Skip to content

গর্জিয়াস রুহিনুর – মোঃ নাঈম মিয়া

১।বানর থেকে মানুষের বিবর্তন এবং সমকামীতা
প্রসঙ্গে

*সেদিন আবরার তার বন্ধুদেরকে নিয়ে বড় বটগাছের তলে আড্ডা দিচ্ছিল।সেখানে রুহিনুর ছিল না।রুহিনুরের থেকে আবরার কোনদিক দিয়ে কম নয়। একদিকে পড়ালেখায় চালাক আরেক দিকে ইসলামিক জীবন-বিধান নিয়ে। আবরার আর রুহিনুর দুজনেই ইসলামিক ধ্যান ধারনার দিক দিয়ে খুবই চালাক। তখন সেখানকার বটগাছের নীচের আড্ডাতে তেমন ভালো কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না। বন্ধুরা যখন একসাথে আড্ডায় বসে তখন কত কী নিয়ে আড্ডা যে জমে তার হিসেব নেই। তবে তাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু মাহবুব। সে চাইলেই মূহুর্তের মধ্যে কাউকে হাঁসাতে পারে। হঠাৎ মাহবুব লক্ষ্য করলো তাদের কলেজের দিকে নতুন একটা ছেলে আসছে। তাকে তারা আগে কোনোদিন এদিকে এই কলেজে আসতে দেখেনি। ছেলেটা কোন ক্লাশে পড়ে তাও কেউ সঠিক জানে না। ওদিকে কলেজে ক্লাশের সময় হয়ে যাচ্ছে। শুনা গেল কলেজে নাকি আজকে একজন নতুন টিচার এসেছেন।ওনার নাম আইয়ুব খান। দেখতে খুব বেশী বয়স্ক নয়। ওনাকে স্বচক্ষে না দেখলে তো কেউ সবকিছু বলতে পারে না।

আজকে কলেজে আসা নতুন ছেলেটির পেছন পেছন সবাই চলে গেল। কে এই ছেলে? মাহবুব কিম্বা আবরার বা তাদের অন্য বন্ধুদের মধ্যে কেউই এই ছেলেটাকে কোনো প্রশ্ন করেনি। ছেলেটা দেখা গেল তাদের ক্লাশেই গেল। সে ক্লাশের সর্বশেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলো- যেখানে প্রতিদিন মাহবুব বসে। আজ কেউ-ই এই ছেলেটার আগে ক্লাশে যায়নি। সে শুধু একা।আর রুহিনুর ও আসছে না এখনও। সবাই চলে গেল ক্লাশে। মাহবুব গিয়ে দেখলো নতুন আসা ছেলেটি তার বেঞ্চে বসে আছে। মাহবুব গিয়ে ছেলেটির ব্যাগটা বেঞ্চের অন্যদিকে রেখে সে তার দখলদারি জায়গায় গিয়ে বসলো। ছেলেটা কোনোকিছু বললো না। সে বেঞ্চের অপরদিকেই বসলো। আবরার চরিত্রের দিক দিয়ে খুবই ভালো। সে গিয়ে ছেলেটিকে হাত বাড়িয়ে বললো—Hello, Good morning.How are you?

ছেলেটি ও হাসিমুখে তার সাথে হাত মিলালো এবং বললো, — I am fine, and you?

— আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। ছেলেটা কেন জানি আবরারের কথা শুনে একটু ইতস্তত বোধ করলো।

নাম কী? এ বলে মাহবুব এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলো।

—‘ মিলন,…………………………your name?’

মাহবুব আমার নাম। তোমার নামটা শুনে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে- গাইবো নাকি? মিলন মুচকি হাসলো।মিলন মাহবুবকে গান গাইতে আপত্তি জানালো না।
“ মিলন হবে কত দিনে…………আমার মনের মানুষের সনে”

কিছুক্ষণের মধ্যেই রুহিনুর ক্লাশে চলে আসলো।সকলেই সমস্বরে তাকে গুড মর্নিং জানালো।সে ও বললো গুড মর্নিং। আবরার রুহিনুরকে তার আজকে দেরীতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু সে বললো;- আজ স্কুলে নতুন টিচারের কথা।রুহিনুর আবরারকে বললো,আমাদের তো একটা সমস্যা বেড়ে গেছে। শুনলাম আজ নাকি আমাদের ক্লাশে নতুন বায়োলজির টিচার আসবেন।

—কী যে তুই বলিস না। তাতে তো আমাদের খুশি হবার কথা। এতে আবার তুই সমস্যা ফেলি কোথায়?

— সমস্যা একটা আছে। তিনি নাকি বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী।বিবর্তনে বিশ্বাসী ঠিক আছে,তবে বানর থেকে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে এতে তিনি বিশ্বাসী।

— কী?

– হ্যাঁ।
— আরে না,ওনি শুধুই বিবর্তনে বিশ্বাস করেন।যেমন- মা বাবার সন্তান তাদের মতো না হয়ে বিবর্তনের ফলে অন্যরকম হয়ে জন্ম নেয় ইত্যাদি।কিন্তু টিচারদের মাথায় বানর থেকে মানুষের বিবর্তন আবার আসবে কী করে- ওনারা তো স্টুডেন্টদেরকে এসব বিষয় থেকে সচেতন রাখেন।

— কেন আসবে না। চার্লস ডারউইন কী একজন টিচার নন? একদিক দিয়ে তিনি ও টিচার।তাহলে,সে যদি এরকম বিশ্রী অবান্তর বিবর্তনের কথা বলতে পারে, আমাদের টিচারের কাছে এটা বিশ্বাস না করা কেমন বিষয়।

— এটা সত্য। তো রুহিন,এটা না হয় বুঝলাম, তাহলে তোর আসতে এতো দেরী হলো কেন?

— কারন আমি একটা বই পড়ছিলাম। সেই বইতে দেখছিলাম এরকম বিবর্তনবাদে বিশ্বাস আমাদের জন্য কী কী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। যদি ওনি আমাদের কাছে এসে এই অবান্তর বিবর্তন সম্পর্কে কোনোকিছু বলেন- তাহলে ওনাকে আমাদের বুঝাতে হবে।

— “ ও তাহলে এই ব্যাপার।”

কলেজের ইন্টার Second year এর ছাত্র রুহিনুর। সেদিন কলেজে নতুন টিচার আসাতে ক্লাশের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কোনো টিচার আসেন নি।

দ্বিতীয় পিরিয়ডে বাংলা ক্লাশ। বাংলা টিচার ক্লাশে চলে আসলেন।আজকের মতো না হয় মানিয়ে নেওয়া হলো। প্রথম পিরিয়ডের ক্লাশ না করেই দ্বিতীয় পিরিয়ডের ক্লাশ শুরু হলো। বাংলা টিচার ক্লাশে এসেই সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। রুহিনুর হয়তো আগে থেকেই মিলনকে চেনে,তাই সে মিলনকে পেছন থেকে তার বেঞ্চে ( সামনের বেঞ্চে) বসতে বললো।

বাংলা টিচার রুহিনুরকে জিজ্ঞেস করলেন সে কীভাবে মিলনকে চেনে। রুহিনুর জানালো সে ইংরেজি টিচারের কাছ থেকে জানতে পেরেছে। আজ কলেজে যে নতুন টিচার এসেছেন ওনার সন্তানই মিলন। তার মা নেই। স্যার এই কলেজে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন বলে ওনার ছেলেকে ও এই কলেজেই ভর্তি করালেন। সবাই অবশ্য এটা বুঝতে পারলো একজন বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী টিচারের সন্তান মিলন। মিলন ওতে বিশ্বাসী কি-না তা সঠিক কেউ জানতে পারলো না।

রুহিনুরের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।সে কেমন হঠাৎ দেখাতেই মিলনকে কাছের করে নিল। একজন ছাত্র হিসেবে রুহিনুর সর্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তি। রুহিনুর বলে— “ বন্ধুত্ব তা’ই যা ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে কাছে টেনে নেয়।যা সকল বিপদকে ভয় না করে পাশে থাকার সংকল্প প্রকাশ করে। ” রুহিনুরের মধ্যে ও এই গুণটি বিদ্যমান রয়েছে।বন্ধুত্বের জন্য সে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না।

দ্বিতীয় পিরিয়ডের ক্লাশ শেষ হয়ে তৃতীয় পিরিয়ডের ক্লাশ ও হয়ে গেল।চতুর্থ পিরিয়ডে বায়োলজি ক্লাশ।এখন নিশ্চয়ই নতুন টিচার ( আইয়ুব খান) আসবেন।সবাই ওনার প্রতিক্ষায় রয়েছে। আইয়ুব স্যার চতুর্থ পিরিয়ডে ক্লাশে চলে আসলেন। ওনি ক্লাশে এসেই বললেন,- ‘How are you guy’s………’

প্রত্যেকে সমস্বরে বলে উঠলো – ‘We are fine, and you?’

রুহিনুর একটু দেরিতে বললো- I am fine, and you?

“The teacher said, sit everyone except the one who answered a little late.”

রুহিনুর ছাড়া বাকি সবাই বসে গেল।সবাই ভাবলো রুহিনুর দেরীতে উত্তর দিয়েছে বলেই হয়তো টিচার তাকে দাঁড় করিয়েছে।

কিন্তু না, ওনি বললেন সর্বপ্রথম ব্রেঞ্চে তুমি আছ -তাই তোমার থেকেই পরিচয় নেওয়া হোক।ওনি সবার পরিচয় একে একে জেনে নিলেন এবং মিলনের পরিচয় সবাইকে বললেন।আজ ওনার প্রথম দিন এই কলেজে এবং এই ক্লাশে তাই প্রথমে এতোটা কথা বললেন না।পরিচয় হওয়ামাত্রই তিনি এটা জানিয়ে দিলেন,যারা ওনার কথা শুনবে এবং কথামতো চলবে তাদের সাথে ওনি ভালো আচরণ করবেন।আর যারা ওনার কথা শুনবে না এবং তার কথামতো চলবে না তাদের সাথে ওনি প্রকট হবেন।সবাই অবশ্য এটা বুঝতে পারলো এই স্যার অন্য স্যারদের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। একদিকে ওনি বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী, আরেকদিকে ওনি কাউকে ছেড়ে কোনো কথা বলেন না।তবে বায়োলজি ক্লাশে একজন ভালো টিচারের খুবই প্রয়োজন ছিল।তিনি মোটামুটি একজন ভালো প্রকৃতির টিচার বলেই সবার মনে হলো।

প্রথম দিনটা তো ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। পরেরদিন আইয়ুব স্যার ক্লাশে চলে আসলেন। তিনি এসেই মন্টুকে দাঁড়াতে বললেন।মন্টু হলো বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত প্রকৃতির একজন।সবাই তাকে তাই গবেট মন্টু বলে ডাকে।

টিচারের কথায় মন্টু দাঁড়ালো।

আর টিচার ও একটু প্রশ্নখোর স্বভাবের। নিজের ক্লাশের বাইরে ও নানান ধরণের প্রশ্ন করতে করতে ওনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।আগে যে কলেজের তিনি অধ্যাপক ছিলেন,সেখানে ও তিনি এরকমই করতেন।তবে তিনি অন্য টিচারদের মতো নন।অন্য টিচারেরা ক্লাশে আসেন,কিছু লেকচার দেন,আবার চলে যান।আইয়ুব স্যার সেরকম নহে।ওনি এমন টাইপের টিচার, যিনি কি-না একটা পড়া জায়গা থেকে শেষ না করে উঠেনই না।

টিচার মন্টু কে জিজ্ঞেস করলো,— ‘মানুষের জন্ম রক্ত থেকে হয় নাকি শুক্রানু থেকে। ’ মন্টু সনাতন ধর্মের ছেলে।সে বায়োলজি বই পড়ে যা জেনেছে তাই বলেছে।সে বললো,— স্যার,মানুষের জন্ম হয় শুক্রানু থেকে।স্যার সম্ভবত এই উত্তরটাই আশা করছিলেন।কিন্তু রুহিনুর তখন দাঁড়িয়ে বললো,স্যার আমি কী বলতে পারি?

— প্রশ্নের উত্তরটা সঠিক নাকি ভূল হয়েছে?

— এই প্রশ্নের উত্তর ভূল হয়েছে।

মন্টু বললো,রুহিনুর তোর কী মনে নেই আমরা যে আমাদের বইয়ে পড়েছিলাম ‘ মানুষের জন্ম হয় শুক্রাণু থেকে।’

— এই প্রশ্ন বইয়ে ভূল নয়, কিন্তু উত্তরটা খোলাশাভাবে দেওয়া হয়নি।সুতরাং, তুই বইয়ের ব্যাখ্যাটা বুঝতে পারিস নি।

আইয়ুব স্যার মন্টু কে বসতে বললেন।ওনি রুহিনুর কে হেঁসে হেঁসে বললেন,তুমি কী সত্যিই জানো এই উত্তরটা তোমার বন্ধু মন্টু ভূল বলেছে?

— জ্বি, স্যার! আমি আপনাকে বিজ্ঞানের আলোকে প্রথমত ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছি। মানুষের প্রজনন হলো যৌন কার্যক্রমের একটি রুপ -যার ফলে কোনো পুরুষের সাথে কোনো নারীর যৌনকর্মের ফলে মানব ভ্রুণের নিষেক ঘটতে পারে।যৌনকর্মের ফলে পুরুষের শুক্রাণু দ্বারা নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় এটা সত্য।

— হ্যাঁ এটাই সত্য।আর এই শুক্রাণুর মাধ্যমেই নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় এবং ভ্রুণ সৃষ্টি হয়। আর একজন নারী তা নয় মাস বহন করতে করতে তা মাংসপিণ্ডে পরিনত হয়ে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি হয়।

— স্যার,আপনি কী দেখেননি আমাদের বায়োলজি বইয়ে উল্লেখ রয়েছে ডিম্বাণুকে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত করা হলো গ্যামেট নামক এক বিশেষ প্রজনন কোষ।এগুলো “মিয়োসিস ” নামক প্রক্রিয়াতে সৃষ্টি হয়।তবে “সাধারণ কোষে ২৩ জোড়া বা ৪৬ টি ক্রোমোজম থাকে,সেখানে গ্যামেট কোষের মধ্যে শুধুমাত্র ২৩ টি ক্রোমোজম থাকে। যখন দুটি গ্যামেট একসঙ্গে যুক্ত হয় তখন জাইগোট সৃষ্টি হয়।আর একেই ভ্রুণ বলা হয়।তবে একে আবার রক্তপিণ্ড ও বলা যেতে পারে।মূলত এটা রক্তপিণ্ডই।কিন্তু এটা সরাসরি শুক্রাণুর মাধ্যমে মানব প্রজনন হয় না।বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ফলে এগুলো মধ্যাবস্তায় রক্তপিণ্ড উৎপন্ন করে।আর এগুলো একজন নারী নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ধারণ করেই সন্তানের জন্ম হয়।”
এবার বলতে পারি পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত তথ্যের কথা।মহান আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনের সূরা আল আলাকে বলেছেন-

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ এবং خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ

অর্থ:-পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। ( সূরা আল আলাক,আয়াত ১-২)

এখানে আলাক অর্থ জমাট বাধা রক্তপিণ্ডের কথা বলা হয়েছে।সুতরাং, বৈজ্ঞানিক যুক্তির থেকে অধিক আল কোরআনের যুক্তিকে মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রাধান্য দেওয়া অধিকতর প্রয়োজন।

টিচার রুহিনুর কে থামিয়ে দিলেন।টিচার বললেন,এখানে তো আমি ধর্ম বিষয়ক কোনো প্রশ্ন করছি না,তাহলে কোরআনের ব্যাখ্যা বলার প্রয়োজন কী?

— অবশ্যই প্রয়োজন আছে।আমি একটু খোলাশাভাবে প্রশ্নটির উত্তর দেব স্যার।
টিচার বললেন,কোরআনের উপর তুমি কীভাবে বিশ্বাস করতে পারছো – যার মধ্যে রয়েছে অনেক ভূল।স্যার ডাঃ ক্যাম্বেল কোরআনের ভূল ধরতে পেরেছেন।আর তিনি এটাও বলেছেন যে মানব প্রজনন কোন রক্তপিণ্ড থেকে হয়নি।কোরআনে উল্লেখিত আলাক অর্থ চক্ষু বিষয়ক কোনোকিছুকে বোঝানো হয়েছে। তবে আমরা কোরআনের যুক্তি কীভাবে বিশ্বাস করতে পারি?

— অবশ্যই পারি স্যার।ডাঃ ক্যাম্বেলের দেওয়া বর্ণনামতে আলাক চক্ষু অর্থে বুঝানো হয়েছে এটা সত্য,তবে এটাও সত্য আলাক অর্থ ঝুলন্ত রক্তপিণ্ড- যা নারীগর্ভে ঝুলে থাকে।ডাঃ ক্যাম্বেলও এটা বলেছেন, আলাক অর্থে চক্ষুর মতো কিছু বুঝানো হয়েছে, তবে তা ঝুলানো থাকে। আশা করি স্যার আপনি আপনার দেওয়া প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন।আর ডাঃ ক্যাম্বেলের ধারণামতে কোরআনে যে ভূল আছে এটাও ভূয়া।সুতরাং, কোরআনের ব্যাখ্যা ডাঃ ক্যাম্বেলের দেওয়া তথ্য কে ভূল প্রমাণিত করে।

টিচার তো রুহিনুরের কথা শুনে একদম চুপ হয়ে গেলেন।
আল কোরআন যা বলে তা বৈজ্ঞানিক ধারণা কখনোই ভূল প্রমাণ করতে পারবে না।বরং বৈজ্ঞানিক ধারণাকে কোরআনের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব।
আইয়ুব স্যার বিজ্ঞানে বিশ্বাসী।বিজ্ঞান সম্বন্ধে বিশ্বাস রাখা দরকার।তাই বলে তো স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করা যাবে না।তিনি রুহিনুরের উভয় দিকের ব্যাখ্যা শুনে একটু কুন্ঠিত হলেন।আইয়ুব স্যার তখন রুহিনুরের যুক্তিতর্ক শুনে তাকে খুব ভালোভাবেই নজরে গেঁথে রাখলেন। তিনি রুহিনুরকে হেঁসে হেঁসে বললেন, — বসো।
রুহিনুর বসে পড়লো।আজ আইয়ুব স্যারের আসার মাত্র দুদিন হলো অথচ এরকম একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন – যা ক্লাশের সবার মধ্যে এক অনন্য বিশ্লেষণবোধ জাগ্রত করলো।তবে সবাই রুহিনুরের বিশ্লেষণের দিকে একমত।
তারপর আইয়ুব স্যার মহিবুরকে দাঁড় করালেন।আজ বুঝি ওনি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নামলেন।তিনি নিজের বিশ্বাসকে জিতিয়ে নিতে আরেকটা নাস্তিকবাদি প্রশ্নের সম্মুখীন করালেন শিক্ষার্থীদের।মহিবুরকে বললেন,

— ’ এবার তুমি দাঁড়াও।’ মহিবুর দাঁড়ালো।স্যারকে সে জিজ্ঞেস করলো কোনোকিছু তিনি বলবেন কি-না।

স্যার বললেন,— ’ মানুষের জন্মের উৎস কোথায় থেকে তুমি কী তা জান?’

— জ্বি স্যার। – আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানব জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মাতা হাওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পাঠিয়েছিলেন।আর ওনাদের থেকেই মানব জাতি দিন দিন বাড়তে থাকে এবং বংশ পরাম্পরা সৃষ্টি হতে থাকে।

— “এ বিষয়ে তোমার আর কোন উত্তর আছে?”

টিচারের কথা শুনে মহিবুরের পা কাঁপছে। সে স্যারের এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না।সে ঢোক গিলতে গিলতে স্যারকে বললো,— জ্বি না স্যার,আমি আর কোনো উত্তর জানি না।স্যার মহিবুরকে বসতে বললেন।( মহিবুর বসলো) ওনি এবার আবরারকে দাঁড়াতে বললেন।এরপর তিনি মহিবুরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আবরারকে জিজ্ঞেস করলেন,

— এই ছেলেটা যে উত্তর দিয়েছে – এটা ছাড়া তোমার আর কোনো উত্তর জানা আছে?

আবরার বললো;- না স্যার।

— ‘তুমি কী বিবর্তন সম্পর্কে কোনোকিছু জানো?’

— জ্বি স্যার,জানি।

— বলতে পারবে বিবর্তনবাদে সর্বপ্রথম কে তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন? কোন বিজ্ঞানী?

— ‘ স্যার,ওনার নাম চার্লস ডারউইন।চার্লস ডারউইন সর্বপ্রথম বিবর্তন সম্পর্কে তত্ত্ব দেখিয়েছেন।’

— ‘বসো।’

তাহলে তোমরা অবশ্যই এটা জানো যে পৃথিবীতে বিবর্তনবাদ সত্যিই আছে।আর স্যার চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব কখনোই ভূল হতে পারে না।

রুহিনুর বললো,স্যার;- বিবর্তনবাদ আছে এটা বিশ্বাসযোগ্য।“কিন্তু–” আইয়ুব স্যার রুহিনুরের কথা না শুনেই বললেন,তাহলে কেউ বলতে পারবে মানুষের বিবর্তন হয়েছে কোন প্রাণী থেকে?

কেউই দাঁড়ালো না।কারণ রুহিনুর সবাইকে আগেই বলে দিয়েছে,যেন এই বিষয়ে কোনো উত্তর কেউ না দেয়।

টিচার বললেন,মানুষের বিবর্তন হয়েছে বানর থেকে।প্রতমে বানরটি একটু পরিবর্তিত হয়েছে।তারপর আরেকটু,এভাবে একটু একটু করে পরিবর্তন হতে হতে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে।আর এটির থিউরি আবিষ্কার করেছেন স্যার চার্লস ডারউইন।

আইয়ুব স্যার এই কথাগুলো বলার জন্যই বোধহয় প্রতিক্ষায় ছিলেন আর রুহিনুর ও এর উত্তর দিতে প্রস্তুত।রুহিনুর টিচারের কথাগুলো এতক্ষণ শুনছিলো আর রেগে যাচ্ছিলো।কারণ- চার্লস ডারউইনের দেওয়া এই তত্ত্ব কখনোই সত্য হতে পারে না- যা তিনি মানুষের বিবর্তনের কথা বলেছেন।
রুহিনুর দাঁড়িয়ে স্যারকে ছট করে কিছু বলেই দিল।চার্লস ডারউইন কীভাবে কখন কেমনভাবে বিবর্তনের তত্ত্ব প্রকাশ করলেন তার ব্যাখ্যা দিতে লাগলো।

— চার্লস ডারউইন কোনো একসময় ( কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে) ‘এইচএমএস বিগল ’
জাহাজে বিনা বেতনের প্রকৃতিবিদ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল।‘ এইচএমএস বিগল ’ নামক জাহাজটি ঘুরে বেড়ায় দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দ্বীপে।তিনি যেখানেই গিয়েছেন প্রত্যেকখানেই জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ব এবং তা পর্যবেক্ষন এবং তার নমুনা সংগ্রহ করেছেন।ডারউইন দেখলেন এক প্রকারের পাখি মাটিতে গর্ত করছে তার ঠোঁট দিয়ে।তিনি লক্ষ্য স্থির করে দেখতে পেলেন পাখি যেভাবে মাটিতে গর্ত বা ছিদ্র করছে এর ফলে তার ঠোঁট ছোট বা বড় হচ্ছে। আর তা দেখেই চার্লস ডারউইন থিওরি আবিষ্কার করলেন।তিনি এটাই ভেবে নিলেন মানুষেরা ও বিবর্তনের মাধ্যমেই আজ মানুষ হিসেবে রুপান্তরিত হয়েছে।প্রথমে বানর,তারপর সেই বানর ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে হতে এখন পূর্ণ মানুষ হয়ে গেছে।

— হ্যাঁ,ঠিক বলেছ।তাই সত্য।

— একদম নয়।এটা ভূল।ডারউইন মাত্র একটি পাখির এমন পরিবর্তন দেখে মানুষের পরিবর্তনের কথা আন্দাজের উপরে বলেছেন।

— তো,তুমি কী আজ এটা প্রমাণ করতে পারবে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি নয়?’

— অবশ্যই পারবো স্যার।মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনে বলেছেন:–

وَاللّٰہُ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ جَعَلَکُمۡ اَزۡوَاجًا ؕ وَمَا تَحۡمِلُ مِنۡ اُنۡثٰی وَلَا تَضَعُ اِلَّا بِعِلۡمِہٖ ؕ وَمَا یُعَمَّرُ مِنۡ مُّعَمَّرٍ وَّلَا یُنۡقَصُ مِنۡ عُمُرِہٖۤ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ.

অর্থ -আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন তারপর শুক্রবিন্দু দ্বারা। তারপর তোমাদেরকে জোড়া-জোড়া বানিয়ে দিয়েছেন। নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং যা সে প্রসব করে তা আল্লাহর জ্ঞাতসারেই করে। কোন দীর্ঘায়ু ব্যক্তিকে যে আয়ু দেওয়া হয় এবং তার আয়ুতে যা হ্রাস করা হয়, তা সবই এক কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। বস্তুত এসব কিছুই আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।( সূরা ফাতির,আয়াত -১১)

আল্লাহ তায়ালার পক্ষে যেকোনো কিছু সম্ভব।এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।এই আয়াতে শুধু নয়, আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনের অনেক আয়াতে মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন – যা বিবর্তনে একদম অবিশ্বাস্য।আপনার বলা বিবর্তনকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না।

: الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ ۖ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ

যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং
কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন।( সূরা আস সাজদাহ,আয়াত -০৭)

আল্লাহ তায়ালা সূরা আল মুমিনুন এ উল্লেখ করেন–

وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَةٍ مِّنۡ طِيۡنٍ​ ( ۚ‏ ١٢)ثُمَّ جَعَلۡنٰهُ نُطۡفَةً فِىۡ قَرَارٍ مَّكِيۡنٍ( ١٣) ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظٰمًا فَكَسَوْنَا الْعِظٰمَ لَحْمًا ثُمَّ اَنْشَاْنٰهُ خَلْقًا اٰخَرَ فَتَبٰرَكَ اللّٰهُ اَحْسَنُ الْخٰلِقِیْنَ.

অর্থ –“আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি।অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রুপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি।এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট বাঁধা রক্তরুপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর মাংসপিন্ডকে পরিণত করি হাড্ডিতে, অতঃপর হাড্ডিকে আবৃত করি মাংস দিয়ে, অতঃপর তাকে নতুন রুপে দাঁড় করিয়েছি।নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যানময়।”( সূরা আল মুমিনুন,আয়াত ১২-১৪)

আইয়ুব স্যার রুহিনুরের কথায় আর কোনো কথা বললেন না। তিনি অবশ্যই এটা বুঝতে পেরেছেন চার্লস ডারউইনের দেওয়া বিবর্তনের তত্ত্ব একদম ভূল। তা ইসলামে কখনোই গ্রাহ্য হবে না।“বৈজ্ঞানিকগণ যা কিছুই আবিষ্কার করুক না কেন – সকল আবিষ্কারের মূল আল কোরআন।”

ইসলাম এটা বিশ্বাস করে মানবজাতির জন্ম হয়েছে মাটি থেকে।আর সর্বপ্রথম মাটি থেকে হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের ইসলামের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা তারই সন্তান। সুতরাং, তিনি যেহেতু মাটির তৈরি আমরাও মাটির তৈরি। বানর থেকে মানব এসেছে এটা একদম অবান্তর।স্যার আইয়ুব খান এবারও কুন্ঠিত হলেন।

আবার ওদিকে ওনার সন্তান মিলন যে সমকামীতায় ভোগছে।মিলন তার বাবার মতোই বানর থেকে মানুষের বিবর্তনবাদ বিশ্বাস করে।সে রুহিনুরের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব পেতে নিল।সে রুহিনুর কে কোনো এক সময় বলে দিল, সে বাস্তবত ছেলে হলেও অন্তর থেকে সে মেয়ে।তাই মিলন বাসায় একা একা মেয়েদের মতো সাজগোজ করে।রুহিনুর মিলনকে বুঝানোর চেষ্টা করলো।সমকামীতা এবং বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে বিশ্বাস করাও এক ধরণের পাপ।আর মুসলিম ধর্মে তো একেবারেই তা স্থান পাবে না।এগুলো আবার নাস্তিকবাদি কাজও বটে।আল্লাহ তায়ালা নাস্তিকদেরকে এবং যারা পাপ করে তাদেরকে ঘৃণা করেন।আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকেই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন —

سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ

“পাক-পবিত্র সে সত্ত্বা যিনি সব রকমের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা ভূমিজাত উদ্ভিদের মধ্য থেকে হোক অথবা স্বয়ং এদের নিজেদের প্রজাতির (অর্থাৎ মানব জাতির) মধ্য থেকে হোক কিংবা এমন জিনিসের মধ্য থেকে হোক যাদেরকে এরা জানেও না।” ( সূরা ইয়াসিন, আয়াত -৩৬)

আল্লাহ তায়ালা যেমন ( নারী বা পুরুষ) করে দিয়েছেন তাকে তেমনি থাকা বাঞ্ছনীয়।

মিলন রুহিনুরের কথা বুঝতে পারলো এবং সে সমকামীতার দিক থেকে ফিরে আসে ইসলামের দিকে। তার বাবা আইয়ুব খান ও বোধহয় কিছুটা বুঝতে পারলেন।

২।আল্লাহর হক হাক্কুল্লাহ, তবে হাক্কুল ইবাদে তিনি কেন খুশি?

