Skip to content

“ নীলাক্ষী ” – অথই মিষ্টি

সে প্রায় হাজার বছর আগের কথা ।ইচ্ছেমতি নামে এক দীর্ঘতম রাজ্য ছিল আর সেই রাজ্যের নামকরন করা হয় রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নামানুসারে ।সে নদী বয়ে যায় আপন ইচ্ছা মতো অর্থাৎ কখনো দক্ষিন দিকে আবার কখনো উত্তর দিকে কখনো বা দ্বারিয়ে থাকে একই অবস্থানে আবার কখনো বা ঘুরতে থাকে ঘূর্ণিপাকে ।সে নদীর জল গাঢ় কালো বর্ণের ।রাজ্যবাসী এ নদীর জলকে বিষাক্ত জল বলে আখ্যাইত করে ।কেননা, এজলের কবলে যেই পড়ে তাকেই সম্পূর্ন রুপে গ্রাস করে নেয় এ জল ।এ কারনে কেউ কেউ এ জলকে রাক্ষসী কিংবা পিশাচিনী নামেও ডাকে ।এ নদীর আশে-পাশে স্ব-ইচ্ছায় কেউই আসেনা ।খায়না কেউই এ নদীর পানি ।
ইচ্ছেমতির রাজ্য তো ছিলো একটাই কিন্তু তা এই নদীর দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে ।এ ইচ্ছেমতির পূর্ব পাশের রাজ্য বিশাল আকৃতির, আর ধন-ধান, হাট-বাজার, রাজার প্রাশাদ, চাষাবাদ সহ প্রায় কোনো কিছুর কমতি ছিলো না সেখানে ।সেখানকার গণমানুষ অনেক সুখে শান্তিতে দিন কাটায় ।পক্ষান্তরে ইচ্ছেমতির পশ্চিম পাশের রাজ্য ছিলো প্রধান রাজ্য থেকে ছিটকে পরা, ছন্নছাড়া, অভাব অনটনে ঘেরা, ছোট্ট একটা দ্বীপের ন্যায় ।যেখানকার মানুষ অনেক দুঃখ-কষ্ঠে, চাষাবাদ করে প্রানী পালন করে কোনো রখমে দিন পার করত আর এই পশ্চিম রাজ্যের এ অবস্থার জন্য দায়ী ছিলো একমাত্র সেই ইচ্ছেমতির নদী ।
বছরে পর বছর ধরে এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন ।সম্পূর্ন ভাবে কেউই জানতো না সে কালো জলধারী ভয়ঙ্কর নদীর ইতিহাস ।পায়নি কেউই কোনো সুত্র এই নদীর সম্পর্কে ।তবে ইচ্ছেমতির পূর্বের রাজ্যে নদীর কিছুটা কাছাকাছি অবস্থিত ছিলো এক জরাজীর্ন কুড়ে ঘর তার কিনারে ছিলো বিশাল আকৃতির এক বট গাছ ।সেই র্নিজনতায় বাস করে শত বছরেরও বেশি বয়সী এক হিন্দু বৃদ্ধা নারী ।তাঁর নাম মৃনালিনী দেবী ।যানা যায় সে মৃনালিনী দেবীই জানেন ইচ্ছেমতির সঠিক ইতিহাস ।তবে হাজার বারেরও বেশি সংখ্যক বার তেনাকে জিজ্ঞাসা করার পরেও তিনি ইচ্ছেমতি সম্পর্কে বলেননী কোনো কথাই ।তাই এখন আর কেউ্ই ইচ্ছেমতি সম্পর্কে তেনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না ।মৃনালিনী দেবী সবসময় নিঃশ্চুপ থাকেন, যেনো কোনো কিছুর ধ্যানমগ্ন আছেন ।জানা যায় তেনার ছেলে এবং ছেলের বউ এই ভয়ঙ্কর নদীর জলে ভুবে মারা গেছে আর একমাত্র নাতিকে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন ।তবে কেউই জানেনা যে, কিভাবে কোথায় তেনার নাতি হারিয়ে গেছে । আরো শোনা যায় সে ঘটনা ঘটার পর থেকেই তিনি কারো সাথে কোনো কথা বলেন না ।

আজ ইচ্ছেমতির পূর্বের রাজ্যে আনন্দের ধুম পরেছে ।তাই সকাল সকাল সমস্ত রাজ্য জুড়ে ঢোল পিটিয়ে ঘোষনা করা হচ্ছে, ‘শোন, শোন, শোন, ইচ্ছেমতির পূর্ব রাজ্যের রাজা শাহ্ উদ্দিনের একমাত্র কন্যার আজ ষোলতম জন্মদিবস ।তাই সারাদিন ধরে রাজপ্রাশাদে সমস্তরাজ্য বাসীকে পেটপুরে ভোজনের নেমন্তন্ন দেওয়া হলো । শোন, শোন, শোন’ এখবর পৌচ্ছালো রাজ্যের ছোট বড় সকল মানুষেন কানে ।এক সময় পৌচ্ছালো এখবর মৃনালিনী দেবীর কানেও আর তা শোনা মাত্র তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো ।দলে দলে যেতে আরাম্ভ করলো রাজ্যবাসী রাজপ্রাশাদের দিকে ।আর জনে জনে কানে কানে বলা বলি করতে লাগলো, ‘ দীর্ঘজীবী হোক, রাজকন্যা, দীর্ঘজীবী হোক ।প্রতি বছর এই দিন এলেই আমরা ভালো-মন্দ একসাথে খেতে পারি পেট পুরে ।’
ইচ্ছেমতি রাজ্যের রাজা শাহ্ উদ্দিনের একমাত্র কন্যার নাম নীলাক্ষী ।নীলাক্ষী দেখতে যেমন সুদর্শন ঠিক তেমন সে মধুময় চরিত্রের অধিকারী ।মিষ্টি ভাষি হালকা স্বভাব তাঁর ।সমস্ত রাজ্যের মধ্যে রাজকন্যারই একমাত্র নীল বর্ণের আঁখি তাই তো তাঁর নাম রাখা হয় নীলাক্ষী ।ঘনো কালো কেশ তাঁর হরিণ রাঁঙা আঁখি, স্থলপদ্ম চেহারা তাঁর যেনো চঞ্চলা এক পাঁখি ।কপালে ভাঁজ পড়ে যখন যেনো সদ্য তৈরি কাঁচা কাদা মাঁটি, গোবরে নয় যেনো রাজপ্রাশাদে আস্ত পদ্ম উঠিয়াছে ফুঁটি ।মোটকথায় অনুপম সৌন্দয্য তাঁর যেনো খাঁদহীন খাঁটি ।
