Skip to content

প্রান্তিক স্টেশন -রমেন মজুমদার

প্রান্তিক স্টেশন
——–
(ছোটগল্প)
–রমেন মজুমদার,06/08/23
শব্দসংখ্যা-১০৫০
—–
দাদা একটু চেপে বসুন, আনত কণ্ঠে বলল সে।
নাম না জানা সদ্য বিবাহিত এক অল্প বয়সের মেয়ে থেকে বউ হয়েছে।
হাতে শাঁখা আছে তাও সরু। বুঝতে পারলাম ইনি জবাই হয়েছে।
একপলক মুখের দিকে তাকালাম। কপালে হিন্দু নারীর সিঁদুরের ফোটা থাকে বিয়ে হলে। এনার কিন্ত তা নেই। দেখলেই মনে হবে সদ্য পাপড়িতে জলের ফোটার আঁচ পড়েছে।
নিখুঁত নিটোল নির্বেদ এক বিদুষী কন্যা সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছে মাটির পৃথিবীতে। একটা তুলতুলে ভাব চেহারায়। একগোছা ববকাট চুলের ঝাঁকড়া বারবার আমাকে ঘাড়, মুখের কাছে দলন দিয়ে আমাকে সুড়সুড়ি তুলছে।
আনত যৌবন যে আমারও….
আমিও সদ্য স্নান সেরে উঠলাম গঙ্গা থেকে। যৌবনের ফুলকি নিশ্চিতরূপে আমাকে তা’ দিয়ে যাচ্ছে। সদ্য ভোরের ওঠা সূর্যের রশ্মির মিষ্টি রোদেলা যেন মনকে উষ্ণায়ন করে মিহিদানার মত ঝুরঝুরে ফুরফুরে করে আমাকে মুড়ি ভাঁজার মত ভাঁজতে লাগল।
এহি প্রেম! দূর ছাই….
আমিও যেন ফালতু একটা চিন্তা করে নিজেকে দুর্বল করছি।

ঝক ঝক করে ট্রেন ছুটছে গাছপালা,গ্রাম,পাহাড়,মাঠঘাট বিদীর্ণ করে। সপ্তাহান্তে দুদিন এই ট্রেন যায় বর্ধমান থেকে নানান জেলা বিদীর্ণ করে লালনের আখড়ায় কুষ্টিয়া। আদৌ কি যায় এই ট্রেন?– গল্প সাজাতে অসুবিধা কোথায় ? তারপর কুষ্টিয়া থেকে পদ্মা ব্রীজ হয়ে আরও দূরে কোথায় (?)
কথায় আছে গল্পের গরু গাছেও ওঠে। পাঠক ধরুন তেমনি আমার গল্পের যাত্রীরা শেষ স্টেশন দেখার বড্ড ইচ্ছে,সে ইচ্ছে আমারও হল।
শুনেছি এই ট্রেন প্রান্তিক স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছবে। প্রান্তিক বলতে একটি কথা।
জীবনেরও একটা প্রান্তিক ঠিকানা আছে,
থাকতেই হবে ।

দাদা একটু চেঁপে বসুন।
–চেপেছি। ঠাসাঠাসি করে মানুষ বসেছে। আমারতো চিরেচ্যাপ্টা হওয়ার মত অবস্থা!
আমা্র বাম পাশে যিনি বসেছে তাকে নিয়েই আমার গল্পকাহিনী তৈয়ার করা।
যৌবনা যুবতি। বয়স সাতের কি আঠার হবে।
নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। নাম আর কি জিজ্ঞাসা করব?
আমারতো বমি পাচ্ছে!
পাঠক ভাববেন,পাশে মেয়ে মানুষ থাকলে আবার এ কি কথা ?
খুশি হবার কথা।
মানুষের গ্যাদারিং,গরম;চান্দি তখন বিয়াল্লিশ ডিগ্রি! মাথার তালুতে ডিম রাখলে হাফ সেদ্ধ হয়ে যাবে।
মেয়ে মানুষের গা থেকে সুগন্ধি আসার কথা, কিন্তু ঘামের একটা ভ্যাপসা গন্ধ যেন বর্মণকে স্বাগত জানাচ্ছে (?)
কি করব?– মুখ চেপে চেপে ঢোক গিলছি
করার কিছু নেই।

