Skip to content

জল সাঁতার — রমেন মজুমদার

জল সাঁতার
–ছোটগল্প
কলমে-রমেন মজুমদার
তারিখ-05/10/23
শব্দবন্ধন-২৩৮৬,(আইডি-১১)
——–
“জল সাঁতারে জীবন ডুবে,জল সাঁতারে মরণ
কার বক্ষে কে যায় ডুবে সে,কে করে বরণ।
একটাইতো সুখ-অসুখ!চাওয়া-পাওয়া একটি;
কোন পাপে!কোন নিদাখ?দুঃখ সাধে ত্রুটি ।।”
—–
( ১)
মহুয়ার বয়স যখন তের বছর,তখন তাঁর বাবা অমরনাথ শীল ওলাওঠা রোগে মৃত্যুবরণ করেন।
বাবার রেখে যাওয়া চুয়ান্ন টাকায় মা বাসন্তি অমরনাথের পারলৌকিকক্রিয়া সম্পাদন করেন । বিষয় সম্পত্তি তেমন কোনকিছুই নেই; অস্থাবর সম্পত্তি বলতে একটি ঘুঁপচি ছনের ঘর; তাও বৃষ্টি বাদলের দিনে ঘরের মধ্যে ফোটা ফোটা জল পড়ে কাঁচা মাটির ঘর একদম স্যাঁত স্যাঁতে হয়ে থাকে।
—-
(২)
বাসন্তির বিয়ে হয় চৌদ্দ বছর বয়সে।
পনের বছর বয়সে মহুয়ার জন্ম হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের এক বস্তি ঘরে। মহুয়ার বাবা অমরনাথ ছিলেন রেল স্টেশনের কুলির সর্দার। তিনি নিজে মুটে না টানলেও,তাঁর সারগেদ কয়েকজন যারা ছিলেন,তারাই সারাদিন কাজকরে যা কিছু পেতো, তার সবটাই এনে দিত অমরনাথের হাতে। সন্ধ্যার শেষে সেই অর্থ সমভাবে বণ্টন করেদিত সকলের মধ্যে।তাতে অমরনাথের একটা কমিশন থাকত;সেই কমিশনের টাকায় তাঁর সংসার ভালো ভাবেই চলে যেত।
—-
(৩)
বাসন্তি এই বস্তিরই এক ব্রাহ্মন কন্যা।রূপে গুণে ওর তুলনা হয়না। বয়স একটু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কয়েকজনের নজর কাড়ে বাসন্তির রূপের ঘ্রাণে..
বারো বছর বয়সে বাসন্তির প্রথমবুক উঠে,
এই বুকের জন্যই যত যন্ত্রণা!!! বস্তি থেকে শুরু করে স্টেশনের কুলি পর্যন্ত বাসন্তিকে ভালোবাসতে চায়। আর এই চাওয়ার মধ্যে যত নোংরা ভাবনা লুকিয়ে থাকে।
একদিন কোনো এক ঝামেলা থেকে বাসন্তিকে মুক্তি করে অমরনাথ ওকে বিয়ে করে। সেই থেকে আর কেউ বাসন্তিকে কটাক্ষ করার সাহস পায়না আজ অবধি।
তারপর ওদের একটি কন্যাসন্তান জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হয় মহুয়া। রূপ লাবণ্যের দিক থেকে এই মেয়েটি আরও এক ধাপ উপরে উঠে এলো মায়ের চাইতেও।
পনের বছরে বয়সে বাসন্তি মা হলেন এবং মহুয়াকে জন্মদিলেন।
—-
(৪)
আজ মহুয়ার বয়স যখন তের বছর,তখন ওর বাবা চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। সংসারে একটা গভীর শূন্যতা দেখা দেয়।
বাবার ওই কয়েকটি রেখে যাওয়া টাকায় পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হয়। তখন বাসন্তি মেয়েকে নিয়ে গভীর চিন্তার সাগরে ভাসতে থাকেন।
