Skip to content

‘‘ তিলোত্তমা ’’ – অথই মিষ্টি

‘তমা ! তরকারীর ঝুঁড়িটা নিয়ে আয় তো’
মায়ের এই কথা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠলো ।কেননা এখন চলতিছে ডিসেম্বর মাস, কনকনে কঠিন সে শীতের কুয়াশায় মোড়ানো প্রতিটি দিন ।
সকাল আটটা বেঁজে গেছে বোধ হয়, মনে হচ্ছে সময় যত এগচ্ছে কুয়াশা ততই দিনকে জড়িয়ে ধরতেছে ।আমার ঘুম ভেঙ্গেছে সেই সকালে, কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে আমি নিসঃশব্দে লক্ষ্যি মেয়ের মতো চুপটি করে ঘুমনোর ভান করে সুয়ে আছি ।
না, না মাকে বুঝতে দেয়া যাবে না যে আমি জাঁগনা, তাই আমি না শোনার ভান করে পুনরায় চুপটি করে রইলাম ।সল্পক্ষন পর আবার মা জোর গলায়,
‘তমা! ও তমা !ওরে নবাবের মেয়ে! এখনো কি তোমার সকাল হ্য়নি? নয়টা বেঁজে গেলো বোধ হয় ।’
কিন্তু সে-কি! মা তো মনে হয় বুঝেই ফেলেছে যে আমি জাঁগনা ।তাই তো তরকারীর ঝুঁড়ি নিয়ে বেরতে বলছে ।এখন আর চুপটি করে থাকার কোনো উপায় নেই ।তাই র্নিরউপায় হয়ে আমি অসহায়ের মতো স্বল্প কন্ঠে উত্তর দিলাম,
‘আসছি মা, আসছি । আমি তো উঠেই পরেছি ।’
‘হুম, এতক্ষনে নবাবের মেয়ের উঠার সময় হলো! এখন তারাতারি করে তরকারীর ঝুঁড়িটা নিয়ে আয় ।’
‘আচ্ছা’
কি আর করার! বিছানা প্রিয় আমার এ শরীরটা কে অনেকটা চৌম্বক থেকে লৌহের মতো কোনরখমে টেনে আালাদা করলাম ।তারপর তরকারীর ঝুঁড়িটা নিয়ে আলসে লোকদের মতো টুপে টুপে মায়ের কাছে যাইতেছি, আর বলতেছি,
‘মা! ভিষণ ঠান্ডা লাগতেছে তো ।’
‘শীতকাল, ঠান্ডার দিন এসেছে তো ঠান্ডা লাগবে না? কথা বাদ দিয়ে তারা তারি করে আয় ।’
‘এই নেও ধরো ! তোমার তরকারী ।’ (মায়ের কাছে এসে)
‘চা করেছি সেই সকালে, ঠান্ডা হয়ে গেছে ।এবার যা, মুখ ধুয়ে আয় আমি গরম করে দিতেছি।’
‘মা’ (লম্বা করে, আলসে স্বভাবে)
‘আবার কি হলো?’
‘পানি তো খুবি ঠান্ডা!’
‘তাই বলে কি মুখ ধুতে হবে না? ঢং বাদ দিয়ে এখন যা, মুখ ধুয়ে আয় ।’
পুনরায় র্নিরউপায় হয়ে , ভ্রু ভাঁজ করে মাথা বাঁকা করে আসল্য কে লালন করে হাত দুটোকে গুটিয়ে মুখ ধুতে গেলাম আমি ।ওরে বাবা পানি কি ঠান্ডা, যেনো তরল বরফ ।পানিতে হাত পরতেই সমস্ত গা কাটা দিয়ে উঠলো ।যাই হোক কোনো রকমে মুখ ধুয়ে মায়ের কাছে এসে বসলাম ।মা এক কাপ গরম চা ঢেলে দিলো আমাকে ।আর বলল,
‘এই নে, ধর! আর ঐ যে বাঁটিতে মুড়ি ।’
‘এত্ত গরম !’ (হাতে নিয়েই)
‘কিছুক্ষন রেখে দে’
মায়ের কথা মতো চা রেখে দিলাম, আর ধনেপাতা দিয়ে খাঁটি সরিষার তেলে মাখা মুড়ি খেতে খেতেই হঠাৎ আমার চোখ পরলো তরকারীর ঝুঁড়িতে থাকা আলুর দিকে ।মুড়ি ছেড়ে আলু হাতে নিয়ে মুচকি হাঁসতে আরাম্ভ করলাম । আমার দিকে তাকিয়ে মা হয়তো কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
‘তোর আবার কি হলো !’