ট্রেন যখন রানাঘাট পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে।ট্রেনের কামড়া অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেল। তখন আরাম করে বসলাম।
এবার একটু ফ্রী হলাম।
মেয়েটি যেন আমার সাথে কথা বলার একটা ইচ্ছা ইচ্ছা ভাব করছে!
আমার অন্তরকে উপলব্ধ অনুভূতিতে জাগিয়ে তুলল মৃদুমন্দ জলের ঢেউ।
সাগ্রহ আমারও তিক্ততা ডিঙিয়ে সুখতার
চারা গাছটি মোচড় দিয়ে ওঠল।
গাড়ি তখন আরও দুটো স্টপেজ এগিয়ে চলল।
মেয়েটি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল,তুমি কোথায় যাবে ?
বললাম প্রান্তিকে…
— তোমার নাম ?
— প্রান্তিকা,
–সে কি ? হ্যাঁ,প্রান্তিকা মজুমদার।
–বাহ, মনে মনে ভাবলাম; কবিরে!
মিলে গেছে খাপের খাপ,কি করবে মন্তাজের বাপ!!
মনে মনে দুহাত তুলে ইস্টদেবতাকে পেন্নাম করলাম। মিলাইছ ঠাকুর মনের মত প্রেমিকা !
এই দিয়ে বর্তমানে সাতাশ নম্বর চলতে যাচ্ছে।
পাঠকের মাথা খারাপ হয়ে যাবে,সাতাশ নম্বর প্রেমিকা ??
ট্রেন তখন গেদে এসে দাঁড়াল। যাত্রী দুই একজন কামড়া প্রতি।
–বলো, প্রান্তিকা তোমার কথা।
সে বলতে লাগল…
স্বামীর নাম প্রশান্ত। এই প’ নামের
একটা যন্ত্রণা জীবনকে কুঁকড়ে দিয়েছে।
এই নামটাই কি কষ্টের !
— বলো কবি।…..
কি বলব ? …. মনে মনে ভাবলাম;
আমার সায়রে জোছনামাখা ঢেউ যেন উছলে পড়ছে মনযমুনায়।
মনকে বললাম,
দাঁড়া, বৌ’টার কথা শুনি আগে।
মন বিবেক প্রেমের রশি পাঁকিয়ে টেনে বলছে,আরে ধুর.!
বৌ নাকি ?- জোয়ান ছেমরি। ওতো মেয়ে,সদ্য কুঁড়ির পাঁপড়ি মেলছে।
….ও বললো,
বিয়ের রাতেই শুনলাম প্রশান্তের বৌ আছে। সাথে নাকি একটি বাচ্চাও …(??)
আমার বাসিবিয়ে তখনও হয়নি। বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম।
এ’ জীবন কাকে দিব ? ওর মত বাটপারকে না দিয়ে দড়িকলশী নিয়ে জলকে উপহার দেই (?)
বিবেকের মাতবর আছে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে,আমারও আছে। সে বাঁধা দিল,পারলাম না।
অগত্যা ট্রেনে চাপলাম। আপাতত বাবার শেষ ঠিকানা প্রান্তিক স্টেশন লালনে আখড়ার কাছেই কুষ্টিয়া যাচ্ছি।
বাহ, ভাবলাল,ঈশ্বরের কি লীলাখেলা(!)
আবার ধিক্কার দিলাম ঐ বাটপারকে।