এমন সময় ওদের পাশে এসে দাঁড়ায় মহুয়ার দূরসম্পর্কের এক মামা হরনাথ মুখুজ্জ্যে। হরনাথ মুখুজ্জ্যে এতদিন কলকাতায় ছিল। সেখানে থেকে আইন পড়ে উকিল হয়েছে। কয়েকদিন দায়রা জজকোর্টে ওকালতি করেন। তারপর ঢাকার জর্জকোটে এসে আইন ব্যবসায় নিজেকে মনোনিবেশ করেন।

(৫)
বস্তি জীবনের দুরূহ কষ্টের মধ্যে থেকে থেকে বাসন্তি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
মানুষের বাড়িতে কাজ করে মেয়েকে নিয়ে ফাঁকা বাড়িতে রেখে সেও নানান ভাবনার মধ্যে কিছুতেই মনকে স্থিরতা আনতে পারছে না। মেয়ে এখন বড় হয়ে ওঠেছে, তাই চিন্তাটা একটু বেশি।
হরনাথ মুখুজ্জ্যে কর্মসূত্রে এখন ঢাকার
বক্সী বাজারে নিজের বাসভবন থেকেই আদালতে যাওয়া আসা করেন। অবশ্য কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে বেশি একটা দূর নয়।
হরনাথ মুখুজ্জ্যে এখনও বিয়ে থা করেনি।
মায়ের দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ে হল বাসন্তি। সেই সূত্রে বাসন্তির আপন বলতে এখন হরনাথ মুখুজ্জ্যেই…
অনেক বছর আগে হরনাথ বাসন্তিকে জানতো ওরা আমাদের নিজের আপন কেউ। তারপর মায়ের কাছে শুনেছে ওদের কথা। যৌবনে পা ফেলার পরে আর বাসন্তিকে সে দেখেনি।
—-
(৬)
বাসন্তির একসময় চরম ভোগান্তির সময়
খুঁজে খুঁজে হরনাথ মুখুজ্যে এলেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। কোন এক কুলির কাছে বিস্তারিত জানতে পারল বাসন্তিদের জীবন কথা ।
সবশুনে হরনাথ উলিকের মনে বেশ কষ্টের পাহাড় এসে জমল। শেষ হরনাথ এলেন প্রয়াত অমরনাথের দো’চালা বস্তি ঘরে।
–বাসন্তি, কাকে চান ?
–হরনাথ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বাসন্তির মুখের দিকে।
ঠিক সেই চেনা মুখটি এতবছর পরে হলেও
বাসন্তির মুখের সেই লাল তিলের দাগটি দেখে তার কাছে ভীষণ চেনা হয়ে ওঠল।
শেষে হরনাথ মুখজ্জ্যে বললেন,
তুমি বাসন্তি না ?? — এই দ্যাখো,
তুমি চিতেই পারলে না। আ-রে আমি
তোমাদের সেই হরনাথ হরি, হারু ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাসন্তি কিছুক্ষণ আড় নয়নে তাকিয়ে থেকে যখন মনের ঘোর কাটল,তখন কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, হরি দাদা তুমি কেমন আছ ? কবে এলে কলকাতা থেকে ?
—-
(৭)
হরনাথ বাবু বলল,
বাসন্তি তুই আজ এতো সুন্দরী হয়েছিস।সত্যিই মাইরি বলছি,
তুইতো আমার সেই খেলার সাথী ছিলিস।তোকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন নিয়ে আমরা
মিছামিছি পুতুল খেলায় মেতে থাকতাম।
তুই বলতিস, হরিদা তুমি বড্ড বেহায়া,
বোনকে নিয়ে কেউ এমন স্বপ্ন দেখে ?
হরনাথ বলত, তুইতো সম্পর্কের বাইরের যাকে বলে দুরসম্পর্ক !!
