Skip to content

জীবন দগ্ধের কিনারায় – রমেন মজুমদার

জীবন দগ্ধের কিনারায়
(ছোটগল্প)
— রমেন মজুমদার
তারিখ;- ০১/০৯/২০২৩
——
একটুকরো মেঘ দেখব বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম,
বাবা বলল যাসনে, ফিরলাম সেদিন।

আমায় একগ্লাস জল দিয়ে যা বিন্দি,
মা নেই, আমিই বাবার সম্বল।
বাবা প্রায় দুমাস হলো বিছানায়,
কি জানি ?
কোন রোগে বাবাকের পেয়ে বসেছে !
টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারিনা,
ভগবান জানেন সব।
ভাতের উপার্জন করতে বাইরে যেতে হয় আমাকেই।
বাবা শুধু বলে তোর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে আমি শান্তি পাই।
সাবধানে থাকিস বিন্দি…
চারদিকে হয়নার দলের অভাব নেই…
বিন্দি বলল,
বাবা তুমি আমাকে নিয়ে এতো
ভেবনা,
নিজেকে সামলে নিব সবটা।

একদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি
মেঘ দেখব বলে,
কই মেঘতো নেই…
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
দুফোঁটা বৃষ্টির মত আমার চোখদিয়ে
গাড়িয়ে পড়ল জলের ধারা।

ওপাড়ায় কাকনের ছেলেটা রোগেভুগছে,
ঘরে খাবার নেই,
ঔষধ কেনার পয়সা নেই।
তার কথা ভাবতে ভাবতে দেখলাম
পাশদিয়ে একটা মিছিল গেল,
ভোট চাই,ভোট চাই,হাতুড়ি মার্কায় ভোট চাই।

ভাবলাম, হায়রে ভোট, হায়রে প্রশাসন!
এ দেশে আমার মত কত বিন্দি,কাকনের ঘরে খাবার নেই।
রোগে শোকে ভুগছে কত মানুষ!
কাজ নেই,
ঘরে ঘরে শিক্ষিত ছেলেরা বেকার,
কত সন্তান আজ পথে পথে কাজের আন্দোলন করছে,
ওরা আছে দিব্যি ভোট নিয়ে…

একদিন চাঁদের গল্প শুনছিলাম মায়ের কাছে, সেই ছোট্ট সময়,তখন বয়স কতই বা, ছয় কি সাত হবে;
আজ দুটি বসন্ত চলে গেল আমার জীবন থেকে।
আমি বুঝতে পারি;
দু’বছর আগে একদিন রাতে পেটটা চিন চিন করে ব্যথা করছে,
বিছানায় কাতড়াচ্ছি, বাবা বলল,
বিন্দি মেয়েরা এ’সময় সবাই এমন ব্যথায় কাতরায়,
পরে ঠিক হয়ে যায়, চিন্তা করিস না
তুই পরিণত বয়সে পা ফেলছিস;
কিছুক্ষণ পরে আমার পড়নের প্যান্ট রক্তে ভিজে বিছানায় দাগ লেগে গেল;
বাবাই সেদিন সব পরিষ্কার করে দিল
আমি বুঝলাম,
এ’ভাবেই মেয়েরা রজঃশলা হয়।

আবার মায়ের কথা মনে হল,
মা থাকলে সেই সামলে নিত সবটা।
ময়ের মুখের সেই গল্পটা মনে পড়ল আজ।
মা বলত,
ওই চাঁদে একটা বুড়ি আছে, দ্যাখ, সে সুতো কাটছে…
আমার বিশ্বাস ছিল মায়ের কথায়,
দেখিস বিন্দি একদিন মানুষ চাঁদ ছুঁয়ে দেখবে।
কি সুন্দর মোলায়েম তার রূপ!!
ওই চাঁদের কোথাও কোন কলঙ্ক নেই,
যত সব মানুষের মধ্যেই ভেজাল।

একদিন বসে বসে মায়ের কথা ভাবছি
আর চোখের জল ফেলছি…
মাটির মানুষ আবার চাঁদের যাবার স্বপ্ন দেখে ?
যে দেশের ঘরে ঘরে শিক্ষিত ছেলেরা বেকার,
ভাত নেই,কাজ নেই,চিকিৎসার পয়সা নেই;
তারা আবার চাঁদে যাবার স্বপ্ন দেখে।
ধিক এই ভাবনাকে!
আমার পেটে ক্ষুধা থাকলে চাঁদ দিয়ে আমি কি করব??

সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এলো ,
কাকনের কান্নার শব্দে কান ভারী হয়ে ওঠল।
ভাবলাম যা, —–তাই হল।
অভাগী মায়ের কোল খালি হয়ে গেল বুঝি ?

মা নেই, তাতে কি ?
বাবাতো আছে, সেই আমার মাথার ছাতা।
বাবা বলত,
যে বাড়িতেই কাজ করিস,নিজেকে সামলে নিয়ে রাখিস,বুঝে বুঝে মানুষের সাথে কথা বলিস।
তখন বাবার কথা মনে পড়ল বেশি করে।
সেদিন মন ভালো নেই…..
কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলাম
ছুটা কাজ করি ওপাড়ায় পঞ্চায়েতের বাড়ি
তিন বেলা কাজ!
থালাবাসন পরিষ্কার,ঘরমোছা, উঠোন ঝাড় দিয়ে মাস মাইনে তিনশ টাকা,
বাবার ঔষুধ কিনতেই সবটা খরচ হয়ে যায়।

একদিন সন্ধ্যায় মনটা ভীষণ ছটফট করছে,
ঘরে ফেরার জন্য,
তখন দেখলাম চারিদিক অন্ধকার হয়ে ঝরবাতাস এলো।
দৌঁড়ে যে বাড়ি যাব , সে উপায় নেই।
একই গ্রাম হলেও এককিলোমিটার তফাৎ।
পঞ্চায়েত রহিম শেখ বলল,
বিন্দিরে ঝরবাতাস থামুক,পরে যাবি।
আজতো তোর মাইনে নেয়ার দিন।
তোর চাচি আম্মা গেছে তার বাবার বাড়ি।
বুকে হটাৎ ব্যথা অনুভব করছে শুনে হালিমা হন হন করে ছুটে গেল বাবার বাড়ি।
বললাম,আকাশের অবস্থা ভালোনা।
সকালে যাব আমরা।
বাড়ি খালি রেখে আমিও কি করে যাই ?
রাতটা ভোর হলেই আমি গিয়ে একবার দেখে আসব।

হটাৎ বিদ্যুৎ চমকে ওঠল,
ঝরের গতি বেড়ে গেল।
বিন্দির মাথায় একরাশ চিন্তা !!
বাড়িতে বাপটা অসুস্থ,
আজ বেতন নিয়ে বাবার জন্য কিছু ওষুধ আর চাল কিনে বাড়ি ফিরব,
কিন্তু বিধি বাম!

রহিম শেখের গোলা ভর্তি ধান, আতালে গরু,পুকুরে মাছ,
পঞ্চায়েতের ইনকাম ভালো,
শুনছি, নেতামন্ত্রীরা কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করে!
গরিবের বুকের রক্ত চুষে নেয় ,
আর এই দেশের এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের কাজ নেই,ভাত নেই।
আমার মত গতর খেটে পেটের ভাত যোগার করা যে কি কষ্টের,
তার মর্ম কয়জন বোঝে ?

রাত বাড়ল,ঝরবাতাস থমলনা।
পঞ্চায়েত কয়,
বিন্দি কি আর করবি?
রাতের খাবারের ব্যবস্থা কর।
আজ তোর বাড়ি যাওয়া হবেনা।
আমার এখানে খেয়ে থাকবি,
ঝর থামলে সকালে যাবি।
তোর চাচি দুপুরে মুরগির মাংস রেঁধেছে।
দ্যাখ, ফিরিজে আছে; গরম করে নিলেই হবে।

আমি ফিরিজ থেকে মাংস বের করে গরম করলাম।
আহারে মাংসের গন্ধ, কতকাল এই গন্ধ পাইনা।
আমার যেন পেটের নাড়িভুরি গুলিয়ে আসছে।
কি জানি ?– হারামির পয়সায় কি এই মাংসের আয়োজন নাকি সৎ উপার্জনে?
জাউগগা সেইটা ভেবে কি করব ?

পঞ্চায়েতের রাইতের খাওন দিলাম টেবিলে।
আমি কোনদিন মুসলমান বাড়িতে খাই নাই।
আইজ বাধ্য হয়ে খেতে হবে।
পেটে প্রচন্ড ক্ষিধা!!!
ধর্ম যায় যাউক, ক্ষুধার কাছে আবার ধর্ম কি ??

