Skip to content

বিমলা — রমেন মজুমদার

বিমলা
—–(ছোটগল্প)
রমেন মজুমদার
১৭/০৯/২০২৩
[[ গল্পটি না পড়ে কেউ কমেন্টস করবেন না ]]
—-(শব্দ সংখ্যা-2970)
“বিদুষী বিমলা তুই,ভেবেছ কী মনে;
কোথা প্রেম থুই–হৃদপ্রাণ বক্ষ বনে।
তোমা হেরি বাঁচি কী রে যৌবনের সনে-
সুখ-দুঃখ ঢালি যবে, বিচিত্র ভুবনে।।”

(১)
তখন তেতাল্লিশের মন্বন্তর বঙ্গ প্রদেশ জুড়ে।ভাত বিহীনে শত শত মানুষ না খেয়ে মৃত্যুরকোলে প্রাণ হারিয়েছে।
একমুষ্টি ভাতের জন্য কিম্বা ভাতের মাড়ের জন্য কত মানুষ যে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত, তার হিসেব কষে বিজ্ঞজনেও হিমশিম খেয়েছে। পড়নে অনেকেরই ছিলনা কোন নতুন বস্ত্র।
ছেঁড়া গামছা,ছেঁড়া শাড়ি,ছেঁড়া পেটিকোট,অর্ধউলঙ্গ ব্লাউজ কিম্বা সেই ব্লাউজের পরিবর্তে অর্ধ ছেঁড়া গামছা দিয়ে বুক ও নিন্মাঙ্গ ঢেকে ওরা নুন-ফেন কুড়াতে আসত বাড়ি বাড়ি। জীর্ণ শরীর
কঙ্কালসার দেহ নিয়ে একমুঠো ভাত বা ভাতের ফেনের জন্য মাটির খোঁড়া নিয়ে দলে দলে ঘুরত গ্রামের পর গ্রাম।
এ’হেন দুর্ভিক্ষ যেন পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনদিন লেখা রয়েছে বলে আমার জানা নেই।

(২)
সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বিমলার বয়স এগার বছর। ফুঁটফুঁটে চাঁদের মত মিষ্টি চেহারায় যেন জ্যোৎস্নার আলো ডুবে গিয়ে অমাবশ্যার রেখায় রূপ নিয়েছে।
কেবল চোখের তারায় রূপের ঝিলিক অনুভব করা যায়।
বুকের বত্রিশ হাড় চামড়ায় টান পড়েছে। বক্ষে জাগ্রত স্তনযুগল সবে প্রবৃদ্ধির হাতছানি দিয়ে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধকে
হাতের ইশারায় আকুতি হয়ে ডাকছে।
পড়নে হাফপ্যান্ট।
বুকে বেষ্টিত মায়ের পুরাতন শাড়ির এক ক্ষুদ্র অংশ দ্বারা পেঁচিয়ে রেখেছে।
হাঁটুর কিছু উপরের অংশে উদোম,সেখান থেকে পায়ের পাতা অবধি কাদা-মাটিতে একাকার! সে এসেছে তার মায়ের সঙ্গে ভিক্ষে করতে।
ওঁরা আজ দুদিন যাবৎ কিছু খায়নি।
বাবা অসুখে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। ওষুধ কেনার পয়সা নেই। আর তখন পাঁচ গ্রাম খুঁজেও কোন ডাক্তার পাওয়া যেত না।
এই কষ্টের দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে কবির দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এমন সময় দুইখোঁড়া ভাত ও একখোঁড়া মাড়ের সন্ধান মিলল সেন বাড়ির দরজায় এসে।

