Skip to content

ঢেউ ভাঙা সুখ -রমেন মজুমদার

ঢেউ ভাঙা সুখ
—-(ছোটগল্প)রমেন মজুমদার
25/06/2023
শব্দসংখ্যা-848

জমির উদ্দিন কাজের তাগিদে নর্থবেঙ্গল ছেড়ে এলো শিবচর। তখন নর্থ বেঙ্গলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছিল। তাই জমির উদ্দিন কাজের সন্ধান পায় লোকের মাধ্যমে। সে তখন চোদ্দ কি পনের বছর বয়সের।
এই শিবচর কোন একসময়ের ফরিদপুরের সাবডিভিশন শহর ছিল । বর্তমানে জেলায় পরিণত হয়েছে।
আড়িয়ালখা নদীর নিকটবর্তী বড়বড় ইটের ভাটা। সেই ইটের ভাটার কাজে এসে যোগদান করলেন।
প্রথমে লেবারের কাজ।
ভাটায় মাটি কাটার কাজে সে নিযুক্ত হল দৈনিক ভিত্তিতে।
মুজুরি মাত্র পাঁচ টাকা।
তবে খাওয়া,থাকা ফ্রী।
মালিকের তৈরি করা ভাটার এক কোণে ঢেউটিন দ্বারা একচালা লম্বা ঘরে শ্রমিক লেবারের থাকার ব্যবস্থা আছে।
ওরা এক একটা দলে দশ পনেরজন করে
গ্রুপ করে থাকে।রান্না বান্না নিজেরাই করে। এবং থাকার জায়গায় ওরা নিজেরাই ঘর নির্ধারণ করে থাকেন।
ঘরের মাঝে মাঝে ইট দ্বারা পার্টিশন করা।
ওদের বিছানা পত্র,হাঁড়ি বাসন সব আলাদা আলাদা।
—–
প্রায় হাজার খানেক মানুষ খাটেন এই ইট ভাটায়।
এলাকার মধ্যে এটি সব চাইতে বড় ইটের ভাটা। এখানে প্রায় দু’শর বেশি মহিলা শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে অনেকে নিজের মেয়ে নিয়েও কাজ করেন।
জমির উদ্দিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারল যে, বেশির ভাগ শ্রমিক-লেবার উত্তর বঙ্গের।
নিজের জেলার কয়েক জনের সন্ধান পেল।
বাসের উদ্দিন এসেছে তার ফ্যামিলি নিয়ে। বাসেরের একটি মেয়ে বার বছর বয়স,সেও ভাটায় তার আব্বা-আম্মার সাথে লেবারের কাজ করে।
জমির উদ্দিন ও বাসের উদ্দিন একই ভাটায় কাজ করে।তবে ওরা আলাদা ঘরে থাকে।
বাসের উদ্দিন এখন ওখানের লেবারের সর্দার।
জমির উদ্দিনের কাজের কোন আলস্যতা নেই। তার কাজ দেখে বাসের উদ্দিন নিজের দলে কাজ করার সুযোগ দিলেন।
লেবার নিয়োগ করেন সর্দার। তার কাজ কেমন তার উপর নির্ভর করে কে কোন কাজ করবে(?)
লেবার চালাক চতুর ও শ্রম দেখে তার কাজ ও মাইনে ঠিক করেন সর্দার মালিকের সাথে বসে।
কারও বেতন দৈনিক চার টাকা,কারও তিন টাকা,কারও সাড়ে চার টাকা, এভাবে
আট টাকা পর্যন্ত মাইনে আছে দৈনিক।
যারা ইট ফ্রেমে ফেলে তৈরি করে তাদের বেতন সাত টাকা,যারা ইট পোড়ায় তাদের মাইনে আট টাকা থেকে দশ টাকা পর্যন্ত।যারা গরু দিয়ে মাটি ছানার কাজ করে তাদের মাইনে ছয় টাকা।
এ’ ভাবে কাজের ভাগ ও মাইনের হিসাব আলাদা আলাদা।
সর্দার এদের থেকে পঞ্চাশ পয়সা কমিশন নিয়ে থাকেন।
—–
একদিন বাসের উদ্দিন জমির উদ্দিনকে বলল,কাল থেকে তুই আমার দলে কাজ করবি। তোকে লেবারের থেকে প্রমোশন দিয়ে শ্রমিকের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে।
মাইনে বাড়বে।
থাকবি আমার ঘরে।
সেই হতে জমির উদ্দিন থাকে বাসের উদ্দিনের ঘরে।
তার ইচ্ছা, মাইয়া যোগলাইতাছে। মাইয়াডার গতি করন লাগব।
কিছুদিন পরে জমির উদ্দিনের ব্যবহারে ছমিরণ ওরে একটু একটু পছন্দ করতে লাগল।
ছমিরণের মা মরিয়ম সেও রাজি।
এক সঙ্গে কাজ করতে করতে জমির উদ্দিন ছমিরণের প্রেমে পড়ল।
ছমিরণ এখন ষোল বছরের নব্য যুবতী। তার দেহ ভরাট। উন্নত বুক।
কোমড়ে তিনটি থরে ভাঁজ ভাঁজ যেন উত্থাল আড়িয়ালখার ঢেউ…
—— ( 91 )(98)323/421/512
ভাটার কাজে জমির উদ্দিনের আরও একটি বছর কেটে গেল।
বাসের তার মেয়েকে জমিরের হাতে তুলে দিলেন।
ভাটার মালিক জমির ও ছমিরণের বিয়েতে সাধ্যমত কিছু মানুষজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াল।
মেয়ের বিয়ের মাসেক ছয় পরে বাসের উদ্দিন হটাৎ একদিন প্রচণ্ড জ্বরে মারা গেলেন।
সকলেই বাসেরের জন্য কান্নাকাটি করলেন।কিন্তু বিধাতার নিয়ম সবাইকে মানতে হয়।
কিছুদিন পরে সকল শোকতাপ মুছে গেল ছমিরণ ও তার মা মরিয়মের মন থেকে।
তারপর ভাটার সর্দার হলেন জমির উদ্দিন।
জমির উদ্দিন নিজে স্বাধীনমত থাকার জন্য ভাটার অদূরে প্রায় নদীর কাছাকাছি গিয়ে একটি ভিটেবাড়ি কিনলেন।
সেখানে তৈরি করা মাটির দেয়াল সমেত টিনের একটি বেশ বড় ঘরসহ দুকাঠা বাড়ি কিনলেন।
ছমিরণ তখন চার মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা।
——
শ্রাবণ মাস।
আড়িয়ালখা নদীর তখন যৌবনকাল।
নদীদেরও জীবন আছে।
ওটাও যৌবতী হয়, ওরাও পোয়াতি হয়।
এই শ্রাবণ মাসে নদীর উত্থাল জোয়ারে কোথাও কোথাও পার ভাঙার খেলা চলে। সে সময় নদীর কাছে কেউ যায়না।