খাওন শেষে পঞ্চায়েত কয়,
বিন্দি বিছনার মশারি টাঙ্গা,
মশা আছে, এখন আবার ডেঙ্গুর ভয়।
চারিদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের মিছিল হয়।
কানে শুনস নাই ?—
বিন্দি কইল,শুনছি চাচা।
পঞ্চায়েত কইল, এহন চাচা মাচা বাদ দে,
বাতি নিভিয়ে ভিতরে আয়….
বিন্দির বুঝতে বাকি রইল না কিছু!
কাইল বেশি করে পয়সা নিয়ে বাড়ি যাবি।
বিন্দি মনে মনে ভাবল,
হালার খাছিলত খারাপ!!
আমি অসহায় এখন,পঞ্চায়েতের সাথে
জোরাজুরি করে লাভ নেই।
আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে।
টাকার ভীষণ দরকার।

বিন্দির বয়স আর কতইবা !
সবে ডজন দুই মাসিক গেছে জীবনের উপর দিয়ে।
পঞ্চায়েত মানি ব্যাগ থেকে হাজার টাকা বের করে বিন্দির হাতে দিল।
নে, —–এটা রাখ।
কাল তোর বাবার চিকিৎসা করাবি।
ফালুর দোকানে বলে রাখব,
মুদি সদায় মাসে যা লাগে নিয়ে নিবি।
তোকে আর ভাবতে হবে না।
আয় দেখি মশারীর ভিতর।
লজ্জা কি ?
অন্ধকারে এ কাম সবাই করে।
তোর ভয়ের কারণ নেই,আমি সব ব্যবস্থা করব।

এই বলতে বলতে আমার হাত ধরে টেনে নিল মশারির ভিতর।
আমি তখন ভয়ে জড়সর !!!
জীবনের সবকিছু সঁপে দিলাম ভগবানের হাতে! তুই দেখিস !!

পঞ্চায়েতের হাত ছুটাতে পারলাম না।
মেয়ে মানুষ, গতরে কতই বা শক্তি?
এখন বিধি যে বাম,সেটা বুঝলাম।
নইলে বাইরে ঝড়তুফান,কেউ শুনবেও না আমার চিৎকার!!!
জীবনের সবকিছ ক্রান্তিকালে এখন বিসর্জন দিতে হবে।
নারীরা বুঝি এ ভাবেই সম্পর্কহীন মানুষের কাছে নগ্নতার সাগরে ভাসতে থাকে ??

তারপর পঞ্চায়েত টেনে তুলল আমাকে তার বিছানায় !
হাত ছেড়ে দিয়ে আমাকে পাঁজাকোল করে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খেল বারকয়েক।
শেষে আমার শরীরের উপরদিয়ে বুড়ায় হাত বোলাতে থাকে।
আমি ভয় কাটিয়ে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম।
তারপর,,,তারপর ,,!!!
মনে করতে পারছিনা কিছু।
রাত কাটল ঘোরের মধ্যে।
আমিও যেন মাতম নেশায় মশগুল হয়ে
সবটা নিঃশেষ করে দিলাম।
এমন কতজনের সর্বনাশ হয়,
কয়জন রাখে সে খবর ?

পেটের ক্ষুধার কাছে সব যেন হাওয়ার বেলুন!!
ফুৎকারে সব উড়ে যায় !
আমাদের মত গরিবের জন্য এর বেশি আর কি আশা করতে পারি।
সেদিন থেকে ওই পঞ্চায়েত আমার মন্ত্রী সাজল।
সময়ে সময়ে ভালো বাড়তি আয় হয়ে পেট পুড়ে খেতে পারছি।
বাবার চিকিৎসা হলো।
আমরাতো আর কেউ পার্থ সারথী হয়ে
টাকার বস্তা সিন্দুকে রাখতে পারব না(?)
আমাদের মত বিন্দিদের শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় আর কি ?
এই দেশ যখন আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে নেয়,
লক্ষকোটি টাকার শ্রাদ্ধ হয়, বেকারত্বের এই দেশে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যৌবন
বিক্রি করে পেট চালায়,
তখন বিন্দিদের বেঁচে থাকার জন্য এ ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা আছে বলে
আমার জানা নেই ।।
—-শব্দ বন্ধন-1082

2 thoughts on “জীবন দগ্ধের কিনারায় – রমেন মজুমদার”

মন্তব্য করুন