(৩)
মেয়ে বিমলা ও মা বিদুষী ভাত ও ভাতের ফেন পেয়ে ওরা খুশিতে টগবগ করছে।
মনে হলো বুকের দহন ক্ষিধায় খৈ ফুঁটছে !
ওঁরা এক খোঁড়া ভাত পাশে রেখে দিয়ে আর এক খোঁড়া ভাত ও ভাতের ফেন
মা-বেটি দুজনে সেন বাড়ির সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে হাপুস হাপুস খেয়ে দগ্ধ চিতার আগুনে জল ঢেকে দুজনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বিদুষী বিমলারে কয়, মা রে! কত দিন পরে দুগ্গা ভাত খেলাম,কী শান্তি যে লাগছে !!
তোকে বুঝাতে পারছিনা ।
— বিমলা, হ’ মা, এই বাড়ির মানুষ গুলা ভালো। পেট ভইরা খাইতে পারলাম। পড়ানডায় শান্তি লাগছে।
বাড়ির কর্তা মশাই শ্যামচরণ সেন গিন্নিরে কইল, আমাগো এত বড় বাড়ি; ওরা গরিব মানুষ। আমাগো বাড়িতে কত ঘর ফাঁকা পইড়া আছে, এক খানে ওরাতো থাকতে পারে। আমাগো আপদে বিপদে কাজে লাগব। বাড়িতে ঝাড়-পোছ দেওনের মানুষ কই ?
হ্যাগো দিয়া এই কাম করাইতে পারবা।
গিন্নি শ্যামলী সায় দিয়ে বলল, তাইলে থাকুক হেরা ।
শ্যামচরণ পরানে দক্ষিণা বাতাসের গন্ধ পেল। মেঘের আকাশে অলোক দ্যুতির
সীমান্ত রেখার অনুসন্ধান পেল। পাহাড়ের গাঁয়ে ধবলগিরির চিহ্ন দেখতে পেল।বাড়ির ঠাকুর ঘরের পিদিম জ্বেলে ওঠল আরও প্রখর উজ্জ্বল হয়ে।
এতদিন মনের আকাশে যত মেঘ জমে জমে কাল পাহাড়ের পাদদেশে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল,আজ তা ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে চলেছে।
অন্তরজুড়ে ভোরের নরম আলোর মত শ্যামচরণ আড়মোড়া দিয়ে সঙ্গোপণে নতুন পৃথিবীর বুকে নিজেকে মেলে ধরতে পারার একটা সূক্ষ্ন ইঙ্গিত পেয়ে গেল।
—-
(৪)
গিন্নির সবুজ সংকেত পেয়ে শ্যামচরণ
বলল,
তয় তোমরা মা-বেটি আইজকা থাইকা যাও আমগো বাড়িতে। কাইল থন তোমরা ইচ্ছা করলে আমগো বাড়িতেই থাকবার পারবা।
— বিদুষী বলল, না। ঘরে অসুস্থ স্বামীরে থুইয়া আইছি। হ্যার জন্য এই এক খোঁড়া ভাত নিয়া যাই। হ্যায় না খাইয়া রইছে।
–শ্যামচরণ বলল, তাইলে অহন যাও। স্বামীরে গিয়া ভাত খাওয়াও।
কাইল থন আমাগো বাড়িতেই থাকবা। আমগো ঘরের অভাব নাই। নিচ তলায় তিনটা ঘর ফাঁকা।
আমগো দোতলায় একটা ঘর এমনিতেই ফাঁকা থাকে। চিলা কোঠায় বড় একটা ঘর পইড়া আছে, মানুষ কই ?
–বিদুষী ক্যান কর্তামশাই আপনার আর মানুষ নাই ক্যান ?
–আর কইও না। আমিও যে কি শান্তিতে আছি হেইডা বুঝবা না।
জানতে চাইলে আর একদিন কমুনে।
—-
(৫)
মন্বন্তর শুরুর মধ্যেই আবার রায়ট-দাঙ্গা! এই দাঙ্গা শুরুর আগেই আমার শ্বশুর কুলের সবাই ভারত চইলা গেছে। আমারে কইছিল আমার শ্বাশুড়ি
শ্যামচরণ তুমিও আমগো নগে চলো, ভারত যাই। এইহানে হিন্দুরা থাকব কেমনে ?
দিনরাইত লুট-ছিনতাই।কেডা শান্তিতে থাকব ?– তাই হ্যারা ভারত গেছে।
শ্যামচরণ বলল বিমলার মায়ের কাছে।
—-
(৬)
পরের দিন বিমলা ও তার মা এলো সেন বাড়িতে ভাত নিতে। সেদিন তিনজনের ভাত-তরকারি দিয়ে দিল। ওরা সেগুলো নিয়ে সেদিনের মত বাড়ি চলে গেল।

(৭)
শ্যামচরণের স্ত্রী শ্যামলী প্রায় বছর খানেক যাবৎ শারীরিক ও মানসিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ।
তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে,শ্যামলী অসুস্থ!! নিঃসন্তান শ্যামলীর মনে অনেকটাই কষ্টের পাহাড় বুকের মধ্যে জমে আছে। বিষয় সম্পত্তির প্রতি কোন লালসা তাঁর নেই। শুধু একটাই আফসোস যে তিনবছর আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও নিজের অক্ষমতার জন্য স্বামীকে কোনদিন সুখ দিতে পারেনাই। তাই বলে শ্যামচরণ কোনদিন স্ত্রীকে কটুকথা শোনায়ও নি।
শ্যামলীর জরায়ুর সমস্যার জন্য হয়তো কোনদিন সন্তানের মুখ সে দেখতে পাবেনা।
এই চিন্তায় শ্যামলী রাতদিন নীরবে নীরবে অশ্রু ফেলে, যাতে স্বামী বুঝতে না পারে।

