Skip to content

পিছনে ফেলে আসি – কোয়েল তালুকদার

পিছনে ফেলে আসি

একদিন বিকালে আমার এক রুমমেটের সহপাঠী কৃষ্ণচন্দ্র রায় আমাদের রুমে আসে। রুমমেটের সহপাঠী সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সাথে আমারও বেশ বন্ধুত্ব হয়। তখন ইউনিভার্সিটি গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়েছে। আমি বাড়িতে আসব জেনেই এই কৃষ্ণচন্দ্রের রুমে আগমন। কৃষ্ণ বলছিল — ‘দাদা, আপনার কাছে কিছু জিনিস দিতাম, এগুলো যদি আমার এক মাসীমার কাছে পৌঁছে দিতেন আমি খুব কৃতজ্ঞ হব। আপনার বাড়ি থেকে আমার মাসিমার বাড়ি মনে হয় খুব বেশি দূরে নয়।’
আমি কৃষ্ণকে বললাম — ‘দিয়ে দাও। পৌঁছে দিব। তোমার মাসী আমারও মাসী।”

কৃষ্ণ একটি কাপড়ের ব্যাগ আমার হাতে দেয়।
দেখলাম ব্যাগের ভিতর দুটো সাদা রঙের শাড়ি কাপড়। দুটো ব্লাউজ, আর দুজোড়া চটি জুতো। কৃষ্ণ একটি সাদা টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। ঠিকানা —
শ্রীমতী সারদা রাণী বৈদ্য
স্বামী — স্বর্গীয় অরুণ কুমার বৈদ্য
ক্ষীরতলা, রায়গঞ্জ, পাবনা।

চৈত্র মাসের একদিন ভোরে আমাদের বাড়ি হতে ক্ষীরতলা রওনা হই। প্রায় ছয় ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। মাঝে একটি নদীও পার হতে হবে। আমি কোনো দিন ঐ পথে যাইনি। চিনিও না ঠিক মতো। তবুও রওনা হলাম।

আমি বাগবাটী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তাই ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত পথ মোটামুটি আমার চেনা ছিল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে ধুলো পথে ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত যেতে আমার প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায়। এইটুকু আসতে রোদে পুড়ে ক্লান্ত হয়ে উঠি। দুতিন জায়গায় গাছের তলায় জিরিয়েও নেই। পথে খুব জলের তেষ্টা পেয়েছিল। এক বাড়িতে গিয়ে জল চাই। একটি বালিকা পিতলের গ্লাসে করে কুয়ো থেকে ঠান্ডা জল দিয়ে আমার তেষ্টা মিটিয়েছিল।

যেতে যেতে একসময় সামনে একটি নদী পড়ে। নদীটির নাম সম্ভবতঃ ফুলজোর। খেয়া নৌকা দিয়ে নদী পার হই। নদী পার হয়ে এক লোককে জিজ্ঞাসা করি — ‘ক্ষীরতলা কোন পথে যাব?’
সে আমাকে ক্ষীরতলা যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়।

এবার মেঠো পথ। পথের দুধারে সদ্য বিজ বোনা আউশধান ও পাট ক্ষেত। এখনও কুশি হয়নি। গন্ধ পাচ্ছিলাম মাটি ও বীজের। একসময় ক্ষীরতলা গ্রামটিতে পৌঁছে যাই।

গ্রামটিতে এসে একটু অবাকই হই। জায়গায় জায়গায় উঁচু মাটির ঢিঁপি। ঢিপির পাশ দিয়ে পাকুড় আর হিজল গাছ। তারই মধ্য দিয়ে পায়ে চলা ধুলার পথ। এই পথ গিয়েছে গ্রামের বাড়িগুলোর দিকে। কোথাও বা চাষের ক্ষেত। কোথাও মিষ্টি আলুর ক্ষেত, কোথাও বা কিছুই নেই—ফাঁকা।

এক লোককে জিজ্ঞাসা করে আমি সারদা মাসীর বাড়টি চিনে নেই। মাটির দুটি ঘর। ছোনের চালা। আমি উঠোনে যেয়ে দাঁড়াই। একজন শীর্ণকায় পঞ্চাশোর্ধ মহিলা ঘর থেকে বের হয় আসে। পরনে সাদা ধুতি কাপড়। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। গায়ের রঙ গৌরিও। হাতে শাঁখা পলা কিছু নেই। আমাকে দেখে মহিলা বলে — তুমি কে গো? কোথা থেকে এসেছ।

— নমস্কার। আমার নাম রঞ্জন। আমি কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু। আপাততঃ কুসুমপুর থেকে এসেছি। আমি কৃষ্ণের মাসিমার সাথে দেখা করব।

— আমিই কৃষ্ণের মাসিমা। তা কি জন্য বাবা?

মাসিমা আমাকে বারান্দায় একটি কাঠের টুলে বসতে দেয়। আমি কৃষ্ণের দেওয়া ব্যাগটি তাঁর হাত তুলে দিয়ে বলি– ‘এগুলো কৃষ্ণ আপনাকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে দিয়াছে।’

আমি যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছি, তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, উনি কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছে। আমাকে এই অসময়ে কী খেতে দেবে?