নীলাক্ষী রাজার একমাত্র কন্যা হওয়ায় সেই ছোট বেলা থেকেই রাজা নীলাক্ষীর সকল আবদার আনন্দের সাথে হাঁসি মুখে মেনে নিয়ে আসছে, আর সে অনুপাতে এখনো তার বেতিক্রম নয় ।প্রতি বছর জন্মদিবসে নীলাক্ষী আবদার করে বসে, সোনার পালঙ্গ, রুপোর মানুষ, হিরের পুঁতুল ইত্যাদী ।কিন্তু এবারের জন্মদিবসে রাজা কিছুটা আশ্চার্য হয়ে গেলো কেননা এবার রাজকন্যা কিছুই আবদার করেনি ।তখন তিনি নিজ থেকে নীলাক্ষীর নিকটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নীলাক্ষী!মা আমার আজকের দিনে কি চাই তোর?’ জবাবে মৃদু হেঁসে বলে উঠলো রাজকন্যা, ‘শুকরান, আমার মহামান্নিত্ব পিতামহের পুত্র । কিন্তু নাহ্, এবারে আমার কিছুই চাই না ।তবে…’ অতিব আগ্রহের সাথে রাজা জানতে চাইলো, ‘তবে কি আমার মা?’ তখনি রাজকন্যা নীলাক্ষী তাঁর পিতাকে সজরে স্নেহের সাথে জরিয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘তবে, আমি শুধু আমাদের পুরো রাজ্যটা সম্পূর্ন ভাবে ঘুরে দেখতে চাই ।’রাজা তাঁর একমাত্র কন্যার চাওয়া মেনে নিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ কন্ঠে ডাক দিলেন, ‘প্রহরী গন?’ মুহূর্তেই হাজির হলো বেশকয়েক জন প্রহরী আর সেই প্রহরীদের উদ্দেশ্যে রাজা কড়া আদেশ জারি করে বললেন, ‘ময়ূরপঙ্খী টমটমে করে রাজকন্যা নীলাক্ষীকে সমস্ত রাজ্য ঘুড়ে দেথাতে নিয়ে যাও।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীরা রাজাকে কূর্নিশ করে টমটম প্রস্তুত করার জন্য চলে গেলো ।
বেশ কিছু সময় পর নীলাক্ষী প্রস্তুত হয়ে তার চারজন সঙ্গীকে নিয়ে প্রহরীদের সঙ্গে সমস্ত রাজ্য দেখার উদ্দেশ্যে বের হলো ।প্রথমেই তারা রাজ্যের ডানদিকে যাত্রা শুরু করল ।সবুজ-শ্যমলে ভরা অপূর্ব ইচ্ছেমতির রাজ্য রাজকন্যার দৃষ্টি আকর্ষন করলো ।তার নিকটের চার সঙ্গির সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে নীলাক্ষী রাজ্যের সৌন্দয্য উপভোগ করতেছিলো এমন সময় হঠাৎই নীলাক্ষীর দৃষ্টি আটকে গেলো আর আচমকা উচ্চ কন্ঠে নীলাক্ষী তারাহুড়ার সাথে বলে উঠলো, ‘গাড়ি থামাও!’ একথা শুনে আর রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গিরা সম কন্ঠে অবাক হয়ে বলল, ‘কি হয়েছে রাজকন্যা নীলাক্ষী?’ কিন্তু তাদের কথায় রাজকন্যার বিন্দুমাত্রও ভ্রুখেপ নেই, সে যেনো তাঁর ভাবনায় ভুবে গেছে ।কোনো কথাই না শোনার মতো রাজকন্যা তার ঐ আকড়ে যাওয়া দৃষ্টি বড় বড় করে আপন মনে টমটম থেকে নেমে সে দিকেই যেতে আরাম্ভ করলো ।তার নিকটে থাকা প্রহরী আর সঙ্গিরা কিছুই বুঝতে পারতেছিলো না ।সাবাই শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নীলাক্ষীর দিকে ।
আর নীলাক্ষীর দৃষ্টি আটকে গেছে সেই অদ্ভূত ইচ্ছেমতির ভয়ঙ্কর জলে ।কোনো এক অজানা মায়ার টান অনুভূত হচ্ছিলো সেই জলের প্রতি তার ।তাই তো সে তার দৃষ্টি ফেরাতে পারছেনা সে জল থেকে ।সেই অদ্ভূত কালো জল সে কখনোই দেখেনি তাই সে কিছুটা অবাকও হয়েছে আর সেই সাথে অধীর আগ্রহের বসে নীলাক্ষী যেতে যেতে চলে গেলো ইচ্ছেমতি নদীর অতিব নিকটে ।আর স্বনিকটে গিয়ে আল্ত ভাবে বসে পড়লো নদীর পাড়ে জলের ধারে ।অতিব আগ্রহের সাথে নীলাক্ষী তার হাত বাড়াতে আরাম্ভ করলো সে অদ্ভূত আর আজব জল স্পর্শ করবে বলে এমনি সময়ে তার কানে পৌচ্ছালো উচ্চ কন্ঠে, ‘রাজকন্যা!’ তখন রাজকন্যা আচমকা চমকে উঠে পিচন ফিরে তাকালো দেখলো এক প্রহরী তার চোখ বড় বড় করে ভীতু হয়ে কম্পিত কন্ঠে বলতেছে, ‘ না, না, এই জল আপনি স্পর্শ করিয়েন না রাজকন্যা ।স্পর্শ করিয়েন না ।’ কয়েক মুহূর্ত রাজকন্যা সহ সকলে নিঃশব্দে অবাক দৃষ্টিতে সেই প্রহরীর দিকে তাকিয়ে রইলো ।পর মহূর্তেই সে তার ভ্রু-দ্বয় সংকুচিত করে কিছুটা রসিকতার সাথে মুচকি হেঁসে রাজকন্যা সেই প্রহরীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘কেন?কি এমন আছে এই জলে ? যে হাতে স্পর্শও করা যাবে না?’ পক্ষান্তরে প্রহরী জবাব দিলো, ‘এই জল বিষাক্ত অভিসাপ্ত ।এই জল স্পর্শ করলে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায় ।আপনি চলে আসুন, চলে আসুন আমরা এখনি রহনা দিবো ।’ অবাক তো হয়েছিলো রাজকন্যা ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো আর জিজ্ঞাসা করলো না প্রহরীকে যে, কি এই জলের রহস্য?