*সুপ্রিয় পাঠক সমাজ। আপনাদের আমার প্রতি রাগ হতেই পারে।

কারণ আমি কেন মূল বক্তব্য না লিখে এইসব পরিচয় তুলে ধরলাম।এই গল্পটার সম্বন্ধে আরো ভালোভাবে জানার জন্যই আপনাদের জন্য প্রথম পরিচয়টি তুলে ধরলাম।

একটু ধৈর্য্য সহকারে এটা ভালো করে পড়ে দেখুন সকলেরই ভালো লাগবে।এটা এক অবাস্তব ধারণার বাস্তবিক কাহিনী বলতে পারেন।আপনারা তো জানেনই এই গল্পের মূলই হচ্ছে রুহিনুর কে নিয়ে।এই গল্পে রুহিনুর এবং তার এক বন্ধুর মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে এবং একজন নাস্তিককে দেওয়া কড়া জবাবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। রুহিনুর তার বন্ধু আবরারের সঙ্গে একদিন তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বলছিল।ঘটনাটি নিম্নে উল্লেখিত:-

কী আর বলবো।জানিস তো আবরার আরিফুলের সাথে কী যে আনন্দ করতাম ছোটবেলায়।আমাদের আরিফুল।আমার ছোটবেলার বন্ধু।ছেলেবেলাটা তার সঙ্গে খুব ভালোভাবে কেটেছে। আর তোর সাথে তো আমার ক্লাস নাইনে উঠামাত্র কিংবা তার ক’ দিন পরে পরিচয় হয়েছে।কারণ আমি আমার গ্রামের স্কুল ছেড়ে ঢাকা শহরে এসে ক্লাস নাইনে ভর্তি হই।আর সেখান থেকেই তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব।কিন্তু আরিফুলের সাথে আমার জন্মের পরিচয়।জন্মের পর থেকেই বলতে গেলে তার সাথে আমার উঠাবসা।ছোটবেলাটা আমার তার সাথে খুব ভালোভাবে কেটেছে।
পাড়াগাঁয়ে দুজন একসাথে চলেছি।ঘুরেফেরে খেয়েছি,কত কত ঝগড়ার নিমেষেই মিটমাট করে বাড়িতে যে ফিরতাম তার তো শেষই নেই। আমার পুরাতন স্মৃতি তথা প্রাক্তন স্মৃতি মনে করতে যেন খুবই কষ্ট লাগে যদিও সেই পুরনো স্মৃতিগুলো নিজের শৈশব কাতরতার দিকে টেনে নিয়ে যায়।

সময়ের আবেদনে আজ আমরা সকল বন্ধুরা দূর দূরান্তে থাকি।যদিও আরিফুল আর আমি এক গাঁয়ের ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলাম। অন্যদিকে আমরা ছিলাম( Batchmate)ক্লাস মিট।একসাথে পড়তাম।

আমরা দুজনেই প্রথমে প্রাইমারি স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। প্রাইমারি স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষাটা সম্পন্ন করেছিলাম।আরিফুল যদিও আমার ক্লাস বন্ধু এবং একই গ্রামের ছেলে ছিলাম দুজনে,তবে আমাদের মাঝে কিছুটা ভিন্নতা আছে।
সে আমার চেয়ে প্রায় চার বছরের বড় হবে।আমি আমার স্কুল জীবনে বা বাস্তব জীবনেই হোক বন্ধু হিসেবে একমাত্র তাকেই বয়সে খুব বেশী বড় হিসেবে পেয়েছিলাম।সে আমার চেয়ে প্রায় চার বছরের বড়,কিন্তু তবু্ও আমি তাকে নাম ধরেই ডাকি।
সে আমাকে বললো, যেন তাকে নাম ধরেই ডাকি এবং তুই তুকারি ভাষাতেই বন্ধুত্বের মতন কথা বলি।ঘনিষ্ঠ সর্বনামে যা হয় আর কী।তার সাথে তো তুই তুকারি ভাষার কোনো শেষই নেই।আর এগুলো আমাদের সমাজে খুব বেশীই প্রচলিত রয়েছে।

আমরা একই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিশু শ্রেণী পার করে একটানেই আমাদের পাড়াগায়ের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম।
একটা খুশির ব্যাপার হলো আমরা ১ ম- ২ য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়িনি।

আমরা শিশু শ্রেণী থেকে বরাবরের মতন তৃতীয় শ্রেণীতে গিয়ে ভর্তি হলাম।আর আমি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারলাম কেবল মাত্র আরিফুলের জন্য।আম্মা আব্বা চেয়েছিলেন আমি যেন প্রথম, দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ে তবেই তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই।কিন্তু আরিফুলের জেদ আমাকে তার সঙ্গ করে রাখলো।সে বয়সে অনেক বড় বলে তাকে প্রাইমারি শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলেন।আর আমি তার তুলনায় অনেক ছোট তাই আমাকে ভর্তি করতে ওনারা অনিচ্ছুক।

আরিফুল বললো স্যার আমার চেয়ে রুহিন পড়ালেখার দিক দিয়ে অনেক চালাক।ভর্তি করেই দেখুন না।স্যার যদিও প্রথমে বিশ্বাস করলেন না।তবে অবশেষে আমাকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করেই নিলেন।তারপর সেই স্কুল থেকেই আমি আর আরিফুল ২০১২ সালে সমাপনী পাস করলাম।
তখন আমার বয়স মাত্র বারো বছর আর আরিফুলের বয়স ষোলো বছর হবে।আমি আর আরিফুল ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম আমাদের পাড়াগাঁয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।ক্লাস সিক্সে আমরা উঠতে না উঠতেই এক প্রবল ঝড় আসলো আরিফুলের জীবনে।তার মা মারা গেলেন।

আরিফুলের বাবাও মারা গিয়েছিলেন প্রায় চার পাঁচ বছর আগেই আমরা বোধহয় তখন ক্লাস টু তে পড়তাম।আরিফুলের বাবা মা আজ দুজনেই পৃথিবীতে নেই। আরিফুল তখন নিজেকে খুব একাকিত্ব মনে করছিল। খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো সে।তার দুইটি ছোট বোন এবং আরো একজন ছোট ভাই রয়েছে। তাদের ভরণ পোষণ করবে কে? ছোট ভাইটির নাম আসিকুল।আসিকুলের জন্মের কয়েকদিন আগেই তার বাবার মৃত্যু হয়।ছোট ভাই আসিকুল জন্ম থেকেই তার বাবার মুখটাও দেখতে পায়নি।আরিফুলের এক বোন আমার চেয়ে দেড় দু-বছরের বড় হবে। আর একজন আমার চেয়ে ছোট।আরিফুলের বোন আমাদের সাথেই পড়তো।তবে পড়ালেখায় দূর্বল বলে সমাপনী পরিক্ষায় অকৃতকার্য হলো।

আরিফুল মনে মনে বোধহয় এই চিন্তা করছিল যে এখন তার দুইটি বোন এবং একটি ভাইকে বরণ পোষণ করবে কে? আরিফুলের আম্মা বেঁচে থাকাকালীন ওনী সেলাইয়ের কাজ করে কোনোভাবে সংসারটা চালিয়ে নিতেন।

তখন আরিফুলের চাচা আসলো তার কাছে।চাচারও খুব বয়সের ঘানি টানতে হচ্ছে। কখন জানি ওনি ও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। চাচী তো সেই আরিফুলের জন্মের আগেই মারা গেলেন।চাচী কে চাচা খুবই ভালোবাসতেন।আর এ জন্যই বোধহয় চাচা আর বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
চাচার কথায় আরিফুলকে ষোলো বছর বয়সেই বাল্য বিয়ে করতে হলো।

বাল্য বিয়ে! যা আমাদের সমাজের জন্য একটা কু-সংস্কার।একটা মারাত্মক ক্ষতিকর দিক।কিন্তু পরিস্থিতির কবলে পড়ে আরিফুলকে এই বিয়েটা করতেই হলো।আরিফুল বিয়েটা করলো।যদিও আরিফুলের বোন রয়েছে তার সমানে সমান।সে পড়ালেখায় সবসময় ব্যস্ত থাকে।ইদানীং সে খুব ভালো করে পড়ছে,কারণ গত সমাপনী পরিক্ষায়( আমাদের সাথে) ফেল করেছিল।আর তার ছোট যে বোনটি সে ও পড়ালেখা করছে।তার বয়স যতটুকু এ বয়সে তো একটা সংসারের কাজ একদম অসম্ভব ব্যাপার।

আরিফুলের স্ত্রী’র বয়স তার বয়সের চেয়ে কম হবে না।কণের বয়স তার বয়সের মতোই হবে, সমবয়সিই হবে দুজনে।পিঠাপিঠি বয়স হলে একদিকে ভালোই হলো, দুজনেই একে অপরকে বুঝতে পারবে।তাদের বিয়ের দেড় বছরের মাথায় একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নিলো।আমি আরিফুলকে বলে তার নাম রেখে দিলাম রবিন।রবিন নামটা আমার খুবই পছন্দের নাম। আমি আমার বন্ধুর ছেলের ( আমার ভাস্তের) নাম আদর সহিত তখন আমি কলেজে সবেমাত্র পা রাখলাম,যখন আরিফুলের সন্তান হলো।
আমি ঢাকা কলেজেই পড়াশুনা করি।

দুই

তখন কীভাবে জানি দু বন্ধুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল।এতো নিকটের বন্ধু দুজন যে এতোটা দূর হয়ে যাবো তা আমি কখনোই ভাবতে পারিনি।আর এটা সত্যিই কোনো কল্পনার বিষয় নয় যে এরকম হতে পারে আমাদের জীবনে। আমার বন্ধু গ্রামে আছে আর আমি আছি ঢাকা শহরে।

আম্মার কাছে শুনলাম আরিফুল তার বউ বাচ্ছা এবং ভাই বোনদের নিয়ে সিলেটের ভোলাগঞ্জে চলে গেছে।
সে গিয়েছে ভালো কথা একবার আমাকে ফোন করে হলেও জানাতে পারতো।আমি এতে খুবই দুঃখ বোধ করলাম।আম্মার কাছে শুনতে পেলাম আরিফুল নাকি তার ফোনের সিমটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে।সিম হারিয়ে ফেলেছে তো কী হয়েছে,সে আম্মার কাছ থেকে আমার নম্বরটা নিতে পারতো।না তাও সে করলো না।

অবশেষে আমিই একদিন ভোলাগঞ্জ যাবো ভাবলাম।প্রায় চার বছর পরে ভোলাগঞ্জ যাবো বলে রওয়ানা হলাম।আমি আমার এসএসসি পরিক্ষা দিলাম ২০১৭ সালে।আমি এসএসসি পরিক্ষাতে এ প্লাস পেয়েছিলাম এবং এইচএসসি পরিক্ষাতে ৪.৬৭ পেলাম।কলেজের এইচএসসি পরিক্ষা শেষ করেই বন্ধুর সন্ধানে ভোলাগঞ্জে পাড়ি দিলাম। এর মধ্যে বোধহয় আরিফুলের ছেলেটাও ( রবিন)অনেক বড় হয়ে গেছে।আর এদিকে আমি এখনো পড়ালেখাই করছি।কী অদ্ভুত বিষয় এটা।আৃমার বন্ধুর সন্তানের প্রায় পাঁচ বছর ছয় বছর হয় হয়,কিন্তু আমি এখনো পড়ালেখাই করি।আগেই তো বলেছি আরিফুল আমার চেয়ে চার পাঁচ বছরের বয়সে বড়।

ভাবলাম বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি তার ছেলের জন্য কিছু নেব না? কয়েকটা খেলনা, দুটো সুন্দর দেখে দামী শার্ট প্যান্ট এবং কিছু মিষ্টি ও ফলমূল নিয়ে গেলাম।আরিফুলের বোন মাহিয়া এবং মারিয়ার জন্য কিছু কিনতে না পেরে বড় আফসোস হলো।কারণ আমার কাছে তেমন টাকাও এখন নেই।আমি আব্বাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, আমি ঢাকা থেকে এবার বাড়ি যাবো না,আমি সিলেটের ভোলাগঞ্জে চলে যাব আরিফুলের বাসায়।

আব্বাকে বলেছি আমি বন্ধুর বাড়ি যাবো তাই আব্বা আমাকে চার হাজার টাকা দিলো,যেন খরচ করি।

আর আমার কাছে আগে থেকেই দুই হাজার টাকা ছিল। এই ছয় হাজার টাকাতেই যা হলো।

আমি রাত ১২ টার গাড়িতে উঠলাম। ফজরের আযানের কিছুক্ষণ পরপরই চলে আসলাম সিলেটের ভোলাগঞ্জ।তবে আরিফুলদের বাসায় এখনও যাইনি। যেতে আরও দু আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে।আমি আরিফুলকে যে ফোন দেব এই উপায় ও নেই।তার ফোন নম্বর আছে কিন্তু সিম সে আর তুলেনি।আমি আব্বার কাছ থেকে শুনেছি আরিফুল কোন জায়গায় থাকে।আমি খুঁজতে খুঁজতে আরিফুলের বাসার কাছে চলে গেলাম। দেখতে পেলাম এক ভ্যান গাড়ি থেকে আরিফুল সিমেন্টের বস্তা টানছে।আমি আরিফুলকে দেখেই চিনতে পেরেছি, যদিও সে এতো অল্প বয়সেই দাড়ি রেখেছে। আমি আরিফুলকে দেখে চিনতে পারলেও সে আমাকে দেখে না চেনার ভান করলো।কারণ – সে পরিস্থিতির শিকার।আজ সে অর্থের দিক দিয়ে নিঃস্ব। “ একজন মানুষ অর্থের দিক দিয়ে ছোট বলে থাকে ছোট মনে করতে নেই, হয়তো বা সে বয়সে কিংবা জ্ঞানের দিক দিয়ে বড়। ”

ঠিক তেমনি আরিফুল আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলো।

আমি সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে আছি।

আর এদিকে আরিফুল সিমেন্টের বস্তা টানছে। এর ধুলো তার পোশাকে লেগে আছে।এগুলো কী আর লক্ষ্য করতে আছে? এতোদিন পর আমার বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। বন্ধুর কষ্ট দেখে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো।বন্ধুকে দেখে আমার আর তর সইলো না,তাই আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।অনুভব করলাম বন্ধু আমার কাঁদছে।তার কান্নার পানি কাঁধে পড়ছে আমার।সে আমাকে আচমকা ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে নিল এবং বললো, – দূর মশাই! কোথা থেকে এসেছেন তার ঠিক নেই – আর এসেই এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন? আমি তো আপনাকে আর এই এলাকায় কখনো দেখিনি।
নিজের পোশাকটা তো নষ্ট করলেনই তার সাথে সাথে আপনি আমার সময়টা ও নষ্ট করলেন।

আমি আরিফুলকে বললাম;- কী রে! তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর বন্ধু রুহিনুর।

সে বললো,-‘ রুহিনুর টুহিনুর বলতে আমার কোনো বন্ধু নেই।’ আপনি সরেন তো আমাকে কাজ করতে হবে।( আরিফুলের কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো)

—‘ আমাকে চিনতে পারিস নি তো কথা বলতে বলতে এভাবে কাঁদছিস কেন?’আমাকে তুই ছল দিয়ে কী করবি? ভালো থাকবি – তো?

আমার বন্ধুর লজ্জাজনক অভিমানী ছল ধরতে পারলাম।তখন দেখতে পেলাম তার এক বোন এদিক দিয়েই আসছে।মাহিয়া নাকি মারিয়া সঠিকভাবে চিনতে পারলাম না।দুনো বোন আগে একরকমই ছিল,এখনও বোধহয় একরকমই দেখতে।আবার তাদের বয়স ও মোটামুটি কাছাকাছি। আমি তাকে ডাক দিলাম।- “মাহিয়া এদিকে আস।”

সে আমাকে দেখে যে কতটা খুশি হয়েছে কী আর বলবো।
সে বললো,- ভাইয়া, আমি মারিয়া।তুমি যে আমাদের দেখতে আসবে তা তো আমি আন্দাজ ও করতে পারিনি।তো তুমি কেমন আছ,ভাইয়া?

— আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি রে বোন।

তিন

আমি মারিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে তাদের বাসায় গেলাম।দেখতে পেলাম রোয়াকে বসে ভাবিসাহেবা (আরিফুলের স্ত্রী) ওনার ছেলে রবিন কে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। এদিকে আরিফুল তোরজোর করে দৌড়ে এসে ঘরে চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম সে আমাকে দেখে এতটাই খুশি হয়েছে যে একা একা নিরিবিলেতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে মনটা শান্ত করবে। আমাকে দেখে আরিফুলের প্রাণটা উল্লাসে ফেটে যাচ্ছে।আমি তখন রোয়াকে প্রবেশ করামাত্রই ভাবিসাহেবা আমাকে দেখে চেনেই উঠে গেল।ওনি আমাকে দেখে খুবই উত্তেজিত দেখতে পেলাম।

“আরে ভাইসাহেব,আপনি?আপনি কেমন আছেন? ভালো আছেন তো? আপনাকে তো প্রায় পাঁচ পাঁচটি বছর পর দেখলাম।”

ভাবিসাহেবা উৎফুল্লে দমাদম কথা বললেন।আমি বললাম, হ্যাঁ ভাবিসাহেবা – আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় খুবই ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন তো?( এ বলে ওনাকে কদম্বুছি করলাম)

— ছিঃ ছি এটা কী করছেন ভাইসাহেব! আমি যে আপনার বন্ধুর স্ত্রী। এটা আপনি কী করলেন?

—‘ তাতে কী হয়েছে। আরিফুল আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু সে আমার চেয়ে বয়সে বড় ও বটে।’ তাই তাতে কোনো সমস্যা নেই মেডাম।

তখন ভাবিসাহেবা’র অনুরোধে বসলাম।আমি যা এনেছি ভাবিসাহেবার হাতে তুলে দিলাম।দেখতে পেলাম আরিফুলের বোন মাহিয়া কে, যে আমাদের সাথেই পড়তো। সে ও এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাহিয়া আর মারিয়া যেন এক ডালে দুটো ফুল।দুটো বোন দেখতে হুবহু একরকম হয়ে গেছে।মাহিয়া আমার চেয়ে বয়সে বড়। তবুও সে আমাকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করলো। কারণ- আমি যে তার বড় ভাইয়ের বন্ধু। আমিও মাহিয়া কে আপা বলে ডাকি।

চার

বেলা নয়টা বাজে,আসিকুল কে সেখানে দেখতে পেলাম না।ভাবলাম সে বোধহয় ইশকুলে চলে গেছে।তার ইশকুল সাড়ে আটটার দিকেই নাকি শুরু হয়ে যায়।আমি তো খুব সকালেই তাদের বাসাতে চলে গেলাম।মাহিয়া আর মারিয়া তৈরী হচ্ছে,কোথাও যাবে তারা।বুঝতে পারলাম মাহিয়া কলেজে যাবে আর মারিয়া হাই ইশকুলে যাবে।আমি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিলাম।সারারাত ঘুমোইনি।গাড়িতে কী আর ঘুমানো যায়?

বিকেলবেলা মাহিয়া মারিয়া এবং আরিফুল চলে আসলো।আরিফুল তার চোখের ঠারে ঠারে আমাকে দেখেই চেনে গেল।সে আমাকে দেখেই দৌঁড়ে এসে আমার কোলে বসে গেল ভাইয়া বলে।তার বয়স হবে বারো বছর।চাচা আর ভাতিজা মাত্র কয়েক বছরের ছোট বড়।যেমন চাচা চঞ্চল প্রকৃতির তেমনি ভাস্তে।মানে সে আমার মতো।আমিই এ কথাটা বললাম।আমার মতোই দুষ্টু আরিফুলের ছেলে।আরিফুল ও তেমন কম দুষ্টু ছিল না।তবে আমি তার থেকে একটু বেশীই দুষ্টুমি করতাম।
ওদিকে আমি আরিফুলের ছেলের ( রবিনের) দিকে চোখ ঠাওরে দেখি চঞ্চল চোখ দুটি কেমন টলমল ঝলমল করছে।বুঝতে পারলাম আমাকে কী বলে ডাকবে এ নিয়ে ছেলেটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

যেই সে আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে চাচ্চু বলতে চাইলো, আমি বললাম হ্যাঁ চাচ্চু।

আমি তোমার চাচ্চু।

সে এসে আমার কোলে বসতে তার চাচার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিল।আসিকুল চাটিতে বসলো এবং রবিন এসে আমার কোলেতে বসলো।

এতো বেলা কিন্তু আরিফুলকে দেখতেই পেলাম না। হঠাৎ দেখলাম আরিফুল বাহিরের কোথায় থেকে বাসায় আসলো।ঘুমিয়ে ছিলাম তাই আরিফুল কখন বাসা থেকে বেরিয়েছিল দেখতে পাইনি।

আরিফুলের সেই মিথ্যা লুকোচুরি অভিনয় শেষ হলে,সে আমাকে গলায় ধরে ডুকরিয়ে কাঁদতে লাগলো।

সে বললো,- বন্ধু আমাকে মাফ করে দে- রে। আমি তোকে আসার বেলায় ফোন দিয়ে ও বলতে পারিনি।আর আমি এসেও কোন ফোন দিতে পারিনি।আজ আমি তোর সাথে স্বেচ্ছায় এরকম আচরন করেছি,কারন আমাকে আজ পরিস্থিতি এরকম করেছে।আমি আর আরিফুল খুব ভাব বিনিময় করলাম। ভাব বিনিময় শেষে রবিনকে তার পোশাক, খেলনা দিয়ে দিলাম।সে এগুলো দেখে কী যে খুশি।খেলনা নিয়ে সে খেলতে শুরু করলো। ওদিকে ভাবিসাহেবা মারিয়াকে ডেকে প্লেটে করে মিষ্টি দিল।মিষ্টি খেয়ে আমি আর আরিফুল কিছুক্ষণ বাইরে ঘুরে আসলাম।সেই পুরনো স্মৃতির কথা দুজনে গল্প করতে লাগলাম। তারপর আমরা এসে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম।অনেক রাত হয়ে গেল।

— আচ্ছা আরিফুল,তোর সেই ছোটবেলার কথা মনে আছে? আমরা আগে কী ———
— ‘তোমরা আগে কী করতে চাচ্চু?’
( কথার মাঝখানেই রবিনের খাড়া প্রশ্ন)

রবিনের কথা বলতে গেলে কী আর বলবো।ছেলেটা যে কেমন হয়েছে তা আসলেই বুঝে ওঠা দুস্কর।মাত্র শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। বয়স আর কী ই বা হবে।ছয় বছর বয়স হবে তার,অথচ ছেলেটার মাথায় প্রশ্নের কোনো শেষ নেই।কোনো কথা তার সামনে হলেই হলো।

এমন কোনো আলোচনা নেই যা তার সামনে করলে সে তার মাঝে টক্কর দেবে না । আসলে ছেলেটা বোধহয় যে কোনো কিছু জানতে ভালোবাসে।চেলেটা এতোই চঞ্চল যে যেকোনো মানুষের সঙ্গে নিমেষেই মিশে যেতে পারে।রবিনকে সারাক্ষণ দেখা যাবে শুধু বড়দের কাছাকাছি।সে এখন থেকেই জানার কৌতূহল প্রকাশ করছে।সে সবকিছু জানতে চায়।তাকে খেলতে যাও বললেই বুঝি যে বলেছে তার দোষ হয়ে গেল।উল্ঠো আরো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেবে।যেকেনো কথা তার সামনে বললেই হলো।
সে প্রশ্ন করতে শুরু করবে “ এটা কী,ওটা কী,এটা কেন,ওটা কেন,এটা কেমন, ওটা কেমন” যা ……………………তা ইত্যাদি।
এমন নাছোড়বান্দা ছেলেপিলে কারো ভাগ্যে খুবই কমই জোটে।ছেলেটার বাবা যদিও তার থেকে একটু কমই দুষ্টু ছিল ছোটবেলায়। তবু ও তার মা ছট করে বলেই দিল “ ছেলেটার বাবাও বোধহয় ছোটবেলায় এরকমই ছিল।”

কারণ একজন ছেলে স্বভাবত তার বাবার মতন আর একজন মেয়ে সন্তান স্বভাবত তার মায়ের মতন হয় বলেই আমরা বাঙ্গালীরা বলে থাকি।

মাহিয়া কলেজে এইচএসসি পরিক্ষার্থী এবং মারিয়া ইশকুলে এসএসসি পরিক্ষার্থী আরিফুল নিজে পড়ালেখার সুযোগ পায়নি বলে খুব কষ্ট করে হলেও ভাই বোনেদের পড়াচ্ছে।তার স্ত্রী ও তাদেরকে নিজের ছোট ছোট ভাই বোনের মতোই আদর আপ্যায়ন করে।কখনো তাদের মুখে ভাবিসাহেবার কোনো বদনাম শুনিনি।আসলাম পর থেকেই তাদের মুখে শুধু ভাবিসাহেবার সুনাম আর সুনাম করতে থাকে আমার কাছে।

পাঁচ

রাতে হঠাৎ মারিয়া একটা পাঠ পড়তেছে।সেই পাঠটি তার ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। সে “ হাক্কুল্লাহ এবং হাক্কুল ইবাদ ” সম্পর্কিত পাঠটি পড়ছিল।হাক্কুল্লাহ কী এবং হাক্কুল ইবাদ কী?এই বিষয়টি আসলেই মহান পাক রাব্বুল আলামীন, রহমানুর রাহিম আল্লাহ তায়ালার বান্দা হিসেবে আমাদের জানা দরকার।তাই মানুষ যেন হাকুল্লাহ এবং হাক্কুল ইবাদ সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করে মূলত সেই আলোকেই বইয়ে আলোচনা।তখন আরিফুলের ছেলে রবিন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো -“ চাচ্চু ফুফু এগুলো কী পড়ছে?”

—কিচ্ছু না বাবা, তুমি এখন যাও।দেখছো না চাচ্চু আমার সঙ্গে কথা বলছে।তুমি গিয়ে ফুফুর পড়া মনোযোগ দিয়ে শুনো।
(আরিফুলের কথা শুনে তার ছেলে চলে গেল ফুফুর কাছে)

হঠাৎ এদিক দিয়ে বাসা বাড়ির কর্তা( ওনারই বাসা) এদিক দিয়ে আসছিলেন।মহিন চাচা! আরিফুল ওনাকে মহিন চাচা বলেই ডাকে।ওনি যদিও শিক্ষিত বটে,তবে ইসলাম নিয়ে পুরো বিতার্কিক তিনি।

নাস্তিক তিনি।আমাকে অবশ্য এটা আরিফুল আসার কিছুক্ষণ পরে গল্পকালীন সময়ে বলেছিল এবং ওনাকে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখিয়ে ও ছিল।

মহিন চাচার বাসা পেছনেই। ওনি এ রুমগুলো বাড়া দেন এবং অন্যরুমে নিজেরা থাকেন।মহিন চাচা হঠাৎ হুট করে ঘরের ভিতর চলে আসলো। এসে বললেন ছিঃ ছিঃ এত্ত বড় ছেলে হয়েছ বাবা আরিফ।কিন্তু তুমি দ্যাখি কুনতা জানো না।

তোমার বইনে ইতা কিতা কয় তুমি ইডার জবাব দিতায় পারবানি? যদি জওপ না দিতায় পারো তোমার বইনরে কও ইতা পড়া বাদ দিত।

আমরার মন মিজাজ ভালা না কইলাম।পাগল সরকার কী যে বইয়ের সংস্করণ করতো কয় নিজেই জানে।মানুষরে ভূল ধারণা দিয়া মনের মাঝে ভয় তোলায় অদৃশ্য বস্তুর প্রতি।ইতা যে কিতা শুরু করছে এরা।

আমি ওনাকে দেখে সালাম জানালাম। আসসালামু আলাইকুম চাচা- ভালো আছেন তো?

– ঐ পুলা তুমি জানো নানি,আমি সালাম টালাম দেওয়া ভালা পাইনা।তোমার দুস্-ত তোমারে এইটা কইছে না।আমি তোমরার নষ্ট ধর্ম মানি না।

– চাচা, আমি আপনাদের সিলেটি ভাষা আসলেই বুঝি না। আপনি তো যথার্থ শিক্ষিত মানুষ, আশা করি আপনি বইয়ের ভাষায় কথা বলতে জানেন।দয়া করে আমার সঙ্গে বইয়ের ভাষাতেই কথা বলবেন।

( আমার কথা শুনে নাস্তিক মহিন চাচা একটু চুপ হলেন)

— তারপর মানে……….

— ‘কী?’ “বলুন?”

— বলছিলাম যে তোমরা হাক্কুল্লাহ এবং হাক্কুল ইবাদ যে বলো এখানে কোনটা আসলে কী বলো তো?

আরিফুল বললো,হাক্কুল্লাহ হলো আল্লাহ তায়ালার যে হক এবং হাক্কুল ইবাদ হলো বান্দার প্রতি বান্দার যে হক।“ মানুষের প্রতি মানুষের যে হক।”
যেমন – আপনার প্রতি আমার হক কিংবা আমার প্রতি আপনার হক।

— আর আল্লাহর হক কী?

(আবারো আরিফুল) আল্লাহর হক হলো বান্দার থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার যা প্রাপ্য- তাই।

হা- হা- হা- হা- হু- হু- হু হাঁসতে হাঁসতে মহিন চাচা বললেন, তাহলে আমাকে বলো তো “এখানে সৃষ্টিকর্তা কে?”

— কেন,আল্লাহ।

—; তাহলে কী বান্দা আল্লাহকে পোষেন নাকি আল্লাহ বান্দাকে পোষেন?

— আরিফুল খুব রাগান্বিত হলেও মাথা ঠান্ডা করে ওনাকে বুঝিয়ে কিছু কথা বললো।চাচা,এখানে ছোটরা আছে তাদের সামনে এগুলো না বললেই নয়? আপনি এগুলো পরে না হয় আমাদের কাছ থেকে জেনে নেবেন? এখন আসতে পারেন।

আসিকুল বললো,-এই কাকু খুব খারাপ। ওনি শুধু ঝগড়া করেন। নিজের তো ধর্ম নেই, এসেছেন আমাদের ধর্ম লুটে নিতে।

— চাচা আপনি ওর কথায় রাগ করবেন না, ছোট ছেলে তো…………………
এই তুই এখান থেকে যা( আরিফুল আসিকুলকে দমক দিল)

— তুই আসিকুলকে দমক দিলি কেন? সে তো ঠিকই বলেছে।ওনার তো ভেবে কথা বলা উচিত।শুনুন চাচা — “যদি আল্লাহ মানুষের সেবাপ্রার্থী, তবে মানুষ মানুষের সেবাপ্রার্থী।কারণ- মানুষ সেবাতেই আল্লাহ সন্তুষ্ট। ”

আরিফুল বললো,রুহিনুর তুই শান্ত হো।তারপর সে নাস্তিক মহিন চাচাকে বললো,- ‘দেখুন চাচা এভাবে হঠাৎ করে কোনো কথা বলতে নেই।আপনি কী জানতে চান?
আপনি যা’ই জানতে চান তা আমি আপনাকে কোনো এক অবসরে বলে দেব।

— তবে তুমি কাল দুপুরে তোমার বন্ধুকে নিয়ে আমাদের বাসায় যেতে পারো।আমন্ত্রণ রইলো——–

(চলে গেলেন নাস্তিক মহিন চাচা)

যদিও আরিফুল ওনার বাসায়,যেতে রাজি হলেন না,আমি তাকে বুঝালাম।
আমাদের নাস্তিকদের অবাস্তব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে ওদেরকে ইমানের দিকে,ইসলামের দিকে,দ্বীনের দিকে নিয়ে আসা দরকার।সে একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেল।যাক গে আজ প্রথম প্রথম দিন তাই তেমন কিছু আর আলাপ হলো না।আজ বিশ্রাম একটু বেশীই নেব।গাড়িতে যাতায়াত করার হাওয়া বাতাস যেন আমার মাঝে এখনও বিচরন করছে।বিশ্রাম আরো নেওয়া দরকার,নইলে আজই কথার ঘনঘটায় মহাকাব্য রচনা করে ফেলতাম দুই বন্ধু।

ওদিকে ভাবি সাহেবা মাহিয়া কে দিয়ে মিষ্টি পাঠালেন আমার আর আরিফুলের জন্য।
আমি যদিও রাতে ভাত ছাড়া কিছুই খাইনা,ভাবির অনুরোধে মিষ্টি খেলাম।
রাতে মিষ্টিও খেলাম আরও আগেই ভাত খেয়েছি।তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।

ফজরের আযানের সময় হয়ে গেছে কিন্তু কোনো আযানের ধ্বনি শোনা গেল না।যদিও শুনা যাচ্ছে, সেটা অনেক দূরের কোনো এক মসজিদ থেকে। কাছে এক মসজিদ আছে সেখানের মসজিদে আযান হলো না।কেউই আযান দেয়নি।আমি আরিফুলকে ডাক দিলাম।সে ঘুম থেকে উঠে ততঃপর বললো ‘কী হয়েছে?’ আমি তাকে মসজিদে আযান না পড়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। আরিফুল বললো, মসজিদে নাকি ইমাম সাহেব নেই,আর মসজিদের মুয়াজ্জিন ও এখন তার বাড়িতে চলে গেছে ।আমি বললাম,ইমাম নেই বলে মুয়াজ্জিন ও বাড়িতে চলে গেল? এ তো ভারী অবাক কান্ড। আর ইমাম এবং মুয়াজ্জিন নেই বলে আযান হবে না এ কেমন কথা।

– আরিফুল বললো,কী আর হবে।সকল নাস্তিক আমার চারপাশে ঘিরে রয়েছে।আমিই শুধু এদিক থেকে নামায পড়তে যাই । আর আমার বাসার থেকে চার পাঁচ ঘর দূর সরিয়ে কয়েকজন আসে নামায পড়তে। কী আর করা যাবে।মুয়াজ্জিন ও নেই, আবার ইমাম সাহেব ও নেই। আমরা নিজেরা নিজেরাই নামাজ পড়ি।কোনো ইমাম ও রাখা হয় না।ইমাম কে তো তার কিছু খরচপাতি দিতে হবে। আমরা এ কয়জন মিলে কত টাকা’ই বা দেব।

আমি আর আরিফুল নামায পড়তে মসজিদের দিক দিয়ে যাচ্ছি। গিয়ে দেখি মসজিদের সামন দিকেই নাস্তিক মহিন চাচা ঘুরোঘুরি করছেন।ওনি আমাকে ডাক দিলেন।

— এই মেহমান,এদিকে শুনে যাও—-

— কী,কিছু বলবেন?

