Skip to content

নাম দিও অভিশাপ – দেবশ্রী মন্ডল

মা
আবার যদি মেয়ে হয়ে তোমার কোলে আসি তুমি আমার নাম দিও অভিশাপ।
যেদিন হাসপাতাল থেকে আমাকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরবে তুমি-
আর সেই খুশির খবর জানিয়ে হাসিমুখে বাবা মিষ্টি বিলি করবে পাড়ায় সেদিন যেন বাবা সবাইকে জানিয়ে দেয় আমার নামটা।
যেন বলে-
আমার ঘরে অভিশাপ এসেছে তোমরা একবার দেখবে এসো।
প্রতিবেশীরা আতঙ্কে আর ভয়ে মুখ সিঁটিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে।
আমাকে দেখতে আগ্রহ পাবেনা আর কেউ।
দাদী পায়ের উপর নিয়ে আমাকে দুলুনি দিতে দিতে হাসবে আর বলবে এ নারী জন্ম যে অভিশাপই দিদিভাই।
দাদু হঠাৎ হঠাৎ বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলবে
নামটা এবার ঠিক হয়েছে, আর ভুল করবো না আমরা।
আমি অভিশাপ হয়ে
তোমার ঘরে বেড়ে উঠবো একটু একটু করে।
পাড়ায় আমার হবেনা কোনো খেলার সাথী।
তাই কারো ঘরে খেলার ছলে অন্ধকারে আমার মুখ চেপে ধরে হঠাৎই কেউ নিতে পারবেনা পৈচাশিক আনন্দের গ্রাস।
আমার কোনো বন্ধু হবেনা স্কুলে।
অভিশাপের সাথে কেউ বন্ধুত্ব চায়না
জীবনে আশীর্বাদ চায় সবাই।
অথবা কেউ একজন
যে অভিশাপই ভালোবাসে
সে আমার নাম ধরে ডাকবে-
এই অভিশাপ…
অন্যরা ভয়ে ফিসফিস করে বলবে ও নাম মুখে আনতে নেই রে।
স্কুলের আন্টি মুখ গম্ভীর করে হয়তো বা বলে উঠবেন পৃথিবীতে নামের কী খুব অভাব পড়েছিল!?
শুধু আমাকে ডাকতে গিয়ে কেমন যেন তোমার গলা কেঁপে উঠবে।
অলক্ষ্যে তোমার চোখ দিয়ে জল গড়াবে,
তুমি কিছুতেই ডাকতে পারবেনা আমায় অভিশাপ বলে ।
তোমার বুক ভেঙে যাবে কান্নায়।
আদর করে আমাকে ডাকতে চাইবে হীরা মণি, তনু,নুসরাত,শেফালী অথবা অন্য অন্য নামে।
অথবা আমার নাম দিতে চাইবে স্বপ্ন,
যে স্বপ্ন তোমার দুচোখ জুড়ে থাকবে আজীবন তোমার দুই নয়নের মণি হয়ে।
কিন্তু মা আমিতো তোমার হীরামণি হতে পারবোনা, হতে পারবোনা তোমার দুচোখের স্বপ্ন।
অতো দামী জিনিসে কার না লোভ থাকে বলো , লোভের চকচকে থাবা বাড়াতে কার না ইচ্ছে করে হাতের কাছে জ্বলজ্বলে হীরে দেখলে!!
স্বপ্ন হলেই তো তা ভাঙার কান্না তোমার দুচোখে থাকবে আজীবন। আমি যে তোমার কান্না হতে চাইনা।
তাই আমি অভিশাপ হবো মা।
যেন আমাকে ছুঁতে গিয়ে ভয় হয়,
আমার বুকের উপর থাবা ফেলার আগে একবার বুক কেঁপে ওঠে অভিশাপের গায়ে হাত দিচ্ছে ভেবে।
যেন হঠাৎ হঠাৎ রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে চিৎকার করে বাঁচতে চায় অভিশাপ থেকে।
যে ছেলেটা আমাকে রাস্তায় একা পেয়ে একটু আধটু খেলিয়ে নেবে ভেবে বলে নাম জানতে চায় তার লোভে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো যেন আমার নামটা শুনেই দপ করে নিভে যায়।
মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গিয়ে যেন বুকের ভিতরটা দমে গিয়ে তার বের হওয়া দাঁতগুলো মুখের ভেতরে ঢুকে যায় অকস্মাৎ।
যেন পাড়ার মোড়ে আমাকে ছিঁড়ে খাওয়ার স্বপ্ন দেখা নরপশুগুলো জীবন অভিশপ্ত হওয়ার ভয়ে আমার থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল ভেবে নেয়।
তারপরও যদি কোনো
এক দুপুরে
এক সন্ধ্যায়
এক রাতে
অথবা এক ভোরে
আমাকে একলা পেয়ে অতর্কিতে দুহাতে চেপে ধরতে চায় আমার মুখ কোনো হায়েনার দল
তখন আমি চিৎকার করে বলবো,
আমি অভিশাপ
আমাকে মেরোনা- আমাকে মেরোনা…
জানি হয়তো সেদিন আর ভয় পাবেনা,
চমকে যাবেনা,
অভিশাপ ভেবে দূরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার আগে আমাকে খুবলে খুবলে খাবে আর অট্টহাসিতে বলবে পৃথিবী থেকে অভিশাপের চিহ্ন মুছে দেবো।
তখন আমার ছোট্ট শরীর ওই জন্তুদের আচঁড়ে নখরে নিষ্পেষিত হতে হতে কেবলই তোমার মুখখানা শেষবারের মতো খুঁজে ফিরবে মা।
দুচোখের জলে
আমি তোমাকেই শুধু বলতে চাইবো,
মা –
আজ তোমায় আমি অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলাম।
পিছমোড়া করে বাধা হাতদুটোকে উপরে তুলে আমার হাজারো কৈফিয়ত করতে ইচ্ছে করবে অদৃশ্যের প্রতি-
কেন আমি অভিশাপ হলাম-
কেন অভিশপ্ত হয় আমাদের জীবন –
কেন আমাদের জন্মই একটা অভিশাপ –
আর কবে ঘুঁঁচবে এই অভিশাপ –
কার অভিশাপে আজ আমি চলে যাচ্ছি –
কার অভিশাপে?
আর
যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ওড়নায় বাধা রক্তাক্ত মুখ তুলে আমি চলে যাওয়ার আগে পৃথিবী মাকে বলে যাবো,
হে পৃথিবী মাতা
তোমার বুক থেকে আজ আরো একটি
অভিশাপ বিদায় নিলো।
-(পৃথিবীতে সকল অভিশপ্ত নারীর প্রতি আমার এই লেখা।)

মন্তব্য করুন