এই নিয়ে ওদের মধ্যে বেশ হাসিঠাট্টার কথা চলত।
বাসন্তি বলল, দাদা তুমি ভিতরে এস বসো।
হরনাথ বলল, আমি তোদের সকলের নামধাম জানি,মানে তোর মেয়ের কথাই বলছি। ততোক্ষণে মহুয়া বাইরে থেকে এসেই মাকে জিগ্গ্যেস করল।
–মা ইনি কে ? তোমার সাথে সম্পর্কই বা কী !বাসন্তি মহুয়াকে বলল, আমি এতোদিন তোর কাছে যার গল্প করতাম;
ইনিই হলেন সেই উকিলবাবু, তোর মামা হন ইনি। একটি দূরের সম্পর্কে।
হরনাথ উকিলকে বসতে দিল একটি আধ ভাঙা টুলে। ধুলোপড়া সেই টুল বাসন্তি নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে গিয়ে বাম পাশের কাঁধের শাড়ির অংশ মাটিতে পড়ে গেল। বাসন্তির গতরে তখন ব্লাউজহীন। একটি জীর্ণ ব্লাউজ কোনমতে ধুঁয়ে দিয়ে পাশের দঁড়িতে শুকাতে দিয়েছে।
হরনাথের দৃষ্টি যে হটাৎ আটকে যাবে বাসন্তির মুক্ত আঙিনায় তা কে জানত ?
হরনাথও কি জানত যে, “চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি”।
বাসন্তির পূর্ণচন্দ্রিমার তিথিতে রাহুর আবির্ভাব ইঙ্গিত দিয়ে গেল যে, হে ঈশ্বর তুমি আছ।
তোমাতে এতো সুখ !! এতো আনন্দ!! বলো,কোথায় রাখি ?
মৃত বাসনার ঘরে পুবের নির্মল সূর্যের মিহি আলোর সম্পাদকীয় সুখ যে এ ভাবেই একদিন ফিরে আসে। মরা গাঙ্গে হয়তো একদিন বান ডাকতেও পারে।
তেমনি হরনাথ। সে জীবনে বিয়েই করল না। আর করবে বলে সে আশার ঘরে অমাবশ্যার নিরেট অন্ধকারে ডুবে ছিল।

(৮)
ইতস্তত হয়ে বাসন্তি মাটিতে পড়া কাপড় তুলে নিয়ে নিজের বক্ষকে আড়াল করল। সেই সময় দুজনের চোখের পাতায় এক নৈস্বর্গিক সুখ অনুভবে আপ্লুত হয়ে এক মহাজাগতিক সুখের আবেশে ভেসে চলল দুটি প্রাণ।
মহুয়া এসে তাঁর মামাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে নিল। হরনাথ প্রাণ ভরে তাঁকে আশির্বাদ করলেন।
–হরনাথ বলল, আজ আমার কোর্ট ছুটি। তাই তোমাদের নিতে এসেছি,চলো, তোমরা কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নাও। আমি ততোক্ষণ বাইরে গিয়ে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আসি।
—–
(৯)
হরনাথ একটি টাটাসুমো ঠিক করে এলো।
ওদের সব বাক্সপেট্রা গুছিয়ে গাড়িতে তুললেন। গাড়ি ছুটল বকক্সি বাজারে হরনাথের বাড়ির দিকে। ঘরে বৃদ্ধ মা-বাবা আছে হরনাথের। তারাও খুশি হল ওদের আসা দেখে।
মা বিন্দুবাসিনী এসে বাসন্তিকে ঘরে ডেকে তুলল। মহুয়া গিয়ে দুই বয়স্কদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল।
হরনাথের মা-বাবা কিছুদিন যাবৎ তীর্থ ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করে এসেছিল এতোদিন। এবার হাফ ছেড়ে বাচঁল বিন্ধুবাসিনী।
সে এসে বলল,বাসন্তিকে। এবার তোরা ঘরদোর সামাল দে।
আমরা তীর্থে যাবার মনস্থ করেছি। হরনাথকে বলল,