হালকা হালকা মেঘমেদুর আকাশ।
সকালের টিফিন সেরে জমির উদ্দিন গেলেন ভাটার কাজে। স্ত্রী পোয়াতি বলে সে এখন ভাটার কাজ করেনা। মরিয়ম মেয়ের দেখভাল করার জন্য সেও আপাতত কিছুদিন কাজ থেকে বিরতি নিয়েছে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর আসার সাথে সাথে
আকাশটা কেমন যেন ক্রন্দসী ভাব! দিনের বেলার জ্যোতি দুর্বল হয়ে মেঘ ভারী হয়ে অঝোরে বৃষ্টি নামল।
মাঝারি ধরনের হওয়া পেয়ে নদী ফুলেফেঁপে যেন একাকার।
নদীর জলথেকে পারের উচ্চতা প্রায় সাত থেকে আটফুট উঁচু।
ভরানদীর জোয়ারের সাথে বাতাসের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। জলের ঝাপটা খেয়ে খেয়ে পাড়ের মাটি আলগা হয়ে গেছে কোথাও।
তীরের মাটি চাপধরে কোথাও ঝপ্পাৎ ঝপ্পাৎ করে পার ভেঙে জলের উত্থাল স্রোত ও ঢেউয়ের সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

ভাটায় বসে জমির বড্ড চিন্তা করছে।
আড়িয়ালখার ভাঙ্গন এ সময় রাহুর মত আকার ধারণ করে। কোথাও এক দুকাঠা জমি,বাড়ি সমেত নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়।
সারাবছর নদীর ভাঙল থাকলেও এই শ্রাবণ মাসটা ভয়ানক !!
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে জমির উদ্দিন ভাটা ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। তার মাথায় প্রচণ্ড চিন্তার পাথর চেপে আছে। মনটা ভালো লাগছে না।
ছমিরণ এখন ভরা পোয়াতি। সেও শ্রাবণ মাসের মতোই….
মনে মনে হিসেব করল জমির। তার বউটা এইতো সাতমাসে পড়ল।
ভাবতে ভাবতে জমির এলো বাড়ির কাছে।
একি !!
এতো দূরে এটা কিসের ফাটল ??
নদীর না তো ??
যদি নদীর হয় তা হলে সর্বনাশ !!!!
জমিরউদ্দিন দৌড় দিল বাড়ির দিকে।
প্রবাদ বাক্যে আছে নদীর ভাঙ্গন দেখা দিলে নাকি ঘোড়ায়ও দৌঁড়ে সারতে পারেনা। জমির সেটাই ভাবছে আর দৌঁড়াচ্ছে।
বাড়িতে আসতে আসতে পুরো বাড়িটাই নদীর গর্ভে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
রাহু যেমন চাঁদ সুরুজকে গিলে খায়,তেমনি আড়িয়ালখা নদী রাহুর মতোই গিলে খাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই গাছপালা সমেত বাড়িটা তলিয়ে গেল জলের মধ্যে।
একটা আর্তচিৎকার দিয়ে জমিরউদ্দিন বলল, ছমিরণ তুমি কোথায় ?? আমাদের সন্তান ??
আম্মা ও আম্মাগো ….
আল্লাহ রহম করো।
কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
ঢেউয়ের তোড়ে একটি গাছের ডাল ধরে ভাসতে লাগল জমিরউদ্দিন।
সমাপ্ত…..

মন্তব্য করুন