক সের লক্ষ্মীদিঘা চাউল কিনলাম চারআনা দিয়ে।
বাড়ি এলাম,মায় খুশি হলো। ভাবলাম, বোধ আর মেধা বিক্রি করে মানুষ বাঁচতে পারে। আমিও বাঁচব।

আড়াই মাসের ব্যবধানে ব্যবসা পাল্টে ফেললাম। বেকারির মালিক বলল,কি রে ?– ব্যবসা পালটালি যে–
বললাম মাথায় একখান বুদ্ধি পাইছি,সেটাও বোধ আমারে বাতলাইয়া দিছে।
–রগর কইরা কইল হেইডা কেমন ? পাঠক আমি যে গেরামের মানুষ,
শুদ্ধ কইলে চলবে না।অশিক্ষিত তাই গেরাইমা ভাষা অইল মায়ের মত মিষ্টি।
মার কাছে গেলে যেমন দুধেল একটা গন্ধ পাই,তেমনি এই আঞ্চলিক ভাষায় দুধেল ও মা মা গন্ধ আছে। ভারী শান্তি পাই।
বেকারির মালিক অইল অশিক্ষিত,কিন্তু ভীষণ চালাক;বুদ্ধিও চতুর!
আমি কইলাম,
ব্যবসা পাল্টানোর কারণ তাড়াতাড়ি জীবনকে পাল্টে ফেলতে চাই।
আরে হেইডাতো ভালো খবর।

চালন খান এখন অন্যাকাজে ব্যবহার করি। স্নান করার সময় পুকুরে কচুরি পানায় খেও মারি। তাতে কিছু গুঁড়া চিংড়ি ও মলঙ্গি মাছ পাই,খাবারের কাজ চলে যায়।
এবার বানালাম একটা ছোট্ট টেবিল
উপরের পার্ট আলাদা। নীচে কাঠের দুইটা চেঙ্গি বানালাম। সেটা ভাঁজ করা যায়। আবার ডালার নিচে দিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে একজায়গায় ব্যবসাও করা যায়। ডালার উপরে টিনের জেরে ভরে মালপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে হাট শেষে মাথায় করে বাড়ি ফেরা যায়।
একটি টিনের জেরে রাখতাম বিড়ি সিগারেট।আর অন্য গুলোতে রাখতাম বাদাম,বিস্কুট,মদন কটকটি,ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার এই নতুন ব্যবসা ভালোই চলছে।
পাউরুটি বিক্রির চাইতে আয়রুজি ভালো।
যেখানে গরুর হাট বসত, সেখানেই পাশে আমার দোকান পাততাম।
একদিন এক কাটুন স্টার সিগারেট বিক্রি করলাম সাড়ে ছয়টাকায় । হিসাব করে দেখলাম লাভ হলো একটাকা।
খদ্দের আমারে পাঁচ টাকার একটি নোট দিল,বাকি খুচরো।
লাভের সংখ্যা ভালোই বুঝলাম। কিন্তু
তখন কুট্টি কাল,নোটের মুদ্রা হাচা না মিছা সেইটার বোধ ভালো করে জন্মায়নি।
টাকা গলায় ঝুলানো খুতিতে রাখতে গেছি,তখন পিছনে দাঁড়ানো পুলিশের স্পাইকে দেখলাম। আমার দোকান থেকে একখিলি পান খেলো সে হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে। বাহ জর্দায় কি সুন্দর ঘ্রাণ।
চারপাশ ম ম করে তার ঘ্রাণে।
আমার মনে বেশ খুশ খুশ ভাব। লাভের কথা ভেবে ভেবে।
ভাবের চোটে একটা বিড়ি ধরলাম। ধরিয়ে পর পর কষে কয়েক টান মারলাম। খদ্দেরের ভালো ভিড় তখন দোকানে।
স্পাই বেটা আমারে কয় মুখের তন বিড়ি ফেলা। দোকান বন্ধকর। আমার সাথে চল।
–কোথায় ?
–থানায়।
পাশেই আমাদের থানা ও বাজার প্রায় ।মিলানো।
স্পাইয়ের কথা কেমন মস্তানী মস্তানী ভাব !!
নেশার পর্ব তখন থেকেই। মুখের বিড়ি ফেলাইয়া দোকান গোটালাম।
আমারে কইল খুতির থিকা ওই পাঁচ টাকা আমার কাছে দে।
থানায় গেলে বুঝবি ওই টাকার নতুন নাম।
–মনে মনে ভাবলাম, বেটা কয় কি ?
টাকার আবার নতুন নাম ? — নাকি মারিং কাটিং করার ধান্ধা করছে ?

দোকান গুটিয়ে তার সাথে থানায় গেলাম।
বড় সাহেব মনে বড় দারোগা বলল,এই টাকা, জাল টাকা।
তোকে হাজত খাটতে হবে। মনে মনে ভাবলাম,বোধের ভাণ্ডার হোঁচট খেয়েছে।
আম ছালা দুটোই গেছে।
এক রাত হাজত বাস করে সেই টাকা খুঁইয়ে বাড়ি ফিরলাম পরদিন।
মনে মনে ভাবলাম,ব্যবসার খ্যাতা মারি!