মাসীমা কাউকে ডেকে বলছিল, যিনি ঘরের ভিতরে আছে। ডাকছিল — ‘অর্চণা, ও অর্চণা! এদিকে আয় তো দিকি !’

সাদা কাপড় পরা একজন বছর একুশের মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়।

মাসী ঐ মেয়েটিকে বলছিল — ‘এই ছোয়ালডাকে কিছু জলপানি খাইতে দাও। রোদে পুড়ে বড়োই পেরেসান হইয়া আসিয়াছে।’

মেয়েটি ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটি বড়ো পিতলের থালায় করে গুড়ের বাতাসা, নারকেল কোরা, সন্দেশ আর একটা কাঁচের গেলাসে জল নিয়ে এসে আমার সামনে রাখে।

মাসীমা বলছিল — ‘এগুলো খেয়ে নাও বাবা।’

মেয়েটি উঠানের জাম্বুরা গাছতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে চুপিচুপি দেখছিল। তখন ঝাঁঝালো চৈত্রের পরন্ত দুপুর। দূরে হিজল গাছের ডালে বসে ঘুঘু আনমনে ডেকে চলছিল।

আমি জলপানি খেয়ে মাসিমাকে বলি– ‘আমি আজই চলে যাব।’

— ‘এটা কী করে হয়, তুমি বড়োই ক্লান্ত। কিছুই তেমন খাও নাই। আজ থাকো। কাল প্রত্যুষে চলে যাবে।’
আমি মাসীমার কথা ফেলতে পারলাম না।

ভাটি দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় শীতল পাটি বিছিয়ে আমাকে খেতে দেয়। ভাতের সাথে ছিল গন্ধরাজ লেবু, নিমপাতা ভাজা, সজনে ফুলের তরকারি আর মুসুর ডাল। অর্চণাই পরিবেশন করছিল। খেতে খেতে জেনে গিয়েছিলাম — অর্চণা অকাল বিধবা। একথা জানার পর আমার মন খারাপ লাগছিল, এত অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে মায়ের ঘরে পড়ে আছে।

পরন্ত বিকালে অর্চণা এসে বলছিল — ‘দাদা ভাই, তুমি আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখে আসো। ভালো লাগবে। এখানে নদী আছে। মন্দির আছে। ভিরাট রাজার ভগ্ন রাজ প্রাসাদ আছে। হিজল তমাল গাছের সারি আছে। কবেকার এক সরজু বালা এখনও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় দিগচিহ্নহীন জয় দূর্গা মন্দিরে। দেখে আসো তুমি– আলোজ্বলা এক সন্ধ্যা রাত্রি।’

আমি ঘুরতে বের হই। পথের দুধারে ঘাটফুলের উপর সাদা ডানা কালো ছিট ছিট প্রজাপতি উড়ে উড়ে এসে বসছে। ক্ষেতের আলপথ ধরে নিমগাছের সারি। নিমফুলের রেঁণু ছড়িয়ে আছে মাটির উপর। পুকুর পাড়ে কদম গাছ। পশ্চিম পাশটায় অন্ধকার বাঁশবন। আছে আম ঝোপ।

অদূরে জয় দূর্গা মন্দির। আজ থেকে আড়াইশত বছর আগে জমিদার নবীন কিশোর রায় চৌধুরী নাকি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা এখন ভগ্নস্তূপ। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। আমি কান পেতে ছিলাম, যদি শুনতে পাই সরজু বালার পূজার সেই আরতির ধ্বনি। যদি কোথাও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে ওঠে। নাহ্ কোনো আলো জ্বলে উঠল না।

রাতে খেয়ে পাট সোলার বেড়ার ওপাশের রুমে চোকির উপর শুয়ে আছি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত বাড়তে থাকে। রাতের পাখিদের অদ্ভুত কিছু ডাক মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল। মনটা এক অস্পষ্ট বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাতে খাবার সময় মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম — ‘মাসীমা আপনারা কী ভালো আছেন?’ কেরাসিন কূপীর আলোয় দেখেছিলাম মাসীমার মুখখানি। কেমন বিমর্ষ ছিল সেই মুখ, কেমন ভয় ছিল চোখে মুখে। মাসীমা বলেছিল — ‘ভালো নেই বাবা।’ কৃষ্ণকে বলো — ‘ও যেন এসে আমাদের একবার দেখে যায়। খুব শীঘ্রই হয়ত ওপারে চলে যেতে হবে।’ হঠাৎ রাতের স্তব্ধতায় কার যেন গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। মেয়ে মানুষের কান্না। মনে হলো, অর্চণা এমন করে কাঁদছে।

ঘুমহীন রাত শেষ হয়। প্রত্যুষেই আমি মাসীমার কাছ থেকে বিদায় নেই। হিজল তমালের ছায়াপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ষখন চলে আসছিলাম , তখন মনে হচ্ছিল- কোনও এক অভাগী অর্চণা আঙিনায় চালতা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।

****

মন্তব্য করুন