Skip to content

দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া

দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া
– (ছোটগল্প)
কলমে–রমেন মজুমদার
তারিখ:-23/08/23
—–
সেদিন শনিবার সন্ধ্যায় গাট্টিবোঁচকা নিয়ে
তিনজন কবি ছুটল গৌরবঙ্গে।
পাঠক,
নাম শুনেছেন নিশ্চই গৌরবঙ্গের। এটা বাংলাদেশের নয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি সনাতনী জায়গার নাম–“গৌরবঙ্গ”
এই গৌরবঙ্গের সাব-সরকারী কাজের দাপ্তরিক জেলা হল ” মালদহ থেকে এখন সংক্ষেপে মালদা।
—-
প্লাটফর্মের বাইরে প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর সুপ্রিয় ঘোষ।
যাকে না বললেই নয় যে,ইনিই সুপ্রিয় স্যার। স্যারকে’তো স্যার সম্বোধন না করে পারা যায়’না । মহাশয়ের কলম কথাবলে।
যেমন তিনি কবিতা লিখেন,তেমনি গল্প।
এই স্যারের লেখা বহুবার পড়েছি।
তাঁর কিছু কিছু লেখনী স্টাইল ও শব্দের মহড়া যেন তাক লাগিয়ে দেয়।
চোখ ধাঁধিয়ে আসে, মগজে ঘুরপাঁক খায় শব্দরা।

স্টেশনের বাইরে প্রায় পৌণে একঘণ্টা স্যার-ছাত্র মিলে দাঁড়িয়ে আছি। রেল স্টেশনের চাতালে ওলা-উবের ক্যাবের যাত্রী ওঠা-নামার ক্ষণস্থায়ী স্টপেজ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি,
ক্যাব থেকে দু’জন বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী নেমে এলেন। দুজনেই প্রায় ছয়ফুঁটের উপরে। দবদবে ফর্সা,মাথার কেশ সাদা মেঘের মতই নজরে এলো।ওঁদের সাথে দুটো ব্যাগ বা ট্রলি নিচে চাকা লাগানো। ওঁনারা ট্রেন ধরবে বলে ব্যাগগুলো টেনে নিচ্ছিল।
দুজন কুলি এসে বলল, স্যার কষ্ট করছেন; আমরা নিয়ে দিচ্ছি ট্রেন অবধি।
বৃদ্ধ বললেন, কত দিতে হবে ?
–কুলি, স্যার বেশি না,মাত্র তিনশ।
— কি বলছ ? — এইটুকু রাস্তায় মানে দুমিনিটের ব্যবধানে এতোগুলো টাকা গচ্ছা?
তবুও বৃদ্ধ দর কষাতে লাগলেন।
— কুলি, স্যার আড়াইশ লাগবে। নইলে ট্রলি ট্রেনে ওঠবে না।
বৃদ্ধা বললেন, হ্যা গো দিয়ে দাও। তুমি পারবেনা একা টানতে।
বাধ্য হয়ে এই দুটো ট্রলি শেষ পর্যন্ত দু’শ,
টাকায় মিটমাট হয়ে গন্তব্যে রওনা হল।

আমি দাঁড়িয়ে আছি।
সুপ্রিয় স্যার বলছেন, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি প্লাটফর্মে গিয়ে দেখে আসি
কত নম্বরে গাড়ি দিচ্ছে ।
আমি বললাম, স্যার সাথে রিজার্ভেশন টিকিটটি নিয়ে যান। নইলে টিটি জানতে চাইবে। অনাহুত স্টেশন টিকিট দশ টাকা বেহাত যাবে।
উনি টিকিট নিয়ে ভেতরে গেলেন।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি মালপত্র নিয়ে।
কারণ,
আর এক স্যার আসবেন দমদম থেকে। তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।
আমি দেখলাম,
সাধারণ নিরহ মানুষদের কি ভাবে সহসাই মুরগি বানায় (?)
এখানে আসা কত নিরীহপ্রাণ কুলিদের হাতে ভদ্রবেশে নিগ্রহ হচ্ছে।
আমাদের কাছেই দেখলাম, কয়েকটি বাইক দাঁড় করিয়ে তার উপর যুবকদের সিগারেট টানাছে ।
সুপ্রিয় স্যার বললেন,এরা এখানকার কুলিদের দাদা। কমিশন খাওয়া দাদারা ভদ্র পোশাকেই সিগারেট টানছে।
আমি মনে মনে ভাবছি,
রাজনীতিতে কত কোটিকোটি টাকার দাদাগিরি হয়, আর এরা চুনোপুটি।

