Skip to content

দৃষ্টি- সবুজ বন্দ্যোপাধ্যায়

দৃষ্টি
@#সবুজ
১৮/১০/২০২০

“চোখের সঙ্গে দেখার কোনো সম্পর্ক নেই।”
বুঝলাম পার্থটার নেশা হয়ে গেছে।তাই উৎপটা়ং বকছে।
বললাম,” বাড়ি চল , আর খাস না”।
– কেন বে শালা , তুই কি আমাকে মাতাল ভাবছিস।
– চল, বাড়ি চল।
আমি নাছোড়বান্দা।জানি উত্তর দিলেই আরো রেগে যাবে। খিস্তিখেউড় করবে।নোংরা ইঙ্গিত করবে।
ওর মা মারা যেতেই এমন করছে।যে ছেলে কখনো কোনো নেশা করতো না সে যে এতখানি নেশাগ্রস্ত হবে তা কখনো ভাবতেও পারি নি। প্রতিদিন নয়।প্রতি রবিবার দুপুর থেকে রাত ওর গন্তব্য ধর্মতলার এই বিখ্যাত বারে।নাচ হয় গান হয়।ও হল আবগারি লাইসেন্স ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। খুবই কাজের , ড্যাসিং পুশিং করিতকর্মা।কতজনের লাইসেন্স ওর হাতে। কিন্তু ঘুষখোর নয়।বেয়ারা থেকে অফিসার সবাই ওকে ভালোবাসে।ওর কথা শোনে।আর ভালো রাঁধতে পারে।অফিসের যে কোন অকেশনে ওর হাতের মাটনে মুগ্ধ সবাই।খেতে কে না ভালোবাসে।এর জন্য ওর প্রতি ভালোবাসা যেন আরো বেড়ে গেছে।
আমার সহপাঠী ছিল পার্থ।মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত। দেখাসাক্ষাৎ হতো না সেভাবে।ওর মা মারা যেতে ওর বাড়ি গেলাম।তেমন কান্নার রোল নেই।যেন আপদ গেছে।ওরা নিজেদের বাড়ীটা প্রোমোটারের হাতে দিয়ে তিন ভাইবোনে তিনটে অ্যাপার্টমেন্টে থাকে।তেমন মিলমিশ নেই , তা কিছুক্ষণ ওদের বাড়ীতে কাটিয়েই বুঝলাম।ওর মা ওর ভাই এর ও বোনের বাড়ীতে থাকতো।পার্থর বৌ খুব মুখরা আর স্বার্থপর।তাই ও মাকে নিজের কাছে রাখতে পারে নি।এ জন্য ওর মনে দুঃখ ছিল।এসব ও আমাকে পরে বলেছিল।অফিসে যে এত পপুলার ,বাড়ীতে তার কোন দাম নেই।
মা মারা যেতেই ও কেমন পাল্টে গেল।
একদিন,প্রায় পাঁচটা বাজে।বাড়ী যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ধরলাম।কে আবার এই বেটাইমে ফোন করল। তিনবারের বার বিরক্ত হয়েই বললাম, হ্যালো?দেখিও নি কে করেছে।
– তুই কি খুব ব্যস্ত আছিস?
গলা শুনেই বুঝলাম পার্থ।
তা একটু আছি।বাড়ি যেতে হবে তো?অন্ধকারে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় ।
আচ্ছা ,বল্, কি বলছিস?
-বাড়ি?আমার বাঁড়া ,বাড়িও নেই?
-ওঃ, মুখ খারাপ করছিস কেন ?
-ওকে গুরু, ক্ষমা করে দাও।
ওর গলাটা নেশাগ্রস্ত লাগল।কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। বললাম,
– কোথায় আছিস?