(৮)
কলকাতা থেকে একদিন টেলিগ্রাম এলো।
দিদি শ্যামলীকে নিয়ে জামাইবাবু যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে।
দিদির সঠিক চিকিৎসা করানোর জন্য দিব্যেন্দু টেলিগ্রাম করেছে ।
শ্যামচরণের একমাত্র শ্যালক দিব্যেন্দু ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কলকাতার বিরাটিতে দ্বিতল বাড়ি কিনে দিব্যি আছে তারা।
কিন্তু শ্যামচরণ বিষয়সম্পত্তি বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চাইছে না।
উল্টো শ্যামচরণ তাঁর শ্যালককে টেলিগ্রাম করল এই যে,
এই মুহূর্তে তাঁর বাড়িঘর রেখে কলকাতা যাওয়া চলবে না।বরং দিব্যেন্দু যেন এসে তাঁর দিদিকে নিয়ে যায়।
পরদিন সেই টেলিগ্রাম গিয়ে পৌঁছল বিরাটি।
দিব্যেন্দু টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে এলো চাঁদপুরে স্টীমার যোগে দিদির বাড়িতে।
—-
(৯)
আকাশে মেঘ থৈ থৈ করছে। ।মেঘনা- যমুনা পদ্মার ত্রিধারা এই নদীর মোহনায় এলে সবাই ভয়পায়। কারণ, একদিকের জল ডালিমের রসের মত স্বচ্ছ,আর একদিকের জল নীল-কালচে,অন্যধারার জল মাটির ঘোলা যেমন তেমনটি দেখতে। এ যে পদ্মার জলধারা।
কিন্তু ঈশ্বরের কী লীলা খেলা যে, এই গাঙ্গেয় জল কারো সাথে কারো সঙ্গম হয়না। কেউ কারও সাথে মিলেও না। একটা বলিরেখার মত চিহ্ন এঁকে রেখেছে
স্বয়ং ঈশ্বর।
স্টীমার ঘাটে এসে ভিড়ল। দিব্যেন্দু এলেন তাঁর বোনের বাগানঘেরা বাড়িতে।

(১০)
শ্যামলী জানত যে সে কোনদিন মা হতে পারবে না। তাঁর জরায়ু সমস্যা। মাসে এক আধ বার স্বামীর জোড়াজুড়িতে মিলনে বাধ্য হলেও তাঁর অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু শ্যামচরণ তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা কোনদিন পূর্ণ করতে পারেনি। জৈবিক ক্ষুধা অন্তরের মধ্যেই গুমরে কাঁদতো।