গেদে থেকে ট্রেন ছাড়ল। পুরানো গাড়ি।মাঝে মাঝে ছারপোকা পাছার কাছে কুটুথ করে কামড় মারে। এক হাত দিয়ে পোদ চুলকাচ্ছি আর ওর সাথে কথা বলছি।
গাড়িতে লাইট নেই।
অন্ধকার কামড়া। কিছুক্ষণ চোখ দুইটারে বললাম,ভালো করে দেইখ্যা ল’ কামড়ায় মানুষ আছে কিনা আমরা ব্যাতিত(?)
চোখ বলল, কবিরে তোর কপাল পোয়া বারো,কেউ নাই। সাগর জলে সাঁতার কাটলেও কুমীরে পাও কামড়াবে না।
আমরা দুজন যতটা দূরত্বে ছিলাম ,
ছেমরি বলল,আমার ভীষণ ভয় করছে।
সারারাত এই অন্ধকার কামড়ায় সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে।
আমাকে প্রান্তিকা বলল,আরও কাছে এসে বসো।
এক প্রকার আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওর গা ঘেঁষে বসাল।
ভাবলাম,আগুনে পুড়তে হবে আজ।
বিয়ের পরে প্রান্তিকা স্বামীর সৌহার্দ্য কি অনুভব করেনি। দড়িয়ায় জোয়ার চলছে।
উপোসী জীবন!
বিবেক কইল, ছেমরা কলসির জল পইড়া যায় জাউগ্যা,নিজের তন ঢালতে যাইসনা। ছাব্বিশ নম্বর পার করে আইছস,তুই বিবেকটারে গোলাইয়া খাইস না। পবিত্রার মধ্যে সুখ আছে।
ছেমরিগো লগে প্রেম প্রেম খেলায় তুইতো ওস্তাদ! কইলাম হ’।
এই জন্যই একের পর এক প্রেমের নৌকা বাইতে পারছস.।
—-
প্রান্তিকা এক সময় আমার কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিল। তারপর এক হাত দিয়ে আমার এক হাত চেপে ধরল।
ঈশ্বরকে বিশ্বাস রেখে বললাম, আমাকে শক্তি দাও। কবি জীবন যুদ্ধে হারতে আসে নাই। সে জিততে চায়।
কবিরা হেরে গেলে চলবে না। নইলে মেয়েরা খালি তোমার প্রেমে ক্যান পড়ে ??
বোধের বিবেক মাথা চারা দিয়ে উঠে বলল,
জানো কি তুমি, রবিঠাকুরও প্রোস মাটি মারিয়েছে, জীবনকে নস্ট করার জন্য নয়,বরং জীবনের একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। ওদের জীবন জীবিকার তল্লাশি করতে।
মনে কর,তোর জীবনের কঠিন পরীক্ষার জন্য এই যাত্রা ।।
রাত তখন প্রায় একটা কি দুটো হবে অনুভব করলাম।
কচ্ছপ গতিতে ট্রেন চলছে। প্রান্তিকা
এক সময় আমার হাত টেনে নিয়ে নিজের দখলে রাখল।
এখন শয়তান মনটারে কইলাম, ভর দুপুরের গরমে ওর শরীর থেকে গন্ধ আসছিল ঘামের! — এখন কেমন লাগছে?
চোরা বিবেক বলল, এখন মিষ্টি গন্ধ আসছে।
হ’ বুজছি, মাইয়া মানুষ অর্ধঘামে নাওয়া দুর্গন্ধ থাকলেও সময় কালে মিষ্টি হয়ে যায়। এরই নাম প্রেম !
মনকে শক্ত করেছি। প্রান্তিকার শরীরে পঞ্চাশ ডিগ্রি উত্তাপ ঢেউ খেলছে। রাক্ষসী মনে হয় আমারে এখনি গিলা খাইব (??)
ভাবলাম,
ওর শরীরের সমস্ত রক্ত মাথা থেকে পাও অবধি টগবগ করছে।
আমারে খ্যাপা কুত্তার মতো গিলে খেয়ে পুড়িয়ে মারবে,শেষে চিতায় পোড়াবে।
আরে ধুর!
স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ল। চিকাগো গিয়ে এক ইংরেজ মেমসাহেবা ঠিক এভাবেই স্বামীজিকে আঁকড়ে ধরেছিল।
ইস্ট দেবতা তার পরীক্ষা নিয়েছে। দেবতা বলল, স্বামীরে ! তুই এলি ধর্ম প্রচার করতে।নিজেকে সামলে রাখিস।নইলে অনন্তকাল ভারতবাসীকে ধিক্কার দিকে ।স্বামীজীর চরিত্র নিয়ে বিদেশিরা ধিক্কার দিবে।
দেবতা বলল,
তোর ভরা কলসির জল থেকে দুইএক ফোটা ঝরে গেলেও ক্ষতি নেই। তাতে তোর কলসি অপবিত্র হবে না,সাধনায় অটল থাকিস।
তেমনি আমার পরীক্ষা চলছে। এতদিন পরীক্ষা দিয়েইতো এলাম,কেউ টলাতে পারেনি।
বললাম মনকে,
প্রান্তিকা তোরনদীতে যতই জোয়ার আসুক,আমাকে কাবু করতে পারবিনা।
ভাবলাম, ছেমরি আমারে গাঙে নামাইতে না পারলেও দলিত হতে চায় বক্ষের পাঠাতনে!
ছি! ধিক !! কবি ব্যর্থ হবে তার সাধনায় ?
এক সময় অনুভব করলাম, আমার হাত টেনে নিয়ে পাহাড়ের উপরে তুলল।মর্দন চায়। আগুন পোড়া কয়লা হয়ে যাব,নয় দরজার শেষ দরজা দিয়ে যদি রক্তের ক্ষীর বেরিয়ে যায় যাক,লালনের গানে শুনছি মানুষের দেহের মধ্যে নয়টি দরজা আছে।
খালি স্বামীজীর কথা স্মরণ করলাম।
শেষে একটি কথা বললাম,
নিজের স্ত্রী ব্যাতিত সকল মেয়ে মানুষ হয় বোন, নয় মা।
আমি আমাকে সমর্পণ করতে পারবনা।বিবেককে যত্নে তুলে রাখলাম মনের কুঠুরিতে।
তালাচাবি দিয়ে আটকে দিলাম আপন স্বত্বাকে।
ধিক কাপুরুষ!!!
প্রান্তিকা বার বার বলতে লাগল নপংশুক কোথাকার!!!
বাইরে তাকিয়ে দেখলাম স্টেশনে এসে গেছি।
হ্যাঁ, প্রান্তিক স্টেশনেই এসে গেছি আমরা।
পাশের মোল্লা বাড়িতে তখন ভোরের আজানের সমাপ্তি ঘটেছে। মোড়গের
ডাক শুনতে পেলাম আশেপাশে থাকা বাড়িগুলো থেকে।
শেষ বাণী প্রয়োগ করে বললাম,আসি রে
প্রান্তিকা, ভালো থাকিস।
—- সমাপ্তি।।

মন্তব্য করুন