– …….বারে
– অ্যাঁ
– হ্যাঁ ভাই মনের সুখে মদ খাচ্ছি।বারের মালিক বলেছে যতখুশি খাব।কেউ কিছু বলবে না।
– আচ্ছা ঠিক আছে ,আমি আসছি।
বাড়িতে গিন্নিকে ব্যাপারটা বললাম। বললাম, দেরী হবে ফিরতে।ওও বুঝল।
বারে গিয়ে জিগ্যেস করতে ওরা একটা কেবিন দেখিয়ে দিল।বুঝলাম ও রেগুলার এবং সবাই চেনে।গিয়ে বসতেই ও হাওহাও করে কাঁদতে লাগল।ম্যানেজার এসে দাঁড়াল।বলল, অনেকক্ষণ ধরে এমন করেছেন পার্থবাবু, একটু দেখুন স্যার।
– আচ্ছা, দেখছি।
দেখছি তো বললাম, এখন মাতাল সামলায় কি করে।ওদের মতিগতি বোঝা বড় দায়।
একবার রাত্রিবেলায় মল্লিকপুর স্টেশনে যাচ্ছি।আমি আর গৌতমদা একটু পিছনে পড়ে গেছি।বিধানের বিয়ের নিমন্ত্রণ সেরে ফিরছি। অফিসের বেশক’জন গেছিলাম। বাকিরা একটু এগিয়ে গেছে।হঠাৎ ভুঁইফোড়ের মত এক মাতাল আবির্ভূত হল আমাদের সামনে।ধরল সোজা গৌতমদাকে।
– এই তুই নাটা কেন?
গৌতমদা গাট্টাগোট্টা বেঁটেখাটো মানুষ।
এখন কি করে ওর হাত থেকে নিস্তার পাই।
ওর এক কথা।
-এই তুই নাটা কেন?
আমি এক ফাঁকে পালিয়ে এসেছি।
হঠাৎ ট্রেন এসে যাওয়ায় গৌতমদা বোধহয় ছাড় পেয়েছে।
ট্রেনে তো গৌতমদা আমাকে বেশ একচোট নিল।আমি স্বার্থপর, ওকে একা বিপদে ফেলে পালালাম….ইত্যাদি ইত্যাদি।
তখন কোনো কথায় আর খাটে না।বিচারের রায় যখন শোনানো হয়ে গেছে তখন আর যুক্তি তর্কের কি মূল্য আছে।
আমি আসলে বেসিক ইন্সটিঙ্কট এর বশবর্তী হয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম। ভেবেছিলাম গৌতমদাও ঠিক সক্ষম হবে।ও যে বিপদে পড়েতে পারে এটা মনেও হয় নি।
মাতালদের মতি বড়ই আনপ্রেডিক্টৈবন এবং সেই সময়ে ওরা একরোখা জেদি ইমোশন্যাল ইত্যাদি হয়ে যায় ।মোট কথা ওরা নেশার সময় নিজের মধ্যে থাকে না।
– কি, রে, পচা কি ভাবিস?
পার্থর কথায় সম্বিত ফিরল।
– না, কিছু না।কি হয়েছে।তুই তো কখনো মদ খেতিস না!
– তো ? এখন খাই। আমার ইচ্ছা।
– বাড়ি চল।
– বাড়ি? তোদের শালা বাড়ি আছে বৌ আছে ছেলেমেয়ে আছে, আমার কে আছে?
– তোরও সবাই আছে।মল্লিকা রাগ করবে?
– ও বেশ্যামাগির কথা বলবি না?
– আমি কিন্তু চলে যাবো।মুখ খারাপ করা চলবে না।
– ওকে গুরু। কিন্তু তুই কি জানিস ওর জন্য আমি মা বাবাকে দূরে ঠেলে ফেলেছি।
– তুই বোঝা।তোর backbone নেই।
– ঠিক বলেছিস।আমি শালা একটা spineless বেজন্মা।
– আবার!এভাবে নিজের বাবা মায়ের বদনাম করছিস।
– কি বলব তবে। মল্লিকা কথায় কথায় আত্মহত্যার ভয় দেখায়।একবার সত্যি সত্যি ঘুমের বড়ি খেয়ে হয়রানির একশেষ করেছিল।পুলিশের ভয় দেখায়।ছেলেদের সামনে চরিত্রের দোষ দেয়।আমি নাকি অফিসের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করি।
– হুঁ
– এমন ভাব করে যেন ওই আমাকে গর্ভে ধরেছে।তাই আমার বাবা মা থাকতে নেই।
– কি আবোল তাবোল বকছিস!