শ্যামচরণ জানত যে তাঁর স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাবে।
তখন তাঁকে দীর্ঘসময় সেখানেই থাকতে হবে।
তাই সেদিন কী ভাবে স্ত্রীকে বলেছিল বিমলাদের ভাতকাপরের অভাব! তা ছাড়া বাড়িতে কেউ স্থায়ীভাবে না থাকলে ঘরদোর পরিষ্কার করবে কে ?সেই প্রস্তাবে কালক্ষেপন না করে শ্যামলী সম্মতি দিয়েছে যে থাকুক আমাদের বাড়িতে এসে।
আমার যদি কোনদিন কলকাতা যাওয়া হয়,তখন এই মস্তবড় অট্টালিকা খাঁ খাঁ করবে। বাড়িতে কেউ থাকলে ওঁনার খাওয়াটা সময়মত হবে। নইলে না খেয়েই দিন কাটাতে হবে ।
—-
(১১)
আজ শনিবার বলে দিব্যেন্দু তাঁর দিদিকে নিয়ে ঘরের বাহির হল না। কাল রবিবার প্রত্যুষে রওনা হওয়া যাবে।
রাতে কারোরই ঘুম হলোনা। স্বামীকে ছেড়ে অনেকদিন কলকাতা থাকতে হবে। সেই কষ্টে শ্যামলী সারারাত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাল।
দুইবার অনুরোধ করল,হ্যাগো,এসো একবার আমরা মিলিত হই।–এ কথা শ্যামচরণ বিনয়ের সাথে স্ত্রীকে অনুরোধ করল। স্ত্রীর এতে ইচ্ছে নেই বলে জানিয়ে দিল।
সে জানে, যদি আমরা সহবাসে লিপ্ত হই তবে অযাচিত রক্তক্ষরণ হতে পারে। অসহ্য ব্যথা হয় ওতে!
আর সেই ব্যথা নিয়ে ভাইয়ের সাথে কলকাতা কাল তা হলে যাওয়া হবেনা।
স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বাহ্যিক আদর করল। শ্যামচরণের গালে,মুখে চুমুদিয়ে আদর খেল। তখন শ্যামচরণ নব্বই ডিগ্রি ফরেনহাইটে টগবগ করছে। স্ত্রী বুঝতে পেরে নিজের বক্ষ খুলে স্তন তাঁর মুখে পুরে দিয়ে বলল, এই নাও। তোমার ইচ্ছেয় যত পারো এ’দুটো নিয়েই আদর করে খুশি থাক।
তুমিতো জানোই যে, সঙ্গম করলে আমার কষ্ট হয়,রক্তক্ষরণ হয়।
—-
(১২)
রাতে কারোরই ঘুম হলোনা।
শেষে দুজনেই ভীষণ কান্নাকাটি করল।
দীর্ঘদিন কেউ কাউকে দেখতে পাবে না।
ভোর হবার আগেই শ্যামলী বেসামাল কাপড় চোপড় ঠিক করে নিল।
শেষে স্বামীর পায়ের কাছে মাথা নুইয়ে আশির্বাদ চাইল।
শ্যামচরণ স্ত্রীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তাঁর দুই চিবুকে ও মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,তুমি ভালহয়ে ফিরে আসবে,কোন চিন্তা করবে না।
ভোর হয়ে গিয়েছে। মোল্লাপাড়ায় আযানের ধ্বনি শুনতে পেল। সেই সাথে বড় বড় মোরগের কর্কশধ্বনি যেন জানান দিয়ে গেল,ওরে সকাল হয়েছে…
তোরা বেরিয়ে পরো ! সকাল ছ’টায় স্টিমার ছেড়ে যাবে চাঁদপুর ঘাট থেকে কলকাতার উদ্যেশ্যে।
দিব্যেন্দু পুকুর থেকে স্নান সেরে নিল। দিদিকে শীঘ্রই তৈরি হতে বলল। সময় বেশি নেই..
সময় যেন দ্রুত চলে যাচ্ছে শ্যামলীর কাছ থেকে। মনে হচ্ছে আয়ু-পরমায়ু আর নিত্ত্বি মাপা সময়গুলো কেবলই দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।
শ্যামলী মনমরা হয়ে কয়েকটা শাড়ি ব্লাউজ,পেটিকোট সুটকেসে ভরে নিল। সেই সুটকেস নিয়ে দিব্যেন্দু বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্যামলী ধীরে ধীরে গেল শ্যামচরণ এর কাছে। তারপর দুটি হাত পা ছুঁয়ে মাথা নুইয়ে প্রণাম করল। কিছু কষ্টের আকুতি ভরা অশ্রুজল পায়ের উপরে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ল।
ওদিকে স্টিমারের ভোঁ ভোঁ শব্দ হুইচেল দিল। শ্যামলী ধীরে ধীরে স্বামীর কাছ হতে বিদায় নিল।
মনে হল এই সংসার কেউ কারো জন্য নয়। সময়ের গতিধারায় মানুষ ঘূর্ণি হয়ে হওয়ায় ভাসছে। প্রেম ভালোবাসার মধ্যে যেন একটা পাহাড়ের ফাঁটল দেখা দিয়েছে।
ইচ্ছে করলে এখন সেই খণ্ডিত পাহাড় ডিঙিয়ে একজন আর একজনের কাছে আসা প্রায় ক্ষীণ!!
এ সংসারে বুঝি কেউ কারো নয়। কেউ অপেক্ষায় করেনা কারো জন্য।
একটা মায়ার চক্র মাকড়সার জাল বুনে দিয়েছে ইহকালের জন্য। আমরা সেই মোহের সুতোয় কেবল চারপাশ দিয়েই ঘুরেই যাচ্ছি সেই জালের সুতো ধরে ।
কিন্তু এই মোহজাল ছিন্ন করে কার সাধ্য আছে যে সে বেরিয়ে আসতে পারবে ??

(১৩)
মুহুর্মুহু অশ্রু বিসর্জন করে শেষ বিদেয় নিল শ্যামলী। শ্যামচরণ এগিয়ে দিয়ে এলো স্টীমার ঘাট পর্যন্ত।
সময়ের মাপা কাঁটায় চলে যেন সবকিছু।
ওরা স্টিমারে গিয়ে ওঠল। শেষ হুইসেল দিয়ে নোঙ্গর তুলল।
ভোঁ ভোঁ করে গন্তব্যে ছুটল স্টীমার। শ্যামলী দ্বিতলে ছাদের রেলিং ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল। যতক্ষণ দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এক চিলতে আবছা দর্শন পাওয়া যায়,ঠিক ততক্ষণ একে অপরের প্রতি তাকিয়ে কেবল বিয়োগান্তক দীর্ঘনিঃস্বাস ছাড়ল।
স্টিমার দৃশ্যের আড়ালে চলে গেল।ভাঙ্গা মনে স্ত্রীকে বিদেয় দিয়ে শ্যামচরণ ভীষণ মানসিক নিঃসঙ্গতায় ঘরে ফিরে এলো।