‘কই কি হলো?’
‘পাঁগলদের মতো হাঁসছিস যে?’
‘এই দেখ, আলু গজাইতেছে ।’
আলুর কথা বলতেই জানি না কেন আমার মায়ের সাধারন গড়নের মাখটা কেমন জানি ফেকাসে হয়ে গেলো ।দেখলাম চুপচাপ হয়ে মা নিজের মতো করে ফুলকপি কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরলো ।না কিছু বলছে সে, আর না আমার দিকে তাকাচ্ছে ।আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম ।তাই পুনরায় হাতের আলুটা মায়ের দিকে বারিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,
‘এই দেখ মা ! আলু গুলো কি সুন্দর গজাইতেছে।’
এবার মা আলুর দিকে একবার তাকালো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রসহীন সুরে শুষ্ক গলায় বলতে আরাম্ভ করলো,
‘যখন আমি তোর মতো ছিলাম, তখন অনেক লোক আমাদের জমিতে আলুর বীজ লাগানোর কাজ করতো আর আমিও বীজ লাগানোর জন্য দৌড় দিতাম কিন্তু সঠিক ভাবে লাগাতে পারতামনা আর আমার আব্বায় আমার উল্টা পাল্টা ভাবে লাগানো বীজ গুলো সোজা করে দিতো ।বিঘার পর বিঘা জমিতে আলু চাষ করতাম আমরা ।কিন্ত বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর মাঝে মাঝে তো রাঁন্না করার আলুটুকুও জোটেনা কপালে ।’(পুনরায় হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে)
চুপশে যাওয়া বেলুনের মতো নিস্তেজ হয়ে আমি বেশ কিছুক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম ।বুঝতে পারলাম সমাজের মাঝে আমার বাবার আবস্থা ।কিন্তু এতে আমার বা কি করনীয়?
বেশ কিছুক্ষন পর চঞ্চলতাকে লালন করে আমি হাঁস্যউজ্বল চেহারায় হেঁসে উঠে হাতে বেশ কিছু আলু নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠলাম,
‘এই আলুগুলো আমি লাগাই?’
মুহূর্তেই মা তার ভার প্রাপ্ত হতাশাকে বিদায় দিয়ে সজাগ হয়ে প্রফুল্ল মনে মুচকি হেঁসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে লাগাও ।’
আমি আনন্দে আত্বহারা হয়ে খুঁশি মনে আলুগুলো নিয়ে দৌড় দিলাম ।তারপর আমাদের বাড়ির উঠনের এক প্রান্তে অল্প কিছু জায়গার মাঁটি খুঁড়ে মায়ের দেয়া নির্দেশে স্বল্প গোবর সার দিয়ে আলুগুলোকে লাগিয়ে দিলাম ।
আমি অনেক খুশি কেননা আমি আলু লাগিয়েছি, আর এই খুশির সংবাদটা বাবাকে দেওয়ার জন্য আমি দৌড়ে মায়ের কাছে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ মা, বাবা কোথায়?’
‘তোর বাবা কি বাড়িতে থাকা লোক! কাজে গেছে।’
‘ও’(লম্বা করে কিছুটা ছন্নছাড়া ভঙ্গিমায়)
দিন তার আপন গতিতে চলতেছে কিন্তু আমার মনে অস্থিরতা কাজ করতেছে এই ভেবে যে কখন আমার এই খুশির সংবাদটা বাবাকে দিব? কখন?
তারপর দিন শেষে বাবা যখন কাজ থেকে বাড়িতে ফিরলো, দৌড়ে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘বাবা একটা খুশির সংবাদ আছে।’
‘আচ্ছা, তো শুনি আমার মা আজ আমাকে কি খুশির সংবাদ দিবে?’
‘আমি এত্তগুলা আলু লাগাইছি বাবা।’
‘কত্তগুলা?’ (অবাক ভঙ্গিমায়)
‘এই যে এত্তগুলা, হুম।’(দু’হাতে ইশারা করে)
‘ও(লম্বা করে) তো কোথায় তোমার সে আলুর জমি?’