– সত্যি রে, কুশল, এভাবেই আমি মাকে হারালাম।মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মা জেনে গেল আমি কত অপদার্থ সন্তান।আমার কথা পর্যন্ত জানতে চায়নি।তাও আমি বেঁচে আছি।
– বেঁচেই তো থাকবি।ছেলেরা আছে , সংসার আছে,
– হয়তো আছে।
দূর দিকচক্রবাল থেকে স্বগোতোক্তির মতো ওর কথা ভেসে এল।
বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার গাড়িতে ওকে বাড়ী পৌঁছে দিলাম।
তারপর থেকে ওরা দুজন আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করল। আমাকে নির্ভর করতে লাগল।
তাই প্রতি রবিবার ধর্মতলার এই বারে আসি পার্থকে নিয়ে।ও একা একা মদ খায় ।নানা কথা বলে।সন্ধ্যেয় আবার মল্লিকার হাতে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি যায়।আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে এ নিয়ে অশান্তি হয়।তবে আমার সুচিন্তায় গিন্নি আর বেশি বাধা দেয় না ।আসলে ও বেশি কচলাকচলি ভালোবাসে না।পায়ে বেড়ি পড়ানোর ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই ওর নেই।সব সময় কাজে ব্যস্ত।স্কুল, রান্না , খাতা দেখা, ডেস্কটপে প্রশ্ন তৈরী, প্রিন্ট করা, ঘর পরিষ্কার ,মেয়েকে পড়াতে উৎসাহ দেওয়া এমনি কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে।আমার দিক থেকে উৎসাহ না পেয়ে আমার প্রতি কোনো কাজ রাখে নি। তবু খেয়াল রাখে ।

-বুঝলি,কুশল,”চোখের সঙ্গে দেখার কোনো সম্পর্ক নেই।”
এমনি এক রবিবারের সন্ধ্যায় পার্থমহারাজের বাণী পেলাম।
ভাবলাম ভুল বকছে।
সামনে তাকিয়ে দেখি,গ্লাস ভর্তি।চুমুক দেয় নি। আজকাল খাওয়াও কমে গেছে।গ্যাস্ট্রিক আলসার ধরা পড়ার পর থেকে বারে আসার নেশাটা আছে মদের মাত্রা একেবারেই কম।
– মানে!
– তোর কি মনে হয় যাদের চোখ আছে তারা সব দেখতে পায়।
– তাই তো ।
– না বন্ধু।আচ্ছা, আমার দিকে আয়।
গেলাম।
– সামনে তাকিয়ে দেখ্।
– দেখলাম।
– কি দেখলি ।
– দুজন বসে মদ খাচ্ছে।
– বেশ , আর।
– ওরা কথা বলছে।টেবিলে খাবার।গ্লাসে পানীয়‌অর্ধেক ভর্তি।আর কেউ নেই।
– আমি দেখছি আরো একজনকে।ওদের পিছনেই।অনেকক্ষণ ধরে আছে।ওদের একটু আড়ালে।
– হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি।
– একটু আগে দেখেছিলি।
– না
– এরকম।
– শুধু চোখ নয়।মনের দৃষ্টি চায়।ভাবনা চায়।ইচ্ছাশক্তি চায়।তবেই দেখা সম্পূর্ণ হবে।
– তা যা বলেছিস। আজকাল তো সামনে কতকিছু ঘটে।দেখেও দেখি না।আসলে দেখতে চায় না।
– এই ঘটনা যদি নিজের ক্ষেত্রে ঘটে তবে কেমন হয়?
– মানে?
– বাড়িতে আমাকে বোঝার কেউ নেই।মল্লিকা শুধু ছেলে সংসার এসব নিয়েই ব্যস্ত। আমার দুঃখ আমার কষ্ট ও দেখতে পায় না।যেন এই বয়সে এসে আমার কোনো কষ্ট থাকতে নেই।
-কেন তুই যখন জীবনরেখায় ভর্তি ছিলি তখন তো ও তোর জন্য উদ্বেগে দিন কাটাত।আমি দেখেছি। প্রতিদিন ফোনে খবর নিতে।তোকে দেখতে আসতে চাইত।আমরা বারণ করতাম , তাই আসে নি
-কেন বারণ শুনবে?
-ঘরেও তো কত কাজ?
-আমারও কিছু ইচ্ছে আছে?তা বুঝতে হবে, দেখতে হবে?