(১৪)
দিন গড়িয়ে যেতে লাগল। কালের নিয়মে মানুষ পুরাতনকে ভুলে গিয়ে নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে চায়,ভাবতে ভালো লাগে এটাই বুঝি মায়ার চক্র!
বিমলারা এ বাড়িতে এসেছে শ্যামলী থাকতেই। শ্যামলী যাবার আগে বিমলার মা’কে বলেছিল যে, তোরা থাকলি।দেখিস শ্যামচরণের সময়মত খাওয়া দাওয়ার কোন বিঘ্ন না ঘটে। সেই মত বিদুষী যথাসাধ্য চেষ্টা করে বাবুর যাতে দেখভালের কোন বিচ্যুতি নাহয়।
বিদুষীর ওই একমাত্র মেয়ে বয়স আর কতইবা ? বিদুষীও অনাহারে অর্ধাহারে রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে উপোসি জীবন যাপন করছে। তার দেহেও তো যৌবনের গণগনে
আগুন চাঁপা পরে আছে। ওদিকে মেয়েটা ঝাঁকি দিয়ে বেড়েই চলছে।
বিদুষীও শ্যামচরণ এর খাওয়া দাওয়ার কোন ত্রুটি হয় কী না তার যত্ন নিতে থাকে।
—-
(১৫)
শ্রাবণ মাস শেষ হয়নি এখনও।
দীর্ঘদিন যাবৎ তালপিঠে খায়ার ইচ্ছে ছিল বিমলার। অভাবের সংসারে সে আশা ছেড়েই দিয়েছে বিমলা।
শ্যামচরণের শানবাঁধানো পুকুর পাড়ে একটি তালগাছে তাল দেখে তার সে কথা মনে পড়ল। মনে মনে ভাবছে, যেদিন গাছথেকে তাল মাটিতে পড়বে,সেদিন মাকে বলবে তাল পিঠে খাওয়ার কথা।
আরও কত কী ভাবছে সে একা একা।এতো বড় বাগান বাড়ি তার জীবনেও দেখেনি। কী সুন্দর সিঁড়ি! পাথর বসানো।
বিমলা তার উপরে বসে হাত দিয়ে দেখছে,
আহারে কী ঠাণ্ডা ! ইচ্ছে করে এখানেই গা এলিয়ে শুয়ে থাকি।
শ্যামচরণ রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।বিদুষী এসে বিছানা সাজিয়ে দিয়ে গেল।
শুয়ে শুয়ে তার ঘুম আসছে না, মনের মধ্যে শ্যামলীর কথা বার বার মনে হল। কাছে থাকতে মানুষ মানুষকে গুরুত্ব দেয়না। চোখের আড়াল হলে জীবনের হিসেব-নিকেশ এক এক করে মনে এসে ভিড় জমায়। শ্যামলীকে যে প্রচণ্ড ভালো বসে। স্ত্রীর অমর্যাদা কোনদিন করেনি শ্যামচরণ। তারপর আরও কিছুক্ষণ তাঁর অসুখের ভাবনা ভাবতে গিয়ে দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আহারে ! সে কী কোনদিন মা হতে পারবেনা ? হায় ভগবান তুমি ওকে ভালোকরে দিও। শেষে মাথার কাছে রাখা হ্যারিকেন নিভানোর আগে একবার বিদুষী এসে একগ্লাস গরম দুধ দিয়ে বলল, কর্তাবাবু এখন এই দুধগ্লাস খেয়ের ঘুমিয়ে পড়ুন।
–কী করে ঘুম আসবে বিদুষী ?
এ যে এক কঠিন যন্ত্রণা! বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করছে আগুন, যদি দেখাতে পারতাম,তবে কিছুটা শান্তি পেতাম।
শ্যামচরণ শেষে বিদুষীর অনুরোধে দুধগ্লাস ঢক ঢক করে পান করে গ্লাসটা টেবিলে রাখল।
বিদুষী হ্যারিকেন নিভিয়ে দিয়ে গ্লাসটি নিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান হল।
—-
(১৬)
কী জানি কি আছে,–কী নাই ! চোখের দুটি পাতা এক করতে পারল না। ওদিকে কলকাতার কোন সংবাদ আসছে না। সাতপাঁচ ভেবে ভেবে ভোর রাতের দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এলো শ্যামচরণের দুটি চোখের পাতা।
ভোরের দিকে থানায় ঢং ঢং করে সময়ের ঘণ্টা বেঁজে ওঠল। পশ্চিমের মোল্লা পাড়া থেকে মাইকে আযানের ধ্বনি এলো কানে।বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে ডাহুকের গা ঝরা পাখার জাপটার শব্দ শুনতে পেল শ্যামচরণ।
বিদুষীরা থাকে বাড়ির নিচতলায় উত্তর পাশের একটি কক্ষে। সে ঘরের পিছনে বেতকাঁটার জঙ্গল ।পাশেই কিছু মানকচুর গাছ অনেক বড় হয়ে দেয়ালে লেপ্টে আছে।
অনেক পুরাতন আমলের বাড়ি এটা। শ্যামচরণের ঠাকুরদার আমলের বাড়ি। শ্যামরণের বাবা থাকতে কিছু সংস্কার হয়ে থাকলেও শ্যামচরণ তাঁর আমলে কোন কাজ সে করেনি বাড়ি সংস্কারের জন্য
বাড়ির অধিকাংশ স্থানেই শ্যাওলা জমে তার ভিতর ছোট ছোট নাম না জানা লতা পাতার গাছ জমে আছে।
নিচতলায় ঘরগুলোর অধিকাংশ জানালা দরজার অবস্থা আশঙ্কাজনক দুর্বল। কোন কোন জানালার পাল্লা অর্ধেক খুলে ঝুলে আছে। বড়সড় ঝড়ঝাঁপটা এলে পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