প্রহরীর কথা মেনে নিয়ে সজরে সে জলের নিকট থেকে রহনার উদ্দেশ্যে টমটমের দিকে আসা আরাম্ভ করলো রাজকন্যা ।এমনি সময়ে হঠাৎ ইচ্ছেমতি নদীর ওপার থেকে ভেষে আসলো আবাগে উচ্ছ্বাসিত মৃদু বেগে এক সুদর্শন যুবকের মধুময় আওয়াজ, ‘ওহে, কে তুমি বালিকা? কেনই বা এসেছিলে তুমি এই কালো জলের ধারে? আর কেনই বা যাচ্ছ ফিরে? দেখিনি তো তোমার এই অপূর্ব চেহারা আমি এর পূর্বে?’ সে অপরিচিত সুদর্শন যুবকের পানে অবাক দৃষ্টিতে খানিক্ষন তাকিয়ে রইলেন রাজকন্যা কেননা কি বলবে সে ঐ অপরিচিত অনুপম সুদর্শন যুবককে বুঝে উঠতে পারছিলো না সহজে ।তার ঐ হঠাৎ আওয়াজে আচমকা প্রশ্নত্তরে রাজকন্যা মৃদুময় মুচকি হাঁসলেন ।বেশ কিছু মুহূর্ত জবাবের অপেক্ষার পর সে অপরিচিত যুবক প্রত্যক্ষ করলো এক মৃদু হাঁসি, তাই অধির আগ্রহে সে পূনরায় বলে ঊঠলো, ‘বালিকা, না দিবে পরিচয়! দিও না ।তবে তোমার অধরে এ কোন রহস্যের স্থলপদ্ম ফুটে উঠলো, তাহার সুত্রখানা বলে যাও ।’ অপরিচিত সে যুবকের কথা মুহূর্তেই স্পর্শ করলো নীলাক্ষীর হৃদয় ।মনে হলো সে সুদর্শন যুবক তার অতিপরিচিত নিকটের কেউ, কিন্তু হয়তো অজানা সে পরিচয় ।রাজকন্যা আর নিস্তব্দ থাকতে পারলো না, পরিচিত মনে হওয়া সে অপরিচিত যুবকের জবাবে বলল, ‘নীলাক্ষী আমার নাম, পাশেই আমার বাড়ি, কিন্তু হে পরবাসী, তোমারে তো না চিনিলাম? তবে কি তোমার নাম? আমায় যে যেতে হবে হচ্ছে দেরি ।’ সুদর্শন যুবক জবাব পেয়ে হেসে উঠলেন আনন্দে ।পুনরায় কথা বলা আরাম্ভ করলো মিষ্টি সুরে, ‘পুরো নাম আমার থাক অজানা, সুজন বলে ডাকিও মোরে, করিবো না হে কোমল বালিকা তোমায় মানা । সৌন্দর্যে তোমার মুগ্ধ হলাম, প্রশান্তিতে মোর হৃদয় হলো শান্ত, বলে যাও তবে, হে বালিকা আসবে আবার কবে? তোমার ব্যস্ততাকে করে ক্ষান্ত !’ মুচকি হেঁসে আবারো জবাব দিলো নীলাক্ষী, ‘আসব ফিরে, এই সময়ে কাল প্রহরে ।এখন যে মোরে যেতে হবে ।’ বলে পিচন ফিরে টমটমের দিকে আসতেছে রাজকন্যা, কিন্তু তার দৃষ্টি যেনো পুনরায় সেই সুজনের দিকে ফিরতে চাইতেছে ।কোনো এক মায়া মাখা পিচুটান যেনো তাকে নদীর ওপারে টানছে ।তাই সে বার বার মুচকি হেঁসে পিচন ফিরে তাকাচ্ছে ।তার পর টমটমে উঠে রহনা দিলো নীলাক্ষী ও তার সঙ্গিরা ।আর এ সমস্ত কিছু দুর থেকে লক্ষ্য করছিলো সেই বৃদ্ধা নারী মৃনালিনী দেবী ।আর নীলাক্ষী চলে যাওয়ার পর সে একা একা বিড় বিড় করে বলতে লাগলো, ‘পাবে, মুক্তি পাবে, খুব তারাতারি মুক্তি পাবে, এই নদী, এই জল ।মুক্তি পাবে এই জলের কবলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সকল লোক ।’
রাজা তার একমাত্র কন্যার অপেক্ষায় দ্বারিয়ে আছে অন্তর মহলের প্রধান ফটকে ।ঠিক তখনি সমস্ত রাজ্য দেখা শেষ করে নীলাক্ষী প্রশোদে ফিরে অন্তর মহলের ভিতরে প্রবেশ করতেছে ।রাজা হাঁসি মুখে হাত বারিয়ে দিলেন কন্যাকে বুকে জড়াবেন বলে ।কিন্তু তেনার স্নেহের ডাকে রাজকন্যা নীলাক্ষী সায় দিলোনা তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর কন্যার ভিন্ন রুপ, তার মুখ ভরা ছিলো বেতিক্রমধর্মী এক আশ্চার্য রখমের হাঁসি আর সে হাটতেছিলো কোমল স্বভাবে হেলেদুলে তার দু’চোখ খোলা ছিলো ঠিকই কিন্তু সে যেনো সামনের কিছুই দেখছেনা হয়তো কোনো এক দৃঢ়তম ভাবনায় ভাষছে রাজকন্যা ।আর দিবা স্বপ্ন দেখতে দেখতেই রাজকন্যা তার নিজের কক্ষের দিকে চলে গেলো ।রাজা তখনো কিছুটা অবাক হয়ে পিচন থেকে কন্যার পানে তাকিয়েই ছিলো ।
পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে রাজা তার কন্যা নীলাক্ষীর কক্ষে গেলেন ।দেখলেন নীলাক্ষী তখনো ঘুমচ্ছে ।রাজা মেয়ের ঘুমনো দেখে মুচকি হেঁসে স্বনিকটে গেলেন তারপর পাশে বসে স্নেহের পরশে আল্ত ভাবে নীলাক্ষীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আরাম্ভ করলেন ।আর অমনি রাজার স্পর্শে রাজকন্যা নীলাক্ষী তার নীল বর্ণের আঁখি খুলেই একবার মৃদুময় হাঁসলো ।তারপর উঠে বসলো পিতার পাশে ।আর তারপর বলতে লাগলো নিজের মতো করে, ‘বাবা, আমাদের রাজ্য অনেক অনেক সুন্দর ।আমার ভিষণ ভালো লেগেছে ।আমি আজও দেখতে যেতে চাই!’ তখন রাজা বললেন, ‘কেন নয়! অবশ্যই দেখতে যাবে ।আমার একমাত্র কন্যা ইচ্ছে পোষন করবে আর আমি তা নিষেধ করব তাই কি হয়? তবে একটা কথা…’ তখন আগ্রহের সাথে রাজকন্যা জানতে চাইলো, ‘কি সেই কথা?’ রাজা বললেন, ‘ইচ্ছেমতির সেই ভয়ঙ্কর নদী থেকে দূরে থাকতে হবে ।’ একথা শোনা মাত্র যেনো রাজকন্যার অন্তর কেঁপে উঠলো বিদ্যুৎ এর ঝলকানির ন্যায় ।কেননা সে ঐ নদীর পাড়েই যেতে মন স্থির করেছে, আর সমস্ত রাঁত্র জুরে ভিনদেশি ঐ সুদর্শন সুজনের ভাবনাতেই ভেষেছে, আর একলা একলা হেঁসেছে, অসম্ভব আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করেছে কখন রাঁত্র ফূরাবে আর উজ্বল প্রহর হবে? আর কখন সে ঐ ইচ্ছেমতি নদীর ধারে যাবে ? তার মন যে আর টিকতেছেনা ঘরে ।তাই সে পিতাকে সজরে আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন বাবা? কেন সেই নদী থেকে দূরে থাকতে হবে? কি আছে ঐ নদীতে?’ রাজা নীলাক্ষীর এই প্রশ্ন শোনার পর একটা হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন তার পর বলা আরাম্ভ করলেন, ‘আমি জানি না কেন এই নদীর জল অভিসাপ্ত! কেনই বা সে জল স্পর্শ করলে মানুষ মরে যায় !ধ্বংস হয়ে যায় সে জলের সংস্পর্শে আসা সব কিছু! তবে এটা জানি যে, এ জল এই নদী পূর্বে এমন ছিলো না ।খুবি সচ্ছ আর সু-স্বাদু ছিলো সে জল ।নাওয়ে করে এপার ওপার যাওয়া আসা করা যেতো খুব সহজে ।আর সব ধরনের যোগাযোগ থাকায় ইচ্ছেমতির গোটা রাজ্যে কোন অভাব অনটন ছিলো না নদীর এপার ওপারের প্রজাদের । আর সে সময় এ রাজ্যের রাজা ছিলো আমার বাবা শাহ্ ওলিউল্লাহ্ ।আর আমি বাবার একমাত্র পুত্র ছিলাম ।আমার বিয়ের পর রাজ্যের দেখাশুনার ভার বাবা আমার কাঁধেই দিয়ে দিলো অর্থাৎ তখন আমি হলাম রাজা ।তারপর একে একে দশটা বছর কেঠে গেলো কিন্তু তারপরও আমি সন্তানের মুখ দেখলাম না ।এ চিন্তায় বড় হতাশ হয়ে পড়ছিলাম আমি ।তখন আমার এমন অবস্তা দেখে আমার বাবা রাজ্যের সেনাপতিকে ডেকে সমস্ত রাজ্য জুরে ঘোষনা দিতে বললেন যে, যদি এমন কোনো ব্যক্তি থেকে থাকে যে আমার বংসের প্রদীপ জ্বালানোর উপায় বলে দিবে বা প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা করে দিতে সক্ষম হবে তাকে আমি সান্মানিত ভাবে পুরস্কৃত করবো ইচ্ছেমতি নদী সহ পশ্চিমের সমস্ত অংশ দিয়ে ।একথা ঘোষনার পর এক এক করে আসতে লাগলো অনেক লোক তারা এটা করতো সেটা করতো অনেক কিছু খেতে দিলো আমাকে কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না ।তারপর হঠাৎ এক দিন এক হিন্দু বৃদ্ধা নারী এলো প্রাশাদে ।তার নাম মৃনালিনী দেবী ।তিনি আমার হাতে দিলেন ক্ষুদ্র আর বেতিক্রম আকৃতির এক গাঢ় নীল বর্ণের পাথর ।সে পাথর দেখতে অনেকটা হীরক খন্ডের ন্যায় ।আর বললেন, এই পাথর পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এক দিন এক রাত তার পর সে পানি পান করলেই আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হবেন ।তখন সে অনুযায়ী আমি কাজ করলাম দেখলাম এক দিন এক রাত নীল রঙের পাথর পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর সে পাথর পানিতে মিশে গেলো আর সেই পানি পান করার পর রানী সত্যি সত্যিই অন্তঃসত্ত্বা হলো ।আর তার ঠিক কয়েক দিন পর আমি ইচ্ছে পোষন করলাম খুব তারাতারি করে এক ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান আয়জনের মধ্য দিয়ে ইচ্ছেমতি নদী ও রাজ্যের পশ্চিম পাশটা সেই নারীর নামে ঘোষনা করবো ।