— নামাজ শেষ হলে তুমি আর আরিফুল আমাদের ঘরে চলে এসো।

— এ– খন,আচ্ছা ঠিক আছে।নামায শেষ হোক।

ছয়

নামাজ শেষে আমি আর আরিফুল চলে গেলাম নাস্তিক মহিন চাচার বাড়িতে।
তিনি আমাদের খুব সুন্দরভাবে ওনার ঘরেতে স্বাগতম জানালেন।হাতে একখানা হুঁকা,টানছেন কিছুক্ষণ পরপরই তিনি।

— আচ্ছা বাপু,বলো দ্যাখিনি কালকের কথার উত্তরগুলো।

আমি বললাম,- আপনার প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহ বান্দাকে পোষেন নাকি বান্দা আল্লাহকে পোষেণ।

‘— কেন বলেছি?

— কারন, আমি বলেছিলাম আল্লাহর হক তাই যা আমাদের থেকে ওনার প্রাপ্য।প্রথমত আমি বলবো আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। ওনার শরিক কেউ নেই।আর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ওনার ইবাদতের জন্যই পাঠিয়েছেন।
সুতরাং, মানুষ যে ইবাদত করবে তা হাক্কুল্লাহ এবং মানুষের সকল ইবাদত’ই আল্লাহর প্রাপ্য।
আর আল্লাহ আমাদের কে ওনার অনুপম সৃষ্টির মাধ্যমেই পোষেণ।সুতরাং, এতে এটা প্রামাণিত যে,আমাদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।

— বাহ্।এ যে দেখি পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো হয়ে গেল। একটি বৃত্তে যখন একটি চতুর্ভুজ অন্তর্লিখিত হয়,তখন বাইরের দিকের কোণ আর ভিতরের দিকের কোণ সমান করতে প্রমাণ করতে হয়।তুমি ও যে দেখি একটা উপপাদ্য রচনা করে ফেললে।

ওনার এই কথা শুনে বুঝা গেল তিনি গণিতের বিষয়ে একটু ভালোই জানেন।

;— আমি বললাম, আপনি কিন্তু বৃথা কথা বলছেন এখন।এসব হাবিজাবি বলার মানে কী? যদি বলেন এটা উপপাদ্য, তবে তাই।নাস্তিকদের জন্য এটাই উপপাদ্য। আরিফুল আপনার বাসায় ভাড়া থাকে বলে কিছুই বলছে না।আর এ কারণে যে আমিও কিছু বলবো না এটা আপনার ভূল ধারণা। আপনাকে আমি আগেই বলেছি আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ওনার অনুপম সৃষ্টির মাধ্যমে পোষেণ।সুতরাং, এতে এটা প্রমাণিত যে, আমাদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাই আমরা আল্লাহকে পোষণ করবো এরকম বলাটা আপনার মতো নাস্তিক এবং মুনাফিকদেরকেই মানায়।

(কথাটি বললে নাস্তিক মহিন চাচা আতকে উঠেন,কিন্তু কিছুই বললেন না)

আরিফুল বললো, – আর আল্লাহ নিজের অস্তিত্বে নিজে বিরাজমান।আমরা শুধুমাত্র ওনার ইবাদতের জন্য এসেছি পৃথিবীতে।

— আচ্ছা,তাহলে বলো তো হাক্কুল্লাহ যদি আল্লাহর হক হয়, তবে হাক্কুল ইবাদে তিনি কেন খুশি? ওনিতো নিজের হকে খুশি হচ্ছেনই।মানুষের হক নিয়ে ওনার দেখার তো কিছু নেই।

— এ তো সহজ ব্যাপার।(আরিফুল বললো—)

আমি বললাম,- ধরে নিন আপনার ছোট ভাই একটা বড় মাছ আনলেন।ওনার আলাদা সংসার।আপনি আপনার ছোট ভাই কে যতটুুকু ভালোবাসেন ঠিক ততটুকুই আপনার বোনকে ও ভালোবাসেন।এখন যদি আপনার ভাই সেই বড় মাছের তরকারি শুধু আপনাকে দেয় আর আপনার বোনকে না দেয় তাহলে আপনার কেমন লাগবে?

— খুব খারাপ লাগবে? আমি আমার বোন ছাড়া সেই মাছ মুখেই দেব না।

— কেন?কেন দেবেন না মুখে?

— কারণ আমি তার বড় ভাই হিসেবে সম্মান পেলেই হবে,কিন্তু আমার বোন টা যে আজ পরের ঘরে।তাকে যদি তরকারি না দেয়া হয় আমার খুব খারাপ লাগবে।আমার ভাই আমাকে তরকারি না দিয়ে বরং সম্মান দিলেই তা আমার তরকারি খাওয়ার অপূর্ণতা পূর্ণ করে দেবে।আর যদি বোনকে তরকারি দেয় তাহলেই আমার তরকারি খাওয়া হবে।

— কেন? বোনকে দিলে তো শুধু বোন খুশি হবার কথা। আপনি কেন তাতে খুশি হবেন?

— কারণ, আপনজনকে ছাড়া যে কোনোকিছু গলা দিয়ে ডুকবে না আমার।বোন যে আমার স্নেহের।

—ইডজেক্টলি,আমি এটাই শুনতে চাইছিলাম যদি আপনার বোন আপনার নিজের হয়ে থাকে,তাহলে এটা বুঝতে অবশ্যই আপনার সমস্যা নেই যে প্রত্যেকটা মানুষই আল্লাহর নিজের। তিনি প্রত্যেককেই সমান নজরে দেখতে পান।মানুষ যদি মানুষের হক আদায় করে তাতেই আল্লাহর হক আদায় হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা তাতে খুশি হোন।তিনি বান্দার হকের পূর্ণতার মধ্যেই নিজের হকের অপূর্ণতার পূর্ণতা পান।

— তবে কী নামায, রোজা— ইত্যাদি না পড়লে ও হবে? তুমিই তো বললে তিনি বান্দার হকের পূর্ণতার মধ্যেই নিজের হকের অপূর্ণতার পূর্ণতা পান।

— তাহলে তো আপনার কথায় যেতে হয়।আপনি আগে বলেছিলেন আপনার ভাই আপনার বোনকে মাছের তরকারি দিলে আপনার খাওয়া হবে।আর আপনাকে সম্মান করলেই হবে।

— তো এতে ওটার মিল কী?

— মিল এটাই যে আপনাকে দেওয়া সম্মানটাও কিন্তু আপনার প্রাপ্তি। আর আপনার বোনকে দেওয়া মাছের তরকারি ও কিন্তু আপনার প্রাপ্তি। আপনার সম্মান প্রাপ্তির মতোই নামাজ রোজা ——- ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার প্রাপ্তির সামঞ্জস্যতা।দ্বীনি কায়েমগুলোই হলো আল্লাহ তায়ালার প্রাপ্তি ( হাক্কুল্লাহ)।

আমাদের এরকম কড়া জবাব শুনে নাস্তিক মহিন চাচা খতম।তিনি আর কোনো কথা বললেন না।তিনি আমাদেরকে যতন করে চা কফি দিলেন। আমরা চা কফি খেয়ে চলে এলাম।

আমি আরো চারদিন আরিফুলের বাসায় থেকেছিলাম।আর কোনো দিন নাস্তিক মহিন চাচা এরকম কোনো প্রশ্ন করেননি যা নাস্তিকবাদি।ওনি এখন প্রতিদিন নামায পড়েন এবং অন্য নাস্তিকদেরকে ও ধীরে ধীরে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেন।

“ মুমিন হতে চান?তাহল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নামাযে যান।বেশী বেশী কোরআন তিলাওয়াত করুন,ওয়াক্ত মতো নামায পড়ুন।দেখবেন সকল পাপ আপনার থেকে বহুক্রুশ দূরে থাকবে।”

‘রুহিনুর এবং আবরার গল্প শেষে মাগরিবের নামায পড়তে মসজিদে চলে গেল। ’

৩।সত্যিই কী স্রষ্টা বলতে কেউ আছে, নাকি ভূয়া?

* আমি আবরার।রুহিনুরের খুব কাছের একজন বন্ধু। কলেজ লাইফে এসে তাকে ছাড়া আমার আর কোনো বেস্টফ্রেন্ড হয়নি।আমি আর রুহিনুর আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবো বলে ভাবছিলাম।আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম আমার সাথে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে।প্রথমত সে না করলো,অবশেষে সে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।আমাদের গ্রামটা খুবই মনোরম।আমার এ গ্রাম নিয়ে বলতে কোনোরকম সংকোচবোধ হয় না।ছোটবেলায় এই গ্রামে থেকেছি,খেলেছি,পড়েছি সব মিলিয়ে গ্রামটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম।কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস আমি আজ ঢাকায় থাকি।কেন? শুধুমাত্র পড়ালেখা করবো বলে।ঢাকাতে ক্লাস সেভেনে এসে ভর্তি হই।সেখানেই পড়ালেখা করতে করতে আজ আমি কলেজ জীবনে পদার্পন করেছি।

আমি রুহিনুরের বাসায় গেলাম তার সাথে দেখা করতে।কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না।মনে হয় রুহিনুর টয়লেটে গেছে।আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।খুব সকালেই তার বাসাতে গেলাম।সকাল সাড়ে সাতটা বাজে।আজ কলেজও বন্ধ। আমি আমার বাসাতে আজ রান্না বান্না করিনি। বাসার কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে।সেই রেস্টুরেন্টেই আজ খেয়ে এসেছি।রেস্টুরেন্ট থেকে বরাবর রুহিনুরের বাসাতেই চলে আসলাম।আজ তার সাথেই আড্ডা দিয়ে দিনটা কাটাবো।আমি রুহিনুরের টেবিলের কাছে গেলাম।দেখলাম একটা ডায়েরি রাখা টেবিলের উপর। ডায়েরিতে লেখা “সমসাময়িক তথ্যের ভান্ডার।”আমি ভাবলাম আমার বন্ধু রুহিনুর খুব ইন্টেলিজেন্ট,নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী এই ডায়েরিতে সংরক্ষণ করেছে।ডায়েরিটাতে একবার চোখ বুলাতে হবে।ডায়েরিটা মেলাতেই একটা প্রশ্ন চোখে পড়লো।“ সত্যিই কী স্রষ্টা বলতে কেউ আছে,নাকি ভূয়া?”

শিরোনামটি দেখে খুবই ভালো লাগলো।এটা তো নাস্তিকবাদি প্রশ্ন।দেখতে হচ্ছে তো।

তখন রুহিনুর ও চলে আসলো।সে এসে বললো,কী রে আজ এতো সকাল সকাল এখানে? খাওয়া দাওয়া করেছিস কী? চল্ দুজনে খেয়ে আসি রেস্টুরেন্ট থেকে।একি! তুই ও আজকে রান্না করিস নি? রুহিনুর বললো,না।আজ রাতটা আমার ভালো ঠেকেনি।সারা রাত খুব জ্বর জ্বর ভাব হয়েছে।এখনও শরীরটা কেমন করছে।তাই আর রান্না করিনি।চল্ না দুজনে গিয়ে খেয়ে আসি।

না,তুই গিয়ে খেয়ে আয়।আমি তোর ডায়েরিটা একটু পড়বো।আমি আরো আগেই খেয়ে এসেছি।

রুহিনুর বললো,খুব ক্ষিধে পেয়েছে।তাহলে তুই থাক্ আমি খেয়েই আসি।রুহিনুর চলে গেলে তার ডায়েরিটা পড়তে লাগলাম।রুহিনুর নিজের ট্যুরের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছে।

“এটা এক ট্যুরের গল্প। আমি বাসে করে পাবনায় যাচ্ছিলাম।বাসে দেখা হলো একজন জ্যান্টলম্যানের সাথে।তিনি আমার পাশের সিটেই বসেছেন।আমার সাথে স্বেচ্ছায়ই কথা বলতে চাচ্ছেন তিনি।মহিলা মানুষ তিনি,তাই আমি এতোটা কথা বলতে চাইলাম না।মেয়েটা বুঝতে পারিনি বিবাহিত নাকি অবিবাহিতকারন- তার হাতে কোনো চুড়ি নেই।মুসলমান মেয়েদের চুড়িই সাক্ষী দেয় সে বিবাহিত কি-না।তাই আমার আরও ভয় করছিল ওনার সাথে কথা বলতে।ওনার বাসা ময়মনসিংহ। তিনি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে থাকেন।রাজশাহি ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেন তিনি।তার বিবাহ ও হয়ে গেছে।পাবনাতে বিবাহ হয়েছে।ওনি আমার কাছে একে একে সব খুলে বলতে লাগলেন।আমার সাথে যাচ্ছে নিলু দা।আমার ডিপার্টমেন্টের। সে আমার একপাশেই। নিলু দা খুব বেশী কথা বলতে ভালোবাসে।আমি নিলু দা’ র বাচাল বাচাল অভ্যাসটা খুবই পছন্দ করি।কারণ- সে বাচাল হলেও একদম খাঁটি কথা বলে।নিলু দা আমাকে কানে কানে বললো,কী রে মেয়েটা তোর সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলতে চাইছে তুই তাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না? আমি বললাম, অপরিচিত কারো সাথে কথা বলা বারণ- তুমি জানো না?

নিলু দা বললো, তাহলে তুই এ সিটে আয়? সিম্পল! আমি কথা বলছি মেয়েটার সাথে।

দেখি মেয়েটার কত দম আছে কথা বলার।আমিও তাই করলাম।

নিলু দা কে মাঝের সিটে বসিয়ে আমি তার সিটে চলে গেলাম।বাচাল দুটো কথা বলতে থাকুক।শুনলাম মেয়েটার নাকি একটা ছেলে সন্তান আছে।ছেলে সন্তান থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা তাদের ভাড়া বাসায় চলে আসলো ঢাকায়।ছেলেটা তার দাদা দাদির কাছেই থাকে।তার বাবা ও রাজশাহি ভার্সিটিতেই পড়তো।সেখানেই দুজনের দেখা হয়, এবং রিলেশন করে বিয়ে হয়।এখন ওনি ঢাকাতেই কোনো এক কলেজের প্রফেসর।একই শহরে দুজন,অথচ কারোর সাথে কেউ দেখা করেনি।শুধুমাত্র একটি কারনে।মেয়েটার স্বামী নাস্তিক। সামনের স্টেশনেই তার স্বামী গাড়িতে উঠবে।মেয়েটা আর কী করবে।ছেলেটার কথা ভেবে তাকে নাস্তিকের ঘর করতে হচ্ছে। আর একটা চাকরি ও সে পায়নি।

মেয়েটার স্বামী আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।আমি তখন মেয়েটাকে আপু বলে সম্বোধন করে বললাম,আপনি ওনার কাছে হার মেনে নিলেন? ওনি বললেন, তো কী করবো? মেয়েদের জীবন তো — আপনি আমার জায়গায় থাকলে ঠিক এটাই করতেন।

আমি ওনাকে বললাম আপনার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কী?

— হ্যাঁ, হয়েছে।দুজনে যোগাযোগ করেই গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ওনি সামনের স্টেশনেই গাড়িতে উঠবেন।এই যে ওনার সিট।
মেয়েটার পাশের সিটেই তার স্বামীর সিট।আমি মেয়েটাকে বললাম,আপু যদি রাগ না করেন একটা কথা বলবো?

ওনি বললেন, কী? বলুন?

বলছিলাম আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে আপনার স্বামীকে ঠিক করার।আপনি কী চান,ওনি নিজের ধর্মের দিকে ফিরে আসুক?

নিলু দা বললো,তুই কী বলছিস এটা।চেনা নেই, জানা নেই একজনের সাথে কথা বলে বাড়াবাড়ি হলে? আবার যদি তোর সাথে সে কোন খারাপ আচরন করে?

— করুক না,একজন মানুষকে ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনতে না হয় একটু অসম্মান পেলাম।তিনি আমার কথায় ধর্মের দিকে ফিরে আসুক আর না আসুক আমরা তো ট্রাই করতে পারি।

মেয়েটা আমার কথায় রাজি হয়ে গেল।সে বললো,তবে সাবধান ভাই,কোনো গোলমাল যাতে না হয়।

— ঠিক,আছে।

সামনের স্টেশনেই মেয়েটার স্বামী বাসে উঠলো।ওনি নিজের স্ত্রী’র পাশেই বসলেন।মুখে মাস্ক লাগানো।তাই ওনার মুখ দেখতে পেলাম না।ওনার মাস্ক খুললে নিলু দা তাকে দেখে চিনতে পারলো।

নিলু দা বললো,মাহিন তুই? সে ও বললো নিলয় তুই এখানে কীভাবে? কোথায় গিয়েছিলি?

যাক তাহলে নিলু দা’র পরিচিতই লোকটি।তাহলে তো ওনাকে দস্তুরমত ঠিক করা যাবে।লাফাংগা নাস্তিকদের ঠিক কীভাবে করতে হয় তা আমার জানা আছে।নিলু দা বললো,আমি ঢাকাতে একটা লাইব্রেরি দিয়েছি,সেখানেই কাজ করছি।তো তুই এখানে কী করিস? সে বললো,আমি ঢাকাতে যব করছি।আর সে হলো মঞ্জু।আমার স্ত্রী।

— আমি ওনাকে চেনি।তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।কিন্তু তোর স্ত্রী সেটা জানতাম না।নিলু দা আমাকে দেখিয়ে বললো, সে রুহিনুর।আমার ডিপার্টমেন্টের।আমি আর সে এক কলেজেই পড়ি।

কলেজে তার মতো প্রতিদিন যাই না।বেশীরভাগ লাইব্রেরিতেই সময় কাটাই।বাড়িতে মা আর বোন রয়েছে তাদের ও তো দেখতে হবে।

নিলু দা বললো,তোর তো অবস্থা এখন খুবই স্বচ্ছল।কিন্তু আজকাল দেখছি তুই অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিস।যখন আমরা একসাথে স্কুলে আসতাম যেতাম তখন তো খুব ধর্মের দোহাই দিতিস।আর এখন ইশ্বরে বিশ্বাস করিস না?

নিলু দা’র কথা শুনে বুঝলাম তারা একসাথেই পড়ালেখা করতো।দুজন এক গ্রামেরই।আজ পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিলুদা আমাদের সাথে আবার নতুন করে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে।নিলুদা কোনোভাবে তার বন্ধুর কাছ থেকে বের করে নিল সে নাস্তিক।

সে বললো– তুই কী অদৃশ্য কোনোকিছুতে বিশ্বাস করিস?

নিলু দা বরাবর বলে দিল,আমি এগুলো সম্পর্কে তেমন জানি না।আমাদের রুহিনুর ইসলাম সম্পর্কে খুব ভালো জানে।আমি ইসলাম ধর্মের নই।তবে আমার এই বিশ্বাস আছে ইশ্বর আছেন।

ওনি আমার সাথে কথা বলতে সম্মতি জানালেন।আমাকে বললেন,তুমি কী এখানে গাড়ির ভেতরে চাঁদ দেখতে পাচ্ছ?

— না।

— তুমি কী গাড়ির ভেতর ডাঃ জাফর ইকবালকে দেখতে পাচ্ছ?

— না।

— যেহেতু এখানে গাড়ির ভেতরে চাঁদ নেই,ডাঃ জাফর ইকবাল নেই সেহেতু এটা বিশ্বাস করা যাবে না তারা আছে।তারা এখানে অদৃশ্য।

— হ্যাঁ,ঠিক তাই।

— তুমি কী এখানে স্রষ্টাকে দেখতে পাচ্ছ?

— না

— তাহলে তুমি কীভাবে বিশ্বাস করতে পারো স্রষ্টা আছে? যেহেতু তাকে দেখা যাচ্ছে না,সুতরাং তিনি নেই।

— আপনি কেমনভাবে বুঝতে পারলেন আল্লাহর অস্তিত্ব নেই?

— কারণ তাকে দেখা যায় না।

আচ্ছা আপনার পাশে বসা মহিলা আপনার কী হয়?

— কেন,স্ত্রী হয়।

— তাহলে আপনি ধরে নিন, আপনার স্ত্রী’র মেন্টালিটিতে সমস্যা।আপনি কী জানেন আপনার স্ত্রী সত্যিই মেন্টালিটিতে ভূগছে নাকি ভূগছে না?

— এটা আবার কোন ধরনের প্রশ্ন? স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা না থাকার সাথে এটার কী সম্পর্ক?

— সম্পর্ক আছে বলেই তো বলছি।আপনি কী আদৌ এটা বলতে পারবেন, আপনার স্ত্রী মেন্টাল ক্রাইসেস কেমন? সে মেন্টাল সাজার অভিনয় করছে নাকি – নয়।

— না,সে তো মিথ্যে বলবে না।আর তার অভিনয় দেখলেই তো বুঝবো “Is he crazy or good, is he losing mentality?”

— তাই যদি হয়,এটা তো কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই তাই তো?

— হ্যাঁ, তাই।

— তাহলে,আপনি কেমনভাবে বিশ্বাস করবেন যে, সে আপনাকে সব সত্যি কথা বলছে?

— অবশ্যই বুঝবো,কারণ সে আমাকে ভালোবাসে।

এই ব্যাখ্যা তার কাছে খুবই ক্রিটিকাল ছিল।এবার ওনাকে সমীকরণ দিয়ে বুঝাতে হবে। আমি ওনাকে বললাম–

আপনি বলেছেন আপনার স্ত্রী মেন্টাল বা আনমেন্টাল ক্রাইসেস এটা বুঝবেন কেবলমাত্র তার প্রতি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।……………………… (১)

এটা হলো সমীকরণ (১)। কারণ এতে বাস্তবসম্মত কোনো প্রমান নেই।

আপনি ওনাকে বিশ্বাস করলেন শুধুমাত্র সে আপনাকে ভালোবাসে বলে।আপনি তো এটা আদৌ জানেন না মেয়েটা আপনাকে ভালোবাসে কি-না।এটাও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই। …………………………(২)

এটা হলো সমীকরণ (২)।কারণ এতেও বাস্তবসম্মত কোনো মিল নেই।

আমি যদি বলি সমীকরণ (১) অনুসারে।আপনি আপনার স্ত্রী’র মেন্টালিটি বা আনমেন্টালিটি বিশ্বাস করলেন কেবলমাত্র তার প্রতি বিশ্বাসের উপর। কিন্তু প্রশ্নটাই হচ্ছে বিশ্বাসের।

মাহিন ভাই তখন একটা ঢোক গিললো।সে এটাই ভাবছে, যেখানে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন সেখানে বিশ্বাস দিয়েই সবকিছু? সে আমাকে আরেকটা যুক্তির সম্মুখে নিলো।সে বললো,না।আমি তাকে বিশ্বাস করবো কীভাবে। যেখানে আমি এটাই বিশ্বাস করি না, স্রষ্টা আছে কি- না সেখানে তো সে তুচ্ছ।

আমি বললাম,তাহলে কী ধরে নেব আমার নির্ণীত সমীকরণ (১) সঠিক।আর আপনার ধারণা ভূল?

সে বললো,না।আমি সেটা তো বলিনি।তার মেন্টালিটি বুঝার আরেকটা উপায় আছে।আমি হসপিটালে ডক্টরের কাছ থেকে চিকিৎসা করে এটা জানতে পরি।

— যেমন……………?

— যেমন,ওনি চিকিৎসা করে দেখবেন তার মাথা ঠিক আছে নাকি ঠিক নেই। তাহলেই তো বুঝতে পারবো আমার ধারণা কতটুকু সত্য।

আমি খুব হাসতে লাগলাম মাহিন ভাইয়ের কথা শুনে।সে কী বলছে সে’ ই জানে।আমি তখন তাকে আরেকটা যুক্তির দিকে টেনে নিলাম।এবার আরেকটা সমীকরণ টানতে হবে।এখন আধুনিক যুগ।তথ্য প্রযুক্তি কি ই না করতে পারে।আজকাল তথ্য প্রযুক্তির কাছে মানুষ খুব সহজেই হেরে যায়।অবশ্য মাহিন ভাই আমার কথার ঘোরপাক বুঝতে পারছিল না।তখন বাসে একজন তার কোনো এক ঘনিষ্ঠ কাউকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছিল,ডক্টর কে বলে দাও – প্রয়োজন হয় দশ হাজার টাকা মাইনে দেব,তবুও যেন রিপোর্টটা ঘুরিয়ে দেয়।আমি মাহিন ভাইকে বললাম,শুনেছেন লোকটা কী বলেছে? ফোন দিয়েই কাজ হয়ে গেল।

আপনার স্ত্রী যদি আগে থেকেই ডক্টরকে মাইনে দিয়ে বলে যেন রিপোর্ট মিথ্যা দেয়,তাহলে কেমন হবে?…………………(৩)

হয়ে গেল সমীকরণ (৩)।

মাহিন ভাই বললো,– হ্যাঁ,এটা তো আগে ভেবে দেখিনি।

এবার আমার তৃতীয় সমীকরণ কাজে লাগলো।আর প্রথম সমীকরণ তো এর সূত্র ধরেই ঠিক।এবার রইলো দ্বিতীয় সমীকরণ। সেটাও যেহেতু বিশ্বাসের উপড়েই নির্ভরশীল, তাই এটাও সঠিক।মাহিন ভাই আর কিছু বললেন না।তিনি কিছুক্ষণ নিরব রইলেন।আমি এটা অবশ্য বুঝতে পারলাম মাহিন ভাই এতো সহজে হেরে যাওয়ার লোক নন।মনে মনে না জানি কোন ফন্দি এঁকে ফেললেন।

আমাকে বলে উঠলেন,- রুহিনুর তুমি তো বলছো স্রষ্টা আছে,আর আমি বলছি নেই – দুটোই তো বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। তাহলে তুমি তোমার বিশ্বাস নিয়ে থাকো আর আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে থাকি তাহলেই তো হয়ে যায়।এবার আমি ওনাকে কাজের কথাটা বলার সুযোগ পেলাম।ওনাকে বললাম, আপনি তো বিশ্বাস করেন স্রষ্টা বলতে কেউ নেই।আর এটা তো আপনার বিশ্বাস। আর আমি বিশ্বাস করি ওনি আছেন। এটাও একটা বিশ্বাস। আপনি তো দুটোকেই বিশ্বাস বলেই সমর্থন করছেন তাই না?

— হ্যাঁ,যেহেতু দুজনেই বিশ্বাস বিষয়টার মাধ্যমেই কথা বলছি – ‘Then there can be no more questions. ’

— “Of course there can be questions. The question is not only based on faith, but the question is based on belief in God. You have to understand it. Isn’t it a shocking question?”

তবুও হেরে যাবেন না মাহিন ভাই।নিজের লালিত পালিত নাস্তিকতাকে জিতানোই তার নেশা।এবার ওনি আমাকে আরেক চক্করে ফেললেন। ওনি বোধহয় এটা জানেন না,আমি রুহিনুর।

মাহিন ভাই আমাকে বললেন,- রুহিনুর তুমি কী এক স্রষ্টায় বিশ্বাসী? হঠাৎ মাহিন ভাই ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন করলো।শুনে খুব বিস্মিত হলাম।এতো সহজ সরল প্রাঞ্জলভাবে এই প্রশ্নটাই আমায় করতে হবে তাকে?এই ভ্রাতা কলেজের টিচার, নাকি মাথায় গোবর ভরা গবেট কে জানে? আমি ওনাকে বলে দিলাম আমি এক আল্লাতে বিশ্বাসী। ওনি একটু হাসলেন।তিনিই ভেল্কিবাজিতে পরলেন নাকি আমি ভেল্কিবাজিতে পড়লাম।ওনার হাবাগোবা প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারলাম না।মাহিন ভাই আবার আরেকটা প্রশ্ন করলো।সে বললো,আল্লাহ এখন কোথায় আছেন? তিনি কী করছেন তা কী তুমি জানো?
আমি এবার বুঝতে পারলাম এই নাস্তিক মাহিন ভাইয়ের কথা। সে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে।কিন্তু তা যে পসিবল নয়,এই রুহিনুর হারতে জানে না।আগে তাকে খুব আপনি আপনি করে খুব বেশী ফস দিয়েছি বলে মনে হলো।এই দস্যিমাস লোকটাকে তার মতো করেই বুঝাতে হবে।আমিও তার সাথে তেমনভাবেই কথা বললাম।মুগুরবিহীন কুকুর কী আর শিখতে জানে কিছু? মাহিন ভাইয়ের দুটো প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন :- আল্লাহ এখন কোথায় আছেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন:- তিনি এখন কী করছেন।

ভাগ্য ভালো আমার কাছে প্রমাণ করার যাবতীয় তথ্য ছিল।আমার কাছে ম্যাগনেটের কয়েকটা পিঁপড়ে ছিল।এগুলো রিমোর্ট দিয়ে চলে।আমি এগুলো আমার ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম। পিঁপড়েগুলো খুব বড় ধরনের। তবে এগুলো রোবটিং তো তাই এর হুল লাগলে অনেকক্ষণ ব্যাথা থাকে।প্রায় দেড় দু ঘন্টা ব্যাথা করে।

কী আর করবো।একটু ব্যাথা না হয় মাহিন ভাই সহ্যই করলো।তবে এর ঔষধও আছে,দু মিনিটেই ব্যাথা দূর করার।কিন্তু ঔষধ দিলে তো সবই শেষ।আমি আমার রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চুপি চুপি পিঁপড়েগুলো মাহিন ভাইয়ের ঘাড়ের দিকে দিলাম।

তাকে বললাম,–মাহিন ভাই,আগে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাক।তুমি বলেছিলে ‘ স্রষ্টা এখন কী করছেন? ’

আমি যতটুকু জানি – স্রষ্টা এখন ওনার সৃষ্টি পিঁপড়ের মাধ্যমে তোমাকে আক্রমণ করতে বলেছেন।

– হা-হা-হা,মাহিন ভাই হাঁসতে লাগলো।তারই সাথে সাথে নিলু দা ও হাঁসতে লাগলো।

এটাও আবার হয় নাকি এটাই বোধহয় নিলু দা’ র মস্তিষ্কে বিরিয়ানি গিনিপিগ পাকাচ্ছে।ওদিকে মাহিন ভাই হাঁসতে হাঁসতে ও মা- গো, জ্বলে গেল জ্বলে গেল বলে ঘাড় হাত দিতেই আমি পিঁপড়েগুলো একটু সরিয়ে নিলাম।আমি বললাম – কী হলো,মাহিন ভাই? আমার কথা কী তাহলে,সত্যি হলো?

মাহিন ভাই বললো,হ্যাঁ বুঝেছি।বুঝেছি ভাই,আর বুঝাতে হবে না।আমার আরেক প্রশ্নের উত্তর রইলো যে।আমি আবার কিছুটা হাসলাম।যে এইমাত্র ব্যাথায় ও মা- গো বলে চিৎকার করলো,সে কি- না হার মানতে রাজি নয়? কী আর করবো।তাকে তো আমায় যেকোনোভাবে বুঝাতে হবে।তখন আমাদের গাড়িতে বসে থাকা ( আগে যিনি ফোনে ডক্টরের সাথে কথা বললেন) লোকটির ফোন আসলো। তিনি হেসে হেসে বললেন।মাশাল্লাহ, মেয়ে হয়েছে? আমি কয়েকদিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুরের ভিসায় চলে আসছি।

আমি মাহিন ভাইকে বললাম, ওনি কী বলেছেন শুনেছ?