(১৭)
সকাল হয়েছে । আড়মোড়া দিয়ে শ্যামচরণ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াল। নিচ তলায় বিদুষী ও বিমলার কান্নার শব্দ আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠল। তড়িঘড়ি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় শ্যামচরণ পা স্লিপ কেটে ধপাস করে পরে গেল।পায়ের হাঁটুতে বড়সড় আঘাত লেগেছে।
নির্জন বাড়ি। দক্ষিণ পাড়া থেকে দুজন লোক ছুটে এলো সেন বাড়িতে।
কোনরকম পা ব্যথা নিয়ে শ্যামচরণ এলো ঘরে। বিদুষী কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়ল শ্যামচরণের পায়ের উপর।
বিমলা হাউ হাউ করে কেঁদে বলল,
দাদু বাবা আর বেঁচে নেই। এই দ্যাখ বাবার পায়ের পাতায় কীসে যেন কামড়িয়ে দিয়েছে। রক্ত ঝরছে!
শ্যামচরণের বুঝতে বাকি রইল না।
নির্ঘাত সাপে কেটেছে।
বাড়িতে আসা লোক দুটি তারই চিরচেনা।
শ্যামচরণ বলল, হরি তুই দেখ, বিনোদ ওঝাকে খুঁজে পাশ কিনা (?)
হরিচরণ ছুটে গেল বিনোদ ওঝার বাড়িতে। গিয়ে শুনল সে মাঠে জমির পাঁকা ধান তুলতে গেছে।
হরি এক দৌঁড়ে বিনোদ ওঝাকে নিয়ে এলো।
সবকিছু দেখে বলল, কর্তামশাই এ’আমার সাধ্যের বাইরে!
একঘণ্টা আগেই জাতি সাপে দংশন করেছে। দেহে প্রাণ নেই। আমাকে বেটে গুলিয়ে খেলেও ওঁকে বাঁচানো সম্ভব না।
—-
(১৮)
শ্যামচরণ হরিকে ডেকে বলল, কি আর করবি ?
এবার শ্মশানের ব্যবস্থা কর। পুকুর পাড়ের বড় আমগাছের ডাল কেটে দাহ করার ব্যবস্থা নে।
বিদুষীকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেল না শ্যামচরণ। ডাগর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে যেতে পারলনা। সব আমার জন্যই বুঝি ওদের কপাল পুড়ল ?
হরিচরণ, বিন্দু সকলে মিলে আমকাষ্ঠ দিয়ে পুকুরের উত্তর পাশের ভিটেয় দাহ করার ব্যবস্থা হল। যেখানে শ্যামচরণের পূর্বপুরুষ ঘুমিয়ে আছে,সেখানেই লাশ দাহ করার জায়গা ছেড়ে দিল শ্যামচরণ।
—-
(১৯)
প্রায় একমাস পেরিয়ে গেল। শ্যামচরণের পায়ের ব্যথা কমছে না।
বিদুষীর স্বামীর যাবতীয় ক্রিয়াদি সুসম্পন্ন হয়ে গেছে।
ওদিকে কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম এলো,শ্যামলীর অপারেশন হয়েছে। তাঁর সন্তানদানির নাড়ি কেটে বাদ দিতে হয়েছে।
তাঁর সুস্থ হতে আরও দীর্ঘ সময়ই লাগবে।
শ্যামচরণ সবিস্তারে অবগত হলেন।
দেখতে দেখতে আরও একটি মাস পেরিয়ে গেল জীবন থেকে। বিদুষীর আর কোথাও যাওয়ার প্রান্তিক জায়গাটুকু নেই জেনে এই কর্তার সেন বাড়িটিকে নিজের ভেবেই বাড়ির সমস্ত কাজের হাল ধরল।
সংসার ক্ষণস্থায়ী জেনে বিদুষী মনে সান্ত্বনা দিয়ে বিমলাকে বলল,মা দেখিস তোর দাদুর যেন কোন অসুবিধা না হয় ?
সেই থেকে ওরা আর নিচের ঘরে থাকে না।
শ্যামচরণের অনুরোধে ওরা দোতলায় জায়গা পেল।
শ্যামচরণ তাঁর পায়ের যন্ত্রণার অনুফান নিজেই বিদুষীকে দিল এই যে,
শোন বিদুষী সর্ষের তেল ও নুন গরম করে কিছুদিন মালিশ করলেই সেরে যাবে। সেই মত তাঁর চিকিৎসা চলতে থাকল।