সুপ্রিয় স্যার ট্রেশন হতে ফিরে বললেন,
গাড়ি চোদ্দ নম্বরে দিচ্ছে। আমি টাইম দেখলাম,তাতে অনেক সময় আছে গাড়ি ছাড়ার।
স্যার দুটো সিগারেট নিয়ে এলেন। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ততোক্ষণে দম মেরে নিলাম।
এমন সময় এক কুলি এসে আমাদের ব্যাগপেট্রা নিতে চাইলেন। হিন্দিতে ওনারা বলাবলি করলেন।আমি বলতে না পারলেও বুঝলাম। যে পয়সায় তোমাকে দিব,তা দিয়ে আমরা একবার খানা খেতে পারব।
যা হোক, ততক্ষণে দমদম থেকে এলেন সুব্রত স্যার। তিনি অফিস থেকে বাড়ি গিয়ে কোনরকম ছুটে এলেন। সুব্রত স্যারের অফিস ডালহৌসি।
—-
আমরা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। তারপর সুপ্রিয় স্যার ভারী ব্যাগটা কুলিকে না দিয়ে নিজের কাঁধে তুলে এলেন চোদ্দনম্বর প্লাটফর্মে।
গাড়ি কেবল ঢুকল।
গাড়ির শরীর জুড়ে লেখা আছে”গৌর এক্সপ্রেস”
আমরা আমাদের নির্ধারিত কামরায় ওঠলাম। উঠেই হাতমুখ ধুঁয়ে রাতের হালকা নাস্তা সেরে নিলাম।
বদঅভ্যাসটা কিছুতেই দমন করতে পারছিনা। এক এক করে তিনজনেই বাথরুম থেকে সে অভ্যাসের তিয়াস মিটিয়ে এলাম।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা বেজে গেছে।
ট্রেন হু হু করে ছুটছে। সকলেই গাড়ির লাইট অফ করে আমরা শুয়ে পড়লাম।
আমরা ছিলাম স্লিপার ক্লাসে।
আমি ও সুব্রত স্যার পাশাপাশি লোয়ার বাথে।সুপ্রিয় স্যারকে দিলাম মিডিল বাথে।
কিছুক্ষণ পরে টের পেলাম। সুব্রত স্যার সারারাত মোবাইল টিপে যাচ্ছেন। তিনি ঘুমাননি। আমি যতটুকু ঘুমিয়েছি,তাতে নাকি নাক দেখেছি,সুব্রত স্যার বললেন।
আর পরিষ্কার আমার উপরে মিডিল বাথে শুয়েছেন সুপ্রিয় স্যার।
তিনিও বেশ চমকে দিয়েছেন নাকডেকে।

ফারাক্কা আসার আগেই আমরা সকলে উঠে বসলাম। যা হোক ট্রেন একঘণ্টা লেট করে এলো মালদা টাউন। পূর্ব সিদ্ধান্ত মত
আমরা ওঠলাম গিয়ে বিশ্বাস বাবুর ওখানে। মানে মরুকান্তি বিশ্বাস। উনি কলকাতায় চাকরি করেন বেশ বড়পদে।ছুটিতে এসেছেন বাড়িতে অনুষ্ঠান উপলক্ষে।