তারপর আমি বাবার হাতের আঙ্গুল টেনে টেনে আমার লাগানো সেই আলু ক্ষেতের দিকে নিয়ে গেলাম ।বাবা আমার আলু লাগানো সেই ছোট্ট ক্ষেত দেখে বলে উঠলো,
‘তাহলে তো মা, এবছর আর আমাদের আলু কিনতেই হবে না!’
আমি আনন্দে আত্বহারা হয়ে খুশি মনে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম,
‘হুম বাবা’
এভাবেই কেটে যেতে থাকলো আমার দিন ।আর প্রতি দিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই আমি দৌড় দেই আমার সে ছোট্ট আলু ক্ষেতের দিকে এই ভেবে যে, নিশ্চই আজ আমার আলু গজিয়েছে ।কিন্তু নাহ্, প্রতি বার যাওয়ার সময় খুশি মনে গেলেও ফেরার সময়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়েই ফিরতে হয় ।
দেখতে দেখতে আজ দীর্ঘ বারো দিন পেরিয়ে গেলো কিন্তু আজও আমার সে আলু মাথা চারা দিয়ে শীতকালের এই সোনার সূর্যের মুখ প্রদর্শন করলো না।
আজ তেরো তম দিন, প্রতি দিনের ন্যায় আজও আমার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে ।আমার মা বাবার ঘুম এখনো ভাঙ্গেনি ।আমার মনে হচ্ছে আজ নিশ্চই আমার সে আলু গুলো গজিয়েছে ।তাই আমি তারাহুরা করে উঠতে গিয়ে আমার মায়ের ঘুম ভেঙ্গে দিয়েছি ।মা কোনোরকমে তার চোখ খুলে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এই শীতে, এতো সকালে কোথায় যাস?’
‘আলু ক্ষেতে’
‘এখন যেতে হবে না, কিছুক্ষন পরে যাস।’
‘না মা, তুমি বুঝতেছো না ।আজ হয়তো আলু গুলো গজিয়েছে ।আমি যাই গিয়ে দেখে আসি ।’(যেতে যেতে)
অনেক খুশি মনে দিলাম দৌড় ।কিন্তু হায়! নাহ্, আজও গজায়নি ।প্রতি দিনের ন্যায় আমি আজও মন খারাপ করে ভালো ভাবে দেখতেছি, আলু গুলো প্রথম দিন ঠিক যেমন ভাবে লাগিয়েছিলাম তার পর দিন একই দেখেছিলাম, তারপর দিনো সে অবস্থাই দেখেছিলাম, এভাবে ক্রমন্বয়ে ঠিক আজও প্রতি দিনের ন্যায় সকাল বিকাল দু’বেলা করে প্রত্যেকটা আলুকে ভালো ভাবে দেখতেছি, কিন্তু ঠিক যেমনটা লাগিয়েছিলাম তেমনটাই রয়েছে ।মা বলেছিলো খুব তারাতারি গাছ হবে কিন্তু হচ্ছে না কেন? সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ডুকতেছেনা ।হাঠাৎ আমার কাঁধে স্পর্শ অনুভব হলো পিচনে ফিরে দেখি মা এসেছে ।মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কি করতেছিস?’
‘মা! তুমিই তো বলেছিলে মাঁটির সংস্পর্শে আসলে খুব তারাতারি গাছ হবে । কিন্তু দেখ, আমি এই আলুগুলো যেমনটা লাগিয়েছিলাম তেমনই রয়েছে।’
‘হুম খুব তারাতারি গাছ হবে বলেছিলাম আর এখনো বলছি, কিন্তু বুঝতেছিনা যে, কেন এগুলো যেমন লাগানো হয়েছে তেমনই রয়েছে?’
‘তুমি আরো বলেছিলে, প্রতিদিন সকাল বিকাল দেখতে, হঠাৎ একদিন গজিয়ে যাবে ।তাই আমি প্রতিদিন সকাল বিকাল দু’বেলা করে মাটি সরিয়ে প্রত্যেকটা আলুকে হাতে নিয়ে দেখি, কিন্তু এর কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না গাছ হওয়া তো দূরের কথা…’
আমার কথা শুনে জানিনা কেন মা তাঁর কপালে ভাঁজ ফেলিয়ে, ভ্রুদয় সংকুচিত করে, বড় বড় চোখে অবাক দৃষ্টিতে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো…

মন্তব্য করুন