কিন্তু ততক্ষনে ইচ্ছেমতি নদী তার পিশাচিনী রুপ ধারন করলো হয়ে উঠলো অভিসাপ এই রাজ্যের জন্য ।আর সেই নদীতে প্রথম প্রান হারালো মৃনালিনী দেবীর একমাত্র পুত্র আর পুত্রবধু ।তখন তিনি প্রাশাদে এসে উম্মাদ হয়ে বললেন, ফিরিয়ে দেও সে পাথর, ফিরিয়ে দেও আমাকে, ওর পাথর ওকে ফিরিয়ে না দিলে এই রুপ বদলাবেনা, ধ্বংস হয়ে যাবে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, ফিরিয়ে দেও ।একথা বলতে বলতে তিনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন ।সেই পাথর ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো উপায়ই ছিলো না ।একথা তিনিও খুব ভালো ভাবেই জানতেন কিন্তু তিনি তেনার সন্তান হারা যন্ত্রনায় জর্জরিত হয়ে পাথর ফেরত চেয়েছিলেন ।তারপর দীর্ঘ সময় পর তেনার জ্ঞান ফিরলে তিনি নিশব্দ হয়ে যান কোনো কিছুই বলেননি সে পাথর আর ঐ নদীর সম্পর্কে ।ঠিক তখন থেকেই দেখে আসছি সে নদীর এ রুপ ।’
দীর্ঘক্ষন ধরে র্মমান্তিক সে ঘটনা শোনার পর রাজকন্যা অজানা কষ্ঠভরা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ।তারপর কিছু মুহূর্ত নিস্তব্দ হয়ে রইলেন পিতা ও কন্যা উভয়ে ।পরক্ষনেই রাজা সেই কষ্ঠ ভরা সৃতি থেকে বের হয়ে বর্তমান সময়কে মেনে নিয়ে হাঁসি মুখে নীলাক্ষীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি প্রহরীদের বলে দিচ্ছি টমটম প্রস্তুত করতে ।’ কিন্তু নীলাক্ষী বলল, ‘তার প্রয়োজন নেই বাবা ।আমি আমার সঙ্গিদের সাথেই যেতে পারবো ।’ পুনরায় রাজা তখন বললেন, ‘ঠিক আছে । কিন্তু সেই জল স্পর্শ করিসনে যেনো ।’ একথা বলে রাজা নীলাক্ষীর কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন ।
তখন আনন্দে আটখানা হয়ে রাজকন্যা নিজেকে প্রস্তুত করে সঙ্গিদের নিয়ে সেই সে ভিনদেশের সু-পুরুষ যাকে এক দর্শনে মনের মনিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছে সে, তাঁর চাঁদ মুখখানা পুনরায় দর্শনের উদ্দেশ্যে রহনা দিলো ।গল্পে গল্পে সাঙ্গিদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পৌচ্ছে গেলো রাজকন্যা তাঁর কাঙ্ক্ষিত সেই ইচ্ছেমতি নদীর পাড়ে ।নীলাক্ষি লক্ষ্য করলো তাঁর সেই সু-পুরুষ অধীর আগ্রহে তাঁর তরে নদীর ওপাড়ে অপেক্ষমান ।আর যেই না নীলাক্ষী সুজনের দৃষ্টি সীমানার মধ্যে তাঁর অরুচরণে পর্দাপণ করলো, অমনি সুজন ব্যকুলতার সাথে উঠে দ্বারালো আর আকুল করা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অপূর্বা চেহারার অধিকারী তাঁর মনোরাজ্যের রানী নীলাক্ষীর দিকে ।অনুরূপ সে একই দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নীলাক্ষীও সুজনের পানে ।নিঃশব্দে চেয়ে রয়েছে দু’জনে, যেনো দেখা হয় নাই তাদের জন্ম জন্মান্তরে, যেনো অতি পরিচিত সে চেহারা যা কখনোই ভোলা যায়না, যেনো শান্তি মিলে প্রশান্তির সে ছাঁয়াতলে, যেনো সমস্ত ভূবনের সকল সৌন্দয়্য সে চেহারায় জমানো, যেনো গাছে ফুল ভূল করেই ফোটে, এই চেহারার সৌন্দর্যের খবর না যেনে, যেনো দিবালোকের সূর্য অজানা তাই সে অস্তিয়মান হয়, এই রূপের জ্যোতি সে জানেনা, যেনো ক্ষুধার্ত হৃদয়ের পরিপূর্ন খোরাক সে রূপেতে বিরাজমান, যেনো এ রুপ না দেখলে চিরঅজানা থাকতো সৌন্দর্যের সজ্ঞা, আঁখি যেনো পরিপূর্নতা পেলো এই চেহারাকে দর্শন করে যার তুলনাই হয় সমস্ত ভূবনকে হিসেব করে, যেনো চেয়ে রই, আরো চেয়েই রই, আর চেয়ে রয়েই প্রশান্ত হৃদয়কে সাক্ষী রেখে, অস্থির আর ক্ষুধার্ত এ আঁখিকে ঐ অনুপম অপূর্ব অতুলনিয় রূপের মাঝে চিরউৎসর্গ করে দেই । এমন্ত মনোভাব নিয়ে বেশ কিছু মুহূর্ত চেয়ে রয়েছে দু’জনে ।