লেখাপড়া তালপাতাতে বাঁশের কঞ্চি আর ভাত রান্নার হাঁড়ির তলায় কালি দিয়ে গাছের তলায় ছেঁড়া ছালা বিছিয়ে তালপাতায় সরেও সরেয়া লিখতাম।
বিদ্যার খাতা ওখানেই শেষ।
দিন কতক পরে বয়স বাড়তে থাকল। তবে যৌবনের ধাক্কা আসেনি তখনও। হিশু করতে গেলে নুনু খারাইত হেইডা টের পাইতাম।
তারও আগের কথা। একদিন পুকুরে হাঁটু পর্যন্ত কাঁদার মধ্যে থালা দিয়া সিং মাছ ধরতেছি। বাবায় কইল ওঠ ছেমরা, হাত পাও ধোঁ। আমার সাথে স্কুলে চল,তোরে ভর্তি করব। আধ বুড়া হৈতেছস পড়াশুনা লাগব না…
খালি মাছ ধরলে হইব ??
বাবার আদেশ শিরোধার্য। হাত পাও ধুঁয়ে অর্ধ ছেঁড়া কাঁদা মাখানো সেই হাফপ্যান্ট পড়েই ছুটলাম বাবার পিছনে পিছনে।
স্কুলে নিয়ে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করল।চোখ বুইজা ফাইভ পাস করলাম দুই বছরেই।
মাইনষে কইত ছেমরার মাথায় বুদ্ধির জাহাজ।
টপ টপ কইরা খালি পাস দেয়।
এমনি একদিন বাবা হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।
বয়স তখন বার হইতে পারে।
ধরলাম ব্যবসা। পুলিশের সঙ্গে একরাত কাটিয়ে বোধকে জিজ্ঞাসা করলাম,আমি কি করব এখন ?
বোধ বলল, হারামজাদা বিড়ি বান্ধার কাজ শেখ।শিখলাম কয়েকদিনের মধ্যেই।
অফার এলো আমার কাজের।
ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটলাম মাদারীপুর শহরে।
বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। তাতে কি ?
আমার সঙ্গী পেলাম কয়েকজন। হাসি আনন্দে দিনগুলি কাটতে লাগল। তখন আটষট্টি সালের কথা। ইচড়ে পাকা বয়স।
যৌবন পাড়ভাঙা নদী। ঐশ্বরিক নির্দেশে যৌবনের সুতো বড্ড বেগতিক! এক এক করে তিনখান মাইয়ার প্রেমে পড়লাম।
একখান মুসলমান নাম সুফিয়া। বাকি দুইখান হিন্দু, শোভা ও মনিকা।
তিনতেতুলের টকঝালে কাটল কিছুদিন।
তার মধ্যেই ভর্তি হলাম নাইট স্কুলে। যারে কইত অবৈতনিক বিদ্যালয়।
প্রাইভেট মাস্টার রাখলাম বিদ্যাকে ঝালিয়ে নিতে। সে আমাকে নাইন টেনের বই থেকে বিদ্যা গেলাতে লাগল,আমিও গিলতাম ভালোই।

কিছুদিন কাটতে না কাটতেই শুরু হলো গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন। কালের চক্রে জড়িয়ে পড়লাম তাতে। এখন প্রতিদিন জীবনযাত্রা রাজপথেই। পরিচয় ঘটল ফণীভূষণ মজুমদারের সাথে।
কলেজের ভিপি বলল, তুমি দাদার নজরে পড়েছে। চলো তোমাকে নিয়ে যাই তার দরবারে।
গেলাম কোন এক সন্ধ্যায়। টিনের চৌচালা বাড়ি।সোফায় বসলাম। নামধাম ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে সববিষয়ে সমর্থন আছে বলে সান্ত্বনা দিলেন।
আশ্বাস শুনে আলহাদে আটখান হলাম।
কিন্তু ঝাণ্ডা তুলে রাজপথে স্লোগান থেকে মুক্তি নেই।
ওদিকে আবার তিন মোহনার জল গুলিয়ে হল একমোহনা।
তার মানে একজন ধনীর জন্য বেশি সুন্দরীর চাপে দুই মোহনায় চড়া পড়ল।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দুদিন পরে আমাদের এখানে সভা করলেন। আমরাই সবকিছু সাজানো গোছানো কাজ করলাম।
ফণীভূষণ মজুমদার মুজিবের সাথে পরিচয় করালেন। তাঁকে একটা হলুদ গাঁদার মালা পরাতে গেলে আমায় বুকে টেনে নিলেন। আমি ধন্য হলাম।
বুঝলাম বোধগুলি জেগে উঠেছে।সাবালক হয়েছে।
আমার অনির্ধারিত প্রেমের কথা কেউ ফণী দাদার কানে তুললেন।আমাকে ওপথ বর্জন করতে বললেন।
আমি বর্জন করলাম।
তারপর একাত্তর শেষ করে পরীক্ষা দিলাম,পাস করলাম।
শেষে বোধের তাড়নায় উপরের ক্লাস শেষ করে সরকারি চাকরি।
অবসর নিয়ে কবির দলে ভিড়লাম।
—– সমাপ্তি

মন্তব্য করুন