(২০)
শারদ উৎসব মহারম্ভে শেষ হয়ে গেল। তার আগে শ্যামচরণ বিদুষী ও বিমলার জন্য নতুন পোশাক কিনে আনিয়ে দিল ওদের জন্য । শ্যামচরণ বিমলাকে ভীষণ ভালোবাসে। নিজের কোন সন্তান নেই বলে বিমলাকে নিজের সন্তানের চাইতেও অধিক স্নেহ করে। বিদুষী মনে মনে শ্যামচরণ এর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন। ঈশ্বর যেন তাঁর সার্বিক মঙ্গল করেন।
আজ কর্তা মশাই ছিল বলে আমরা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। মেয়েটার লেখাপড়া চলছে। ইতি মধ্যেই বিমলা ম্যাট্রিক দিয়েছে। হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই ফল বেরুবে। সেই অপেক্ষায় আছে শ্যামচরণ।
ভালো ফল হলে মেয়েটাকে কলেজে ভর্তি করবে।
পুজোর গন্ধকেটে গিয়েছে। নভেম্বর মাসে
প্রতি বছর একটা না একটা দুর্যোগ আসে। সেই আশঙ্খায় শ্যামচরণ প্রচণ্ড কাতর হয়ে আছে। সে ঝড়কে ভীষণ ভয় পায়। এমন এক নভেম্বরের ঝড়ে তাঁর বাবাকে হারিয়েছে। গ্রাম তছনছ হয়ে যায়। কত মানুষ যে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয় তার হিসেব বলা মুশকিল।
তাই শ্যামচরণ নভেম্বর মাস’টাকে ভয় পায়।
সেদিন ত্রিশে নভেম্বর উনসত্তর সাল ছিল। পায়ের ব্যথা কমেনি। বিদুষিই সবসময় তাঁর দেখভাল করে থাকে।
সকালে বন্দর থেকে হকার একটা পত্রিকা দিয়ে গেল শ্যামচরণের বাড়িতে।
এটা কর্তা মহাশয়ের একটা পুরাতন রুটিন বলা যায়। সে নিয়মিত খবরাখবর কাগজের মাধ্যমে দেখতে পায়।
রায়ট ও দাঙ্গা কমেছে। হিন্দুদের বঙ্গদেশ ছাড়ার হিড়িক কলামের হেড লাইনে দেখতে পেল। মন্বন্তরে যে কত মানুষ মরে ভেসে গেছে গাঙে,সে খবর দেখতে পেল শ্যামচরণ।
পত্রিকার শেষ পাতার হেডলাইনে ম্যাট্রিকের রেজাল্ট শিরোনামে দেয়া আছে। ভিতরের চতুর্থ পৃষ্ঠায় মেধা তালিকায় প্রায় পঞ্চাশ জনের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে।
আগ্রহ ভরে শ্যামচরণ তা দেখতে লাগল শুয়ে শুয়ে। প্রথম তিনজনের পরে বিমলার ছবি ও নাম দেখে উৎসাহে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিদুষী তৎক্ষণাৎ কর্তা বাবুকে ধরে বসালেন বিছানায়।
–, এই দেখ বিদুষী তোমার মেয়ে আজ আমার মুখ রেখেছে। ওর ফলাফল বোর্ডের মধ্যে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। আমার যে কী আনন্দ লাগছে এই বলে সে বিদুষীকে জড়িয়ে ধরল। বিদুষীর হিমশীতল শরীর বেয়ে উষ্ণ লাভা দরদর করে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নেমে এলো।
তারপর, বিদুষী কর্তার মহাশয়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বলল, সবটাই আপনার দান কর্তা।
এবার আমাদের মেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিতে শহরে পাঠাতে পারব,বললেন শ্যামচরণ।
খুশিতে বিদুষীর মৃত শরীরে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল।
—-
(২১)
আজ ত্রিশে নভেম্বর। আকাশ সকাল থেকেই গুমট হয়ে আছে। প্রকৃতির কোলে হাওয়া ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে গেছে। মনে হয় একটা কিছু দুর্যোগ নেমে আসবে। সেই আশংকায় শ্যামচরণকে পেয়ে বসল।
বিমলা এখন বড় হয়েছে। ওর জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হল চিলে কোঠার ঘরে। নতুন চেয়ার টেবিল আনিয়ে সাজানো হল ওর পড়া ও থাকার ঘর।
বেশ কয়েক দিন যাবৎ মা বিদুষী দাদু আংকেলের সেবায় নিয়জিত থাকে বলে শ্যামচরণের ঘরের পাশেই এতদিন ওরা যে ঘরটাও ছিল,সেই ঘরেই থাকে বিদুষী।
ওদিকে ভালো রেজাল্ট করায় একজন ইংরেজি শিক্ষক যিনি কলেজ থেকে রিটায়ার করেছে,তাঁকে বিমলার জন্য দু’বেলা পড়ানোর জন্য রেখে দিলেন শ্যামচরণ। সে এসে যথা সময়ে বিমলাকে পড়িয়ে যায়। তার জন্য মাস মাইনে প্রায় তিন হাজার টাকা ধার্য্য করাই থাকে।
বিমলা তার চোখে একজন দেবতার দর্শন পেলো শ্যামচরণকে পেয়ে।