বাবা,এবার আমাদের কাশিতে যাবার ব্যবস্থা করে দে। দিনদুই পরে হরনাথ একটা ট্যুরিজম সংস্থার মাধ্যমে বাবামায়ের কাশিতে যাবার ব্যবস্থা করলেন। দুজনের কাশিতে যাওয়া আসার সমস্ত খরচ ম্যানেজ করে সেদিন কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরলেন।
বললেন, আমি সব ব্যবস্থা করে এলাম।
তোমরা আগামী পরশু ট্যুরিজমের সেকেন্ড এডিশনে কমলাপুর স্টেশন থেকে রওনা দিতে পারবে। ট্রেনের সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় ছেড়ে গিয়ে কলকাতা স্টেশনে পৌঁছবে বিকেল তিনটেয়। তারপর ওখানে একরাত্রি যাপন করে পরদিন সকালের হাওড়ার দিল্লি এক্সপ্রেস ধরে যাত্রা…।

(১০)
মা বিন্দুবাসিনী একদিকে খুশির বন্যায় ভাসতে লাগল,অন্যদিকে দুই চোখ বেয়ে জল টপ টপ করে পড়তে লাগল।একটিই আফসোস যে, হরনাথ তোর বিয়েটা হলো না। তুই সেদিকে নজর দিলি না। বললি, জীবনের বিবাহ নামক অধ্যায়টিকে তুই প্রাধান্য দিস না। ঘরে আজ বৌমা,নাতি নাতকুর থাকলে বেশি খুশি হতাম। হরনাথ বলল, মা,তুমি অকারণে চিন্তা করছ। আমার সে ইচ্ছে নেই। বয়স প্রায় অর্ধেক চলেই গেল ওকালতি পড়তে গিয়ে, এখন আর সে কথা ভাবছিনা।
মা বিন্ধুবাসিনী সংসারের সকল ভার বাসন্তির হাতে অর্পণ করে বলল, বাসু তুই এই সংসার সামলে হরনাথকে দেখে রাখিস।
অনেক সময় না খেয়েই কোর্টে চলে যায়। নিজের সংসার হয়নি বলে সবসময় অগোছালো ভাবে চলাফেরা করে। তুই গুছিয়ে রাখিস। হরনাথ যেন না খেয়ে কোনদিন কোটে না যায়; সে খেয়াল রাখিস।

(১১)
পরের দিন ওরা কাঁশি-পুরীর উদ্দেশ্যে রওনা হল। হরনাথ গাড়ি করে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসল কমলাপুর। সময় মত ট্রেন হুইচেল দিয়ে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ট্রেনের চাকা ঘুরতে লাগল। হরনাথের দুচোখ বেয়ে জল টপ টপ করে পড়তে লাগল।
যতক্ষণ ট্রেন দেখা যায়,ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্টেশনে। শেষে ট্রেনটি অদৃশ্য হলে হরনাথ ফিরে এলেন বাড়িতে। সেদিন মনটা খারাপ লাগছে, তাই আর সেদিন কোর্টে গেলেন না হরনাথ। সারাদিন একমনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটি আইনের বইতে চোখ বুলাতে লাগলেন।
বাসন্তি এসে ঘরে তারজন্য খাবার দিয়ে বললেন, দাদা তুমি খাবার খেয়ে নাও। অনিয়ম করোনা।
হরনাথ এই প্রথম অনিয়মের তাবেদারী সুর তাঁর কর্ণমূলে গিয়ে বিঁধল। ভাবল, আমার স্ত্রী থাকলে সেও এ’ভাবেই হুকুমের তাবেদারী সুর শুনতে হতো।
কিছুটা ভালো লাগল,কিছুটা মন্দও লাগল।
হরনাথ ভাবল, মহুয়ার প্রায় বিয়ের বয়স হয়ে এসেছে। ওকে একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পেত সে… মহুয়ার বয়স এখন পনের চলছে। ওর বিয়ের বয়স হয়ে এসেছে। মহুয়া বড় দুখি!!