— হ্যাঁ,শুনেছি।ওনার কথা শুনে আমাদের কাজ কী?

আমি বললাম, ওনার কাছ থেকে কিছু জেনে নাও।ওনার ওয়াইফ কোথায় থাকেন? ওনার যে মেয়ে সন্তান হয়েছে,কে দিয়েছে?

মাহিন ভাই ওনার কাছ থেকে জানতে পারলো,ওনার স্ত্রী সিঙ্গাপুর থাকে।ওনি বাংলাদেশে এলেন কয়েকদিন হলো।এসেছেন নিজের মা বাবা কে সেখানে নিয়ে যেতে।সিঙ্গাপুর তার ভাই, বউ এবং ভাবি থাকে।মা বাবাকে নিয়ে যাবে।তার মেয়ে হলো বলে! মাহিন ভাই বললো,তো আপনার মেয়ে কে দিয়েছে?

ওনি বললেন,আল্লাহ তায়ালা।ওনি তো সবখানে আছেন।ওনি ছাড়া কী এগুলো সম্ভব?

আমি মাহিন ভাইকে বললাম,এদিকে আল্লাহ তোমার গায়ে পিঁপড়ে দিলেন।ওদিকে ওনার মেয়ে। আরও না জানি কাকে কী দিয়েছেন।তাহলে তো বুঝতেই পারছেন তিনি এখন কী করছেন? আর আপনার প্রথম প্রশ্নের সমাধান পেলেন তো? আপনি বলেছিলেন “স্রষ্টা এখন কোথায় আছেন? ” তিনি মহাবিশ্ব, পৃথিবীর সবখানেই আছেন।

মাহিন ভাই একটু কুন্ঠিত হলো,যা ওনাকে দেখে মনে হলো।সে আমাকে বললো,আল্লাহ যে এক এটার প্রমাণ কী? আমি তো তোমার কথার উপরে ভিত্তি করে এটা বুঝতে পারবো না,ওনি যে এক।আমি তখন পবিত্র আল কোরআনের কয়েকখানা আয়াত ওনাকে বললাম–

وَأَنَّهُ تَعَالَىٰ جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلَا وَلَدًا

অর্থ–এবং আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার উর্ধ্বে। তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোন সন্তান নেই।( সূরা জ্বিন, আয়াত-৩)

قُلۡ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ​ [ ۚ‏١] اَللّٰهُ ا صَّمَدُ​ ۚ‏ [ ٢] لَمۡ يَلِدۡ   ۙ وَلَمۡ يُوۡلَدۡ ۙ‏[ ٣]
وَلَمۡ يَكُنۡ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ‏[ ٤]
অর্থ – বল, তিনি আল্লাহ, এক অদ্বিতীয়।আল্লাহ কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন, সবই তাঁর মুখাপেক্ষী।তিনি কাউকে জন্ম দেন না, আর তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।তাঁর সমকক্ষ কেউ নয়।( সূরা ইখলাস, আয়াত ১-৪)

মাহিন ভাই বললো,যেখানে আমি এখনো স্রষ্টাকেই বিশ্বাস করি না সেখানে আল কোরআন কীভাবে বিশ্বাস করবো? সকল বানোয়াট উত্তর আমার কাছে প্রদর্শন করছো কেন?

আমি আর কোনো উপায় পেলাম না।তবে কী আমার সকল পরিশ্রম বৃথা হয়ে গেল? মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম।আমি যতটা কষ্ট পেলাম, না জানি মাহিন ভাইয়ের স্ত্রী তার চেয়ে কত গুণ বেশী কষ্ট পাচ্ছে।সে কীভাবে সারাজীবন তার নাস্তিক স্বামীর ঘর করবে? একজন মুসলিম নারী কী তবে – নাস্তিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বেঁচে থাকবে? তাহলে কী এভাবে ইসলাম ও নৈতিকতা মানুষের ( নাস্তিকদের) কাছে হেরে গিয়ে একদিন নিমেষ হয়ে যাবে?

আমাকে নানামুখী প্রশ্ন যেন খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিলো।আমি মাহিন ভাইয়ের স্ত্রী’ র দিকে থাকালাম।চেয়ে দেখলাম এক অতৃপ্ত বুক যেন তার মাঝে তৃপ্তি অর্জন করতে পারেনি।যদি স্বাপ্নিক রংয়ের আর এতটুকু আলোছায়া পড়তো তার বুকে।আমি খুব আফসোস করলাম।অবশেষে কি-না এই রুহিনুর নাস্তিকের কাছে হেরে গেল? মাথা নিচু করে বসে রইলাম।আজকের মতো আমি আর কোনোদিন এমন গো হারানো হারিনি।হঠাৎ আমার মাথায় সর্বশেষ প্ল্যান আসলো।এই প্ল্যানটা যেন সর্বশেষ সূত্র। এই সূত্র যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে।আমি মাহিন ভাইয়ের দিকে একটু থাকালাম।দেখলাম, তার মুখে কেবলি চঞ্চলতা আর জিতে যাওয়ার চমক খেলানেলা।আমি বললাম, মাহিন ভাই – আমার একটা কথা আছে।

সে বললো,- কী?

— তুমি আমাকে বলেছিলে আল্লাহ এক প্রমাণ করতে, তাহলেই তুমি আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করবে।

— শিওর।তোমার শেষ সুযোগ আছে।

— তুমি আমাকে ১০০ থেকে উল্ঠো করে সব সংখ্যা গুণে আসতে পারবে?

— পারবো,কেন নয়?১০০,৯৯,৯৮,৯৭…………………৭,৬,৫,৪,৩,২,১।

আমি বুঝলাম, এবার আমার প্ল্যান সাকসেসফুল। কী হলো মাহিন ভাই,আর গুণছো না যে?

সে বললো,আর সংখ্যা থাকলে তো গুণবো? ১ ই সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংখ্যা।

আমি তখন বললাম, এবার তো বুঝতে পারলে ১ ই সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম। তার চেয়ে ছোট আর কোনো সংখ্যা নেই? তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা ও এক।ওনার কোন শরিক নেই।তিনি এক ও অদ্বিতীয়। ”( সমসাময়িক তথ্যের ভান্ডার,রুহিনুর)

আমি রুহিনুরের ডায়েরিটা পড়ে শেষ করলাম। তখন রুহিনুর ও চলে আসলো রেস্টুরেন্ট থেকে।এভাবে কেউ এতো ব্যাখ্যা দিয়ে নাস্তিক কে বুঝিয়ে দিল, আমার মনটা উল্লাসে ভরে গেল।সত্যিই আজ রুহিনুরের ডায়েরিটা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না আমার বন্ধু রুহিনুর কতোটা যুক্তিবাদী। আর এই গল্পটাতে উল্লেখিত নিলু দা’র পুরো নাম নিলয়।আমরা তাকে নিলু দা বলে ডাকি।সে আমাদের থেকে চার ক্লাস সিনিয়র ছিল।কোনো এক দায়বদ্ধতার কারণে সে আজ আমাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাসমিট।চার বছর সে পড়ালেখা করেনি।আর আমাদের চেয়ে সে বয়সে ও অনেক বড়।সে সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাই আমরা তাকে নিলু দা বল ডাকি।

রুহিনুর রেস্টুরেন্ট থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,— কী রে,তোর পড়া শেষ হলো? আজকে তো আমাদের আড্ডা দেবার কথা।আর আমি ভাবছি, দুজনে শপিং করতে যাবো।কাল তোদের বাড়ি দুজনে এক রঙয়ের পাঞ্জাবি পায়জামা আর উত্তরিয় পরে যাবো।আমি কখনো রাজশাহি যাইনি।ভাবছি তোদের বাড়ি গেলে রাজশাহী ভার্সিটি ট্যুর করে আসবো।

রুহিনুর এতোই কথা বলতে লাগলো যার কারনে আমার কোনোকিছু বলার সুযোগই নেই। আমার ব্রিলিয়ান্ট গর্জিয়াস ফ্রেন্ডটা অনেক সময় অনেক রুপে আসে।এখন দেখি বাচাল হয়ে গেল।একটু আগে যার ডায়েরিতে পড়লাম নিলু দা আর মাহিন ভাইয়ের স্ত্রী বাচাল,এখন দেখি সে নিজেই বাচাল।আমি কোনো কথা না বলে,রুহিনুরের মুখ চেপে ধরলাম।এই বাচাল ফ্রেন্ড, চুপ।তার সাথে ইংরাজিতে কথা বলার চেষ্টা করলাম।

“Too much is not good. Please give me a chance to say something. I read your diary and I saw such a wonderful talent in you, I read a story that made me want to know more. Or did he turn around and remain the same?”

— ;He can not be an atheist! He told me, – ‘If you had not opened my blind eyes today, I would have been drowning in darkness. Thank you friendly little brother. I and Nilu bro reached their Pabna. Nilu bro I went to Mahin brother’s house. I understood him a lot in these few days. .He quickly asked me to get him a book on the rules of Islam. What other book should I give? I came to say one last thing – “Just as Allah is the creator of everything, so is Al-Qur’an the source of all knowledge.”

আমি রুহিনুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম “ নৌন প্রবলেম ইসলাম ইজ্ আ ওয়ার্ক অব্ প্রসপারিটি।”

রুহিনুর হাঁসতে হাঁসতে বললো;-“ Problem-free Islam is a work of prosperity.”

৪।কোরআন আল্লাহর বাণী, নাকি মোহাম্মদের?

* এত তোরজোর কেন?বৃষ্টি কমলেই যাওয়া হবে। উদ্দেশ্য সিলেটে যাওয়ার।সিলেটে অনেক বিখ্যাত জায়গা আছে।সেখানেই যাচ্ছি আমরা।আমি তো সবসময় রুহিনুরের ছায়াসঙ্গী হয়েই থাকি।সে আমাকে কখনো কখনো বলেই দেয়,– সত্যিই রে আবরার,তোর মতো একজন বন্ধু পেয়ে আমি খুবই গর্বিত।আমিও মনে মনে ভাবতে থাকি ঢাকা পড়ালেখা করতে এসেছি সেই রাজশাহী থেকে আর রুহিনুর এসেছে মৌলভীবাজার জেলা থেকে, কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে কতোটা বন্ধুত্ব।

আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের বন্ধুত্ব এরকমই অটুট রাখেন।আমরা যাচ্ছি রুহিনুরের বিভাগ সিলেট বিভাগে।উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলা।সেখানে অনেক বিখ্যাত লোকেদের জন্ম।তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লোকগানের কবিগণ।যেমন- হাসন রাজা,রাধারমন,দুর্বিন শাহ,শাহ আব্দুল করিম সহ অনেকে।আমি এদের গানের প্রতি খুবই জাগ্রত।কোথাও ট্যুরে গেলেই তাদের কোনো না কোনো গানে আমিই সুর দিই।তবে বাজনা দিয়ে কখনোই গাই না।আমরা মাত্র পাঁচজন আসলাম ট্যুর করতে।অন্য কোথাও যখন যেতাম তখন পুরো ডিপার্টমেন্ট টিম চলে যেতাম।মন্টু একটু নরম স্বভাবের ছেলে।সে আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছিল না।তার নাকি নৌকায় ভ্রমণ করতে ভয় করে।বিশেষ করে নদীতে যখন লঞ্চ চলে তখন খুব বেশীই ভয় করে।আমরা মন্টুকে জোড় করে আনলাম।বাকি রিলো মাহবুব আর মহিবুর।এই আমরা পঞ্চপান্ডব।আমরা যেন কোনো এক স্থানে গোয়েন্দাগিরিতে যাচ্ছি।রুহিনুর বললো,তোরা কী তিন গোয়েন্দা সিরিজ পড়েছিস? আমি পড়েছি।আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগলো ভুূতুরে সুরঙ্গের বুড়ো লোকটার ডায়ালগ।সেই বুড়ো,নাম ডিন মারটিন।বুড়ো লোক, অথচ সবাইকে বললো,তার নাম ধরে ডাকে যেন সবাই।ডিন বলে।আমি ও সিরিজটা পড়েছি।তবে এই কথাটা আমার তেমন ফলো নেই।রুহিনুর এতো অল্প একটা কথায় চোখ বুলিয়ে রাখলো? কী গর্জিয়াস! রুহিনুর অবশ্য এটা বুঝাতে এই কথাটা উল্লেখ করলো।মাহবুব আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোন কথাটা।ঐ যে বন্ধুত্ব।বৃদ্ধ লোক ও বন্ধু হতে চায়।সবাই একটু হা-হা-হা-হা করে প্রান খুলে হেসে নিলাম।

আমরা সবাই ঢাকার ডেমরা ঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম।সবসময়ই গাড়িতে যাওয়া আসা করি।আমরা কেউই এভাবে লঞ্চে করে প্রথমবারের মতো কোথাও যাচ্ছি।রুহিনুর টান দিল তার পছন্দের গানে।হাসন রাজার গান।এটা রুহিনের প্রিয় গান হয়ে গেছে।“ আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে”।এদিকে বৃষ্টি ও থামছে না।কখন যে লঞ্চ ছাড়বে? নদীতে জোয়ার উঠলে তো সর্বনাশ হবে।আমার জোয়ার খুবই ভয় করে।আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি না থামলে ও বাতাস কমেছে।মাঝি কে রুহিনুর ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কখন লঞ্চ ছাড়বে।মাঝি বললো সাড়ে সাতটায়।সকাল ছয়টায় এসেছিলাম আমরা।এখন সাতটা পনেরো বাজে। এক ঘন্টা পনেরো মিনিট ধরে আমরা অপেক্ষা করতেছি।

রুহিনুর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,তোরা বস্ আমি আসতেছি।এই বৃষ্টিতে ভিজেই রুহিনুর ডাঙায় উঠলো।সামনে ছোট একটা চা কফির স্টল।পাঁচটা কফির অর্ডার দিল।স্টলের ছ্যাকরা পাঁচটা গরম কফি নিয়ে আসলো।আর রুহিনুর সাথে করে নিয়ে আসলো পাঁচটি পানির বোতল এবং বড় দুটি বিস্কুটের প্যাকেট।অনেক দূরের পাড়ি।পথে ক্ষিধে লাগলে?
আমি এখন কেবল কফিই খেলাম।তারাও কফিই খেল।কিন্তু রুহিনুর পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে নিল।এই বৃষ্টিতে তার তৃষ্ণা লেগেছে।আমরা সবাই লঞ্চের নীচতলায় বসলাম।সেখানে চেয়ারের ব্যবস্থা ও আছে।
আমরা সবাই ভলোই আনন্দ উপভোগ করেছি এতক্ষণ। হঠাৎ আমার পাশের চেয়ারে একজন ভদ্রলোক বসলেন।ওনার বয়স খুব কমও হবে না আবার খুব বেশী ও হবে না।মোটামুটি ৩৮-৪০ বছর হবে।চোখে চেইনটানা চশমা।ওনার দিকে রুহিন পুলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।যেন এই ভদ্রলোক তার কতদিনের চেনা।পরিচিত কেউ হলে তো তার লাফিয়ে উঠার কথা।কিন্তু না,সে ওনার দিকে খুব গভীরভাবে তাকিয়ে রইলো।লোকটার মাথায় বড় টুপি,পড়নে একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা। ভদ্রলোক রুহিনুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

তিনি রুহিনুর কে কিছু বলতে ও পারছেন না,আবার তার সামন থেকে সরে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে ও পারছেন না।আর কোথাও কোনো সিট নেই লঞ্চে।মানুষ খুব বেশী হয়ে গেছে।রুহিনুর লঞ্চে কোনোরকমের কথা বললো না। তার মধ্যে কী এমন দুশ্চিন্তা ডুকেছে এটা সে জানে আর আল্লাহ জানে।মাহবুব রুহিনকে জিজ্ঞেস করেছে তার কী হয়েছে,কিন্তু রুহিন তার কথায় কর্ণপাত করলোই না।সবাই খুব ভারী মুখ করে বসে রইলো।যার জন্য সবার কুতুকুতে মন উল্লাসে ভরপুর হয়ে থাকে তারই আজ মন খারাপ।তাহলে অন্য কারোর মন কীভাবে ভালো থাকতে পারে? আমি ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করলাম ওনি রুহিনুর কে চেনেন কি-না,কিন্তু তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলেন না।ওনি আমার হাতে পায়ে ধরাটাই বুঝি বাকি রাখলেন।বলছেন,ভাইজান আমাকে বিশ্বাস করুন আমি ভালো হয়ে গেছি।কী ভালো হয়ে গেছি ভালো হয়ে গেছি করছেন ওনি, আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। মন্টু বললো,আপনাকে কেউ কোনোকিছু করেছে কি-না তা জিজ্ঞেস করেছে কী? বোধহয় পাগল,ওনার কথা ছেড়ে দে।আমরা মন্টুর কথা শুনে লোকটাকে আর জেরা করলাম না।রুহিনুরও অপলক দৃষ্টিতে ব্যক্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।সে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো,তার চোখের পানি আপনা আপনি বেয়ে পড়তে লাগলো।আমার বড্ড মায়া হলো তার দিকে তাকিয়ে।মনে হচ্ছে যেন রুহিনুরের গলায় ধরে কেঁদে কেঁদে তার কান্নায় শামিল হই।কিন্তু তাও করলাম না।

আবার ভাবলাম – এই লোকটা বোধহয় রুহিনুরের কোনো এক নিকটাত্মীয় হবে,যে আজ পাগল হয়ে গেছে।আর রুহিনুর তাকে দেখে ব্যাকুল মনে চেয়ে রইলো এবং তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো।কিন্তু আজ যে রুহিনুর কোনো কথাই বলছে না।আমি তাকে অনেক জোড় করেছি,সে যেন আমাদের সাথে কথা বলে।কিন্তু তার সাথে অনেক মটিবাইট কথা বলেও কোনো সায় পেলাম না।আমরা চারজন চেয়ারেই শুয়ে রইলাম।লক্ষ্য করলাম রুহিনুর ও শুয়ে রয়েছে।এদিকে আমার পাশের ভদ্রলোক ও ঘুমিয়ে রয়েছেন।

কিছুক্ষণ পর লঞ্চ কোনো এক ঘাটে ফেরায়েছে বলে শুনলাম। গোয়াইনঘাট লঞ্চঘাটে এসেছি আমরা।ভদ্রলোকটি উঠে বেরিয়ে গেলেন।আমরা সঠিক জানতাম না, সিলেট গোয়াইনঘাট এটা।লোকটি বাইরে থেকে আবার এসে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,– আপনারা এখানে নামবেন না? আমি ওনার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কোন ঘাট।ওনি বললেন – সিলেট গোয়াইনঘাট এর লঞ্চ ঘাট।আমি রুহিনুর কে ঘুম থেকে জাগালাম।প্রায় নয় ঘন্টা জার্নি করেছি।এর মধ্যে পুরোটা বেলা রুহিনুর বিষন্নতা আর ঘুমের মধ্যেই কাটিয়েছে।

রুহিন বাইরের দিকে চেয়ে দেখলো বোর্ডে লেখা গোয়াইনঘাট লঞ্চ ঘাট।এদিকে সব যাত্রিরা নেমে গেছে।যারা সিলেটে আসবে বলে লঞ্চে উঠেছে।রুহিনুর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত সবাইকে জাগালো।এই চল্ চল্ লঞ্চ ভাসিয়ে দিচ্ছে। আমরা ঘাট হারাবো নচেত।সবাই লাফাঙ্গা হয়ে ব্যাগ নিয়ে এক ছুটে লঞ্চের আগায় গেলাম।লঞ্চ ভাসিয়ে দিল।ওই ভদ্রলোক আমাদের বলে চলে গেলেন।অনেক কাকুতি মিনতি করে লঞ্চ আবার ঘাটে লাগালাম আমরা।ভাগ্যিস সারেং খুব ভালো মানুষ,নইলে কী আর এ ঘাটে উঠতে পারতাম।রুহিনটাও নিজের এলাকায় যাবে,অথচ ঘুমিয়ে ছিল লঞ্চে।রুহিনুর এতক্ষণে কথা বললো আমাদের সাথে। সামনেই বাস ইস্টেশন। সবাই বাসে উঠলাম।মৌলভীবাজার এর উদ্দেশ্যে।তখন রুহিনুর খুব উৎসাহিত। আমরা তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। আমি রুহিনুরকে জিজ্ঞেস করলাম, লঞ্চে এরকম করার কারণ কী? সে বললো,তোরা যখন জানতে চাস- শুন তবে–

“ আমি গত বছর কুরবানির ঈদে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম।গ্রামের বাড়িতে এসে শুনতে পেলাম,গ্রামে নাকি মিটিং হচ্ছে। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের মিটিং।আম্মা বললেন – কীসের মিটিং আবার, কোন মোল্লা নাকি বলছে কোরআন আল্লাহর বাণী না,কোরআন মোহাম্মদের বাণী।তাই সেখানে তার উপযুক্ত বিচার হবে।এই বেটার গলায় জুতোর মালা দেওয়া হবে।

সে কী? এটা কী বলছো আম্মা? একজন মানুষ না জেনে না বুঝে না হয় নাস্তিকবাদি একটা প্রশ্ন করেই নিল,কিন্তু তাই বলে এভাবে তাকে জুতোর মালা গলায় দেওয়ানো টা কী ঠিক?

আম্মা বললেন,হায়রে আমার উড়নচণ্ডী ছেলে।তুই থাকিস শহরে,এসব গ্রামের প্যাঁচ কী আর বুঝবি? গ্রামের লোক কী জানে,আর তারা ওই বেটাকে কী শিখাবে? দিক,তার চেয়ে বরং জুতোর মালা দিক।জুতোর মালা গলে নিয়ে ঘুরলে খুব লজ্জা পাবে। আর এই লজ্জা সারাজীবন মনে রাখবে।

আমার আম্মার ওসব কথা আর শুনতে ভালো লাগছিল না।আমি আম্মাকে না বলেই বিচারের সামনে চলে গেলাম।সেখানে আমার পুরনো এক বন্ধু বৃদেশের সাথে দেখা হয়।সে বললো,কোনো একজন যুক্তিবাদি মুন্সিসাহেবের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে।আমি বললাম,- সেটা আবার কোন জায়গায়? সে বললো,তা তো জানি না।তবে এবারের বিচারে খুব কড়াকড়ি আছে।আমি তখন মানুষের ভিড়ের কারনে ডুকতে পারলাম না,এবং বুঝতেও পারলাম না – বিচারে কী রায় দেওয়া হচ্ছে।
খুব আক্ষেপ হচ্ছিলো দেখার।আমি বৃদেশকে বললাম যেন আমাকে একটু ফাঁক খুঁজে দেয় সামনে যাওয়ার।সে আমাকে একটা ঠাঁই খুজে দিল।ভিতরে গেলে দেখতে পেলাম, একজন কম বয়সী মোল্লা।তিনি কে?

যার সাথে আমাদের লঞ্চে দেখা হলো।কিছুক্ষণ পর তার ছাড় আসলো।সবাই বললো কালকে আবার বসতে হবে।তবে এই মোল্লা যেন গেরাম ছেড়ে পালিয়ে না যায়।কয়কজনকে পাহারাদার হিসেবে রাখতে হবে।দুজনকে দেওয়া হলো তার সাথে মসজিদকোটায় থাকার জন্য।সেই দুজনের মধ্যে আমি একজন।যদিও আম্মা আমাকে না করলো পাহারা দিতে।আমি স্বেচ্ছায় আসলাম।কারণ একজন লোকও রাজি হচ্ছিল না পাহারা দিতে।একজন রাজি হয়েছে।তার নাম সাহিদুর।সে এসে আমাকে বিনয় করলো বলেই আমিও তাদের সাথে থাকতে রাজি হলাম। সাহিদুর আমাদের গাঁয়েরই,সম্পর্কে ভাই হয়।ঐ মোল্লা একদিকে,আমি একদিকে আর সাহিদুর ভাই মধ্যে শুইয়েছে।সেখানে ঘটে যায় এক বিরল ঘটনা। আমি এটা আগে জানতাম না,এই মোল্লা একজন নাস্তিক। অবশ্য তার দেওয়া প্রশ্ন শুনে বুঝেছিলাম।আমার জানামতে সাহিদুর ভাই একজন ভালো লোক।ছিঃ,এরকম চরিত্রের মানুষ গ্রামেও আছে? আমি তো ভেবেছিলাম শুধু শহরেই আছে।তারা দুজন সমকামী। নাস্তিক মোল্লা আর সাহিদুরের সমকামীতায় আমি অতিষ্ট প্রায়।তারা ভেবেই নিল আমি ঘুমিয়ে আছি।আমি তখন কাশি দিলাম।তখন দুজনেই উঠে গেল।তারা আমাকে খুব বিনয় করতে লাগলো এটা যেন কাউকে না বলি।আমি তখন খুব বিরক্তিবোধ করলাম।একে তো অন্যায় করেছে,ধর্মবিরোধী কাজ করেছে,আবার আমাকে বিনয় করছে।
তখন রাত পৌনে চারটে বাজে।ফজরের আযান পড়বে আর কিছুক্ষণ পর। আমি সেদিকে না থাকিয়ে,এক দৌড়ে চলে আসার চেষ্টা করলাম।কিন্তু না,আমাকে দেখতে হলো তাদের ভয়ানক রুপ।তারা আমাকে ধরলো,বেধে রাখতে।আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি তাদের হাতে কামর দিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসি।আমি আম্মা আব্বার কাছে সব খুলে বললাম।আমার কী আর কান্না থামে? লাইফ ফাস্ট কেউ আমাক মারার চেষ্টা করলো। আব্বা আমার চাচাতো ভাইদের নিয়ে মসজিদের কোটায় অনুসন্ধান করতে লাগলো,এই নাস্তিক ভন্ড দুটো কোথায় গেছে।তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না।আব্বা আর আমার চাচাতো ভাইয়েরা তাদের ধরে আনলো।তারা সামনের রাস্তার মোড়ে পালিয়ে যায়।সেখানে আমার চাচার দোকান। চাচা সেখানেই ঘুমিয়ে থাকেন।আব্বার ফোনে চাচা তাদের ধরলো।আম্মার যে কী রাগ তা কীভাবে বলবো? তিনি দানবের মতো চিৎকার করতে করতে দুটোকে ঝাড়ু দিয়ে পেটাতে লাগলেন।তারা এসে আমার পায়ে ধরে।তাদের মতো নিকৃষ্টদের কী মাফ করা যায়? আমি বললাম, বিচারে সব হবে।তবুও আমি তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বললাম না।তাদের তো আম্মা অনেক মেরেছে।আমাদের ঘরে দুজনকে রাখা হলো।সকালে সালিশ বসবে।কিন্তু নাস্তিক মোল্লার গলা নামে না। কথায় আছে না “ চুরের মায়ের বড় গলা” – ঠিক তেমনি।আমি এর মধ্যে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। সমকামীতা পাপ ডেকে আনে।আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তা পবিত্র আল কোরআনে রয়েছে।নাস্তিক ও সাহিদুর ভাই সমকামীতার বিষয়টি বুঝতে পারলো এবং তারা তওবা করলো আর কখনো এরকম করবে না।

আর নাস্তিক মোল্লা আমাকে দেখলেই হলো একদম চুপ হয়ে যায়।কিন্তু সেই রাতের কথাটা মনে পড়ে যায় তাকে দেখলে।আমাকে ভাবায়, আমি কেন সেদিন গিয়েছিলাম।না গেলে এরকম হতো না।”

রুহিনুরের কথা একটু থামলে মাহবুব বললো,তুই লঞ্চে বলিস নি কেন?এরা আমাদের বন্ধুকে বেধে রাখতে চাইলো,অন্যায় করেও? এই বেটা কে সেখানেই মজা শিখিয়ে দিতাম।আর কখনো সমকামীতার নাম নিত না।

— ভালো হয়ে গেছে।এখন সে আস্তিক হয়ে গেছে।নাস্তিকতা তাকে বেশীদিন গ্রাস করে রাখতে পারে নি।

মন্টু বললো,কীভাবে সে নাস্তিক হলো?

— সে আল্লাহ কে বিশ্বাস করে, নবী রাসুল,আল কোরআন, সবকিছুই বিশ্বাস করে।কিন্তু সে এটা বিশ্বাস করে না কোরআন যে আল্লাহর বাণী।সে এটা বিশ্বাস করে কোরআন মোহাম্মদের লেখা।

‘আমি বললাম, আর কী সালিশ হয়েছে?’

—‘ না, হয়নি।’

‘নাস্তিকটাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলি?’

— না রে মাহবুব। আমি তাকে বুঝিয়েছি।
‘ বুঝিয়েছি মানে? তুই কোথায় ভন্ডটাকে শাস্তি দিবি,তা না করে বুঝিয়েই ছেড়ে দিয়েছিস?’

— হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনে বলেন

الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۳۴﴾ۚ

অর্থ– “যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে থাকে। আর আল্লাহ (বিশুদ্ধচিত্ত) সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন।”( সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৪)

মানুষকে ক্ষমা করতে জানতে হয়,এবং এটাও বিশ্বাস রাখতে হয় সেই ব্যক্তিকে বুঝালে সে বুঝবে।

আমি রুহিনুরের মধ্যে এক উজ্জ্বল গুণ দেখতে পেলাম।এই ছেলেটা এতোটাই ভালো যে তার সাথে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনা ভূলে সে মানুষটাকে ক্ষমা করে দিল।

মাহবুব খুব রাগমেজাজি।আমাদের ফ্রেন্ড’দের মাঝে সে যেমন সবাইকে হাসাতে জানে তেমনি রাগ উঠলে কারো গায়ে হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করে না।মাহবুব যদি লঞ্চে ঐ ব্যক্তিটির চরিত্র জানতে পারতো তাহলে সেখানেই তাকে আধমরা করে নিত।আমি রুহিনুরকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ ব্যক্তির করা প্রশ্নের উত্তর সে দিয়েছে কিনা।সে বললো,দিয়েছি বৈকি।ওনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন –“ কোরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী, নাকি মোহাম্মদের?”