-তুই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছিস।
-স্বার্থপর নয়, আত্মপর।তাই তো মা বাবাকে অনায়াসে বাদ দিয়েছিলাম।বৌয়ের সঙ্গে থাকবো বলে।
একটু বিরতি।কি যেন ভেবে চলে পার্থ।মদের গ্লাসে হাতই ছোঁয়ায় নি আজ এখনো।ওকে আজ কথায় পেয়েছে।
– জানিস, এখনো যা রোজগার করি সব সংসারের পেছনেই খরচ করি।নিজের জন্য কিছুই তো রাখি না।তবে কেন আমার চাওয়া পাওয়ার দাম পাবো না।
– এখন কি এসব ভাবার সময়।এখন ছেলেদের কথা ভাববি।ওদের কেরিয়ারের কথা ভাববি।
– সেসব তো মল্লিকা ভাবে।আমাকে কবে ভাবতে দিয়েছে।আমার কাজ শুধু টাকা দেওয়া আর ছোটাছুটি করা।
আবার থামল।লক্ষ্য করলাম ওর কপালে ঘাম।শীতের ভোরে কচুপাতার ওপর জমে থাকা শিশিরের মতো।এসির ঠাণ্ডায় ও ঘামছে।বড় অধৈর্য্য মনে হল।অস্থিরতায় কেমন এক পুরনো নষ্ট হওয়া পেন্ডুলামের মত কমবেশি বিশৃঙ্খল দুলে চলেছে।
– চল বাড়ি চল।আমি বললাম।
বাধ্য ছেলের মত উঠল।
ওকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে বাড়ী ফিরছি , ও বলল গুডনাইট বন্ধু।
একটু অবাক হলাম ।কখনো তো বলেনা।অবশ্য তখন নেশার ঘোরে থাকে তাও..
-কি রে ,
চমকে তাকাতেই দেখি ওর মুখে করুণ হাসি।কাছে এসে বলে গুডনাইট ফরএভার..
নাটকীয় প্রস্থানে ঘরে যায়।

মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল।সত্যিই তো সংসারে শুধু দেওয়ার সম্পর্ক। নেওয়ার ঘর শুন্য।এত গভীরে ভাবি না তাই ওতেই সুখে থাকি।ভাবতে গেলেই, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে।
আর কি দারুনভাবে দৃষ্টির কথা বলল।
দৃষ্টিকোণ।
কে কিভাবে দেখবে।কিভাবে দেখাবে।কিভাবে দেখাতে চাইবে।
আর দৃষ্টি।
কত কিছুই সামনে থাকলেও দেখতে পাই না।
আবার কতকিছু দৃষ্টিগোচরের বাইরে থাকলেও দেখতে পাই।
রাত তখন প্রায় তিনটে।জল খেয়ে ওয়াশরুমে গেছি, মোবাইলের শব্দে চমকে উঠলাম।বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।অসময়ের ফোন শুভ হয় না।
– হ্যালো, কুশল বলছি। ঘুম চোখে বললাম।
– দাদা আমি মল্লিকা বলছি।
– কি হয়েছে? এত রাত্রে?
– একটু আসতে পারবেন?
ভাবলাম নিশ্চয়ই ঝগড়া হয়েছে।বড়সড় গন্ডগোল। বললাম ,আসছি।
গিন্নিকে ওঠালাম। বললাম মল্লিকার কথা।ও অসন্তুষ্ট হল।একটু গজগজ করল।
-নিজের স্বামীর প্রতি নজর দিতে পারে না। শুধু সংসার আর সন্তান।ওর বাইরেও জগৎ আছে জানে না।কুপমন্ডুক একটা।
নজর।গিন্নীও বলল নজর। ঘুরেফিরে সেই দৃষ্টি।যাহোক একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
– দরজায় তালা দিয়ে দিও।আজ রাত্রে তো আর ফিরতে পারবো না।এখনি তো তিনটে বেজে গেছে।
– হাই তুলতে তুলতে গিন্নি দরজায় তালা দিল আমি চললাম পার্থর বাড়ি। পৌঁছে দেখি আলো জ্বলছে।কিছু লোকজন।হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গদ্বারের যান।ভিতরে চোখ মেলেই দেখি আমার প্রিয় বন্ধু আমার এতদিনের অভিমানী সখা সুখশয্যায় চিরনিদ্রায় শায়িত।ওর দুই ছেলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ব্যবস্থা করছে শেষকৃত্যের জন্য।
– কখন হল। মল্লিকার দিকে তাকিয়ে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
– জানিনা দাদা।রাত্রে এসে সেই যে ঘুমালে আর ওঠে নি।শরীর খারাপ বলে কিছু খেল না।রাত্রে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে প্রথমে ভাবলাম নাক ডাকছে।তারপর চুপচাপ।সন্দেহ হওয়াতে উঠে দেখি খুব ঘামছে।ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে সত্যজিৎ ডাক্তারকে পাপুন ডেকে নিয়ে এল।উনি দেখেই বললেন…
আর বলতে পারল না ঝরঝর করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
হঠাৎ মনে পড়ল পার্থ কাল বলেছিল , গুডনাইট ফরএভার। মৃত্যু কি ওর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল? অনেকের কাছে শুনেছি, গল্পে পড়েছি, অনেকে নানা কিছু দেখতে পায়, যা আমরা বাস্তবে দেখি না।
দৃষ্টি।
– হ্যালো মনীষা , আমি কুশল বলছি।
– হ্যাঁ বলো।ফিরছ?