বাপটাও অকালে চলে গেল!
দিন গড়িয়ে চলল। আয় উপার্জনের কিছু টাকা মহুয়ার নামে ব্যাংকে জমাতে লাগল। মেয়েটি সংসারী হলে ওর টাকার দরকার হবে। সেই ভেবে ব্যাংকে টাকা জমাতে লাগলেন হরনাথ।
—-
(১২)
মাঘের দোল পূর্ণিমা। চারিদিকে একটা দোলের উৎসব যেন অনুভব করল হরনাথ। কলকাতা থাকতে এই দোলে মানুষ অনেক উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে থাকত। দোলের রঙ ছড়াছড়িতে রাজপথ আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠত। এ দেশে’ত তেমন রঙ খেলার জন্য মানুষ রাজপথে বেরোয় না। এটা মুসলিম দেশ।
হাতে গোনা মুষ্টিমেয় হিন্দুরা দোলের উৎসব করে নিজেদের এক ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে তাও ঘরে বা মন্দিরে বসে।
বাসন্তি বলল,
দাদা এবার ঘর থেকে একটু বাইরে যাও। দোকান থেকে আবির নিয়ে এসো। নিজেরাও একটু বাহ্যিক রঙে রাঙ্গায়িত হই। মনের রঙ নাই থাকুক; ঠাকুর ঘরে গোবিন্দের চরণে একটু আবির মাখাব।
হরনাথ বলল,
তোর যদি এতই ইচ্ছে থাকে,তবে যা না…
দ্যাখ, ঠাকুর ঘরের আসনের পাশেই মায়ের রাখা আবিরের কৌটা আছে,সেখান থেকে তোর যা মন চায়;তুই তাইই কর।
ঠিক আছে বলে বাসন্তি স্নান সারতে যাবার আগে বলল, তা হলে তোমাকে আর বাইরে যেতে হবে না।আমি স্নান শেষ করে যাচ্ছি ঠাকুর ঘরে।

(১৩)
স্নান ঘরে গিয়ে বাসন্তি ভাবছে, পোড়া কপাল আমার !
সারাজীবন বস্তির ঘরে থেকে সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। কী করে দোল খেলে মানুষ তাঁর মনের রঙ পরিবর্তন করে (?) সেটা বাসন্তির কপাতে জোটেনি। সেই সাধ,আল্হাদ এই জীবনে হয়ে ওঠেনি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আজ আবিরের ফোঁটা দিতে পারব।
বাসন্তি স্নান সেরে হরনাথকে বলল,দাদা তুমি এবার অলস বিছানা ছেড়ে স্নান করতে যাও। মহুয়াকেও বলল,তুইও যা…
স্নান করে আয়।
ওরা যে যার মত করে স্নান সেরে আসল।
বাসন্তি নতুন কাপড় পড়ে গেল ঠাকুর ঘরে।
সেখানে গিয়ে আবিরের কৌটা খুঁজে বের করে নিজের ভক্তিদ্বারা সকল দেবতার চরণে আবিরের রঙ মাখিয়ে প্রণাম করল।
মহুয়াও এসে মায়ের দেখানো মতে আবির মাখলেন ঠাকুর দেবতার পায়ে,তারপর ভক্তিভরে প্রণাম করল।
হরনাথ এলো ঠাকুরঘরে।বাসন্তি হরনাথের কপালে আবির ছুঁইয়ে তাঁর পায়ের দুই চরণের শীর্ষদেশে আবির মাখলেন,পরে পায়ে হাত দিয়ে উপুড় হয়ে প্রণাম করলেন।
হরনাথ স্বর্গীয় সুখ অনুভব করলেন।
শেষে বাসন্তির হাতের থালা থেকে খানিক আবির নিয়ে বাসন্তির কপালের মধ্যভাগে আবিরের ফোঁটা দিয়ে আশির্বাদ করলেন।
বললেন,
বাসন্তি জীবন যে কত সুন্দর সেটা আগে ভাবিনি। আজ বুঝতে পারলাম, সংসারে সুখ আছে,প্রেম আছে,ভালোবাসা আছে। তুমি ভালো থেকো– সেই কামনা করি।।