ঠিক তখন হঠাৎই কোনো এক কোকিলের মধুমাখা সুরেলা কন্ঠের ডাক এসে পৌচ্ছালো রুপদর্শনে ধ্যানমগ্ন উভয়ের কানে, আর অমনি নীলাক্ষী তাঁর আঁখি সরিয়ে নিলো, অনেকটা লজ্জাবতী উদ্ভিদের ন্যায় গুটিয়ে নিলো নিজের দৃষ্টিকে ।সে মুহূর্তে নীলাক্ষীর দুধে-আলতা নমনীয় চেহারা লজ্জা আর অনন্দের রং মেখে রক্তাম্বরী বর্ণ ধারণ করলো ।কিন্তু অপর পক্ষের প্রেমো পিয়াশে পিপাশাক্ত সুজন তখনো তার দৃষ্টি ফেরাতে ব্যর্থ ।তখন নীলাক্ষী তার লজ্জামাখা নমনীয় কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমার পরান যে আর টিকে না, থাকেনা ঘরেতে, জানিনা কেন বার বার প্রতি বার উড়ে যায় সে, ওহে ভিনদেশী তোমার কাছে!’ মতান্তরে ওপার থেকে ভেষে আসলো, ‘নীলাক্ষী, তোমার ঐ আঁখি যে মোর হৃদয় কেরেছে ।আমি পারিনি যে গত রাতে ঘুমতে ।শুধু সজাগ স্বপ্নে দেখেছি তোমারে আর এঁকেছি তোমারে ।এক দর্শনেই যে তুমি বাসা বেঁধেছো আমার অন্তরে ।তবে বল, বল হে , ওহে অপূর্বা কন্যা কেমনে ভূলি তোমারে?’ হৃদয় স্পর্শী সুজনের এ কথা নীলাক্ষীর হৃদয় স্পর্শ করলো আর আবেগে আপ্লুত নীলাক্ষী, সুজনের প্রেমো অস্ত্রে ক্ষত হৃদয়ের অসহনীয় না দেখা যন্ত্রনায় নিজের মাঝে নিজে ছটফট করতে লাগলো ।নীলাক্ষী তার করুনার দৃষ্টিতে সুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো পূনরায় ।তারপর বলতে শুরু করলো, ‘আমি আমার প্রেমো পেয়ালা উজার করে সখা সুজন, দিলাম তোমার পাদো তলে ঢেলে, কৃপা করে তবে তুমি গ্রহন করো মোরে ।প্রতিক্ষা করো যাবে নাহে যাবে না, কখনো মোরে ভূলে !’ অপর প্রান্তে প্রেমের টানে ছটফট করনেওয়ালা সুজন নীলাক্ষীর জবাবে অস্থিরতার সাথে বলে উঠলো, ‘কেমনে যাব বল ভূলে ! চলে যদি যেতেই হয় প্রিয় তোমারে মনে রেখে তোমারে বুকে বেধে চলে যাব ঐ পরপারে শুধু তোমারে হৃদয়ে করে রাখবো ধরে জন্ম জন্মান্তরে ।’ তখন আকুল কন্ঠে নীলাক্ষী বলল, ‘ তবে বল, বল হে সখা কেমন থাকবো তোমায় রেখে দূরে? কোন পথে আসবে সে তুমি আমার কাছে? এ জল কেমনে দিবে পারি? এজল যে তোমার জিবন নিবে কাড়ি ।তোমার নিকটে যেতে যে আমার আকুল হৃদয় উদাশী ।’ সুজন বলল, ‘যদি না পাই তোমারে, তবে নিঃভয়ে হে কন্যা এ জীবন দিবো এজলে উৎসর্গ করে শুধু তোমার তরে ।’ কলিজা ছেড়া এ কথা শুনে নীলাক্ষী শিউরে উঠে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘এ কথা বলিওনা হে প্রানের মানুষ, যদি না থাকো তুমি তবে কি নিয়ে এজীবনে বেঁচে থাকবো আমি ।তোমারে নিয়ে স্ব-শরীরে সংসার বাঁধিব আমি এ জীবনে ।থাকিতে চাই সারাটা জীবন তোমার সনে ।তবে আজ আর নয় ।ফিরতে হবে ঘরে ।’ তখন সুজন বলে উঠলো, ‘কেনো এত সংসয় প্রিয় কেন এত তাড়া ? ব্যকুল হৃদয় স্থির হয় না যে তোমায় ছাড়া ।তবে যাও যাও চলে, প্রিয় যেওনা যেনো ভূলে মোর ।তোমার তরে অপেক্ষমার থাকবো প্রতি প্রহরে ।’ তখন খন্ডিত হৃদয়কে ওপারে রেখে নীলাক্ষী পিচনে ফিরলো মহলে ফেরার উদ্দেশ্যে কিন্তু তবুও যেনো নয়ন ফিরছেনা সুজনের থেকে ।চলে না আসতে চেয়েও সে চলে আসলো মহলে ।
এভাবেই কেটে গেলো বেশ কয়েক দিন ।দিনে দিনে তাদের প্রেমের টান শিকরের গভিরে পৌচ্ছে গেলো ।এখন একে অপরকে না দেখে একটা দিনও থাকতে পারেনা । একে অপরকে ছাড়া ভাবতে পারে না কোনো কিছুই । যেনো দুই দেহে এক প্রান হয়ে উঠলো ।আজ-কাল মহলে যেনো নীলাক্ষীর আর সময় কাটছে না সুজনের বিহনে ।সারাক্ষন তার প্রিয় মানুষটাকে দেখতে ছটফট করছে মন ।যেনো তার মনে হচ্ছে সুজন বিহনে উত্তপ্ত জীবন ।