তাকে কোরআনের কিছু অলৌকিকতা সম্পর্কে বলতে হলো।নইলে তাকে বুঝানো সম্ভব না।যা বলেছিলাম –

কোরআনে অনেক কিছু উল্লেখ রয়েছে যা বৈজ্ঞানিকগণ ধীরে ধীরে তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমান করছে।যেমন- কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই উল্লেখ রয়েছে সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ এবং অন্যান্য সকল গ্রহ উপগ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরে।কিন্তু মাত্র চার পাচশ বছর আগে থেকে বিজ্ঞানীরা এর তত্ত্ব অনুসন্ধান করতে লাগলো।এটা প্রথম দু বার ভূল প্রমাণিত হয়।একজন বিজ্ঞানী বললো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে,আরেকজন বললো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে।কিন্তু এটা অবশেষে প্রমাণিত হলো প্রত্যেক গ্রহ উপগ্রহ এবং সূর্য তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরে।
মোল্লা বললো;– আমি ওসব বিজ্ঞানের থিওরী টিওরী কিছু বুঝি না।এগুলোর উপরও আমার কোনো বিশ্বাস নেই।

তাজ্জব ব্যাপার! সব নাস্তিকেরা শুনলাম ধর্মে বিশ্বাস না করলে ও বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে।এ আবার কোন নাস্তিক। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না।যদিও ইসলাম বিশ্বাস করে,তার দুইটি জায়গায় ফাঁরা রয়েছে।একটা সমকামীতায় বিশ্বাস, আরেকটা হলো কোরআন আল্লাহর বাণী না মেনে নিয়ে মোহাম্মদের বাণী বিশ্বাস করা।

নাস্তিক মোল্লা বললেন,কোরআনের সত্যতা যাচাই করে দেখাও?
আব্বা বললেন,আগে তোর প্রাণ তো বাঁচা।আমি এক্ষুনি গায়ের লোক সব জড়ো করছি।
মোল্লা তখন আব্বার পায়ে ধরলো।বললে– আমি শুধু এটা জানতে চাই।শুধু এই প্রশ্নের কারণে আমাকে সবাই নাস্তিক বলে।আমি এটা জেনে সবার কাছে ক্ষমা চাইবো।

আব্বা কে আমিও বিনয় করলাম।তাই নাস্তিক মোল্লা কে তিনি ছেড়ে দিলেন।নাস্তিককে বললাম, আপনি কোরআনের একটি আয়াতে লক্ষ্য করুন–

اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ ؕ وَ لَوۡ کَانَ مِنۡ عِنۡدِ غَیۡرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوۡا فِیۡهِ اخۡتِلَافًا کَثِیۡرًا ﴿۸۲﴾

অর্থ–তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত।( সূরা আন নিসা, আয়াত ৮২)আল-বায়ান

এখানে বলা হয়েছে তারা কি কুরআনের মর্ম বিষয়ে চিন্তে-ভাবনা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তাতে তারা অবশ্যই বহু অসঙ্গতি পেত। (তাইসিরুল)

তার মানে এটা নিশ্চিত যে কোরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর বাণী নয়।নবী মোহাম্মদ পৃথিবীতে এসেছেন পথপ্রদর্শক হিসেবে, মানুষ রুপ নিয়ে। তবে ওনার পক্ষে একটি ভূল বানান ছাড়াও কীভাবে কোরআন রচনা করা সম্ভব? তাছাড়া ও আল্লাহ তারা আরও বলেছেন –

وَ مَا کَانَ هٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ لٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ تَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۟۳۷﴾

অর্থ–এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।  ( সূরা ইউনূস, আয়াত-৩৭)(আল-বায়ান)

এ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচিত নয়। উপরন্তু তা পূর্বে যা নাযিল হয়েছিল তার সমর্থক আর বিস্তারিত ব্যাখ্যাকৃত কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে (নাযিলকৃত)।( তাইসিরুল)

মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এতো শুদ্ধ ( ভূলহীন) গ্রন্থ রচনা করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।কোরআন অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার রচিত মহাগ্রন্থ।আর যারা কোরআনকে আল্লাহ তায়ালার বাণী মনে করে না,যারা বলে কোরআন রাসুল মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী তাদের নিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন –

اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىهُ ؕ قُلۡ فَاۡتُوۡا بِعَشۡرِ سُوَرٍ مِّثۡلِهٖ مُفۡتَرَیٰتٍ وَّ ادۡعُوۡا مَنِ اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۱۳﴾

অর্থ– “নাকি তারা বলে, ‘সে এটা রটনা করেছে’? বল, ‘তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।” ( সূরা হুদ,আয়াত -১৩)আল-বায়ান

তারা কি বলে ‘‘সে [অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা.)] ওটা রচনা করেছে? বল, ‘‘তাহলে তোমরা এর মত দশটি সূরা রচনা করে আন, আর (এ কাজে সাহায্য করার জন্য) আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকতে পার ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়েই থাক । (তাইসিরুল)

যারা বলে কোরআন আল্লাহর বাণী নয়, মোহাম্মদের বাণী তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা বলেন- তারা যেন মাত্র দশটি সূরা রচনা করে। আর যদি তা ও না পারে তাহলে যেন একটি সূরা রচনা করে দেখায়।অনেক বিজ্ঞানীর দিন দিন যুগ যুগ চেষ্টা করেও একটি সূরা রচনা করতে পারে নি।বরং বারংবার ব্যর্থ হয়েছে।

তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে কোরআন মোহাম্মদের নয়,বরং মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী। ”

রুহিনুরের চমক শুনে আমরা সবাই অবাক হলাম।

৫।সত্যিই কী কিয়ামত হবে? আল্লাহ তো বিচার দিবসে বিচার করবেন, তিনি নিরাকার হলে কোন রুপে আসবেন?

* আমি তখন মোবাইলে ই বুকে একটা বই পড়ছিলাম। বইটা কোনো মহাগ্রন্থ নয়,সিম্পল দিকের।বইটা একজন বিখ্যাত লেখকের।হুমায়ুন স্যারের বই।বলতে পারো কোন হুমায়ুন স্যার।হুমায়ুন আহমেদ,হুমায়ুন আজাদ নয়।হুমায়ুন আহমেদ স্যারের হিমু সিরিজের একটা বিখ্যাত বই।“আঙুল কাটা জগলু ” বইটার নাম।বইটা খুবই চমকপ্রদ। খুবই ভালো লাগলো পড়ে।

আমি বইটার নাম এবং বইয়ের কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য করতে গিয়ে একটা ডোক গিললাম।বইয়ের জগলু।ভেবেছিলাম জগলুর আঙুল কাটা।আর সেই আঙুল কাটা নিয়ে হয়তো কোনো এক মহাকান্ড করেছে, যার ফলে লোকজন তার কথা খুব বলাবলি করে।কিন্তু না,এ দেখি পুরো ভিন্ন সাইজের।কোথায় আঙুল কাটা জগলু আর কোথায় আঙুল কাটনেওয়ালা জগলু। কতটা পার্থক্য এই বইটার মধ্যে। জগলু একটি অসাধারণ চরিত্র,যাকে দিয়েই বইটার মূল কাহিনি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।জগলুর বাস্তবতা কেউ জানলেই হয়তো সে তার আঙুল কেটে ফেলবে নইলে পানির ট্যাংকিতে মাথা চুবরোবে।বইটার নাম আঙুল কাটা জগলু না দিয়ে আঙুল কাটনেওয়ালা জগলু দিলেও হতো।

আমার পারাগায়ে অনেক বন্ধুই রয়েছে।নিজের গ্রামের বাড়িতে গেলে আমার জিরুবার কোনো চান্স নেই।একবার এ বন্ধুর সাথে বায়াপ করতে হবে,আবার ঐ বন্ধুর সাথে।ঢাকা শহরেও খুব কম যাচ্ছে না। ঢাকা শহরের ও সব অলিগলি এখন যেন আমার চেনা হয়ে গেছে।আমার বন্ধুর সংখ্যা এবং পরিচিতদের সংখ্যা ও খুব হয়েছে বটে।মোটামুটি ভালোই চলছে ঢাকা শহরের কলেজ জীবনটা।ঢাকা শহরে প্রথম প্রথম যখন আসলাম,তখন যেন সবার কন্ঠ একরকম লাগতো।কিন্তু এখন ধীরে ধীরে মানানসই হয়ে গেছে।অনেকের সাথে চেনা পরিচয় ও হয়ে গেছে।

মাহবুব,মহিবুর,মন্টু,মিলন,নিলু দা আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রুহিনুর। তাছাড়াও অনেক বন্ধু রয়েছে।অনেকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন পরিচয় ছাড়াও অন্য পরিচয়ে পরিচিত হয়েছি।আমার কলেজ লাইফের শিক্ষকগণ।রঙলাল কাকা,চায়ের স্টলের পলাশ কাকা, চায়ের স্টলের কাছের স্কুলের দপ্তরি মুজু ওরপে মুজাহিদ ভাই সহ অনেকের সাথে আমার আর রুহিনুরের ভালোই সম্পর্ক।

আমি অসুস্থ বলে দুদিন কলেজে যাইনি।হঠাৎ শুনতে পেলাম রুহিনুরের কন্ঠ।সে এসেছে আমি কলেজে যাবো কিনা এটা জানতে।আমি যাবো।রুহিনুর আজ বাসায় ফালুদা বানিয়েছে।আমি তার অনুরোধে তার বাসাতে গেলাম। সেখানে দুজনে ফালুদা খেয়ে একটু বাইরে যাবো।

রুহিনুর আমাকে সুস্থ দেখে একটু বেড়িয়ে আসতে বললো।আমি বাসায় রুটি বানিয়েছিলাম।আগে রুটিগুলো প্যাকেট করলাম,এগুলো মন্টুকে দেব।সে আজ কলেজে যাবে না।মন্টুর বাসায় রুটিগুলো দিয়ে আসলাম।আজ তার বাবা এসেছেন গ্রাম থেকে।আঙ্কেল ঘুমিয়ে রয়েছে।তাই আর তার বাসায় থাকা হলো না।মন্টু ও আজ আমাদের সাথে বেড়ুলো না।

তারপর চায়ের স্টলে চলে গেলাম।চায়ের স্টলের পলাশ কাকার সাথে আমাদের ভালোই মিল মহব্বত। কাকা আমাদেরকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। তখন মুজু ভাই আসলো এদিক দিয়ে।তার একটা স্বভাব আছে,সবাইকে তুই করে ডাকবে।পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলে।“আবে হালা এইখানে তোরা করছিস কিলা? খবর টবর ভালা টেকতাছে তো? নাকি মাইয়া দৌড়াইয়া ছময় কাটাছ? ”
মুজু ভাই এরকমই।সবসময় শাসন আর শাসন।তবে খুব ভালো তিনি।মুজু ভাইকে বললাম আমাদের সাথে এক কাপ চা খেয়ে যেতে।সে আসলো।তখন পলাশ কাকার এক আবদার, সে আমাদেরকে খুব ধরলো।পাশের এক বাসায় রঙলাল কাকু থাকে।
পলাশ কাকার আবদার ওনাকে যেন আমরা ঠিক করি।ওনি বাস্তবত হিন্দু হলেও ইসলাম কে খুব মান্য করেন।তবে একটু চাপাবাজ টাইপের।যার সাথে যেকোনো বিষয় নিয়ে তর্ক করুক না করুক, অন্যায় তার হলেও তাকে চাপাবাজিতে জিততে হবে।

রঙলাল কাকুর চাপাবাজী হারিয়ে দিতে হবে যুক্তি প্রদর্শন করে।এটাই হলো পলাশ কাকার আবদার রুহিনুরের প্রতি।রুহিনুর বললো;- আচ্ছা দেখা যাবে।আমরা যেইমাত্র চায়ের স্টলের সামনের বেঞ্চ থেকে উঠলাম তখন দেখা গেল রঙলাল কাকু এদিকেই আসছে।এবার তো আমাদের পলাশ কাকার জেদ ও বেড়ে যাবে খুব।এক্ষুনি বলবে যেন রঙলাল কে চাপায় হারাইয়া দেই।

ঠিক তাই হলো।রুহিনুর যাইস না,লোকটা এসে গেছে বলে পলাশ কাকা আমাদেরকে থামিয়ে দিলো।আমি আর রুহিনুর তখন আবার বসলাম।মুজু ভাই বললো;- আবে হালা,তুই এ দুইডারে আটকাইছ কিলা?এদের তো পত্তে দত্তে হবে লাকি? কলেজে যাইবার টাইম অইতাছে তোমার তো খাইয়া কোনো কাম নাই,ছারাদিন চা বেচতে থাকো।আমরা মুজু ভাইকে থামালাম। তখন রঙলাল কাকু বললো,পলাশ এক কাপ চা দে।আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো;- কী রে,আবরার,রুহিনুর, মুজাহিদ তোরা কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই আছি কাকু।

‘ চা খাবি,তোরা? নেব?’

রুহিনুর বললো, না এইমাত্র চা খেলাম তো।

পলাশ কাকা রঙলাল কাকু কে জিজ্ঞেস করলেন আজকে কোনো জপমালা শিখে আসলো কি-ন।

‘ ক্যান,শিখবা তুমি?’

এই, ঠিক করে কথা বল।

‘ কী ঠিক করে বলবো,তোমার কথার ছিরি আছে?’

দুজনেই নিরব হয়ে গেল।পলাশ কাকু একটু পরে রুহিনুর কে জিজ্ঞেস করলো ;- আল্লাহ সম্বন্ধে।প্রশ্নটা এরকম-“ আল্লাহ তো বিচার দিবসে বিচার করবেন, তিনি নিরাকার হলে কোন আঁকারে আসবেন? ”

দেখেছ রুহিনুর, এতোদিন ভাবছিলাম এটা শুধু চাপাবাজ। আজ দেখি নাস্তিক ও হয়ে গেছে।কথা বলতে পারে বড় করে।সেই তো বলে আমি মুসলমান হয়েছি,আমি আর হিন্দু নই।(পলাশ কাকার কথায় রঙলাল কাকু কোনো পাত্তা দিল না।)

রঙলাল কাকু বললো “ একেক জনের কাছে শুনি আল্লাহ তায়ালা নাকি সাঁকার তথা ওনার নাকি আঁকার আছে।আবার একেকজনের কাছে শুনি আল্লাহ তায়ালা নাকি নিরাকার ওনার কোনো আঁকার নেই।তবে যে পবিত্র কোরআনে শুনলাম আল্লাহ তায়ালা মহাবিশ্বে যা কিছু হচ্ছে সবকিছু দেখেন।আর মহাবিশ্বের যে যা বলছে সবই তিনি শুনছেন।

“ওয়া লিল্লা-হিল মাশরিকু; ওয়াল মাগরিবু ফাআইনামা- তুওয়াল্লু ফাছাম্মা ওয়াজ-হুল্লাহি ইন্না-ল্লাহা ওয়া-ছিহূন আলিম। ”

অর্থ– “আর পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা। নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। ”( সূরা আল বাকারাহ,আয়াত-১১৫)আল-বায়ান

আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই, সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ কর না কেন, সেদিকেই আছে আল্লাহর চেহারা, আল্লাহ সুবিস্তৃত, সর্বজ্ঞ। (তাইসিরুল)

তবে আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো যে ওনি নিরাকার।আর ওনি কাল হাশরের ময়দানে কোনো এক বাস্তব চেহারাবিহীন আসবেন।
আল্লাহ তায়ালা পাক রাব্বুল আলামিন আরেক আয়াতে বলেছেন–
فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا وَّ مِنَ الۡاَنۡعَامِ اَزۡوَاجًا ۚ یَذۡرَؤُکُمۡ فِیۡهِ ؕ لَیۡسَ کَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱۱﴾

অর্থ –“ তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা; তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে জোড়া বানিয়েছেন এবং চতুষ্পদ জন্তু থেকেও জোড়া বানিয়েছেন, (এভাবেই) তিনি তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মত কিছু নেই আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।”( সূরা আশ শুরা, আয়াত-১১),  আল-বায়ান

আল্লাহ তায়ালা বলেন তিনি এই আকাশসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে জোড়ার জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, চতুস্পদ জন্তুদের মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া, এভাবেই তিনি তোমাদের বংশধারা বিস্তৃত করেন, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সব শোনেন, সব দেখেন। 
যদি ওনি নিরাকার হোন তাহলে তো ওনার কোনোকিছু শোনার এবং দেখার কথা নয়।কারণ ওনি যদি শুনেই থাকেন আমাদের অবশ্যই এটা বিশ্বাস করতে হবে যে ওনার কান আছে।যদি ওনার কান না থাকে ওনি কিভাবে আমাদের সবকিছু শুনতে পাবেন? আবার,ওনি বলেছেন সবকিছুই তিনি দেখেন।আল্লাহ তায়ালা যদি নিরাকার হোন তাহলে ওনি কীভাবে দেখতে পান? চোখবিহীন তো কোনোকিছু দেখা সম্ভব নয়, তাহলে ওনি কীভাবে সবকিছু দেখবেন?

আমি ওনার প্রশ্ন শুনে তো একদম হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি রঙলাল কাকুর বলা দুটো আয়াত কত বার যে পড়েছি তার ঠিক নেই।কিন্তু কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি। আর ওনি গত মাস দুয়েক আগেও হিন্দু ছিলেন।এরই মধ্যে তিনি কোরআনের এত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ওনি দেখেছেন। রঙলাল কাকু একজন জ্ঞানী পর্যায়ের মানুষ বটে।

রুহিনুর কোনো কথা না বলে প্রথমত কিছুক্ষণ নিরব থাকলো।তার নিরবতা তাকে এটাই বলছিলো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এটা নির্দিষ্ট সময় নয়।এখন কলেজে যাওয়ার সময়।এই ব্যাপারটা রঙলাল কাকুকে বুঝাতে গেলে অনেক সময়ের দরকার।কলেজ থেকে এসে সময় দেওয়া যাবে।এখন না বুঝালে আবার রঙলাল কাকু ভাববে রুহিনুরের এই সম্বন্ধে ধারণা নেই।আমাদের রুহিনুরের মতো জ্ঞানী লোক খুব কম আছে।তার পক্ষে তো এই বিষয় একদম সিম্পল।রুহিনুর বলে দিল,কাকু একটা কথা বলবো?

‘কী বলবে,তুমি এটা জানো না তাইতো?’

আরে এটা নয়,আমি উত্তরটা জানি।কিন্তু এখনতো আমার কাছে সময় নেই।আজ কলেজ আছে। কলেজে যাবার সময় হয়ে গেছে।বিকেলে তোমার সাথে দেখা হবে।ভাগ্যিস রঙলাল কাকু নাস্তিকদের দলভূক্ত নয়,নইলে আজ আর তার কাছ থেকে ছাড়া পেতাম না।এটা যে ২০২১ সাল,ডিজিটাল যুগ। আজকাল সবার মধ্যেই ডিজিটালিটি রয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে আমরা কলেজের একটি দিন মিস করি বস্তুজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা বুঝতে পারে।রঙলাল কাকুও বুঝতে পেরেছে বলেই আজকে আমরা দুই বন্ধু কলেজে যেতে পারলাম। রুহিনুর কে সে বললো;- তোমার কলেজের বেলা হয়েছে যাও, তবে আমায় কিন্তু সঠিক উত্তরটা বিকেলে জানাইয়া দিও।আমি অধীর আগ্রহে থাকবো কিন্তু। ‘ইনশাআল্লাহ,আমি তোমাকে যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো ’ বলে রুহিনুর হাটতে লাগলো।আমিও তার সাথে সাথে হাটতে লাগলাম। তখন তখন পলাশ কাকা ডাক দিয়ে বললো– আবরার, রুহিনুর তোরা কিন্তু আচ্ছা বেটার ফাঁদে পড়েছিস ঠেলা সামলিয়ে নিস।হা- হা -হা।

আমি আর রুহিনুর কলেজের ক্লাশ শুরু হবার আগেই আমাদের ক্লাসরুমে চলে গেলাম।তখন আমাদের অন্য বন্ধুরা আমাদের নিয়ে খুব মাতামাতি করলো।কী হয়েছে রে তোদের? আজ এতো দেরী কেন হলো? আবরার তোর শরীর পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে তো- মন্টু বললো।আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ আছি বলেই তোদের সামনে আজ আমি উপস্থিত হয়েছি।

চতুর্থ পিরিয়ডে বায়োলজি ক্লাশ। ক্লাশরুমে আইয়ুব স্যার আসলেন।খুব কড়া সাইজের টিচার তিনি।তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন না।তবুও তিনি ক্লাশে আসলেই শুধু ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।যদিও জানি তিনি নিজের ক্লাশ ছাড়াও অন্যান্য প্রশ্ন করতে ভালোবাসেন,ধর্ম নিয়ে খুব বেশী প্রশ্ন করবেন এটা মূলত আমরা কেউই জানতাম না।তিনি ধর্মকে , বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে “Believing in the body” বলে আখ্যায়িত করেন।ওনার Atheism and unbelief কে সবাই চিনতে পেরেছে। এই কলেজে একজন এরকম শিক্ষক আছেন তাও জানলাম বটে।ওনি তো কলেজে আসলেন মাত্র মাস দেড়েক হলো।
স্যার ক্লাশে এসে আমাকে দাঁড়াতে বললেন। আবার নতুন করে কিচ্ছু না বলে উঠেন।তিনি আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম আবরারুল আবরার। বাহ্,নামটা তো বেশ।স্যারের প্রশংসায় একটু কুন্ঠিত হলাম।স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইশ্বর বলতে কেউ আছেন কি-না।

‘ইয়েস স্যার,শিওরলি আছে।’

‘তুমি কী ওনাকে দেখেছ?’

‘না স্যার,তবে তিনি আছেন বিশ্বাস করি।’

তাহলে ওনার রুপ কেমন? হলুদ পাঞ্জাবিওয়ালা হিমু,রণভাষিণ্য শেখ মুজিব,নাকি মাথার আপেল পড়া আইজ্যাক নিউটনের মতো?হা-হা-হা-হা।

স্যারের তাচ্ছিল্য আমি বুঝতে পারলাম, তাই মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু রুহিনুর মাথা হেট হওয়া ছেলে নয়।সে নির্ভয়ে বলে উঠলো,স্যার আমি বলবো?

‘বলবে,তাহলে বলো?’ কী বলবে?

স্যারের তাচ্ছিল্য স্টার্ট আবারও। রুহিনুর বরাবরের মতো বলে দিল“This is not a sarcastic issue, so please stop being sarcastic.”

বাহ্?!বাপ কা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া,কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া।এ কথাটি যখন বললাম তখন সবাই রুহিনুরের জন্য খুব জোরে করতালি দিতে লাগলো।এদিকে আমাদের বায়োলজির টিচার আইয়ুব খান স হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কে যেন তার সাথে এসে ব্যাঙ্গাচরিত্রে কিছু করে গেল,আর ব্যঙ্গঢল সাজিয়ে রাখলো।

রুহিন বললো;- ‘স্যার,অ্যানি মোর কুয়েশ্চান?’

‘ইয়েস,অফকোর্স – হোয়াই নট?’ বলতো স্রষ্টার রুপ কেমন?

– স্রষ্টা তো শুধু একরুপে রাঙিত নয় স্যার?

আমিসহ ক্লাশের সবাই রুহিনুরের এরকম কথা শুনে থ হয়ে গেলাম। সবসময় শুনে আসছি স্রষ্টা নিরাকার, ওনার বাস্তব কোনো রুপ নেই,অথচ রুহিনুর বলছে আল্লাহ তায়ালার নাকি একরুপ নয়!

স্যার,হাসতে লাগলেন আবারও।

‘Please স্যার don’t laugh you, listen to me?’[1]

‘Of course, tell you.’[2] স্রষ্টার কতগুলো রুপ আছে?

ওনার ৯৯ টি গুণবাচক রুপ আছে।আর রহমান – অতি দয়ালু তিনি,আর রহিম – অতিশয় মেহেরবান,আল কুদ্দুস -অতি পবিত্র —–

হয়েছে, হ-য়ে-ছে।আর বলতে হবে না।এবার আমার মূল প্রশ্নটা বলবো?

–জ্বি বলেন।

আমার প্রশ্নটা হলো– “ আল্লাহ তো বিচার দিবসে বিচার করবেন, তিনি নিরাকার হলে কোন রুপে আসবেন? ”

আমি স্যারের প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলাম।হাতে একটা চিমটি কাটলাম, এ প্রশ্নটা সত্যিই কী স্যারের মুখ থেকে শুনতেছি?

রুহিনুর ও মনে হয় মনে মনে এটাই ভাবছে,এটা স্যারের কাছে শুনতেছে নাকি রঙলাল কাকুর কাছে।যাই হোক প্রশ্ন তো সত্যি।

আইয়ুব স্যার রুহিনুরকে বললো,সরি রুহিনুর।আমি না বুঝে প্রশ্নটা করেছি।ওই বোকা রঙ — মা – মা মানে বলছিলাম যে।

স্যার খুব তোতলানো শুরু করলেন।আমি আর রুহিনুর ঠিকই বুঝতে পারলাম তিনি কেন তোতলাচ্ছেন।রঙলাল কাকু ওনাকে এই প্রশ্নটা করার কথা বলেছেন। স্যার বললেন ;- যেখানে কিয়ামত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই সেখানে আবার হাশর ময়দানে আল্লাহ তায়ালা আসার প্রশ্নই আসে না।অথচ আমি বলছি তিনি নিরাকার হলে কোন রুপে আসবেন।

রুহিনুর স্যারের প্রশ্নটা বুঝতে পারলো। তিনি রুহিনুর কে দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন করলেন।একটা হলো “সত্যিই কী কিয়ামত হবে?” আর দ্বিতীয়টা হলো “আল্লাহ তো বিচার দিবসে বিচার করবেন, তিনি নিরাকার হলে কোন রুপে আসবেন? ”

প্রশ্ন-১:- সত্যিই কী কিয়ামত হবে?

রুহিনুর:-“কিয়ামত হবে এটা নিশ্চিত। আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত সম্পর্কে পবিত্র আল কোরআনে বহুবার বলেছেন।তিনি সূরা নাবার আয়াত ১৮ তে বলেছেন-

یَّوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ فَتَاۡتُوۡنَ اَفۡوَاجًا ﴿ۙ۱۸﴾

অর্থ– “সেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে আসবে।”[1] ( সূরা নাবা,আয়াত-১৮)আল-বায়ান

আপনি চাইলে পবিত্র আল কোরআনের এই আয়াত দেখতে পারেন।তাছাড়াও আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন কোরআনের বহু জায়গায় কিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। সূরা (আল মজাদালাহ, আয়াত-১৮), ( আল মুমতাহিনাহ, আয়াত-০৩),( আল কামার,আয়াত-৬,৮) ছাড়াও অনেক আয়াত রয়েছে।সূরা নূহ এর আয়াত ১৮ তে বলা হয়েছে:-

ثُمَّ یُعِیۡدُکُمۡ فِیۡهَا وَ یُخۡرِجُکُمۡ اِخۡرَاجًا ﴿۱۸﴾

‘তারপর তিনি তোমাদেরকে তাতে ফিরিয়ে নেবেন এবং নিশ্চিতভাবে তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন’।[2]( সূরা নূহ,আয়াত -১৮)আল-বায়ান

আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনে যেহেতু কিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন সেহেতু কিয়ামত নিয়ে কোনো দ্বিধাবোধ আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।”

নাস্তিক টিচার আইয়ুব খান কিয়ামত নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।

প্রশ্ন ২:- আল্লাহ তো বিচার দিবসে বিচার করবেন, তিনি নিরাকার হলে কোন রুপে আসবেন?

রুহিনুর – আল্লাহ তায়ালা নিরাকার।তবে তিনি যে আছেন এটা সত্য।এর প্রমান আমরা নিজেরাই।আমরা জানি প্রত্যেক কিছুরই কেউ না কেউ স্রষ্টা আছেন।তেমনিভাবে আমাদের ও স্রষ্টা আছে।কিন্তু ওনাকে দেখা যায় না।ওনার উপর আমাদের বিশ্বাস রাখা অত্যাবশ্যক।আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়।যার আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস নেই তার ইমানের ঘাটতি আছে। ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ের মধ্যে সর্বপ্রথম হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।

আল্লাহ তায়ালা বিচার দিবসে হাশরের ময়দানে আসবেন।

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي عُمَرَ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ سُهَيْلِ بْنِ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ ‏”‏ هَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ فِي الظَّهِيرَةِ لَيْسَتْ فِي سَحَابَةٍ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا لاَ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَهَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ لَيْسَ فِي سَحَابَةٍ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا لاَ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ رَبِّكُمْ إِلاَّ كَمَا تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ أَحَدِهِمَا – قَالَ – فَيَلْقَى الْعَبْدَ فَيَقُولُ أَىْ فُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ وَأُسَوِّدْكَ وَأُزَوِّجْكَ وَأُسَخِّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالإِبِلَ وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ فَيَقُولُ بَلَى ‏.‏ قَالَ فَيَقُولُ أَفَظَنَنْتَ أَنَّكَ مُلاَقِيَّ فَيَقُولُ لاَ ‏.‏ فَيَقُولُ فَإِنِّي أَنْسَاكَ كَمَا نَسِيتَنِي ‏.‏ ثُمَّ يَلْقَى الثَّانِيَ فَيَقُولُ أَىْ فُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ وَأُسَوِّدْكَ وَأُزَوِّجْكَ وَأُسَخِّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالإِبِلَ وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ فَيَقُولُ بَلَى أَىْ رَبِّ ‏.‏ فَيَقُولُ أَفَظَنَنْتَ أَنَّكَ مُلاَقِيَّ فَيَقُولُ لاَ ‏.‏ فَيَقُولُ فَإِنِّي أَنْسَاكَ كَمَا نَسِيتَنِي ‏.‏ ثُمَّ يَلْقَى الثَّالِثَ فَيَقُولُ لَهُ مِثْلَ ذَلِكَ فَيَقُولُ يَا رَبِّ آمَنْتُ بِكَ وَبِكِتَابِكَ وَبِرُسُلِكَ وَصَلَّيْتُ وَصُمْتُ وَتَصَدَّقْتُ ‏.‏ وَيُثْنِي بِخَيْرٍ مَا اسْتَطَاعَ فَيَقُولُ هَا هُنَا إِذًا – قَالَ – ثُمَّ يُقَالُ لَهُ الآنَ نَبْعَثُ شَاهِدَنَا عَلَيْكَ ‏.‏ وَيَتَفَكَّرُ فِي نَفْسِهِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْهَدُ عَلَىَّ فَيُخْتَمُ عَلَى فِيهِ وَيُقَالُ لِفَخِذِهِ وَلَحْمِهِ وَعِظَامِهِ انْطِقِي فَتَنْطِقُ فَخِذُهُ وَلَحْمُهُ وَعِظَامُهُ بِعَمَلِهِ وَذَلِكَ لِيُعْذِرَ مِنْ نَفْسِهِ ‏.‏ وَذَلِكَ الْمُنَافِقُ وَذَلِكَ الَّذِي يَسْخَطُ اللَّهُ عَلَيْهِ ‏”‏

সহিহ মুসলিম ৭৩২৮-(১৬/২৯৬৮) “মুহাম্মদ ইবনু আবূ উমর (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের রবকে দেখতে পাব? জবাবে তিনি বললেন, আকাশে মেঘ না থাকাবস্থায় দুপুরের সময় সূর্য দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? সাহাবাগণ বললেন, জী না। অতঃপর তিনি বললেন, আকাশে মেঘ না থাকাবস্থায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? সাহাবাগণ বললেন, জী না। তারপর তিনি বললেন, ঐ সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন! চন্দ্ৰ-সূৰ্য কোন একটি দেখতে তোমাদের যেরূপ কষ্ট হয় না, তোমাদের রবকেও দেখতে তোমাদের ঠিক তদ্রুপ কষ্ট হবে না। আল্লাহর সাথে বান্দার সাক্ষাৎ হবে। তখন তিনি বললেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি, কর্তৃত্ব দান করিনি, জোড়া মিলিয়ে দেইনি, ঘোড়া-উট তোমার কাজে লাগিয়ে দেইনি এবং সুখ-স্বাচ্ছদের মাঝে তোমার পানাহারের ব্যবস্থা করিনি? জবাবে বান্দা বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব। তারপর তিনি বলবেন, তুমি কি মনে করতে যে, তুমি আমার মুখোমুখী হবে? সে বলবে, না, তা মনে করতাম না। তিনি বললেন, তুমি যেরূপভাবে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে তদ্রুপভাবে আমিও তোমাকে ভুলে যাচ্ছি।

অতঃপর দ্বিতীয় অপর এক ব্যক্তির আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হবে। তখন তিনি তাকেও বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি, নেতৃত্ব দেইনি, তোমার পরিবার (জোড়া মিলিয়ে) দেইনি, উট-ঘোড়া তোমার কাজে লাগিয়ে দেইনি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পানাহারের জন্য তোমাকে কি সুবিধা করে দেইনি? সে বলবে, হ্যাঁ করেছেন। হে আমার পালনকর্তা! তারপর তিনি বললেন, আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে এ কথা তুমি মনে করতে? সে বলবে, না। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, তুমি যেমন আমাকে ভুলে গিয়েছিলে অনুরূপভাবে আমিও তোমাদেরকে ভুলে যাব। তারপর তৃতীয় অপর এক ব্যক্তির আল্লাহর সাথে দেখা হবে। এরপর তিনি আগের মতো অবিকল বলবেন। তখন লোকটি বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার প্রতি এবং কিতাব ও রসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছি। আমি সালাত আদায় করেছি, সাওম পালন করেছি এবং সাদাকা করেছি। এমনিভাবে সে যথাসাধ্য নিজের প্রশংসা করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা বলবেন, এখনই তোমার মিথ্যা প্রকাশিত হয়ে যাবে।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর তাকে বলা হবে, এখনই আমি তোমার উপর আমার সাক্ষী উপস্থিত করব। তখন বান্দা মনে মনে চিন্তা করতে থাকবে যে, কে তার বিপক্ষে সাক্ষী দিবে? তখন তার জবান বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তার উরু, মাংস ও হাড়কে বলা হবে, তোমরা কথা বলো। ফলে তার উরু, মাংস ও হাড় তার আমলের ব্যাপারে বলতে থাকবে। এ ব্যবস্থা এজন্য করা হবে যেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগ তার অবশিষ্ট না থাকে। এ ব্যক্তি হচ্ছে মুনাফিক যার প্রতি আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট।” (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭১৬৯, ইসলামিক সেন্টার ৭২২২)

আল্লাহ তায়ালা মিথ্যাবাদি এবং মুনাফিকদের কাছ থেকে সওয়ালের জবাব নেওয়ার পর সাক্ষী দ্বরা তার জবাবের প্রমান করবেন।তিনি বলেন–

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَشۡتَرُوۡنَ بِعَهۡدِ اللّٰهِ وَ اَیۡمَانِهِمۡ ثَمَنًا قَلِیۡلًا اُولٰٓئِکَ لَا خَلَاقَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ وَ لَا یُکَلِّمُهُمُ اللّٰهُ وَ لَا یَنۡظُرُ اِلَیۡهِمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ لَا یُزَکِّیۡهِمۡ ۪ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۷۷﴾

অর্থ– “নিশ্চয় যারা আল্লাহর অঙ্গীকার ও তাদের শপথের বিনিময়ে খরিদ করে তুচ্ছ মূল্য, পরকালে এদের জন্য কোন অংশ নেই। আর আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং কিয়ামতের দিন তাদের দিকে তাকাবেন না, আর তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্যই রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব। ”( সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৭৭)আল-বায়ান

আল্লাহ তায়ালা কাল হাশরের ময়দানে শুধু ইমানদার মুমিন বান্দাদের সামনে আসবেন।তিনি নিজের গুণবাচক রুপে আসবেন,যা দেখে ইমানদারদের আফসোস মিটবে না।তারা বারবার আল্লাহ কে দেখার প্রবল বাসনা প্রকাশ করবে।আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও নেককার বান্দাদের সামনে বিচার দিবসে আসবেন,তবে ক্ষনিকের জন্য আসবেন।আর ওনার রুপ একমাত্র তারাই দেখতে পাবে,এবং তারাই বলতে পারবে ওনি কোন রুপে আসবেন।তিনি বসর্বগুণসম্পন্ন।যে যেরকম গুণের কাজ করেছে দুনিয়ায়, আল্লাহ তায়ালার পবিত্র রুপ যার যার কাজের প্রতিফল হিসেবে দেখতে পাবে।তবে তিনি হাশরের ময়দানে আসবেন এটা সুনিশ্চিত। তখন জাহান্নামীরা আল্লাহকে প্রকট এবং জান্নাতিরা অতি শান্ত ও গুণময় রুপে দেখবে।মহান আল্লাহই নিজের রুপ সেদিন মানুষের সামনে সম্মুখীত করবেন।

আইয়ুব স্যার খুব শান্ত হয়ে গেলেন।আল্লাহ তায়লার প্রতি ইমান আনা খুবই অত্যাবশ্যক। তিনি বুঝতে পারলেন।কলেজ শেষে তিনি আমাকে ও রুহিনুরকে পলাশ কাকার চায়ের স্টলের কাছে ডাকলেন।সেখানে রঙলাল কাকু ও ছিল।সে আমাদের কে সরি বললো,স্যারকে কানাঘুষা করার জন্য।রুহিনুর মুচকি হাসলো। এবং বললো;– স্যার এখন তোমাকে সব বুঝাবেন।

৬।সকল কাজের দায় স্রষ্টা নেন কী?