—-
(১৪)
আজ হরনাথের মন কেমন যেন একটা অনিত্য ভাবনার সাগরে সাঁতার কাটছে।
মা-বাবা বাড়িতে থাকলে তাঁদের আবির মাখিয়ে প্রণাম করতে পারতাম। অনেকদিন হলো, তাঁরা তীর্থে গিয়েছে।কোন খোঁজ খবর নিতেও পারছেন না।তাঁদের জন্য মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।

দুপুরে খেতে বসে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই উঠে গেলেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
বাসন্তি জানো?— আজ না আমার মন কেমন যেন একটা কু’ ডাকছে। প্রায় একমাস হতে চলল, কোন সংবাদ পাচ্ছিনা। টেলিগ্রাম বা ফোনের কোন বিধিব্যবস্থাও নেই।
লোক মুখে জানতে পারলাম উত্তরদেশে পাহাড়ি ধ্বস নেমেছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপ!!
অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
রাতের খাবার খেয়ে মান্ধাতার আমলের একটি কাঠের বাক্সের রেডিও নিয়ে এলো স্টোররুম থেকে। ওটা এতদিন অযত্নে স্টোর রুমেই ধুলোবালি জমে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। কারও রেডিও শোনার তেমন সখ নেই।
বাইরের দোকান থেকে দুটি ব্যাটারি কিনে আনলেন। তারপর বাক্সের ধুলো পরিষ্কার করে ব্যাটারি লাগিয়ে রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এক সময় ঘস ঘস ফস ফস করে বাক্সের মধ্য থেকে সাউন্ড বেরিয়ে এলো।
খুঁজে খুঁজে দিল্লির আকাশবাণীর স্টেশন ধরলেন। কিছুক্ষণ পরে প্রথমে হিন্দিতে খবর পরিবেশন হল। তারপর বাংলা খবর।
—- আকাশবাণী, দিল্লি থেকে বাংলা সংবাদ পাঠ করছি প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
এখনকার বিশেষ বিশেষ খবর হল, ভারতের উত্তর প্রদেশে বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুরশাস্ত্রী সেই এলাকায় রেড এলার্ট জারি করে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন দুর্গতদের উদ্ধারের জন্য। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীরাও রয়েছেন।
এই পর্যন্ত রয়টার্স বরাত অনুসারে প্রায় দুশ যাত্রীর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা। হয় তারা স্রোতে ভেসে গেছে,নয়তো পাহাড়ের ধ্বসে কোথাও চাপা পরে আছে।
—-
(১৫)
রেডিওর খবর শোনার পর হরনাথের মন ভালো নেই। রেডিও নিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। বাসন্তিকে বলল,তোরা খেয়ে নিস।
আমাকে ডাকিস না। তীর্থযাত্রীদের দুর্ভোগের খবর শুনে মন ভালোনেই। কী জানি ওঁনাদের ভাগ্যে কী জুটেছে !!!
বারাণসী,মথুরা,বিন্দ্যাচল ইত্যাদি স্থানেও চরম ভোগান্তিতে মানুষ জীবন কাটাচ্ছে!