তারপর একদিন রাতে রাজা নীলাক্ষীর কক্ষে এলেন ।আর নীলাক্ষীর পাশে বসে বললেন, ‘নীলাক্ষী মা আমার, ছোট্টবেলা থেকেই তোর কোনো আবদার আমি অপূর্ন রাখিনি ।কিন্তু এবার তোর কাছে আমার একটা আবদার ।’ নীলাক্ষী মুচকি হেঁসে বলল, ‘তোমার আবদার! আবদার নয় বল আদেশ ।এখন বল কি তোমার আদেশ?’ তখন রাজা বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে আদেশ ।বিষয়টা হচ্ছে, বয়স তো আমার কম হলো না ।আর মাশাআল্লাহ্ তুইও অনেক বড় হয়েছিস ।তাই আমি ঠিক করেছি আমাদের সেনাপতির দক্ষ পুত্রের সাথে আমার একমাত্র কন্যার বিয়ের কাজ সম্পূর্ন করে তাকে রাজত্ব দিয়ে দিবো ।’ একথা শোনা মাত্র নীলাক্ষীর কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো, চোখ বড় বড় করে সে শুকনো মুখে ঢোক গিলে অনুন্বয়ের কন্ঠে পিতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাবা! তুমি আমার সব আবদার রেখেছো ।আজ শেষ বারের মতো আমার শেষ আবদার নয় বরং অনুরোধটা রাখো!’ মুচকি হেঁসে রাজা আস্থার সাথে বললেন, ‘কেন নয় অবশ্যই রাখবো ।জন্মের সময় রানী মারা যায় তার পর থেকে তো তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই ।আমি এতো দিন তোর সব আবদার রেখেছি প্রয়োজনে বাকি জীবনও তোর সব আবদার রাখব মা ।’ তখন নীলাক্ষী কিছুটা আস্থা পেলো ,এবং অনুরোধের কন্ঠে বলল, ‘বাবা, তুই চাও আমার বিয়ে দিতে,তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা । কিন্তু বাবা, তুমি আমায় মাফ করো আমি সেনাপতির পুত্রকে বিয়ে করতে পারবো না, কারন আমি সুজনকে অনেক অনেক ভালোবাসি বাবা ।’ নীলাক্ষীর এ কথা শুনে রাজা খানিক্ষন স্তব্দ হয়ে রইলো, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমার একমাত্র কন্যার কোনো চাওয়াই আমি অপূর্ন রাখিনি আর রাখবোও না ।হ্যাঁ, অবশ্যই সে সুজনের সঙ্গেই আমার কন্যার বিয়ে হবে ।তো আমার মা, কে সেই সুজন? কি তার পরিচয়?’ আনন্দে আত্বহারা হয়ে উঠলো নীলাক্ষী, আর হাঁসি মুখে বলল, ‘শুকরান আমার মহামান্নিত্ব পিতামহের একমাত্র পুত্র ।সুজন কৃষকের ছেলে ।আর দেখতে সু-দর্শন আর দক্ষও বটে ।তবে… ’ রাজা বললেন, ‘সামস্যা নাই সে কৃষক হোক, আর জেলে হোক সেই হবে সামনে দিনের রাজা, আমার কন্যার পচন্দ আমি কি অমত করতে পারি! তবে কি মা?’ তখন কিছুটা রসহীন চেহারায় শুকনো কন্ঠে নীলাক্ষী বলে উঠলো, ‘সে ইচ্ছেমতি নদীর ওপারের গ্রামে থাকে ।’ একথা শোনা মাত্র রাজা অবাক হয়ে গেলেন, মুহূর্তেই রাজার চোখ কপালে উঠেগেলো ।আর সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো, হতভম্ভ হয়ে গেলেন রাজা ।সঙ্গে সঙ্গে দরাজ কন্ঠে রাজা বললেন, ‘নাহ্, তা হয় না । এ মেনে নেওয়া যায় না ।এটা কোনো দিনও সম্ভব নয় ।প্রয়োজনে জোর পূর্বক সেনাপতির পুত্রের সাথে তোর বিয়ে দিবো ।তবুও আমি তোকে ঐ পিশাচিনী ভয়ঙ্কর জলে বিসর্জন দিতে পাবো না ।’ মুহূর্তেই কলিজা ছেড়া কষ্টে জর্জরিত হয়ে উঠলো নীলাক্ষী ।নিথর দেহে পাথরের মতো হয়ে দ্বারিয়ে রইলো সে ।বুকের কষ্ট জল হয়ে দু’চোখের কোঠায় এসে পৌচ্ছালো ।কেননা সে কখনো পারবেনা প্রান প্রিয় সুজন কে ভূলতে । সুজন যে তার প্রান সমতুল্য, তাকে ছাড়া যে সে আর কিছুই ভাবতে পারে না ।অসহায় হয়ে তখন নীলাক্ষী তার পিতার পায়ে জড়িয়ে পড়লো আর কাঁন্না ভেজা কন্ঠে বলতে আরাম্ভ করলো, ‘বাবা, আমি, আমি সুজনকে ছাড়া আর কিছু্ই চাই না ।বাবা, আমি সুজনকে ছাড়া মৃতদেহ । তাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না ।বাবা…’ রাজা কখনোই কোনো কারনে তাঁর একমাত্র কন্যার চোখে এক বিন্দু জলও আসতে দেয়নি ।এখন চোখের সামনে কন্যার হৃদয় ভাঙ্গা এ করুন কাঁন্না দেখে রাজা স্থির থাকতে পারলোনা ।রাজার চোখেও পানি চলে এলো, ভেঙ্গে গেলো চুড়মুড় করে কন্যার উপড়ে আরজ করা দরাজ কন্ঠের নিষেধাজ্ঞা ।টেনে তুলে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিলো তার কন্যাকে আর বলতে শুরু করলো, ‘কাঁদিসনে মা, কাঁদিসনে । আমি যদিও জানিনা, কি ঐ নদী রহস্য । তবুও তোর জন্য আমি চেষ্টার কোনো কমতি রাখবনা ।আমি কালসকালেই যাব মৃনালিনী দেবীর কাছে, প্রয়োজনে তেনাকে অনুরোধ করবো । নিশ্চই কোনো না কোনো একটা পথ ঠিকই বের হবে, কাঁদিসনে তুই…’