* রুহিনুরের বাসায় একজন নতুন লোক এসেছে।তিনি রুহিনুর কে ভাগ্নে ভাগ্নে বলে ডাকেন।বাসা আরামবাগ।ওনার নাম টুটুল রায়হান।

রুহিনুর ও ওনাকে মামা মামা বলে ডাকে।তিনিও একটু বেশী কথা বলুয়া স্বভাবের।তবে নিলু দা’ র মতো অতিরিক্ত কথা বলেন না।আমার বাসাটাও চ্যাঞ্জ করে ফেললাম।দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা কোনো বন্ধুরাই হোস্টেলে থাকি না।মনে মনে ভাবি হোস্টেলে থাকলে বোধহয় বেশী আনন্দ হতো।এখন আমাদের সবার বাসা কাছাকাছি। আমি যে মালিকের বাসায় থাকি ওনার ভাইয়ের বাসা এই বাসার পাশেই।সেই বাসার এক রুমে রুহিনুর ভাড়াটে।এক রুমে এখন নিলু দা এসে গেছে।আমি যে বাসাতে এটাতে পাশাপাশি চারটে রুম।চারটেতে চার বন্ধু থাকি।আমি,মাহবুব, মহিবুর আর মন্টু।সজল আর রাগীব কিছুটা দূরের বাসাতে থাকে।

রুহিনুরের বাসাতে টুটুল মামা আসার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।তিনি রুহিনুরকে ফোনে পাচ্ছিলেন না তাই তার কাছেই চলে আসলো।সামনেই ওনার একটা হোটেল রয়েছে।ওনি রুহিনুর কে সেখানে বিকেলে যেতে বললেন।হোটেল কী মালিক ছাড়া অন্য কেউ চালাতে পারে? টুটুল মামা চলে গেলেন।
আমি রুহিনুরের সাথেই আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছি।
তার ফোনে একটা মেইল এসেছে

রুহিনুর
“ এখনও আসছো না যে? আমি কিন্তু তোমার অপেক্ষাতে রয়েছি।আজ আমার তাড়া ছিল, কিন্তু আমি যাইনি।”

রুহিনুর আমাকে বললো– চল যাই।আশ্চর্য বিষয়, আমি আবার কোথায় যাব!

‘ আরে, চল তো আবরার – বলে সে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল’

টুটুল মামা হোটেলের ক্যাশবাক্সের সামনের চেয়ারে বসা।আমরা যাওয়াতেই তিনি বের হয়ে গেলেন।আমাদেরকে ভেতরের দিকে একটা টেবিলের সামনে বসালেন।তিনিও আমাদের সাথেই চেয়ারে বসলেন।আমি তো আর ওনার সম্পর্কে কোনোকিছু জানি না।যা জানে সব রুহিনুর। ঢাকা শহরে সবাইকে ডিরেক্টলি মামা ডাক ছাড়া কোনো কথাই নেই।চোর বাটপারকে ও মামা! কিন্তু সেটা তো সেখানকার চল।কথায় আছে না“ যেদিকে যে ভাও,উঁপুত হয়ে নাও বাও।” রুহিনুর টুটুল মামা কে নিজের মামার মতোই ডাকে।
আমি আর রুহিনুর টুটুল মামার হোটেলে যাবার পর রুহিনুর কে বললো;- ‘কী ভাগ্নে বইটা কেমন লাগলো?’

– ভালোই লেগেছে।এখনো বইটা পড়ে শেষ করিনি।

আমি বুঝতে পারলাম না তারা কী বলছে।ওনি বললেন,তাকে পড়তে দিয়েছো? কোথায় ওনি আগে আমার নাম টাম জিজ্ঞেস করবেন,পরিচিত হবেন,তা না করে…………

‘হ্যালো জ্যান্টলম্যান,হোয়াটস ইয়র নেইম? আই হোপ ইউ আর ওয়েল?’

আমার ভাবনা দেখি ভূল।টুটুল মামার সাথে পরিচিত হলাম।ওনাকে আমিও বললাম –
‘My name is Abrarul Abrar. Everyone calls me Abrar. You can also call me Abrar. I am fine Alhamdulillah.’

অর্থ – আমার নাম আবরারুল আবরার। সবাই আমাকে আবরার বলেই ডাকে।আপনিও আবরার বলেই ডাকতে পারেন।আর, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

আমি আর কোনো কথা বললাম না।রুহিনুর কে টুটুল মামা বললেন,তুমি ইশ্বর টিশ্বর এগুলোতে বিশ্বাস করো না।যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে সব চলে সেখানে ইশ্বর কে? এখন বৈজ্ঞানিকগন বিভিন্ন থিওরী বের করছে। তো এখন বিজ্ঞানে বিশ্বাস করো? আমার বইটা অনুসারে জীবনধারণ করো।

রুহিনুর বললো – আমি আপনার বইটা পড়েছি ভালোই লেগেছে।তবে এই বইয়ের উপর আমি ইমান আনবো না ‘ইটস্ মাই ডিসিশন ’।ইউ ডন’ট নৌ,আই এম এ্যা ফলোয়ার্স অব ইসলাম?

‘তাতে কী হয়েছে, এখন ডিসিশন এক্সচেঞ্জ করো!দ্যাটস সিম্পল। প্লিজ এনজয়নিং অব এন এথেইস্ট লাইফ।’

কখনোই না,আমি নাস্তিকতা কে ঘৃণা করি।আপনি নাস্তিক জানা সত্ত্বেও আপনার দেওয়া বইটা আমি নিয়েছিলাম।একভাবে ভালোই হয়েছে, নাস্তিকদের সম্পর্কে সব জানতে পারলাম বইটাতে। আল্লাহ যা করেন সব মঙ্গলের জন্যই করেন।
টুটুল মামা বললো;- এখানে আল্লাহ কে নিয়ে কোনো প্রশ্ন হয়েছে কী?

– হয়েছে বৈকি।এখন যদি নাস্তিক হয়ে যেতাম আমার লাইফে এর চেয়ে খারাপ কিছু হতেই পারতো না।

‘ বাহ্,ভালোই তো যুক্তি দেখাও দেখছি।তাহলে কী সকল কাজের দায় স্রষ্টা নেন?’

না, নেন না।

নেবেন,ইডজেক্টলি নেবেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, আর ওনি কোনোকিছুর দায় নেবেন না? ধরে নাও আমি কাউকে দংশন করলাম কিংবা খুন করলাম, তার দায় স্রষ্টা নেবেন?

‘ না’

‘কেন?’ আগে তো বলেছ স্রষ্টা সকলকিছু ভালোর জন্যই করেন।তাহলে খুন খারাবি বা যেকোনো কিছু করা মানেই কাজ।স্রষ্টা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে মানুষের কাজের দায় নেবেন না কেন?

— স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এটা সত্য।এটাও সত্য তিনি যা করেন ভালোর জন্য করেন।কিন্তু ওনি কোনো কাজের দায় নেন না।কারণ – তিনি মানুষদেরকে নির্ধারিত তকদির লিখে দিয়েছেন। মানুষ তাদের তকদিরে যা লেখা আছে তাই করে।

– তবে কী এবার স্রষ্টার সাথে সাথে তকদিরেও বিশ্বাস করতে হবে?

– ‘জ্বি’।ইমানের সাতটি মৌলিক বিষয় রয়েছে।এর মধ্যে তকদিরের প্রতি বিশ্বাস অন্যতম।

– আমি আগেই বলেছি খুন খারাবির কথা।যদি আমি ওসব করি,তাহলে কী ধরে নিতে হবে এটি আমার তকদিরে লেখা ছিল?

– জ্বি, লেখা ছিল।কিন্তু ওনি আপনাকে খারাপ কাজ করার নির্দেশ দেননি।ওনি আপনার তকদিরে নির্ধারিত কয়েকটি পন্থা দিয়েছেন।তার সাথে আপনার মস্তিষ্ক, জ্ঞান দিয়েছেন।এটা আপনার উপর নির্ধারণ করে আপনি ভালো কাজ নাকি মন্দ কাজ করবেন।

– যদি আমি ভালো কাজ করি,সেটাও কী তকদিরে লেখা ছিল?

জ্বি।

– তাহলে তো স্রষ্টা সকল কাজের মূল।কারণ ওনিই আমাদেরকে তকদির লিখে দিয়েছেন। খারাপ কাজ এবং ভালো কাজ উভয়টাই লিখে দিয়েছেন। খারাপ বা ভালো কাজ করলে কেন তাহলে স্রষ্টার উপর দায়ভার পড়বে না।

– আল্লাহ তায়ালা মানুষের তকদির ওনার মতো করে লিখেননি।ওনি এটা জানেন,কে পৃথিবীতে ভালো কাজ করবে আর কে মন্দ কাজ করবে।আল্লাহ তায়ালা তার উপর নির্ধারণ করে তকদির লিখেছেন।

–এটা না হয় বুঝলাম, স্রষ্টা এটা জানেন কে পৃথিবীতে ভালো কাজ করবে আর কে মন্দ কাজ করবে।আর তারই উপর ভিত্তি করেই তকদির লিখেছেন। এখন আমার প্রশ্নটা হচ্ছে “ সকল কাজের দায় স্রষ্টা নেন কী? ”

– আমি তো আগেই বলেছি, না।

টুটুল মামার হাবভাব ভালো ঠেকলো না।হা হা হা হা,তিনি হাসতে লাগলেন।এ যেন ফিন্যান্সের অনিশ্চয়তা নীতি।স্রষ্টা সম্পর্কে ও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

রুহিনুর বললো ;- তা মোটেও না। ভবিষ্যতে কোনো ঘটনা ঘটা বা না ঘটার আশঙ্কা হলো অনিশ্চয়তা।এখানে তো ভবিষ্যত সম্পর্কিত কোনোকিছু বলা হয় নি।

( টুটুল মামা এবার ওনার প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফেললেন)

রুহিনুর, মনে করো এখন আমি বড় একটা ফার্নিচার্স কোম্পানির মালিক, আমি সবসময় ওনার ইবাদত বন্দেগি করি,সুদ ঘুষ ছাড়া সবকিছু করেছি এতে স্রষ্টার প্রশংসা রয়েছে কী?

– জ্বি,আল্লাহ তায়ালা ভালো কাজের প্রশংসা অবশ্যই পাবেন।ওনি যতটুকু পাবার ঠিক ততটুকু প্রশংসা’ই পাবেন।

– তাহলে মন্দ কাজের জন্য দায়ী কে?

– মানুষ

– ভালো কাজের জন্য?

– এতেও মানুষই

– যদি সব ক্রেডিট মানুষেরই হয় এখানে স্রষ্টাকে আছে বলে কীভাবে মানবো?

রুহিনুর টুটুল মামাকে বুঝানোর জন্য যুক্তি প্রদর্শন করলো।যুক্তিটা এরকম–

“ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেমন নির্ধারিত তকদির লিখে দিয়েছেন, তেমনি তাদের ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা ও তিনি দিয়েছেন। মানুষকে কাজ করার জন্য বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেওয়া হয়েছে। কেউ ভালো কাজ করে আবার কেউ মন্দ কাজ।”

ধরে নিন আপনি একটা দোকান খুললেন। সেখানে আপনি মুদি মাল থেকে শুরু করে ছোটদের চিপস, বিস্কিট ইত্যাদি ও রাখলেন।তাছাড়াও ইদুর মারার বিষ ও রয়েছে আপনার দোকানে।আপনি কিন্তু যা কিছু আপনার দোকানে এনেছেন সবকিছুই মানুষের ভালোর জন্যই এনেছেন।

– ‘শিওরলি তাই’।কিন্তু এখন এই প্রশ্নটা আসছে কোত্থেকে।?

( রুহিনুর ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগলো) এখন আপনার দোকান থেকে কেউ একজন ইঁদুর মারার বিষ কিনে নিল।আপনি কী জানেন সে এই বিষটা কেন নিয়েছে?

– কেন জানবো না,এটা যেহেতু ইদুর মারার বিষ – এটা দিয়ে ইদুর মারবে এরকমটাই তো স্বাভাবিক।

– আপনি কীভাবে বুঝলেন,সে ইদুর মারার বিষ নিয়েছে শুধু ইদুর মারবে বলেই।

– বললাম তো এটা ইদুর মারার বিষ, এটা দিয়ে তো ইদুরই মারবে কেউ।

– না,ইদুর মারবে না।যিনি বিষটা নিয়েছেন ওনি একজন মানুষকে মেরে ফেলতে নিয়েছেন। ধরে নিন এরকমই হলো।ইদুরের বিষটি সে তার কোনো এক শত্রু কে খাইয়ে দিল।তখন তো পুলিশ বা আইনের লোকেরা এসে আপনাকেই ধরবে।

– কেন? আমাকে ধরবে কেন? আমি তে ইদুর মারার বিষ ইদুর মারতেই এনেছি। আমি কী তাকে বলে দিয়েছি সে মানুষ মেরে ফেলতে!

— ও আচ্ছা, তাই।তাহলে আরেকটা কথা বলা যাক আপনাকে।আপনি যে ইদুর মারার ঔষধ আনলেন এটাতে যদি একজনের ঘরের ইদুর সব মারা যায় তাহলে কী আপনার কোনো লাভ হবে?

– অবশ্যই হবে।আমার দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়বে।যে ইদুর মারার বিষ নিয়েছে, সে কাউকে না কাউকে বলবে আমার দোকানের এই বিষটা যথাযথ কাজ দিয়েছে। তখন এর মুখ থেকে অমুক,অমুকের মুখ থেকে তমুক সমুক এভাবে অনেকের কাছে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।তখন আমার কাস্টমার বৃদ্ধি পাবে।আমার এই ভালো একটি ঔষধের জন্য পুরো দোকানের মাল খুব বেশী পরিমাণে বিক্রিত হবে।তখন মানুষ শুধু বিষের কথা বলবে না,তখন বলবে অমুকের দোকানের মাল ভালো,ওখান থেকেই কিনবো।

– তাহলে তো বলবো আপনি আপনার কাজটির জন্য খুব প্রশংসা পেলেন।

– হ্যাঁ,এটা যেহেতু একটা ভালো কাজ তো ভালো কাজের জন্য আমি প্রশংসা পাবোই।

– আর আগে যে একটা খারাপ দিক হয়ে গেল? আপনার ইদুর মারার বিষ খেয়ে যে মানুষ মারা গেল,তার দায় নেবেন না?

– কেন নেব? আমি কী বলেছি সে বিষ খেয়ে মরে যাক।আমি তো ভালোর জন্যই এই বিষটা এনেছিলাম।ইদুর মানুষের ঘরে খুব বেশী উৎপাত করলে এটা দিলে তা খেয়ে সেটি মরে যাবে।তাহলে ইঁদুরের উৎপাত কমে যাবে।এটা তো খুব ভালো দিক।এখন এগুলো দিয়ে একজন খারাপ কাজ করলো তার দায় আমি নেব কেন?

এবার রুহিনুর হা হা হা হা করে হাসতে লাগলো।

– তাজ্জব ব্যাপার, এতে আবার হাসার কী হলো?

– হাসবো না,আপনিই ভেবে দেখুন তো – আমি কেন হাসলাম?

– ওসব আমি জানি না( টুটুল মামা একটু ঘাবড়ে গেলেন)

مَاۤ اَصَابَکَ مِنۡ حَسَنَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ۫ وَ مَاۤ اَصَابَکَ مِنۡ سَیِّئَۃٍ فَمِنۡ نَّفۡسِکَ ؕ وَ اَرۡسَلۡنٰکَ لِلنَّاسِ رَسُوۡلًا ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ شَهِیۡدًا ﴿۷۹﴾

অর্থ -“আপনার যে কল্যাণ হয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর আপনার যে অকল্যাণ হয় তা আপনার নিজের কারণে।আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি আমার পয়গামের বাহক হিসেবে। আর আল্লাহ সব বিষয়েই যথেষ্ট – সব বিষয়ই তার সম্মুখে উপস্থিত। ”( সূরা আন নিসা,আয়াত -৭৯)রুহিনুর আয়াত শুনিয়ে বললো;-

– আপনি তো আগে খুব কড়া করে বলেছিলেন আল্লাহ ভালো কাজের ক্রেডিট নেন কিন্তু মন্দ কাজের ক্রেডিট নেন না। আপনি যেমনভাবে ইদুরের বিষ দিয়ে ভালো কাজ হওয়ায় সুনাম লাভ করেছেন, প্রশংসা পেয়েছেন।ঠিক আল্লাহ তায়ালাও মানুষের ভালো কাজের ক্রেডিট নেন।তিনি ভালো কাজের জন্য প্রশংসা পান।আপনি যেমন ইদুরের বিষের জন্য একটি মন্দ কাজের দায় নিজের উপর নিতে চাননি, আল্লাহ তায়ালা তেমনভাবেই মন্দ কাজের দায় নিজে নেন না।আপনি বলেছেন,ইদুর মারার বিষ কেবল মানুষের ভালোর জন্যই এনেছেন।আল্লাহ তায়ালা ও মানুষকে ঠিক তেমনিভাবে ভালো কাজের জন্যই পাঠিয়েছেন। এখন সে মন্দ কাজ করলো বলে আল্লাহ তার দায় নেবেন এটা ভূল কথা।

রুহিনুরের যুক্তিটা হয়তো টুটুল মামার কানে একেবারে গেঁথে গিয়েছে। কীসের মধ্যে কীসের মিল টেনে এতোটা যুক্তি শুনে হয়তো তিনি নিজেও ইন্টেলিজেন্ট হয়ে গেছেন।কারণ তিনি এক ইন্টেলিজেন্ট ব্যক্তির কাছ থেকেই যুক্তি শুনেছেন।রুহিনুর বললো, সকল কাজের দায় আল্লাহ তায়ালা নেন না।তবে তিনি মানুষের ভালো কাজের প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত প্রশংসা পান।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনে বলেন-

مَنۡ جَآءَ بِالۡحَسَنَۃِ فَلَهٗ عَشۡرُ اَمۡثَالِهَا ۚ وَ مَنۡ جَآءَ بِالسَّیِّئَۃِ فَلَا یُجۡزٰۤی
اِلَّا مِثۡلَهَا وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ ﴿۱۶۰﴾

অর্থ – যে সৎকাজ নিয়ে এসেছে, তার জন্য হবে তার দশ গুণ। আর যে অসৎকাজ নিয়ে এসেছে, তাকে অনুরূপই প্রতিদান দেয়া হবে এবং তাদেরকে যুলম করা হবে না। ( সূরা আল আনআম, আয়াত ১৬০)

আপনি সৎ কাজে নিয়োজিত হোন,আপনার মঙ্গল হবে।অসৎ কাজ ধ্বংস ডেকে আনে।

আল্লাহ তায়ালা আরেক আয়াতে বলেছেন–

مَنۡ یَّشۡفَعۡ شَفَاعَۃً حَسَنَۃً یَّکُنۡ لَّهٗ نَصِیۡبٌ مِّنۡهَا ۚ وَ مَنۡ یَّشۡفَعۡ شَفَاعَۃً سَیِّئَۃً یَّکُنۡ لَّهٗ کِفۡلٌ مِّنۡهَا ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ مُّقِیۡتًا ﴿۸۵﴾

অর্থ- যে ভাল সুপারিশ করবে, তা থেকে তার জন্য একটি অংশ থাকবে এবং যে মন্দ সুপারিশ করবে তার জন্যও তা থেকে একটি অংশ থাকবে।আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের সংরক্ষণকারী।( সূরা আন নিসা, আয়াত-৮৫)

টুটুল মামা কোনো কথা না বলে নিজের ক্যাশবাক্সের কাছে চেয়ারে চলে আসলেন।গো হারানি হেরে ওনার মাথা হেট হয়ে গেছে।আর ওদিকে আমার গর্জিয়াস ফ্রেন্ডের দিকে তাকালাম। সে বোধহয় মনে মনে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছে আর বলছে–“হ্যাঁ আল্লাহ যারা বুঝে না তাদেরকে বুঝার ক্ষমতা দিন,জ্ঞান দিন প্রভূ।”

বিঃদ্রঃ- এটি এক বাস্তব ঘটনার উপর লেখা হয়েছে। শুধুমাত্র স্থান ও চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে।

৭।যখন নাস্তিকের সাথে আলাপ

* এক

বিয়ে বাড়ি।সেখানে ঘুমানোর কষ্ট তো থাকবেই।মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ে যেমন এক মাথার বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তেমনি মানুষ হ্যান্ডেল করাও আরেক বোঝা।এই বোঝা আর ওই বোঝা দুই ই সমান।

রুহিনুর গিয়েছে খালাতো বোনের বিয়েতে।বিয়ের আনন্দ উল্লাস উপভোগ করা তার জীবনে তেমনটা হয়নি।একবার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে উপভোগ করেছে,আর করা হয় নি।রুহিনুর পড়াশুনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকে, যার কারনে বাহ্যিক কোনো স্বাধ সে গ্রহণ করতে পারেনি।বাহ্যিক স্বাধবঞ্চিত এক কুঠুরিবদ্ধ পক্ষি যেমনটা।

পক্ষি তো কেউ একজনের আওতায় আবদ্ধ থাকে কুঠুরিতে, নিজের মোহমায়ার স্বাধে পিঞ্জিরা থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রুহিনুর, সে আধুনিক সাজত্যবোধে আকৃষ্ট নয়।নিজেকে নিজে হৃদয় পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে রেখেছে।কখনো বাইরের কোনো আত্মিয়ের বাড়িতে বেড়াতে যায় নি।লাইফে অনেক জায়গায়’ই অনেকে বেড়াতে যায়, কিন্তু রুহিনুর একদম না।এখন কলেজ কয়েকদিনের ছুটি।আবার সে কখনো খালার বাড়িতে যায় ও নি।

এদিকে খালু এসে দাওয়াত দিয়ে গেল বাড়িতে।যেন স্বপরিবারে ওনি সবাইকে দেখতে পান।রুহিনুরের মা জানিয়ে দিয়েছে,রুহিনুর এবার শিওরলি ওদের বাড়ি যাচ্ছে।

ভালোই চলছিল বিয়ের তুলকালাম।খালার অনুরোধে রুহিনুর খালাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি গেল।বাঙালি মুসলিম পরিবারের একটা রিচুয়্যাল আছে।সেই রিচুয়্যাল যেহেতু অর্গানাইজ হলো আজীবন থাকবেই।কনের বিদায়ের সময়ে তার সাথে কনেপক্ষ কাউকে সঙ্গে দিতে হয়।

রুহিনুর কে দেওয়া হলো খালাতো বোনের সাথে।সে কখনো নিজের খালাতো বোনের মুখ কিংবা ছবি দেখেনি।কিন্তু খালাতো বোন তার ছবি দেখেছে।আর এজন্যই সে তাকে চেনে।খালাতো বোনের নাম রাহেলা।বয়সে ছোট।রুহিনুর তার থেকে তিন মাসের বড়।একবার তার মা বলেছিল রাহেলা আর রুহিনুরের বিয়ে দিতে।খালা না করলো,কেবলমাত্র আত্মীয় বাড়াবেন বলে।রুহিনুর তার খালাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠলো।

সেখানে মানানসই চলতে পারছিল সে,কারণ সেখানে এক বন্ধু পেয়েছে সে।বরের চাচাতো বড় ভাই।বিয়ে করেনি সে।বয়স তেমন বেশী নয়।রুহিনুরের বয়স আর তার বয়স কাছাকাছি। রুহিনুরের বয়স একুশ হলে তার বয়স বাইশ কী তেইশ হবে।রাহেলার স্বামী আর তার চাচাতো ভাই পিঠাপিঠি বয়সের।
রুহিনুর ছেলেটার সাথে বন্ধুত্বপূর্নভাবেই কথা বলে,তার সাথে ঘুরাফেরা করে।কিন্তু রুহিনুর এটা মোটেও জানতো না ছেলেটা নাস্তিক। এটা রুহিনুর জানতে পেরেছে সেদিন ফজরের নামাজের সময়।দুজনে একসাথেই ঘুমিয়েছে। রুহিনুর নামাজের জন্য ডাকতে লাগলো,আদনান ভাই উঠেন- নামাজে যাবেন।কিন্তু না,ছেলেটা উঠলো না।রুহিনুর আবার ডাকলো,আদনান ভাই উঠেন না, নামাজ পড়তে হবে তো।আদনান বললো,তুমি নামাজ পড়বে তো আমাকে ডাকছো কেন? রুহিনুর একটু বিস্মিত হলেও এটা বুঝতে পারলো সে নামাজ পড়ে না।রুহিনুর মনে মনে ভাবলো,এই ছেলেকে পরবর্তীতে বুঝানো যাবে।সে নামাজ পড়তে চলে গেল।

সকালের নাস্তা শেষে রুহিনুর আর আদনান বাইরের দিকে ঘুরাতে গেল।রুহিনুর আদনান কে বুঝানোর চেষ্টা করলো, সে যেন নামাজ পড়ে ।আদনান পাল্টা প্রশ্ন করলো রুহিনুর কে। বললো,নামাজ কেন পড়বো? রুহিনুর এমন আনলজিক্যালি কুয়েশ্চান খুব কমই শুনেছে।সে যেন আদনানের ডিফিকাল্ট প্রশ্নে উত্তর দিতে ইতস্তত বোধ করলো। এটা কী একটা প্রশ্ন হলো? “ সর্বজনম সাধের কানাই রাধা রাধা করে – অবশেষে বললো কি-না রাধারাণী কে রে?” তারও দেখি ঠিক একই অবস্থা। মানুষ শুনি সবসময় নামাজ নামাজ করে,কিন্তু নামাজ কেন পড়ে এমন কোনো প্রশ্ন আদৌ কারও মুখে তো শুনিনি।রুহিনুর বললো,নামাজ পড়ি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য,‘ দ্যাটস সিম্পল আর্গুমেন্ট। ’
‘ আর যদি আল্লাহকেই না মানি?’ আদনানের নাস্তিক্যবাদ কোয়েশ্চান শুনে রুহিনুর বুঝতে পারলো, সে এই মুহূর্তে একজন নাস্তিকের সাথে আছে।

শিওরলি এটা জানা হয়ে গেছে এই আদনান এই মুহূর্তে হতাশ হয়ে আছে।রুহিনুরকে সে ধীরস্থিরভাবে বললো,এটা যেন কাউকে বলো না – আমি যে এসব বলছি।এ দেখি সাতপাকালি নাচ।মাথা ঘুরিয়ে নাচতেও মানা করবো না,আবার নাকি মাথাও ঘুরাবে না।রুহিনুর বললো,আচ্ছা ঠিক আছে কাউকে বলবো না।সে রুহিনুর কে বুঝানোর চেষ্টা করলো ধর্ম বলতে একটা বিবাদ মাত্র,আর ইশ্বর বলতে প্রকৃতির অবমাননা।শুনে রুহিনুর হাঁসতে লাগলো।
সে বললো,কেউ কী চায় ধর্ম আলাদা আলাদা রেখে বিবাদ সৃষ্টি করতে? আর রইলো আপনার ইশ্বর সংক্রান্ত ভূল মন্তব্য।আপনি বললেন ইশ্বর বলতে প্রকৃতির অবমাননা। আপনি কী এটা বলতে চাইছেন,ইশ্বরকে বিশ্বাস করলে প্রকৃতির সবকিছু নিছক হয়ে যাবে?