সেখানেও নাকি আরও ক্ষতি বেশি হয়েছে।এই ভেবে ভেবে হরনাথের রাতের ঘুম হলোনা।
রাতে একসময় বাসন্তি হরনাথের জন্য খাবার দিতে এসেছিল। টেবিলে রাখা ড্রাই খাবারও মুখে তুলেনি। সারারাত একটা পাগলের মত ছটফট করতে লাগল হরনাথ।
বাসন্তি একবার মধ্যরাতে এসে মাথার কাছে রাখা জ্বলন্ত হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে নিবু নিবু অবস্থায় রেখে এলো। পায়ের কাছে পড়ে থাকা বিছানার চাঁদর টেনে বুকের কাছে তুলে দিল। বুকের উপর থেকে রেডিওটি নামিয়ে টেবিলে রাখতে গেলে তার বাম হাতে চেঁপে ধরা বাক্সটির থেকে হাত সরাতে গেলে হরনাথ আচমকা সজাগ হয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠল। বাসন্তি সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
দাদা তুমি না বিজ্ঞ জ্ঞাণী মানুষ,তোমার বুকেও আজ এত কষ্ট!!!
ঈশ্বর সহায় থাকলে মাসি-মেসো সশরীরে ফিরে আসবেন। তুমি মনকে শক্ত রাখ।
তুমি ভেঙে পড়লে আমরা দাঁড়াব কোথায় গিয়ে (?)
অনেক কষ্টের মধ্যে হরনাথ বাসন্তিকে কাছে পেয়ে কিছুটা কষ্ট প্রশমন করার জন্য ওঁর হাত চেঁপে ধরে বলল,
বাসন্তিরে, আমি যে এতিম হয়ে যাব !!
তোরা আছিস তাই কিছুটা মনকে শক্ত করতে পারছি।
বাসন্তি বলল,
হরদা তুমি চোখের জল মুছে নাও। উপরে ভগবান আছেন,তিনিই সব সামলে নিবেন।
হরনাথ বাসন্তিকে বলল, আমার কাছে একটু বস তুই। আমার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না। বাসন্তি পাশে বসে হরনাথের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
—-
(১৬)
ভোরের আযানের সময় মহুয়ার ঘুম ভেঙে গেল।বিছানায় উঠে দেখল,মা কাছে নেই। এতো ভোরে কোথায় গেল ? ধীরে ধীরে দরজার বাইরে এসে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে হরনাথের ঘরের দিকে পা’ বাড়াল। হরনাথ কোনদিন দরজা সেঁটে দিয়ে ঘুমায় না,সে কথা জানত মহুয়া।
মামার ঘরের দরজা হাট করে খোলা না থাকলেও আজ তাঁর ঘরের দরজা ভেজানো।
ধীরে ধীরে পা চেপে এলো তাঁর ঘরের দিকে। তারপর আস্তে করে দরজা চাপ দিয়ে একটি পাল্লা সরিয়ে দেখল, টেবিলে রাখা খাবার সাজানো। হ্যারিকেনের আলো নিবু নিবু। হরনাথের বিছানায় মা তাঁর বুকের উপর শুয়ে আছে।
মহুয়ার মনে তেমনটি কোন সন্দেহের দানায় পূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
বুদ্ধিমতী মেয়ে মহুয়া ভাবল,
যার যার সম্মান তার তার কাছে থাকাই ভালো। আমি বড় হয়েছি। সন্দেহের অসুখে ধরলে আমিও বাঁচতে পারবনা।
মায়ের কী দোষ! মা যে এখনও তাঁর ভরাট জীবন ও যৌবন নিয়ে বহির্গামী হয় নি!!!
