পরাজিত জীবনের সংক্ষিপ্ত কাহিনিঃ
রচনায়ঃ মোঃ ইব্রাহিম হোসেন -রাজশাহী।
তারিখঃ ০৫-০৩-২০২৪ ই, মঙ্গলবার।
বাবা ছিলেন জমিদার বংশের নামি-দামি জমিদার ব্যক্তি।
আমার বাবার সহায় সম্পত্তির অভাব ছিলো না। বাবার ছোট পক্ষের সন্তান বলে সবই গোল্লায় গেলো। সে অনেক কাহিনি। বলতে গেলে রাত পোহাবে না।
বাবার ৮০-৯০ বিঘা সম্পত্তি থাকার পরেও তা থেকে কিছুই পাইনি। বাবার ইচ্ছাতেও এমনটি হয়নি। কম করে হলেও এক বিঘা সম্পত্তি আমাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বাবা তাদেরকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলেন। কিন্তু বাবার রিকুয়েষ্ট তাদের কাছে মঞ্জুর হয়নি।
আমার ছোট বেলা থেকেই জীবনটা অনেক কষ্টের,অনেক কষ্টের!
তারপর খুব ছোট অবস্থায় বাবা চলে গেলেন এতিম করে দিয়ে। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করলেন।
আমার ছাত্রজীবনটা ছিলো খুবই সুন্দর মধুময়।
লেখাপড়ায় আমার মত কেউ ভালো ছাত্র ছিলো না তৎকালীন সময়ে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
বাল্যকালেই ছাত্রজীবনে পেলাম বিষাদময় প্রেমের আঘাত। যা শুনলে মানুষে হাসবে, ছি ছিক্কার দিবে। কারণ, প্রেমের যন্ত্রণা প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া পৃথিবীর কেউ বুঝে না, বুঝতেও চায় না।
যাইহোক, মরণের হাত থেকে মায়ের দোয়া ও আল্লাহর রহমতে আবার নতুন করে জীবন ফিরে পেলাম এবং তারপর ছাত্রজীবনেই বিয়ে ১৯৯৯ সালের ৬-ই আগস্ট, রোজ: শুক্রবার। আমার ছাত্রজীবন হলো নষ্ট। তবে বিয়ের জন্য নয়। নিজের জন্যই।
লেখাপড়ায় মন বসতো না। শুধু তার ছবি স্মৃতির পাতায় ভাসতো। পড়তে বসলেই বইয়ের পাতায় তার ছবি ভাসতো। বিবাহিত জীবনেও কিছুদিন ক্লাস করার পরেও আর পড়া হলো না। আমার শিক্ষকগণ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা কয়েকবার আমাদের বাড়িও গেলেন আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁরা বললেন, আমার একটা টাকাও খরচ দিতে হবে। শুধু লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বললেন।
স্যার যখন আমাদের বাড়িতে যেতেন, তখন দু’একদিন ক্লাস করতাম। পরে আর ভালো লাগতো না। আমি ক্লাসে না গেলে স্যার আবার আমাদের বাড়ি আসবেন। লেখাপড়ার কথা বলবেন। আমাকে খারাপ লাগবে ভেবে প্রধান শিক্ষক বরাবর স্যারদের কাছে চিঠি লিখলাম,
স্যার! আমাকে মাফ করবেন। আমার দ্বারা আর লেখাপড়া করা সম্ভব না। বিবাহিত জীবনেও লেখাপড়া করা সম্ভব। কিন্তু ব্যর্থ জীবনে লেখাপড়া করা কখনোই সম্ভব না। তারপর স্যার আমাদের বাড়ি আশা বন্ধ করলেন। আমার ছাত্রজীবন হয়ে গেলো নষ্ট। স্যার বুঝতে পারলেন, ছেলেটি নষ্ট হয়ে গেছে। আফসোস!!!
আমার সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ এখনো আমাকে অনেক ভালোবাসেন।
ছাত্রজীবনে একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। সে তার বাড়িতে খেলে আমাদের বাড়িতে এসে তার ভিজা হাত মুছতো। সে ছাত্র খুব দুর্বল ছিলো। পরীক্ষায় নিজের খাতায় লেখা বাদ দিয়ে বন্ধুর খাতায় লিখে দেওয়ার পর নিজের খাতায় লিখেছি। আমার বিয়েতে সমস্ত কিছুতেই তাকে দাওয়াত দিলাম। কিছুটা হলেও একসাথে আনন্দ ফূর্তি করলাম। কিন্তু তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত তো দূরের কথা খবরটাও দিলো না।
এখন তার মাথায় ঘর্ষণ লাগলেও কথাটা পর্যন্ত বলে না। অথচ, তার সাথে কোনো রাগারাগি বা রেষারেষি কিছুই হয়নি।
একজনকে নিজের বোনের মত ভালোবাসলাম। তার বিয়ের পরে সেও অনেক আঘাত করলো। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরলো।
একজনকে আপন ভাইয়ের মত ভালোবাসলাম। সে-ও আঘাত করলো। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে অনেক ভালোবেসেছিলো। যা অন্য কোনো স্ত্রী কখনোই করবে না।
কেন জানেন?
কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে তার প্রেমিকার জন্য অঝর ধারায় নয়ন ভাসায়, তবে নিশ্চিত সে স্ত্রী কখনোই তার সংসারে থাকবেনা। তাকে ভালোবাসবে না। এটা ১০০% সত্য।
আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই হয়েছিলো। কিন্তু সে আমার স্ত্রী কখনো বিরক্তবোধ মনে করেনি। আমার উপর রাগও করেনি। সে শুধু কাঁদতো। আমি তাকে চলে যেতে বলতাম।
বলতাম , আমার যা আছে সব কিছু নিয়ে তুমি চলে যাও। আমার কাছে থেকে তোমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট করো না। একদিন তার হাত ধরে জোর করে বাড়ি থেকে টেনেহেঁচড়ে বের করেই দিলাম। বাড়ির দরজার পাশেই ছিলো বরোই গাছ। সে গাছটি শক্ত করে ধরেই রইলো। আর আমি টানতেই থাকলাম। এতো শক্ত করে গাছটি ধরে রইলো যে, আমি তাকে আর টানতে পারলাম না। অবশেষে হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম,
তুমি চলে যাও। আমার ব্যর্থ জীবনে থেকো না। তোমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি ভালো দেখে আরেকটা বিয়ে করে নাও। এ বিয়ে আমার ইচ্ছাতে হয়নি। মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য আমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। বিয়ের আগের কয়েদিন যাবৎ শুধু কান্না করেছি। অনেকে আমাকে বুঝিয়েছে। এতো কিছু করার পরেও সে আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে কখনো যেতে চায়নি, যায়নি। উল্টা আমাকেই বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে আর কান্না করেছে নীরবে।
সে বলতো, দেখো, সে তোমার ভাগ্যে নাই, তাই তোমার হয়নি। আমি তোমার ভাগ্যে আছি, সে জন্যই তোমার কাছে এসেছি। এটা তো আল্লাহই লিখে দিয়েছেন। তার জন্য কেঁদে কি আর কোনো লাভ হবে? আর এখন ইচ্ছে করলেও তো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি না, যেতে পারবো না। মরলে তোমার কাছেই মরবো। আর বঁচলেও তেমার কছেই বাঁচবো। তার কান্না দেখে আমারও কান্না আসতো। কিন্তু তবুও মন বসতো না। ভালো লাগতো না৷
সেদিন আমার খুব মায়া হয়েছিলো তার প্রতি, যেদিন আমি তাকে টেনেহেঁচড়ে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মা তাকে কখনোই চোখের আড়াল হতে দিতেন না। খুবই ভালোবাসতেন। নিজেই মাথার চুল বেঁধে দিতেন, চুলে বেনি বেঁধে দিতেন। মাও আমাকে অনেক বুঝাতেন। তার পক্ষ থেকে আমাকে অনেক বকাঝকা করতেন।
এখনো মাঝে মাঝে তাকে প্রেমিকাকে মনে পড়ে, রাতে স্বপ্নে দেখি। এখনো তার জন্য মনের অজান্তেই দুচোখের জল চলে আসে। আর যখনই তাকে দেখতে পাই, তখনই একটা বিরহের কবিতার সৃষ্টি হয়। তবে আগের থেকে মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে অনেক ধৈর্য দিয়েছেন।
বর্তমানে আমার জীবনের যা অবদান সবই আমার স্ত্রীর জন্য। এখন আমিও তাকে অনেক ভালোবাসি। একসাথেই মরতে চাই। আল্লাহ কবুল করবেন কিনা জানি না। সে অনেক ভালো মনের মানুষ। তার মতো স্ত্রী পাওয়া খুবই দুষ্কর। তার মতো গুণবতী স্ত্রী পাওয়া সত্যি আমার সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া। আলহামদুলিল্লাহ। তাকে আমি আমার জীবন সঙ্গিনীরূপে কাছে পেয়েছি।
এখন একটাই আশা। বাকী জীবনটা যেন শুধু তাকেই ভালোবেসে অতিবাহিত হয়। মহান আল্লাহ যেন আমার স্ত্রীর মনের সকল নেক আশা পূরণ করেন এবং সদাসর্বদা সুস্থ রাখেন, নেক হয়াত দান করেন। আর আমাদের মৃত্যুটাও যেন একসাথেই হয়৷ একসাথেই পাশাপাশি কবরে থাকতে চাই। যদিও একই কবরে থাকার ইচ্ছা, যা সমাজ কখনো মেনে নেবে না। ইসলামের বিধানে নাই। এই কামনাই করি মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে। আল্লাহ যেন কবুল করেন।
আমিন ইয়া রাব্বুল আলামিন!