আমরা এলাম এখানে কবি সম্মেলন করার জন্য। বিশ্বাস স্যারের বাড়িতে তিনতলায় আমাদের অনুষ্ঠান হবে।
ইতি মধ্যেই আমাদের চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র সাহা স্যার বার তিনেক ফোন করলেন। কারণ সকালের টিফিন ওনার বাড়িতে করার কথা।
আমরা মালদা শহরের মঙ্গলবাড়ি এসে উঠেছি।এখানেই দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে সকল কবিসাহিত্যিকদের জন্য।
এই মঙ্গলবাড়ি থেকে অনিল স্যারের বাড়ি অনেকটাই দূর । জায়গাটার নাম মালঞ্চপল্লী ।মহানন্দা নদী পার হয়ে যেতে হয় মালঞ্চপল্লীতে।
—-
ওদিকে এই সম্মেলন উপলক্ষে সুদূর আসাম প্রদেশ থেকে ছুটে এলেন আমাদের তিনজন মহিলাকবি। কাব্যকস্তুরী,নিলতি,ও লিনাদিদি। ওনারা আসামের প্রখ্যাত অসম ভাষার কবি। তবুও বাংলাভাষার টানে ওনারা ছুটে এলেন আমাদের সম্মেলনে।

ব্যাগপেট্রা মরুকান্তি বিশ্বাস স্যারের বাড়িতে রেখে স্নান ও প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে ছুটলাম অনিল স্যারের বাড়িতে।
সেখানে আমরা সবাই সকালের টিফিন দুস্তলমত সেরে এলাম নির্ধারিত সম্মেলনের জন্য মঙ্গলবাড়িতে।
—-
সুদূর পাকুয়া সহ গ্রেটার মালদহ গৌরবঙ্গের প্রখ্যাত নামিদামি লেখক, কবি,ছড়াকার এসে উপস্থিত হলেন এখানে।
দুপুরের খাবার শেষ করে শুরু হল অনুষ্ঠান। দুটি কাব্যগ্রন্থ স্বাড়ম্বর আনন্দের সহিত মোড়ক উন্মোচন শেষে
কবিতা পাঠ,গান,ছড়া,কবি পরিচয়ে পূর্ণিমার আলো সাহিত্য পরিবার থেকে হয়ে গেল এই অনুষ্ঠান। আসর মাতালেন অসমের একটি আঞ্চলিক ভাষায় গান পরিবেশন করে কাব্যকস্তুরী দিদি।
অনেক প্রশংসা হলো কবিদের মধ্যে বই বিতরণ,সম্মাননা পত্র বিতরণ, ক্রেস্ট বিতরণ ও উত্তরীয় পরিয়ে।
পূর্ণিমার আলো সাহিত্য পরিবারে চেয়ারম্যান শ্রী অনিল চন্দ্র সাহা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ছড়াকার অমর মণ্ডল (জেঠুমণি) ও মাতিয়ে তুললেন তার ছড়া পরিবেশন করে।

গৌরবঙ্গের অনেক কিছু দেখা হয়নি। নামকরা গৌরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সহ গৌড়ের মঠ আরও অনেক অনেক দর্শনীয় স্থানগুলি চোখের আড়ালেই রয়ে গেল।
কিন্তু সেই গৌরবঙ্গের না দেখা স্থানগুলো নিলতি বণিক কর্মকার দিদি ও লীনা দেবনাথ দিদি হোটেলে থেকে গেলেন গৌরবঙ্গের দর্শনীয় স্থানগুলো। তাঁরা সমস্ত মালদহ ঘুরে ঘুরে দেখলেন পরেরদিন। যা আমরা তাঁদের তোলা ছবি দেখে আফসোস করেছি। সত্যই অনেক কিছু দেখা হলনা এ’পোড়া চোখ মেলে।
আমাদের সেদিনই রাতের ট্রেনধরে ফিরে আসতে হল। মনে অনেক না দেখার ক্ষুধা মনের মধ্যেই রয়ে গেল।
শুধু অমর মণ্ডল সহ নামকরা কবি সাহিত্যিকদের কথাই জীবন পটে অনন্তকালের জন্য স্মৃতি হয়ে থাকল।।
—- সমাপ্তি। শব্দবন্ধন–900

মন্তব্য করুন