আমাকে বুকে আলগে রেখেছে। আর,মামাকে এই দোষে দোষী করে আমরা ঘরছাড়া হতে চাইনে। সংসারের সুখ যার যার,তার তার কাছেই নিরাপদ।
মায়ের এমন কী বয়স হয়েছে ?– সেতো সুখে থাকলে আমার কাছেই সেটা শান্তি।
অকালে বাবার মৃত্যু হওয়াতে মা’ইবা কি পেয়েছে ?জীবনভর দুঃখ আর কষ্টে কাটল মায়ের জীবন।
মামার কাছে থেকে যদি কিছুটা শান্তি পায় তবে আমার তাতে কি ? আমি ঐ মানুষটিকে সারাজীবন দেবতার আসনে রেখেই পুজো করব।
সংসারে সন্তানের কাছে জন্মদাত্রী মা যদি বেশ্যাও হয়,তবে সে মাইই…. তাঁকেতো আর অস্বীকার করতে পারব না।
—-
(১৭)
মহুয়া ফিরে এলো তার ঘরে। তারপর বিছানায় গা’ এলিয়ে দিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে লাগল।
এমনি করে আরও দুটিদিন কেটে গেল।
হরনাথ দুদিন পরে চূড়ান্ত খবর পেল, সেই পাহাড়ি ধ্বসে পূর্বপাকিস্থান থেকে আসা গ্রেটার ট্যুরিজমের কোন অস্তিত্ব নেই। সবাই সেই ধ্বসে জ্যান্ত সমাধি হয়েছে।
খবর শুনে হরনাথ অনেক কান্নাকাটি করল। এই গ্রেটার ট্যুরিজমের সাথেই তাঁর বাবা-মা এসেছে তীর্থ করতে।
শেষে বৈদিক মতে বাবা-মায়ের ক্রিয়াদি সম্পন্ন করলেন।

হরনাথ সেই থেকে মনমরা হয়ে বসে থাকেন। ঠিকমত কোর্টে যান না। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেন না।
অনেক বুঝিয়ে বাসন্তি ও মহুয়া তাঁকে খাওয়ায়।
মহুয়া মাকে ডেকে বলল,
মা তুমি মামার যত্নআদি নিও ঠিকমত।
মামার কিছু হয়ে গেলে আমরা কোথায় দাঁড়াব ?
এই ভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেল।স্বর্গীয় সুখের কাছে স্বর্গীয় কষ্ট বেশিক্ষণ থাকে না। ভাঁটার পরে জোয়ার আসে,সে কথা মহুয়া বুঝতে পারল।
মামা এখন অনেকটাই ভালো। নিয়মিত কোর্টে যায়। মায়ের মন বেশ ফুরফুরে দেখে মহুয়া মনে মনে খুশি হল।

(১৮)
এমনি করে কাটল আরও একটি বছর।
হরনাথ মহুয়ার জন্য পত্রের সন্ধান করতে লাগল।মহুয়া বড় হয়েছে,ওকে বিয়ে দিতে হবে; সে কথা আলোচনা করল হরনাথ বাসন্তির সাথে।
বাসন্তি তাতে সায় দিল।
কিছুদিন পরে কোন এক ফাল্গুনে পাত্র দেখে মহুয়ার বিয়ে দিল হরনাথ।
কিন্তু মহুয়ার কপাল খারাপ!!
বিয়ের ছয়মাস যেতে না যেতেই অশান্তিতে মহুয়া অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল। স্বামীর অত্যাচার আর দাবি দাওয়ার চাপ বেড়েই চলল। মাঝে মাঝে তাঁর মাকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনা মহুয়ার স্বামী দেবজিৎ।
একদিন স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
— না, এবার আর মামার কাছে ফিরে যাবেনা। সেখানে গিয়ে আমার কষ্টকে জানিয়ে মায়ের সুখশান্তিতে বিষ ধরাতে চায় না মহুয়া।
তাই জীবন দেবতার কাছে ক্ষমা চেয়ে ঠাকুর ঘরে এসে ঠাকুর দেবতার চরণে কান্নাকাটি করে গভীর রাতে মহুয়া ছুটল বুড়িগঙ্গার দিকে। সাথে আনা একটি মাটির কলসিতে নিজের পড়নের কাপড় জড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে নামল বুড়িগঙ্গায়।
তারপর থেকে মহুয়ার আর কোনো সংবাদ কেউ দিতে পারল না আজ পর্যন্ত।
—সমাপ্ত।।
শব্দবন্ধন (2386)
হরিদেবপুর ।।

মন্তব্য করুন