– না।পার্থ চলে গেল।
– অ্যাঁ, কোথায়?
– পরপারে…
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।তারপর খুব গভীর স্বরে বলল, তুমি সাবধানে থেকো।সবদিক সামলে এসো।

তখন সকালের আলো ফুটছে।দমকলের গাড়ির জলে রাস্তা স্যানিটিইজ হচ্ছে।পেপারওয়ালা সাইকেলে কাগজ ক্যারিয়ারে বেঁধে বাড়ি বাড়ি দেওয়ার কাজে লেগে পড়েছে।রেডিওতে ভেসে আসছে আগমনী গান।সামনের চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে ঊনুনের ।এখনো ধোঁয়া ওঠা ঊনুন আছে।বাইরে যাচ্ছি ওখানে এককাপ চা খেয়ে আসবো বলে।সামনেই একটা অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাঁড়াল।
-excuse me, এটা কি কুশল ভট্টাচার্য্যর বাড়ি।
-হ্যাঁ, অবাক হয়ে বললাম,
কিন্তু
-আমরা দেহদান সংস্থা থেকে আসছি।শুনলাম উনি মারা গেছেন।
-হ্যাঁ
-উনি রাষ্ট্রীয় দেহদান মিশনে ওনার দেহদান করে গেছেন।আমরা বডি নিতে এসেছি।
আমি এতদিন ওর সঙ্গে আছি কখনো জানতামই না।ও এতবড় একটা কাজ করে বসে আছে।
মল্লিকাকে সবটা বললাম।ছেলেরা রাজি নয়।ওরা রেডি হয়েছে বাবার দেহ নিমতলায় দাহ করবে বলে।
কিন্তু অবাক হলাম মল্লিকার ব্যবহারে।
– দাদা , আমাকে ডাকল
– বল
– আপনি ওদের কাজে সাহায্য করুন।সারাজীবন আমি শুধু নিজের জোরই খাটিয়ে গেলাম ওর ওপর।আজ আর ওর শেষ ইচ্ছায় জোর খাটাব না।
আমাদের চোখের সামনে ওর দেহ নিয়ে চলে গেল রাষ্ট্রীয় দেহদান মিশন। সঙ্গে গেলাম আমি পাপুন আর ওর বন্ধুরা ।অন্য গাড়িতে।
পিছনে পড়ে রইলো সবাই।যতক্ষণ দেখতে পেলাম, দেখলাম ফুঁপিয়ে একটানা কেঁদে যাচ্ছে মল্লিকা।
দৃষ্টির আড়ালে দেখি আকাশের এককোণে হালকা লাল মেঘের আড়ালে হাসছে পার্থ।
-কেমন দিলাম।
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।এখুনি বর্ষা আসবে মনে হয়।চশমাটা খুলে নিজের ভিতরে দৃষ্টি দিলাম।আবছা আলোয় দেখি গঙ্গোত্রী থেকে বরফ গলতে শুরু করেছে।এখনি হয়তো বয়ে যাবে গঙ্গা নদী।দেখতে দেখতে দুকূল প্লাবী জলধারা ভিজিয়ে দিল গাল চিবুক জামা।
গলার কাছে আটকে থাকা অস্ফূট আওয়াজ হল,
পার্থ……..
তারপর সবকিছুই দৃষ্টির আড়ালে ।

////////////////

মন্তব্য করুন