নিছক ছোট গল্পঃ বাবু থেকে ইব্রাহিম
কলমেঃ মোঃ ইব্রাহিম হোসেন
সত্য কাহিনি অবলম্বনে এখন থেকে ৯০ দশক আগের কথা। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। ১৯৮৮ – ১৯৯০ সাল হবে। মায়ের মুখে শোনা সত্য কাহিনি। আমার মনে পড়ে না, মায়ের মুখ থেকে শুনেছি।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার নিকটতম একালাকার হরিশংকরপুর গ্রামে জয়নাল আবেদীন সরকার (পিতাঃ রফাতুল্লাহ সরকার) নামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বাস করতেন। তাঁর দ্বিতীয় পরিবারে ছোট্ট সংসারে ছিলো তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র অবুঝ ছোট্ট একটি ছেলে। (নাম: মোঃ ইব্রাহিম হোসেন – রাজশাহী, আয়ুব নামে তার একটি ছোট ভাইও ছিলো। কিন্তু সে খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছে)। তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে বিশাল পদ্মা নদী। পদ্মার নদীর এপার-ওপার জুড়ে ছিলো তাঁর প্রায় শত বিঘা সম্পত্তি। তাঁর জমিজমা অন্য মানুষে বর্গা চাষ করতো। আদারপাড়া নামের এক গ্রামে ছিলো তাঁর ১৫ থেকে ২০ বিঘা সম্পত্তি। তাঁর সে জমিও সেখানকার এক কৃষকে চাষাবাদ করতো।
একদিন ভদ্রলোক তাঁর জমি দেখতে যায়। তাঁর জমিতে ছিলো বুটের চাষ। ফসলের বুটে ভরপুর। দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন যে, এ জমি থেকে তিনি যদি তাঁর ছেলের জন্য কিছু কাঁচা বুটের দানা তুলে নিয়ে যান ; তবে তাঁর ছেলে খুব খুশি হবে। এ বলে তিনি জমি থেকে কয়েকটি বুটের ঝাড় মানে বুটের গাছ নিজের ইচ্ছায় তুলে নিয়ে বাড়ি গেলেন। তিনি আবার তাঁর ছেলেকে “বাবু” নামে ডাকতেন।
বাড়ি গিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতেই ডাক দিলেন,
বাবু! বাবু! কই তুমি?
তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসো। আমি তোমার জন্য বুটের ফল নিয়ে এসেছি।
ছেলে খুব খুশি মনে বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে বললো,
আব্বু! এইতো আমি। আমার জন্য কি নিয়ে এসেছেন?
বাবাঃ এই তো তোমার জন্য মিষ্টি বুটের ফল নিয়ে এসেছি। বাবা ছেলেকে ডেকে তাঁর কোলে বসিয়ে বুটের ফলগুলো ছিলেছিলে তার মুখে দিতে যাবেন ঠিক এমন সময় ছেলে বললো,
বাবা! একটা কথা বলবো বাবা?
বাবাঃ ঠিক আছে বাবা বলো।
ছেলেঃ বাবা! আপনি যে ফল নিয়ে এসেছেন, সে ফল কি আমাদের?
বাবাঃ হ্যাঁ, আমাদেরই। আমাদের আদারপাড়ার জমি থেকে আমি নিজে তুলে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।
ছেলেঃ আমাদের ঠিক আছে, কিন্তু চাষ তো আপনি করেন না। চাষ করে অন্যলোকে। আপনি কি তাকে বলে এই ফল নিয়ে এসেছেন?
বাবা একদম চুপ! হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন। এ তো আমার কোনো সাধারণ ছেলে নয়। এই বলে বাবা খুব আনন্দ চিত্তে তার নাম দিলেন “ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ”। তখন থেকেই ” বাবু” হয়ে গেলো “মোঃ ইব্রাহিম হোসেন”। তারপর তিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চলে গেলেন আবার সেই কৃষকের বাড়ি আদারপাড়া। কৃষকের নাম ছিলো “সাবুর মাঝি”।
উনার বাড়িতে গিয়ে বললেন,
ভাই বাড়িতে আছেন? আমার সাথে একটু মাঠে চলেন তো।
সাবুর মাঝি বললেন, কেনো কি হয়েছে ভাই? আমাকে খুলে বলেন তো।
জয়নাল আবেদীন সরকার বললেন, আগে মাঠে চলেন, সেখানেই সব খুলে বলবো।
এই বলে তারা দুজন মাঠে চলে গেলেন এবং কৃষক সাবুর মাঝিকে বললেন,
ভাই! দয়া করে এই জমি থেকে আমাকে কয়েকটি বুটের ঝাড় মানে বুট গাছ তুলে দেন।
সাবুর মাঝিঃ কি বলেন ভাই? আপনার জমি, আপনার ফসল। আমার কাছে অনুমতির কি প্রয়োজন আছে?
জয়নাল আবেদীন সরকারঃ সব ঠিক আছে ভাই। আমি আপনাকে না বলে কয়েকটি বুটের ঝাড় তুলে নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু এই ফল আমার ছেলেকে খাওয়াতে পারিনি।
সাবুর মাঝিঃ কেনো? কি হয়েছে ভাই?
জয়নাল আবেদীন সরকারঃ আপনাকে বলে নিয়ে যাইনি তাই। আমার ছেলে বলেছে,
“বাবা! জমি আমাদের, ফসল আমাদের বুঝলাম। কিন্তু জমি তো আমরা নিজে চাষ করি না। চাষ করে অন্যলোকে। তাই এই ফলে তাদেরও হক আছে। এই ফল আমি ততক্ষণ পর্যন্ত খাবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি উনার অনুমতি নিয়ে না নিয়ে আসবেন।”
কৃষক সাবুর মাঝি অনেক অবাক হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ!
এতো ছোট্ট ছেলের এত জ্ঞান! এতো বুদ্ধি হবে এ তো আমার জানা ছিলো না। আল্লাহ যেন আপনার ছেলেকে সহিসালামতে রাখেন। এই বলে তিনি নিজের হাতে ক্ষেত থেকে বুটের ঝাড় তুলে দিলেন।তারপর জয়নাল আবেদীন সরকার সেই ফল নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন এবং তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন,
বাবা! আমার কাছে এসো। এবার আমি এই ফল চেয়ে নিয়ে এসেছি। এসো এসো, নাও, খেয়ে নাও। তখন সেই ছোট্ট ছেলেটি খুব খুশি মনে ফল খেতে লাগলো। বাবা মায়ের মন খুশিতে ভরে গেলো।
তাঁদের সকলের মুখে হাসি ফুটলো। দু’চোখে সুখের বন্যা বয়ে গেলো। পাশে মা ও বাবা ছেলেটির জন্য আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে প্রাণভরে দোয়া করলো।
———————- সমাপ্ত———————-
মমতাময়ী মা জননী – মোঃ ইব্রাহিম হোসেন