পরদিন সকাল সকাল রাজা পৌচ্ছে গেলেন মৃনালিনী দেবীর কুঠিরে ।তারপর বিনয়ের সাথে করুনার কন্ঠে তেনাকে সকল কথা খুলে বললেন আর জানতে চাইলেন সামাধানের পথ ।কিন্তু মৃনালিনী দেবী কোনো সারা দিলেননা ।তখন রাজা অনুরোধ করলেন তেনাকে ।তারপর মৃনালিনী দেবী মুখ খুললেন, ‘আমি, আমি সঠিক জানিনা । তবে, তবে আপনার মেয়ের মাঝেই রয়েছে ঐ নীল পাথর ।যদি আপনার মেয়ের শরীরের কোনো এক বিশেষ অংশ ঐ নদীর কালো জলে অর্পণ করা যায় তাহলে হয়তোবা সে নদী তার আপন রুপ ফিরে পাবে ।আমি, আমি এর থেকে বেশি কিছু যানিনা । চলে যান আপনারা, চলে যান ।’ একথা শুনে রাজা নিথর হয়ে গেলো ।পাথরের মতো কিছুক্ষন সেখানে দ্বারিয়ে থেকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মহলে চলে আসলেন ।তারপর কন্যার কক্ষে গিয়ে কাঁন্না জড়ানো কন্ঠে সব কথা বলে দিলেন তিনি ।
রাজা কক্ষ থেকে চলে যাওয়ার পর হৃদয় হারা নিস্ব নীলাক্ষী অঝরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো ইচ্ছেমতি সেই সে নদীর কিনারে ।প্রানপ্রিয় নীলাক্ষীর চোখে জল দেখে সুজন উত্তেজিত হয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো, ‘কি হয়েছে? কি হয়েছে তোমায়? কেনো তোমার চোখে ঝরছে অঝরে জল? তোমার চোখের জল যে ঝড়ে ভূমিতে নয় অগ্নি হয়ে হানছে আমার অন্তরে ।যেনো মনে হচ্ছে, কাঁদছে সমস্ত ভূবন । আমি যে আর সইতে পারছিনা ।আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে, প্রান বেরিয়ে আসছে প্রিয় তোমার চোখে জল ঝড়া দেখে ।’ ব্যথার বিরহ সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠলো সুজনের । দু’চোখের সামনে প্রানের চেয়েও প্রিয় বুকের ভিতরে স্ব-যত্নে পুষে রাখা অপূর্বা বালিকা নীলাক্ষীর নিথর হয়ে অঝড়ে কাঁন্না দেখে সুজন অস্থির আর বেপরয়া হয়ে উঠলো প্রেমের আবেগে আপ্লুত হয়ে সে ভুলে গিয়েছিলো সামনের নদীর জল, জল নয় বরং স্বয়ং মৃত্যুর দরজা ।নীলাক্ষীর কাঁন্না করা চেহারার দিকে তাকিয়ে সে তাঁর নিকটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, ভয়ঙ্কর, বিষাক্ত, পিশাচিনী সেই কালো জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো । হতবাক হয়ে গেলো নীলাক্ষী সময় যেনো দ্বারিয়ে গেলো তার, নিশ্বাস পড়লো দ্বারিয়ে নিথর হয়ে পাথরের মতো দ্বারিয়ে রইলো সে, বেঁচে থেকেও যেনো মরে গেলো নীলাক্ষী, দু’চোখের সামনে মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর জলে হাতরায়ে জীবনের থেকে প্রিয় সুজনকে ডুবে যাওয়া দেখে ।শুকনো ঠোঁট, চুপশে যাওয়া চেহারায়, সর্বহারা অন্তর আর শুকিয়ে যাওয়া মরুভুমির ন্যায় দৃষ্টিতে শুধু হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো নীলাক্ষী ঐ রাক্ষসী কালো জলের দিকে ।এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছু মুহূর্ত তারপর হঠাৎ নীলাক্ষী জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো জমিনে জলের দিকে খুব কাছাকাছি পড়লো তার মাথা আর পা পড়লো নদীর চরের দিকে ।
নীলাক্ষীর দু’চোখের কোঠায় জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়লো ভয়ঙ্কর, পিশাচিনী, রাক্ষসী, বিষাক্ত সেই জলে ।
তারপর বেশ কিছু সময় পর, খুব চেনা প্রিয় আর অতি পরিচিত সুরেলা কন্ঠস্বর এসে পৌচ্ছালো নীলাক্ষীর কানে ।চমকে গিয়ে চোখ খুলেই প্রানের চেয়েও প্রিয় সখা সুজনকে দেখে সে অবাক হয়ে গেলো …

1 thought on ““ নীলাক্ষী ” – অথই মিষ্টি”

মন্তব্য করুন