আদনান হাঁ বোধক মাথা নারলো।

রুহিনুর বুঝতে পারলো না,নাস্তিকরা এরকম কোনোকিছু অভজার্ভ করে কীভাবে।এদের এক্সপেরিমেন্ট তো ক্লাসিকাল বা আনক্লাসিকাল বুঝাটাও দুস্কর।

রুহিনুর আদনান কে বুঝানোর চেষ্টা করলো।সে পবিত্র আল কোরআনের একটি আয়াত বললো–

وَ مَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡهُ ۚ وَ هُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۸۵﴾

অর্থ–“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত -৮৫)

আদনান রুহিনুর কে বললো,তুমি কী আমাকে ধর্মের গোঁড়ামি দেখাচ্ছ? আমি আল কোরআন বলতে কিছু বুঝি না,আর এর কথা বিশ্বাস করবো কীভাবে? আদনান বললো,এখন ধরে নাও কোনো একজন মানুষ মারা গেল।তাকে ধৌত করা হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে।সেই স্থানে মোমবাতি জ্বালানো হয় চল্লিশ দিনভর।কারণ সন্ধ্যায় এই মৃত ব্যক্তির আত্মা এখানে এসে ঘুরোঘুরি করে।

রুহিনুর বললো, না। এটা কোনো বাস্তবসম্মত কথা নয়।“ডেমোক্রেটিক কথ্যে- মানুষ মরলে ধৌতস্থানে মোম দিতে হয়,কিন্তু এটা বাস্তবিক কুসংস্কার। ”

‘ইডজেক্টলি,আমি সেটাই তোমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি।মানুষ যা ভাবে তা কাল্পনিকভাবে ভাবতে থাকে।আর তা সবসময় সত্য হয় না।’ আর এখন তুমি যা বললে, আল কোরআনে উল্লেখিত রয়েছে-

–“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত -৮৫)

এটা কীভাবে সত্য হতে পারে? ইসলামের ধার্মিকেরা বলে ইশ্বর আছে,যা নাস্তিকেরা নেই বলে সম্বোধন করে।ইসলাম বলে কোরআন ইশ্বরের বাণী,নাস্তিকেরা বলে মোহাম্মদের।ইসলাম বলে, ধর্ম মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে,নাস্তিক বলে পাপ সব ধর্মের শিকর।ইসলাম বলে কোরআনে ১৪০০ বছর আগে থেকেই যা উল্লেখ আছে, তা বৈজ্ঞানিকগণ এখন প্রমাণ করতে পারতেছে, কিন্তু নাস্তিক বলবে গ্রিক পুরাণ,বাইবেল এবং বৈজ্ঞানিকদের ধারণা মেরে দিয়ে কোরআনের সৃষ্টি।

রুহিনুর এসব শুনতে পেয়ে একদম শিওর হলো আদনান কোন কোন দিক দিয়ে নাস্তিক। তাকে এই সবগুলো বুঝাতে হবে।রুহিনুর বললো,আদনান ভাই- আপনি আমার কাছ থেকে ওসব প্রশ্নের উত্তর নেবেন? আমি যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুর অ্যানসার আমি আপনাকে দেব ইনশাআল্লাহ। আদনান বললো,যেখানে আমার কোনো কোয়শ্চান নেই সেখানে আবার অ্যানসার আসলো কোথা থেকে? এগুলো তো আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস।‘ বলতে পারেন তাই’ আপনি চাইলে আমি আপনার বিশ্বাসকে যুক্তিসহ অবিশ্বাস এবং আপনার অবিশ্বাস কে যুক্তিসহ বিশ্বাসে পরিণত করতে পারবো।

আদনান একটু অবাক হয়ে বললো,তাই নাকি! তাহলে চলো।

‘ কোথায়?’

সামনে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে,আজ সেটি বন্ধ। সেখানে পার্কের দোলনায় বসে কথা হবে।এভাবে রাস্তায় তো এসব বলা যায় না।(রুহিনুর চললো আদনানের সাথে)

রুহিনুর আদনান কে জিজ্ঞেস করলো সে ইশ্বরে বিশ্বাসী কি-না।সে বললো,না।রুহিনুর আদনানের সেই পুরনো কথাটা মাথায় রেখেছে। আদনান বলেছিল “ধর্ম বলতে একটা বিবাদ মাত্র,আর ইশ্বর বলতে প্রকৃতির অবমাননা।”
ইশ্বর, ইসলাম যাকে আল্লাহ বলে।তিনি এক ও অদ্বিতীয়। বলতে পারেন কোরআন মানেন না।তবে এটা কোরআনের আলোকেই বুঝানো ভালো হতো।না হয় বাদই দিলাম। আপনি বলেছেন ইশ্বর,স্রষ্টা বা আল্লাহ বলতে কেউ নেই।তাহলে এই মহাবিশ্ব কার অর্ডারে চলে- বা মহাবিশ্ব পরিচালনা করেন কে?

আদনান বললো,আমি তো আগেই বলেছি ইশ্বর বলতে প্রকৃতির অবমাননা। তোমার প্রশ্ন মহাবিশ্ব কার অর্ডারে চলে -বা মহাবিশ্ব পরিচালনা করেন কে। ইটস সিম্পল অ্যানসার।মহাবিশ্ব তো তার প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে।আর এটা প্রাকৃতিকভাবেই পরিচালিত হতে থাকে।সুতরাং কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয় না।এতে স্রষ্টা বলতে কোনো বস্তুর অবলম্বন করলে প্রকৃতির অবমাননা করা হবে।কারণ প্রকৃতির নিয়মে সবকিছু চলে।

রুহিনুর বললো,-‘তাহলে প্রকৃতি কোথা থেকে এলো? ’ আদনান বলতে পারলো না।রুহিনুর তার গর্জিয়াস যুক্তি উপস্থাপন করতে লাগলো।সে বললো– যদি আল্লাহ বলতে বা স্রষ্টা বলতে কেউ না থাকে তাহলে এই মহাবিশ্ব চলে কীভাবে? আর যদি মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে,তাহলে প্রকৃতি আসলো কোত্থেকে? অবশ্যই এটা মেনে নিতে হবে, পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তার স্রষ্টা বলতে কেউ না কেউ আছেই।যেমন- একটা টেলিস্কোপ, একটা রেফ্রিজারেটর কিংবা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা।যদি কেউ বলে এই টেলিস্কোপটা কে বানিয়েছে? তখন আপনি কী বলবেন? তখন হয়তো বলবেন এটা তার অাবিষ্কারক বানিয়েছে।নইলে বলবেন তার স্রষ্টা, তার উদ্ভাবক,উৎপাদক বা যা’ ই বলা যায়।কিন্তু এটা কেউ না কেউ তো বানিয়েছে সত্য।তাহলে এটাও বুঝতে হবে মহাবিশ্ব যেহেতু সৃষ্টি হয়েছে তার সৃষ্টিকর্তাও রয়েছে। আর তিনিই সবকিছু দেখেন এবং পরিচালনা করেন।

রুহিনুরের কথাগুলো আদনান মনোযোগ সহকারে শুনছিলো।রুহিনুর বললো;- আপনার আরেক উক্তি “ ধর্ম একটি বিবাদ মাত্র”। এটা আদৌ সত্য নয়।ধর্ম হচ্ছে সঠিকভাবে জীবনধারণ করার পন্থা।ধর্মে রয়েছে স্রষ্টাভীতি,তার ইবাদত এবং পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার কলাকৌশল। কিন্তু অনেক বিধর্মীগণ ধর্মকে বিবাদ বলার কারণ রয়েছে।কারণ, তারা এটাই মনে করে ধর্মকে মেনে চললে মানবতা বোধ লোপ পায়।তারা মানবধর্মে বিশ্বাসী।শুধু মানবধর্মে বিশ্বাস করলে সেটা মানবিক কল্যাণে এগিয়ে গেলেও তার মধ্যে ইবাদত বলতে কোনো ছায়াসন্ধি প্রবেশ করে না।তাই ধর্মকে বিবাদ বলা যায় না কিংবা প্রাদান্য না দিয়ে পারা যায় না।

নাস্তিক আদনান রুহিনুরের যুক্তিতর্ক শুনে কিছুটা নরম হলো।তার মধ্যে একটা সত্যতা বিরাজ করেছে।সত্যতা এটাই, সে এতোদিন যা ভেবেছি তা নিজের কল্পনামাত্র।সে আগে কখনো যুক্তি সহকারে ভেবেই দেখেনি, যেভাবে রুহিনুর বললো।তবুও তার জানার আগ্রহ রয়ে গেছে।সে রুহিনুরকে জিজ্ঞেস করলো,তাকে আস্তিক হতে কী কী করতে হবে? আর যেগুলো নিয়ে তার ভ্রান্ত ধারণা সেগুলো সম্পর্কে সঠিক উত্তর জানতে হবে।আদনান রুহিনুরকে জিজ্ঞেস করলো, কোরআন আল্লাহর বাণী, নাকি মোহাম্মদের?

“ আল্লাহর বাণী কোরআন”। কারণ কোরআনে এমনকিছু উল্লেখ রয়েছে যা মোহাম্মদ পৃথিবীতে মরু দেশে থেকে এগুলো সম্পর্কে জানতে পারতো না।আল্লাহ তায়ালা তার দেওয়া ওহির মাধ্যমে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জানিয়েছেন। আর পবিত্র কোরআনকে আল্লাহ তায়ালা নবী মোহাম্মদের উপর নাজেল করেছেন। কোরআনে একটা বিষয় উল্লেখ আছে, যা নবী মোহাম্মদের মরুর দেশ থেকে জানার কথা নয়।কোরআনে উল্লেখ আছে –

وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ وَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ ﴿۳۳﴾

অর্থ – “আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবস এবং সূর্য ও চন্দ্র; প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।” ( সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত-৩৩)

আদনান বললো,এতে কী প্রমাণিত হয়?

‘ প্রমাণিত এটাই কোরআন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রচিত নয়।এটা আল্লাহ তায়ালার বাণী।আরব দেশে থাকা একজন মানুষ কীভাবে দিন ও রাত্রি সৃষ্টি, সূর্য ও চন্দ্রের সৃষ্টি এবং তারা নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরন করে জানতে পারলেন? নিশ্চয়ই ১৪০০ বছর আগে কোনো টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয়নি,যার মাধ্যমে তিনি এটা জানতে পারবেন।তাই বলা যায়,আল কোরআন মোহাম্মদের রচিত কোনো গ্রন্থ নয়,এটা এসেছে সরাসরি আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে।আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মহাবিশ্বের সবকিছুই তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরন করে।এগুলো বিজ্ঞান সহজে প্রমাণ করতে পারেনি।

বিজ্ঞান তিনমুখী উত্তর প্রদর্শন করেছে কালে কালে।তারপর নিশ্চিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে।বৈজ্ঞানিক টলেমি বলেছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ ও সূর্য ঘুরছে।তিনি একটি মডেল তৈরী করেন এসবের উপড় ভিত্তি করে। কিন্তু অবশেষে গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং কোপারনিকাস তার ধারণা কে ভূল প্রমান করেন এবং বলেন সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ ঘুরছে।তারা এটা কখনোই বলেনি প্রত্যেক গ্রহ উপগ্রহ ( তেমনকি সূরসূর্য ও)নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং, প্রত্যেকটি গ্রহ ও উপগ্রহ তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে ঘূর্নায়মান,যা ১৪০০ বছর আগে মহান আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে লিপিবদ্ধ করেছেন।

আদনান সায়েন্সের ছাত্র বলে সে এটা খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো। রুহিনুর সায়েন্সের ছাত্র হলেও প্রত্যেক গ্রুপের ধারনা তার আছে।

রুহিনুর আদনান কে একসাথে দুটো প্রমাণ করে দেখালো।কোরআন যে মোহাম্মদের বাণী নয়,আল্লাহ তায়ালার বাণী।

এটা সত্য এবং কোরআনে যা ১৪০০ বছর আগে লিপিবদ্ধ হয়েছিল বিজ্ঞানীরা এখন ধীরে ধীরে তা প্রমান করছে।সুতরাং কোরআনে যা বর্ণিত রয়েছে তা গ্রিক পুরাণ কিংবা বাইবেলে নেই।তাই বলা যায় কোরআন একটি শ্বাশত গ্রন্থ যা মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী।

দুই

আদনান আর রুহিনুর জোহরের নামাজ আদায় করে বাসায় চলে আসলো।আদনান এখন পুরোপুরি আস্তিক হয়ে গেছে।কিন্তু তার জানার কৌতূহল রয়ে গেছে।তাই সে রুহিনুরের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চাইলো।আদনান রুহিনুরকে একটা বই দেখালো।বইয়ের নাম “ আমার অবিশ্বাস ”। লিখেছে বাংলাদেশেরই একজন লেখক। নাম হুমায়ুন আজাদ।এই বইটা সে রুহিনুরের কাছে দিল।রুহিনুর বইটার কয়েকটি লাইনে চোখ বুলালো।বইটিতে লেখা;-

“ ধর্মগুলো কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ পাঠায়নি,তেমন কেউ নেই; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীই সৃষ্টি করেছে এগুলো।কোনো পরম সত্য যদি থাকতেন,এবং তিনি যদি পৃথিবীতে ধর্মের প্রয়োজন বোধ করতেন। (সম্ভবত বোধ করতেন না,তুচ্ছ মানুষের তুচ্ছতর স্তব তার ভালো লাগতো না),তাহলে একটি ধর্মই পাঠাতেন তিনি।”

তাছাড়া ও হুমায়ুন আজাদের বইয়ের একই পৃষ্ঠায় উল্লেখিত –

“ ধর্মগুলো বিশ্বসৃষ্টি, মানবসমাজ,মানুষের পরিণতি সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রতিযোগী তত্ত্ব ;– পরস্পরবিরোধী, ও ভূল।এ জন্যেই বহু সরল প্রশ্নের উত্তর এগুলো দিতে পারে না; সাধারণত নিষেধ করে প্রশ্ন করতে। এগুলো কথা বলে এমনভাবে, যা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায়।যা প্রমাণ ও অপ্রমাণ করা যায় না,তা অবৈজ্ঞানিক। ”

আদনান প্রশ্ন করলো ;- হুমায়ুন আজাদের কথা মতো কী এটা সত্য, মানুষেরা মানুষেরা ধর্ম সৃষ্টি করেছে? আর একটি ধর্মই কী মানুষের জন্য প্রযোজ্য ছিল?

রুহিনুর বললো,এটা ভূল যে মানুষেরা মানুষেরা ধর্ম সৃষ্টি করেছে।আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরিক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধর্ম দিয়েছেন। তবে তিনি পবিত্র আল কোরআনে ইসলাম ধর্মকেই একমাত্র মনোনীত ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰهِ الۡاِسۡلَامُ ۟ وَ مَا اخۡتَلَفَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَهُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ فَاِنَّ اللّٰهَ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ ﴿۱۹﴾

অর্থ–“নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরও তাদের মধ্যে মতানৈক্য ঘটিয়েছিল!আর যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে), নিশ্চয় আল্লাহ সত্বর হিসাব গ্রহণকারী।”( সূরা আলে ইমরান, আয়াত -১৯)

তাছাড়াও তিনি একই সূরায় আবার বলেছেন –

–“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।”( সূরা আলে ইমরান,আয়াত-৮৫)

আল্লাহ তায়ালা পাক রাব্বুল আলামিন কেবলমাত্র ইসলামের কথাই উল্লেখ করেছেন।আর ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীরা যে আখিরাত জীবনে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তার নিশ্চয়তা রয়েছে এই আয়াতে। সুতরাং , হুমায়ুন আজাদের কথার কোনো ভিত্তি নেই।ওনি যা বলেছেন তা কেবলমাত্র অযৌক্তিক। আল্লাহ তায়ালা একটি ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন।আর এ ধর্মই শুধু মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়,তা বুঝা যায় মানুষের আচরনে।তবে এই কথাটির দিক দিয়ে হুমায়ুন আজাদের কথাটি সামান্য ভিত্তি:স্থ।

আদনান তখন আরেকটি প্রশ্নের সম্মুখে আসলো।যারা নাস্তিক বা স্রষ্টা, ইশ্বর, আল্লাহ’র প্রতি অবিশ্বাসী তাদের পরিণতি কী হবে? তারা ও তো একটি বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। যেমনটা আস্তিকেরা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই বলে,আল্লাহ আছেন।

‘ এটা সত্য যে বিশ্বাসের উপরেই আস্তিক ও নাস্তিক উভয় দলের সবকিছু। একদল বিশ্বাস করে স্রষ্টা আছে,আরেক দল বিশ্বাস করে স্রষ্টা নেই।’ ধরে নাও তুমি টয়লেট পরিষ্কার করো,আর তোমার বন্ধু অফিসে সুপারভাইজারের চাকরি করে।এখন তুমি কী তার সামনে গিয়ে বলতে পারবে আমি চাকরি করি? ব্যঙ্গলিটা সরকার কিন্তু সবগুলো কাজকে ইমপ্লয়ই হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও “সকল কাজই সমান” এটা বলেছে।তাহলে কী টয়লেট পরিষ্কার করা আর সুপারভাইজার হওয়া কাজ নামে এক হলেও যোগ্যতায় এবং কর্মদক্ষতায় এক হবে?

‘ না,এক হবে না।’ তবে – দুটোই কাজ তো বটেই।

— তাহলে তো নাস্তিকগণ যেমন বিশ্বাস করে স্রষ্টা নেই, আস্তিকগণ বিশ্বাস করে স্রষ্টা আছেন উভয়টাই সত্য।কারণ – দুটোই তো বিশ্বাস। যদি একজন ভালো কাজ করে এটাও কাজ,আবার যদি খারাপ কাজ করে এটাও কাজ।ভিন্নতা হলো একটা খারাপ দিকের আরেকটা ভালো দিকের।সবসময়ই কোনোকিছুর দুটো দিক থাকে।একটা ভালো দিক এবং একটা খারাপ দিক।নাস্তিকগণ যে যেভাবেই যুক্তি দিবে তা ইসলামের বিপরীত। এগুলো কখনোই ইসলামের জন্য যৌক্তিক নয়,বরং কুযৌক্তিক।আর আস্তিকদের বিশ্বাস যেমন সত্য ও ন্যায়ের উপর দন্ডায়মান ঠিক এর যুক্তি মানবজাতির কল্যাণ ও শুভবোধের জন্য।বিশ্বাসের বা কোনো চিন্তার ভিন্নতা তখনই বুঝতে পারা যায় যখন দুটি পক্ষ থাকবে।যেহেতু আস্তিকদের বিশ্বাস স্রষ্টা ও দ্বীন ইসলামের প্রতি তাই এটাই সত্যের গালিচা হিসেবে প্রাধান্য পাবে।এটাই সু বিশ্বাসের মানদণ্ড।
নাস্তিক, বিধমী বা স্রষ্টায় অবিশ্বাসীগণ আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কে কুটুক্তি বা মিথ্যা বলে তাদের নিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۱﴾

অর্থ–“আর যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তার থেকে অধিক যালেম (অত্যাচারী) আর কে? যালেমরা অবশ্যই সফলকাম হবে না। ”( সূরা আল আ’নআম,আয়াত-২১)

আদনান কে রুহিনুর জিজ্ঞেস করলো;- তার দেওয়া প্রশ্নটা কী?

‘ যারা নাস্তিক বা স্রষ্টা, ইশ্বর, আল্লাহ’র প্রতি অবিশ্বাসী তাদের পরিণতি কী হবে?’- এটা ছিল আদনানের প্রশ্ন।

রুহিনুর বললো,তাহলে এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তাদের পরিণতি কেমন হবে।আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন যারা আল্লাহকে নিয়ে কিংবা ওনার আয়াতসমূহকে নিয়ে মিথ্যা বলে তারাই সবচেয়ে বেশী অত্যাচারী।আর তারা কখনো কোনোকিছু সাফল্য অর্জন করতে পারবে না।“

“আল্লাহতে আস্থা রাখতে হয়, কারণ- তিনিই তার জোগান দেন যা আমরা চাই।তিনি অগ্রিমতার দায় নছিবে লিখেন।”
মনে রাখবেন ;- “ সৃষ্টিকর্তা তিনিই যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন যিনি আমাদের স্বভাব অনুযায়ী তকদির লিখেছেন। ”

( আদনান তার বাস্তবতা আবার নতুন করে শুরু করলো। রুহিনুর তাকে সাহায্য করলো নতুন বাস্তবতার আহ্বানে।) – একমাত্র অবলম্বন মহান আল্লাহ।।

৮। পীরপ্রথা বনাম ভন্ডগাঁথা

*
এক

আঃ বারিকের চাচা শ্বশুর বিলাতে থাকেন।ওনার বয়সটাও খুব বেশী নয়। ওনার বড় ছেলেটার বয়স আঠারো – উনিশ কিম্বা তার চেয়ে কিছু বেশী হবে।তারপরে একটা মেয়ে সন্তান যার বয়স সতেরো’ র কাছাকাছি। আর সবচেয়ে ছোট ছেলটার বয়স হবে ১২ বছর,যার জন্মের ছয়দিন পরই তাদের বাবা বিলাতে চলে যান।

বলতে পারো আঃ বারিকের প্রসঙ্গটা কেন তুললাম।মূলত তার চেনাতেই তার চাচা শ্বশুর পীর ভজেছিলেন।

আঃ বারিক গল্প করতে খুব ভালোবাসে। সেদিন আঃ বারিক কাউকে যেন তার চাচা শ্বশুরের কথা বলছিল।প্রথমত সে বলছিল চাচা শ্বশুরের বংশ সম্বন্ধে। সে বললো–

’আমার চাচা শ্বশুর হলেন লিয়াকত তালুকদার।আমার শ্বশুর আকমল তালুকদার ওনার নামটা খুব আদর যতনে রেখেছেন।’

সে আর কী বলা যায়? ভারি লজ্জ্বার কথা এটাই যে আমার চাচা শ্বশুড় আমার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট।ব্যাপারটা হলো আমার শ্বশুড়মশায় জন্মগ্রহণ করার পরে ওনার ছোট আরো তিনজন জন্ম নিলেন দাদা শ্বশুরের গৃহে।জানিনা কীভাবে জানি তারা মারা গেলেন।দাদিমা এখনো বে়ঁচে আছেন।ওনি সন্তান হারানোর কতই যে শোক জ্ঞাপন করেছেন তার অন্ত নেই।

আমার শ্বশুর মশাই যখন বিয়ে করেন তখন নাকি আমার বয়স তিন বছর। এটা শুনেছি আমার মায়ের কাছে।আমরা একই গ্রামের।আমার মা আমার শ্বশুরের দূর সম্পর্কের বোন হোন- যা সম্ভবত শুনেছি।শ্বশুরমশাই বিয়ে করার বছর দেড় এক পর আমার স্ত্রীর জন্ম,যে কিনা শ্বশুর শ্বাশুরির একমাত্র আদরের সন্তান।তার ক’ দিন পর চাচা শ্বশুরের জন্ম।আমার স্ত্রী তার চাচার চেয়ে চারদিনের বড়।

“ আঃ বারেক তার এক প্রতিবেশীর কাছে আরো অনেক গল্প করছিল।” তখন রুহিনুর সেদিকে হেটে যাচ্ছিলো।সে’ই সবকিছু শ্রবণ করে আমাকে বলেছিলো।আমি তো তা শুনে অবাক।ভাস্তি চাচার চেয়ে ছোট কথাটি শুনে।

একদিন আঃ বারিকের চাচা শ্বশুর তার স্ত্রী মাহিয়া কে ফোন দিয়েছে।কোথায় বিলেত কোথায় বাংলাভূম! সেদিন তাদের বাড়িতে পীর বাবা এসেছেন।লিয়াকত তালুকদার বললে;- শুনো চুমকির মা- বাবার যেন আদর আপ্যায়নে খামতি না পড়ে।আর চুমকি আর চুটন কে বলে দিও ওনার কথার অবাধ্য না হতে।

মাহিয়া বেগম নিজের স্বামীর কথায় জ্বী, আচ্ছা জ্ঞাপন করছেন।পীর বাবা বাড়িতে এলেন সে তো খুশি হবার কথা। কিন্তু চুটনের মন খারাপ।সে পীর বাবাকে সহ্যই করতে পারে না।কিন্তু একেবারে ছোট ভাই চন্টু সে পীর বাবা কে খুব ভালোবাসে।ওদিকে চুমকি ও পীর সাহেব কে নিজের দাদা মহাশয়ের মতোই আপ্যায়ন করে।পর্দাপ্রথাকে সে কটাক্ষ করতে চায় না।সবসময় সে কুন্তলঃশীর ওড়নায় ঢেকে রাখে।বাবার কথামতো দাদা সাহেবের আপ্যায়নে মেয়েটি মশগুল।কিন্তু,চুটন তাকে বরাবরই কথা শুনিয়ে নেয়।চুমকি বলে,ভাইয়া তুমি অযথা বকো না।তোমার বোন পরপুরুষ দেখে গাবরে যাবে না।

চুটন বললো,বেটার চোখের চাহন দেখেছিস কী নোংরা? মা বাবা কী গুণ দেখে যে এই ভন্ডপীর ঘরে আনলো তারাই জানে।দূর ভাল্ লাগে না।চুটন রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বাহিরের দিক দিয়ে চলে গেল।
মা এসে চুমকি কে জিজ্ঞেস করলে সে বরং উল্ঠোটা বললো।ভাইয়া চায় যেন দাদা মহাশয় ভালো আপ্যায়িত হোন।কিছু ত্রুটি হয়েছে দেখে সে রাগান্বিত হলো।

ও দিকে পীর বাবা চৌকিতে বসে সিদ্ধি খাচ্ছেন।গাজা, যাকে মুলত গাজা বলা হয়।পীর বাবা গাজাকে সিদ্ধি বলেন এবং ছন্দ মেরে বলেন-

“ সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি মেলে – খেয়ে দেখনা তোরা
দেখবি আঁধার নাচচে আলোয়, নাচচে বসুন্ধরা।”

বোকা মার্কা ছন্দ সে বলেই যাচ্ছে।আহা রে,কী যে রুপের ছিরি! লম্বা দাড়ি গোঁফ , লম্বা চুল।মাথায় লাল কাপড়ের পট্টি বাঁধা, যাকে গ্রাম অঞ্চলে শালু বলে।পরনে টুকটুকে লাল শার্ট পথুয়া এবং লাল টুকটুকে লুঙ্গি।বাম হাতে মোটা দুটি স্টিলের চুড়ি।সব মিলিয়ে এক অনন্য রুপে বাবা পীর আগমন হয়েছে।ঢাকা শহরে এমন পীর দেখা যায় না।

দুই

আমি আর রুহিনুরের ভ্রমন কাহিনি মূলত এটা।আমরা দুজন ময়নামতি দেখার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা গিয়েছিলাম। দেবিদ্বার চান্দিনায় গিয়েছি দুজন।সেখানে নিলু দা’ র জ্যাঠীর বাড়ি।নিলু দা হলো আমাদের ঢাকার ফ্রেন্ড’দের মধ্যে একজন।ওনি আমাদের চেয়ে বয়সে দশেক বড় হলেও আমাদের সাথে ওনার বন্ধুত্বভাব রয়েছেই।ওনার একটা লাইব্রেরী আছে।যখন মন চায় আমি আর রুহিনুর ওনার লাইব্রেরী থেকে বই কিনি।তবে বেশীরভাগই বিনা টাকায় বই নিই।
দেবিদ্বারে যখন পা রাখলাম তখন নিলু দা’ র জ্যাঠুমশায় আমাদের তিনজন কে সু স্বাগতম জানালেন।ওনাদের পাশের ঘরেই পীর বাবা।ওদের ঘর থেকে পীর বাবার ছন্দটা পুরোই ভেসে আসছে-

“ সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি মেলে, খেয়ে দেখনা তোরা
দেখবি আঁধার নাচচে আলোয়, নাচচে বসুন্ধরা।। ”

হিন্দু মুসলমানের যৌথ গ্রাম এটা।তবে বেশীরভাগই মুসলমান,যার কারণে হিন্দুরাও মুসলমানদের মতো আচরন করে।আমরা যে ঘরে থাকি বুঝাই যায় না ওনারা হিন্দু। আর আমাদের নিলু দা কে তো নয়’ ই।

নিলু দা আরবি ফারসি ভাষা খুব জানে।অনেক হাদিস সম্পর্কে তার ধারণা আছে।তাছাড়াও কুরআনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথার যথাযথ ব্যাখ্যা সম্পর্কে তার ধারণা আছে।
আমরা সেদিন বের হলাম গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই চুটনের সাথে দেখা হলো।সে একটা বটমুলে মাথা গুঁজিয়ে বসে আছে।রুহিনুর তার সাথে ভাব বিনিময় করতে এগিয়ে গেলো।রুহিনুর তার সাথে মিলে গেল।চুটন আমাদের চেয়ে বয়সে তেমন বড় হবে না।এক – দু বছরের বড় হবে।

চুটন কেন তাদের ঘরে আসা পীর কে সহ্য করতে পারছে না রুহিনুর জানতে চাইলো।চুটন বললো-
ওনার আচার আচরণ একদম খারাপ।কোনো পীর সাহেব আসলে আল্লাহ রাসুলের দুরুদ কালাম পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। মানুষকে সে সৎ পথে আনার চেষ্টা করবে, হারাম খাদ্য বর্জন এবং হালাল খাদ্য গ্রহণ করার কথা বলবে।কিন্তু না- সে নিজেই ওগুলো কটাক্ষ করে,ওসব সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তবে সে কাকে কী শেখাবে? গাজা খাওয়া, বলুন তো? আবার কী সুন্দর ছন্দ বলে।গাজা নাকি সিদ্ধি।ছন্দ বলে-

“সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি মেলে,খেয়ে দেখনা তোরা
দেখবি আঁধার নাচচে আলোয়, নাচচে বসুন্ধরা।। ”

নিজে তো গাজা খাবেই অন্যকে ও শিক্ষা দেবে।আঁধার যদি এটা খেলে আলোকিত হতো তবে কী আর কেউ দিন রাতের পার্থক্য দেখতে পেত?
সব কিছুর মূল আমার বাপ মা আর ঐ নেকড়ে বারিক।আমার তো আঃ বারিককে সহ্যই হয় না।আবার নাকি দুলাভাই।

চুটনের কথা শুনে যেন আমার মনেও সন্দেহ বিরাজ করলো।

তিন

রুহিনুর তো পীর বাবার আচরণের প্রতি পুরোপুরি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে।রুহিনুর চুটনকে বললো;- ‘ প্লিজ ডন্ট ওএ্যারি, আই উইল ট্রাই টু হেল্প ইউ।’
অমন সময় পীর সাহেব চায়ের স্টলের দিক দিয়ে আসছিলেন।চায়ের স্টলের ভিতরে এসে বললেন,এই বেটেয়া এক কাফ চা দ্যাও তো।ওনি চায়ের কাফ নিয়ে আমার পাশে না বসে বরং আমাকে ধমক দিলেন।বললেন,বেটা ওঠ তো এখানে বসবো আমি।ওনার কথা শুনে বরাবরের মতো আমি ওঠে গেলাম।রুহিনুরের পাশেই বসলেন তিনি। এক হাতে চায়ের কাফ আর এক হাতে গাজা।কীভাবে যেন এক টানেই আমাদের আগে চা টা খেয়ে নিলেন।”এই বেটা কাফখানা নে।”

আজ্ঞে, আসছি বাবা।তারপর চা ওয়ালা কাফটা নিয়ে গেলো।বাবা আর কিছু খাবেন? স্টলের মালিক এমন উক্তির কারণ অবশ্য বুঝতে পারলাম। সে ও এই বাবা মহাশয়ের ভক্ত। চা ওয়ালা এসে পীরসাহবের পা টিপতে লাগলেন।বাবা কতদিন ধরে যে আপনার সেবা করি না।ওদিকে পীর সাহেব দমাদম গাজা খেয়ে যাচ্ছেন।রুহিনুর তো আর এসব সইতে পারছে না এসব দেখে।সে হুট করে বলেই দিল,এই যে সাহেব গাজা খাওয়া ক্ষতিকর।কিন্তু না,ওনি রুহিনকে ধমক দিয়ে বললেন-“ আমায় শিখাস বেটা?” সাহস তো দুর্দান্ত হয়েছে বটে।তুই কী খাবি? খেলে নে,নইলে যা- জ্ঞান দিস নে।