(২২)
রাত যতই গভীর হয়,ততই আকাশ যেন বিরূপ হয়ে ওঠেছে। হালকা বৃষ্টির সঙ্গে মৃদু হওয়া ধীরে ধীরে তার গতি বেড়েই চলছে।
রাতের খাবার শেষ করে বিমলা চলে গেল তাঁর ঘরে উপরে। জানলা দরজা সেঁটে দিয়ে কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে সে শুয়ে পড়ল।
বিদুষী,শ্যামচরণকে তাঁর খাবার শোয়ার ঘরে টেবিলে এনে বলল, কর্তা বাবু এখন খেয়ে নিন। আমি খেয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে আসি। পরে আপনার পায়ে তেল গরম করে মালিশ করে দিব।
শ্যামচরণ বলল, বিদুষী আমার না আজ ভীষণ ভয় করছে।
বিদুষী বলল,ভয় কিসের ? আমি আছি,কোন চিন্তা করবেন না। এ যে প্রকৃতির খেলা!!
তার নিয়মে সে চলবে। আপনি খেয়ে নিন। আমি বাকি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি আসছি। বাইরে দমকা হওয়ার গতি যেন বেড়েই চলল। ঘরের আশপাশের গাছপালা মটমট করে ভাঙতে লাগল। তার শব্দ শ্যামচরণ স্পষ্ট শুনতে পেল।
তাড়াতাড়ি শ্যামচরণ টেবিলে রাখা খাবার শেষ করে নিল।
বিদুষী তাঁর কাজ শেষ করে শ্যামচরণের খাবারের এঁটো থালা-গ্লাস রেখে এলো রান্না ঘরের পাশে কলপারে।

(২৩)
রাত গভীরের সাথে সাথে ঝড়ের গতিবেগ বাড়তে থাকল। শ্যামচরণ আন্দাজ করল আবার আর একটা তেতাল্লিশের ধাক্কা সামলাতে দুর্যোগ মানুষের ঘাড়ে নেমে এলো।
বিদুষী হ্যারিকেনের ছাকনিতে তেল গরম করে শ্যামচরণের হাঁটুতে কতক্ষণ মালিশ করল।
আকাশে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকে আকাশ ঝলসে দিচ্ছে মুহুর্মুহু !
শ্যামচরণ ভয়ে বারবার বিদুষীকে জড়িয়ে ধরে ভয়কে জয় করতে চেষ্টা করল।
বিদুষী সময়ে সময়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে শ্যামচরণের মধ্যে। শ্যামচরণও তাঁর গতিপথ হারাতে লাগল।
আজ রাত কী যে মধুর লাগছে, এই মত প্রকৃতি যদি বিরূপ হয়,তবে লাভের অংক বেড়েই যাবে,আনমনা হয়ে ভাবল বিদুষী।
সেই ভাবনার মধ্যে কখন যে নদী সঁপে দিল সাগরের বুকে উজাড় করে। এ যে প্রকৃতির খেলা!
নইলে এমনটি কেন হবে। শ্যামচরণ ভুলে গেল তাঁর ভয় ও পায়ের ব্যথার কথা।
আজ কী তা হলে ঈশ্বর নবরূপে ইহ জন্মে আবার একটি নিখুঁত বাসর শয্যার মধ্যে রেখে দুইটি পুরাতন প্রেমকে পুড়িয়ে মারতে এই দুর্যোগ ?
সে কথা ভাবল ওরা একই অঙ্গে মিলিত হয়ে।
—-
(২৪)
পরদিন ঝড় থেমে গেল। কিন্তু প্রকৃতি যে সূত্র গ্রথিত করে দিলেন আজ,তার পুনরাবৃত্তি হতে আর কোন বাঁধা রইলনা।
সপ্তাহ খানেক পরে হরিকে দিয়ে উকিলকে খবর পাঠানো হল । উকিল এলো বাড়িতে।
বিষয় সম্পত্তির অর্ধেকটা বিমলার নামে উইল করে রাখল শ্যামচরণ। বাকি সম্পত্তি তার স্ত্রী শ্যামলীর নামে সম্পাদিত হল।
** সমাপ্ত–
🙏🙏🙏🙏🙏🙏

মন্তব্য করুন