রুহিন তো ওসব আর সহ্য করবে না।এই যে শুনুন,আমি আপনার ওসব ছাইপাশ খেতে আসিনি।আপনাকে হুশিয়ার করতে এসেছি।প্লিজ আপনি এসব খাবেন না।“যখন আপনি একাকিত্ব বোধ করবেন আল্লাহ কে ভয় করুন।নামায পড়ুন,বেশী বেশী দুরুদ পড়ুন,তাসবিহ পড়ুন, দেখবেন হৃদয়ে শান্তি আসবে।”

চা ওয়ালা বললো,এই মিঞা কোত্থেকে আসলেন? ভালোই তো জ্ঞান দিচ্ছেন দেখছি।ওনি যে পীর সাহেব চোখে লাগছে না?ওনার কাছ থেকে কোথায় জ্ঞান নেবে, না জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছে। আরে,দু কথা শিখে নাও কাজে লাগবে।রুহিনুর তো পুরো রাগান্বিত হয়ে গেলো।তবুও জানি তার মাথাটা কেমন শান্ত্বতা অনুভব করছে।খুব সুন্দর মাধুর্যভাবে কথা বলছে ওদের সাথে।সে বললো,দেখুন পীর সাহেব;- “গাজা খাওয়া ভালো নয়।” আর আপনি তো শিষ্যদের আত্মাকে সুশিক্ষায় উদ্ভোবিত করবেন।কিন্তু তা না করে গাজার তালেম দিচ্ছেন? পীর বাবা বরাবরের মতন উত্তর দিলেন,মারফত কী তোদের মতন মূর্খরা বুঝবি রে? মারফত বুঝতে হলে মুর্শিদ ভজতে হয়।তুই আমার কাছে তালেম নিস।ওই যে ওদিকের ঘরটাতে থাকি।মনে হলে যাস।তোকে গাজা কী জিনিস শিখিয়ে দেব।( পীর সাহেব রুহিনুর কে চুটনদের ঘর দেখিয়ে দিল)।তারপর পীর সাহেব চলে গেল।
“এরকম ভন্ডদের একদম ভালো লাগে না ”- কথাটি বলে রুহিন সেই স্থান প্রস্থান করলো।আমি আর নিলু দা তার পেছন পেছন গেলাম।
কী রে, এতো রাগারাগি করলে কী চলে? নিলু দা রুহিনকে বললো।
— তো কী করবো,নিজে মূর্খ – আর আমাকে মূর্খ বলছে।

তারপর আমরা এদিক ওদিক অনেক ঘুরোঘুরি করে গ্রামের চারদিক উপভোগ করলাম।ঘুরতে ঘুরতে আছরের আযান দিল।আমি আর রুহিনুর নামাযে চলে গেলাম।নিলু দা আমাদের জন্য বাহিরে অপেক্ষা করছে ভাবলাম।কিন্তু না,নামায থেকে বেরিয়ে দেখি সে নেই।সে গিয়েছে চুটনদের বাড়ির মসজিদে।তার কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম।আমরা ভূবন দা’র কথামতো সেখানে চলে গেলাম।দেখলাম ঐ পীর মহাশয় নামাযেও আসেনি।ও সব ভন্ড পীরেরা মারফত নামক তরীকা একদম নষ্ট করেই ছাড়বে।মারফতের মরমি সাধনা কে গাজা আর লিপ্সা দিয়ে জর্জরিত করে ফেলছে।রুহিনুর আরো কত কী বললো।আমরা অবশেষে চলে গেলাম নিলু দা’র জ্যাঠির বাড়িতে।দেখলাম জ্যাঠি মা গীতা পাঠ করছেন হিন্দু শাস্ত্রের।ওনাকে আর বিরক্ত করলাম না আমরা।ওনি আমাদের দেখলে কাজে কাজেই জিজ্ঞেস করতেন কোনো কিছুর দরকার আছে কী? আমরা বেরিয়ে গেলাম,ওনি দেখার আগেই।রাত হয়ে গেল আসতে আসতে।এতক্ষণ বাজারে ছিলাম।আমাদের বইপোক রুহিনুর বই কিনবে বলে বাজারের লাইব্রেরিতে গেল।আরিফ আজাদের “ মা,মা,মা এবং বাবা” বইটি সে কিনে আনলো।আর কিনলো “হাদিসে কুদসি ” হাদিসগ্রন্থ।এগুলো সম্ভবত তার সংগ্রহে ছিল না।

আমরা বাড়িতে ফিরলে জ্যাঠির কাছে শুনলাম চুটন নাকি এসেছিল আমাদের খোঁজ করে।আমরা চুটনদের ঘরে গেলাম।গিয়ে দেখলাম চুটন ঘরে নেই।তার মা বসার কথা বললেও না বসে বেড়িয়ে পড়লাম।চুটন মনে হয়ে সেই গাছটির নীচে বসে আছে।আমরা তার খুঁজ করলে অবশেষে তাকে সেখানেই পেলাম।আমাদের দেখে চুটন উঠে গেল এবং রুহিনকে কেঁদে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো।আমাদের রুহিন তো তার চোখের পানি আর থামাতে পারলো না।চুটনের কান্না দেখে তার চোখে পানি চলে আসলো।চুটনের কাছে সবকিছু শোনার জন্য আমরা অধির আগ্রহ প্রকাশ করলাম।

চুটন বললো– ; এই ভন্ড পীর আমাদের সমাজটাকে গ্রাস করে ফেলেছে।আমাদের এলাকার মেম্বারসহ সবাই তার শিষ্য। কেউ তার সম্পর্কে কোনো কথা বিশ্বাস করে না।এই ভন্ড পীরের নজরে আমার আদরের বোনটি পড়লো বলে।সে বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছে চুমকি কে বিয়ে করার।আর বলছে পীর সাহেবের কাছে আমার বোনের বিয়ে হলে তার সন্তান ও পীর হবে।সে বললো একমাত্র আমিই পারি তার ( চুমকির)ভাগ্য খুলে দিতে।

রুহিন বললো,আর কিছু বলেছে কী?

– বলেছে বটে।সে নিজেকে একজন আদর্শ পীর মনে করে,যার কারণে সে শিরক করতে ও একবার দ্বিধাবোধ করছে না।আমার বাবা মা তার কথায় ছোট্ট বোনটিকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে।বোনটি আমার কেঁদে যেন দু চোখে বন্যা বেয়ে আনলো।

রুহিনুর বললো;- চলো চুটন,এক্ষুনি আমরা তোমাদের ঘরে যাব।আমরা চুটনদের ঘরে গেলাম।সেখানে ভন্ড পীর বাবাকে সালাম জানালাম। পীর বাবা সালাম ফেরিয়ে আমাদের বসতে বললো।আমরা বসলাম।রুহিনুর ওনাকে বললেন, পীর সাহেব আপনি কী ইসলাম দ্বীন মানেন?
তিনি বললেন,অবশ্যই।কেন নয়? তবে আমার নজরে সকল মানুষই সমান।আমি মানুষদের মধ্যে শান্তি ছড়াতে চাই।এটা তুই আমাকে প্রশ্ন করলি কেন?

বলবো,সব বলবো।আর কিছু প্রশ্ন যে বাকি রইলো- রুহিনুর বললো।পীর সাহেব আপনি নামায পড়েন?

– পড়ি,আমি নামায পড়ি।

আপনি কোথায় নামায পড়েন মসজিদে, নাকি ঘরে?
– কোথ্থায় ও না।
আমি বললাম,তবে আপনি কোথায় নামায পড়েন?
– এই তো ক্বলবের মাঝে সরাসরি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে।
তার মানে আপনি আল্লাহ কে দেখতে পান?
– অবশ্যই! সে তো আমার মুর্শিদ।মুর্শিদ কে আল্লাহ মেনে নিতে হয়।তাহলে বিচার দিবসে আল্লাহ কে মুর্শিদ রুপে দেখা যাবে।

রুহিনুর বললো,এটা আপনার ভূল ধারনা।

 
وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ کُفُوًا اَحَدٌ ﴿۴﴾

অর্থ– “আর তার কোনো সমকক্ষও নেই।”( সূরা ইখলাস, আয়াত-০৪)

আর আল্লাহ সম্পর্কে দ্বী মত পোষণ করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর সমতুল্য কেউ নেই।তিনি কাউকে জন্ম দেননি ,কিংবা ওনাকে কেউ জন্ম দেয়নি।আপনি পবিত্র কোরআনের( সূরা ইখলাস) সূরা পড়তে পারেন। আর পৃথিবীর সকল পাপের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো শিরক।যে শিরক করে সে মুশরিক।সুতরাং, আপনিও মুশরিকদের মধ্যে পড়েন।

চুপ, একদম চুপ! আমাকে অসম্মান করিস বেটা? স্পর্ধা তো কম নয় দেখছি। এ বলে পীর বাবা দাড়িয়ে গেলেন।

রুহিনুর ধীরস্থির হয়ে বললো,দেখুন ইচ্ছে করলে আমিও ওভাবে উচ্চ কণ্ঠে চ্যাঁচাতে পারি।আপনি আল্লাহ তায়ালার শরিক করছেন আপনার পীর কে।যেমন পীর তেমন শিষ্য। যদি আপনার পীর আপনাকে সুশিক্ষা দিতেন তাহলে আপনি আজ এমন শিরকের মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত হতেন না।নিজে তো জাহান্নামের আগুনে পুড়বেনই, সঙ্গে সঙ্গে এই নীরিহ মানুষদেরকে ও জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে পুড়াবেন।চুটনের মা রুহিনুর কে ধমক দিয়ে বললো,এই ছেলে তুমি কী জানো পীর বাবা সম্পর্কে? অযথা ওনার নামে বদনাম রটাচ্ছ কেন? ওনি আল্লাহর মনোনীত বেলায়তের পীর।অযথা কেন পীর বাবার নামে বদনাম রটাচ্ছ?
তখন আমি বললাম, খালাম্মা রুহিনুর কোনোরকম বদনাম দিচ্ছে না – বরং কোরআন হাদিসের আলোকে ওনাকে ঠিক বেঠিক বুঝিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহ মাফ করুন আমরা না আবার এদের পাপে লিপ্ত হই।রুহিন আমাকে বললো;- না আদনান,এদের পাপ আমরা নেব না।

অপমান,সব অপমান! এ বলে পীর সাহেব চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আল্লাহ কে যারা চিনেনা তাদের আল্লাহ কে চেনার জন্য চোখ খুলতে আজ আমাকেই মুশরিক বলছে।এই ছেলেপিলে তোরা সিদ্ধি খা জ্ঞান হবে।আর নইলে এখান থেকে চলে যা।যারা আমার কাছ থেকে শিক্ষা নেবে না, তাদের আমি শিক্ষা দিতে চাই না। রুহিনুর ওনাকে বললো, আপনার দেওয়া কু শিক্ষা আমরা নিতে চাই না,যা আমাদের জন্য অপকারি।আর আমাদের গাজা খাওয়ার কথা বলতে বিবেকে বাধলো না? এগুলো খাওয়া হারাম।আল্লাহ তায়ালা কোনগুলো হারাম আর কোনগুলো হালাল তা কোরআনে বলে দিয়েছেন। আপনি হারাম বর্জন করুন? এটা ইসলামের দাবি।তাই আমি হারাম বস্তু খেতে পারবো না।আপনিও এগুলো ছেড়ে দিন।
আর আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এই মতবাদ মেনে চলতে হবে আপনাকে।একজন মুসলমান হিসেবে এ জ্ঞান রাখা অপরিহার্য। পীর সাহেব বললেন;-
মানুষের মাঝেই আল্লাহ বিরাজ করেন তাহলে মানুষকে আল্লাহ মানতে সমস্যা কিসের?

রুহিনুর পীর সাহেবকে বিভিন্ন ধারণায় ধারণা দিচ্ছে। রুহিনুর পীর সাহেবকে বললো,-আপনি দয়া করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন না।আপনি যে পীর হিসেবে স্বীকৃতি চাইছেন এটা আপনার আবেগ মাত্র।আপনার আবেগের কারণে অন্য কারোর আবেগ ভাঙতে পারে না।নিজের ভন্ড ভেল্কিবাজি ছেড়ে সুন্দরভাবে জীবন গঠন করুন,আপনাকে সবাই ভালোবাসবে।আর গাজা নামক হারাম জিনিস পরিহার করুন।

যদি পীর হতে চান কোরআন হাদিস থেকে শিষ্যদের ইসলামিক সুশিক্ষা দিন।আপনার সুনাম পুরো দেশে ছড়িয়ে যাবে।এভাবে যদি গাজার শিক্ষা দেন, একে একে আমার মতন বহুলোক তার প্রতিবাদ করবে।বলা যায় না কে কখন আপনাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।“আল্লাহর ইবাদত নিজে করুন এবং অন্যকে উৎসাহিত করুন।নিজে বেশী বেশী কোরআন তিলাওয়াত করুন এবং অন্যকে ও শিক্ষা দিন।নবী রাসুলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের দেখানো পথে জীবন পরিচালনা করুন।” এতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে মানুষের অন্তরে।
একটা কথা মনে রাখবেন-
“ আবেগ যখন উত্তাপে জাগ্রত হবে , তখন তা দাবাতে পারে নিজের আবেগই।।”
নিজের খারাপ আবেগকে হ্রাস করতে ভালো কিছুর আবেগ করুন।তাহলে আপনার ভালো হবে।

পীর সাহেব বললেন, আমি নিজেই যে চুমকি কে বিবাহ করতে বললাম তা নয়,তার মা বাবাও রাজি আছে বটে।আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে।বৃদ্ধকালে আমায় দেখবে কে? তাই বিবাহ করতে চাইলুম।

একদম চুপ! ভন্ডামির শেষ নেই এখন আমার মা বাবার দোষ? খুব তো গাজা মদ খেয়ে মারফত কে অপমান করে,শিরক করে,ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার নামে নোংরামি করেছ – আর ও তোমার বাকি রয়েছে করার?”
চুটন এ বলে আবার কাঁদতে লাগলো এবং বললো,আমার বোনের জীবনটা এই বুড়ো শেষ করে দেবে নিলু দা।নিলু দা তখন চুটন কে স্বান্ত্বনা দিল এবং গামছা দিয়ে মুখ মুছে দিল।
পীর সাহেব তবুও হার মানবে না।আমরা চুটন কে বললাম এই পীর সাহেব আর কিচ্ছু বললে যেন আমাদের জানায়।আমরা চলে এলাম সেখান থেকে।

চার

আঃ বারিক পীর সাহেবের সৎ অসৎ উভয় কর্মকেই সায় দেয় সবসময়।পাড়ার এক ঘরে শুনেছি এক মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে গেছে।তাকে সুস্থ করতে মা বাবা পীর সাহেবের কাছে এলো।পীর সাহেব ওদের জানালেন,মেয়েকে কেউ বশীকরণ করেছে।আর এ জন্যই তার এমন হয়েছে।মেয়েটাকে চিকিৎসা করতে হবে,নিখুঁত চিকিৎসা।এই মেয়ে দুই দিন দুই রাত আমার কাছে থাকবে।তাকে বারবার ফুঁক দিতে হবে।

মেয়েটার মা পীর সাহেবের এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছে।পীর সাহেব বলে কথা।ওনার বর পেলে তো মেয়েটা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।মা তখন পীর সাহেবকে বললেন;- “ বাপজান আন্যে যা কইবেন তাই করুম – তবুও আমার মাইয়াটা রে সুস্থ করাইয়া দেন।” মা তখন নিজের মেয়েকে এক ভন্ডপীরের হাতে তুলে দিতে চাইলো।মেয়েটা বোধহয় আর প্রাণে বাঁচলো না।মেয়েটা বরাবরের মতোই তার মাকে বলে দিল- আমি ওনার সাথে থাকতে পারবো না।আমি একদম সুস্থ আছি।আল্লাহ আমাকে রোগ দিয়েছেন, ওনিই আমাকে সুস্থ করে তুলবেন।আল্লাহ যদি আমাকে ভালো না করেন তাহলে এই পীর বাবা কে? মেয়েটির মা বললো,এমন কইতে নাই রে লক্ষি আমার।ওনি তো আল্লাহর আউলিয়া, ওনার কথা কী আল্লাহ না রাইখা পারবেন? মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ে।মুটামুটি বোঝার ক্ষমতা আছে তার।সে বলে দিল, আল্লাহ তায়ালা নিজের বান্দার কথা শুনতে পান।হোক পীর সাহেব কিংবা সাধারণ মানুষ।

মেয়েটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের জোড়ে তাকে পীর সাহেবের সাথে রাত্রি যাপন করতে হবে।মেয়েটি যদি পীর বাবার সেবা না করে, তবে তার সমস্যা বাড়তে পারে।এই কথাটি আঃ বারিক কানে কানে জানিয়ে দিল মেয়েটির মা কে।ওদিকে চুমকির সাথে বিবাহের আলাপ। চুমকির বাবা চুমকিকে ফোনে বিবাহের কথা বললে সে না বোধক উত্তর দিল।আর এদিকে এই অসুস্থ মেয়েটি।একজন ভন্ড পীরের জন্য দুইজন মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এটা তো কিছুতেই হতে পারে না।রুহিনুরের কানে কথাটি গেল।

পাঁচ

মেয়েটি চিৎকার করতে লাগলো।আঃ বারিক ভন্ড পীরের কথামতো তাকে ধুতুরা পাতার রস খেতে দেওয়া হয়।মেয়েটি এটা খেতে চাইছে না।তার মা খুব জোরপূর্বক তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। তখন আমরা সেখানে উপস্থিত। রুহিনুর মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী পাতার রস।তিনি বললেন,কোনো ঔষধী গাছের পাতার রস হবে।বাবা তো আর আমার মাইয়ার খারাপ চাইবেন না।

তাদের অন্ধবিশ্বাস তাদের বিপদের কারণ হতে যাচ্ছে, কিন্তু এটা বোকাগুলো বুঝতেই পারছে না।রুহিনুর বললো– আন্টি, প্লিজ গিভ মি দি মেডিসিন গ্লাস ইন ইয়র হ্যান্ড।

নিলু দা বললো– সে বলেছে,আপনার হাতের ঔষধের গ্লাসটা তাকে দিতে।

রুহিনুর গ্লাসটা নিয়ে পাতার গন্ধ শুষতে গেলে তার বমি বমি ভাব হলো।এটা তো ধুতুরা পাতার রস,বলে রুহিনুর গ্লাসটা ফেলে দিল।পাতার রস সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।রুহিনুরকে মহিলাটি খুব কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল।তখন ভন্ড পীর এসে রুহিনুরের গালে চড় দিতে চাইলে নিলু দা হাতটি ধরে ফেলে।মহিলা আর ভন্ড পীরকে রুহিনুর ধুতুরা রসের ক্ষতি সম্পর্কে জানালো।
ধুতুরা পাতার রস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।এটি একটি ক্ষতিকর উদ্ভিদ।আর এই গাছের ফুল এবং ফলের মধ্যে তিনটি ক্ষতিকারক বিষাক্ত গ্যাস বিদ্যমান।স্কোপল্যামিন,হাইয়োসালামিন এবং অ্যাট্রোপিন। এই তিনটি বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ধুতুরা মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ধুতুরার পাতা, ফুল বা পাতার রস খেলে মানুষ সমসাময়িক হতবুদ্ধি হয়ে যায়।

এ-এ-এগুলো কী বলছো তোমরা।এ বলে আঃ বারিক তুতলাতে শুরু করলো।মহিলাটি রুহিনুর কে বললো;- ঠিক আছে,এটা না হয় মাইনা নিলাম ওনি ওইটা দিছেন।কিন্তু তিনি না জাইনা দিছেন,এখন তোমরা যাও।আমরা চলে আসলাম। মেয়েটিকে চুপি চুপি বলে আসলাম সে যেন চুটনদের বাড়িতে চলে আসে।মেয়েটি তাই করলো।চুমকি আর মেয়েটি একসাথেই থাকলো।কাল দেখা যাবে কী হয়।আমরা গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

রুহিনুর আমাকে ফজরের আযান দিলে ডাকতে থাকে আবরার আবরার করে।আমরা দুজনে নামাজ পড়তে গেলাম।নামাজ থেকে আর ঘরে আসলাম না।কারণ নিলু দা মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।দিনটি শুক্রবার। এত্ত সকাল সকাল পীর বাবার সামনে তার মুরিদানেরা জড়ো হয়েছে।পীর জুড়ে জুড়ে বলছে,আজ জুম্মার দিন।জুম্মা আম্মা দুটোই সমান।আম্মা থেকে জুম্মা শব্দটি এসেছে,তাই আম্মার সেবা করলেই হবে জুম্মা পড়তে হবে না।আমরা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম বলেই শুনতে পেলাম। তারপর তিনি কোরআন শব্দটির একটি অপব্যাখ্যা করলেন যা সমাজে খুবই ঘৃণিত শব্দ। তিনি বললেন শব্দটি হলো কুরান,কোরআন নয়।কুরান বানানটি দুইভাগে বিভক্ত। একটি হলো কু,আরেকটি হলো রান।কু মানে খারাপ,আর রান মানে মুরগের বা যেকোনো কিছুর পায়ের উপর বিশেষ। সুতরাং, রান বলতে নাকি লিঙ্গস্থান বুঝানো হয়েছে। রুহিনুর এগুলো শুনে একদম পাগলের মতো ব্যবহার করলো।এ তো দেখি কাফের এসেছে এখানে।কোথায় ইসলাম প্রচার করবে,তা না করে সে কটুক্তি বুঝাচ্ছে সাধারণ মানুষকে? আর সাধারণ মানুষ ও এগুলো শিখছে মূর্খের মতো।এদের কী কোনো সাধারণ নলেজ নেই? রুহিনুর গ্রামের মেম্বারের বাড়িতে গেল।আমিও গেলাম তার সাথে। আমরা ওনার কাছে সব খুলে বললাম। ওনি বিশ্বাস করলেন না।মেম্বার ও এই ভন্ড পীরের মুরিদ হয়ে গেছে।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনে বলেছেন-

وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۱﴾

অর্থ-– ”আর যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তার থেকে অধিক যালেম (অত্যাচারী) আর কে? যালেমরা অবশ্যই সফলকাম হবে না। ”( সূরা আল আ’নআম,আয়াত-২১)

কিন্তু এই ব্যক্তি কোরআনের আয়াতকে নয়,কোরআনকেই অবমাননা করছে।মেম্বার সাহেব বুঝতে পারলেন বিষয়টি।তাই তিনি ভন্ড পীরের কাছে গেলেন।ভন্ডের সাথে ভন্ডামী না করলে চলে না।তিনি বললেন কয়েকজন লোক দিয়ে ভন্ড পীরকে মেরে তার কাছ থেকে সব স্বীকারোক্তি নেবেন।রুহিনুর না করলো।সে বললো,তাকে বুঝিয়ে বললেই হবে।মেম্বার বললেন– এই লোক বুঝবে না কখনো তাই একে আমিই বুঝাবো।

ছয়

ভন্ড পীরকে গাছের সাথে বাঁধা হলো।মেম্বার সাহেব রুহিনুরের কাছে সব তুলে দিলেন।সে যা বলবে এখন তাই করা হবে।রুহিনুর বললো;- ওনাকে বুঝিয়ে দ্বীনের পথে আনতে হবে।মিথ্যা, পাপ আর কু চরিত্র ওনাকে এক আলাদা খোলসের ভূষণ দিয়ে রেখেছে।মেম্বার তখন ভন্ড পীরকে বললেন– “কোরআন অর্থ কী?”

“আমি জানি না”!

জানিস না তো আগে কেন বললি,কোরআন কে বিকৃতি করে বলার শাস্তি জানিস? মনে হচ্ছে তোকে ——–

— থাক চাচা,ওনাকে আমি বলে দিচ্ছি।রুহিনুর ভন্ড পীরের বাধন খুলে মেম্বার কে বলো ইসলাম প্রচারে শান্ত্বতা বজায় রাখতে হয়।আমরাও শান্ত্বতা বজায় রাখবো।তারপর ভন্ডপীরকে বললো;–এইযে ভন্ডবাবু,কোরআন শব্দটি এসেছে ক্বারউন থেকে।যার অর্থ পঠিত।কোরআন অর্থ সর্বাধিক পঠিত।কোরআন সারা বিশ্বের মুসলমানগণ একাধিকবার তিলাওয়াত করে বলেই কোরআন অর্থ সর্বাধিক পঠিত। মহান আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান বিজ্ঞানের যাবতীয় সব বিষয় কোরআনে একত্রিত করেছেন, এদিক দিয়ে কোরআন অর্থ মিলিত করা।( রুহিনুর তখন একটু নিরব হলো)

আমি জিজ্ঞেস করলাম,জুম্মা কী?

সে এটারও উত্তর দিতে পারলো না।

রুহিনুর আবার তাকে বুঝাতে শুরু করলো।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۹﴾

“হে বিশ্বাসীগণ! জুমুআর দিনে যখন নামাযের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের জন্য ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।”( সূরা জুমুআ,আয়াত -০৯)

এখানে কোরআনের আয়াতে আম্মার কথা উল্লেখ করা হয়নি। যদি আম্মা শব্দ থেকে জুম্মা হতো তাহলে অবশ্যই আম্মা শব্দটি উল্লেখ থাকতো।

মহান আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ইলম বা জ্ঞান দিয়েছেন,কেউ সেই জ্ঞান কে ভালো কাজে লাগায়,কেউ খারাপ কাজে।“ প্রকৃত মানুষ হতে হলে জ্ঞান কে ভালো কাজে স্থানান্তর করুন,আর মন্দ কাজ পরিহার করুন।” যে ভালো মন্দের পার্থক্য করতে জানে,সে মনুষ্যত্ব বিকাশে নিমেষেই নিজেকে বিলিয়ে দেয়।কোনো পাপ কাজ করলে স্রষ্টার কাছে তওবা করুন,তিনি দয়াময়- দয়া করবেন।

( বিঃদ্রঃ- এই গল্পটি এক বাস্তব কাহিনী থেকে লেখা হয়েছে।শুধু চরিত্র ও স্থানের নাম পরিবর্তন হয়েছে।এটা আমাদের গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে নির্মিত)

৯।মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা কী করতেন?

* আমি রীতিমতো খেতে খুব ভালোবাসি।বন্ধুদের মধ্যে আমিই একটু বেশী পেটুক টাইপের।পেটুক বলে কেউ তাচ্ছিল্য করলেও এটাতে আমার রাগ করার কোনো বিষয় নয়।

আজ আমাদের একজন স্যারের বার্থ ডে সেলিব্রেশনে যেতে হবে।আমিনুর স্যার।তিনি আমাদের কোনো ক্লাশ নেন না।আমাদের বন্ধু রাগিবের ডিপার্টমেন্টের। সে মানবিক শাখার স্টুডেন্ট। “Geography and environment ”এর টিচার তিনি।তিনি এমনভাবে পড়ান,ওনি যেন ভূগোল বই চিবিয়ে খেয়েছেন।আমি যা শুনেছি রাগিবের থেকে।

রুহিনুরের সাথে আমিনুর স্যারের সম্পর্ক একটু ভালোই,পরিচিত হয়েছে বলে।রুহিনুর আমিনুর স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ভূগোল বিষয়ে জানতে ছুটে যায়।

আমরা সবাই আজ স্যারের বাসায় যাবো।স্যার থাকেন নারায়ণগঞ্জ রোড।তখন আমরা সবাই মন্টুর বাসায় চলে গেলাম।গবেট মন্টু যেন আমাদের পাগল বানিয়ে ছাড়বে।

এমনিতে তো মন্টু কখনো আমাদের সাথে খুব বেশী কথা বলতে চায় না,এখন কয়েকদিন ধরে কলেজে ও যাচ্ছে না।তাই আমরা তার বাসায় চলে আসলাম। আমরা কেউই কলেজ হোস্টেলে থাকি না,তেমনকি গবেট মন্টু ও না।সবাই মন্টুর বাসায় নোডলস খেলাম।আমাকে শুধু বকাবকি।আবরার বেশী খায়,বেশী খায় করে সবাই মাথা ঘ্যানিয়ে দেয়।

মন্টুর সাথে মহিবুরের ঝগড়া হয়েছিল।তাই মনে হয় সে কয়েকদিন কলেজ যায় নি। মন্টু সেদিন অন্যায় তর্ক করেছিল মহিবুরের সাথে। তাই আমরা কেউ তার সাথে ক’দিন কোনো কথা বলতে চাইনি।রুহিনুর ঠিকই তার কাছে গিয়েছে। তার সাথে কথাবার্তা ও বলেছে।আজকে মন্টুর বাসায় অনেক আড্ডা হলো।আড্ডাতে শুধু বাজে আলাপ হয়, তা নয়।আমরা কে কোন বই পড়ি তা এসে সবাই গল্প করি।সেদিন মন্টু ফেসবুকের একটি মুক্তমনা নাস্তিকবাদি আইডিতে ডুকেছে।

সে একটি প্রশ্ন পেয়েছে।আইডি যে চালায় সেটার অ্যাডমিন বা সদস্য কেউই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলো না। কেউ কেউ তো এ প্রশ্নের সম্মুখে এসে নাস্তিকতায় ডুকে পরেছে। মন্টুও নাস্তিকদের মতো আচরন করে।আমাদের বন্ধুদের মধ্যে নাস্তিক কেবলমাত্র একজনই।রাগীব। সে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না।তবে আমরা যখন ইসলামিক আলোচনা করি,তখন সে কোনো কথা বলে না।

মন্টু আর মহিবুরকে মিলিয়ে দিলাম আমরা।মন্টু ফেসবুকে একটা প্রশ্ন ফেল, যার সমাধান দিতে সবাই ব্যর্থ।প্রশ্নটা হলো– ” কোরআনের আয়াতে কী শুধু আল্লাহর কথা?”

আমি প্রশ্নটি শুনে হা-হা-হা বলে একটু প্রাণ খুলে হেসে নিলাম।

রুহিনুর আমাকে হাত দিয়ে একটু ঠেলা দিয়ে বললো,হা- হা- হা করছিস কেন? এটা হাসার কোনো প্রশ্ন হলো? এমনভাবে হাসছিস যেন নিজে সব পারিস,সব জানিস?রুহিনুরের কথা শুনে হাসতে হাসতে বললাম,এটা পারবো না একটা কথা হলো?

আমি তখন বললাম ;– কোরআন তো আল্লাহরই কথা।তাহলে- ‘প্রশ্নটা কী শুনি?’ রুহিনুর বললো।আমি শুনেও না শুনার ভান করলাম।রুহিনুর আবার বললো;- তোকে বলছি,প্রশ্নটা কী বলতে।এখন যেন আমার কান খুলে গেল।আমি বললাম– ‘ কোরআন কী স্বয়ং আল্লাহর কথা? ’ দেখলি তোরা,আরেকটা গবেট সবার সামনে আছে।খুব করে তো আমাকে সবাই গবেট বলিস।মন্টু বললো।

মন্টুর কথায় কেউ তেমন কর্ণপাত না করলেও আমি মনে মনে ভাবলাম, আমাকে সে গবেট বললো কেন।অবশেষে বুঝতে পারলাম,আমি প্রশ্নটাই বুঝতে পারিনি।

বলে নেই,প্রশ্নটা হলো ‘কোরআনের আয়াতে কী শুধু আল্লাহর কথা? ’ এখন আমি প্রশ্নটা রাইট বলেছি হান্ড্রেডে হান্ড্রেড।

আমি এই প্রশ্নটা শুনে একটু ভাবতে লাগলাম।উত্তরটা কী হবে? কোরআনের আয়াতে শুধু আল্লাহর কথা নাকি না? কোরআনের আয়াতে শুধু আল্লাহর কথা হলে আর কারোর স্থান নেই,আর কারোর স্থান থাকলে ………… না এগুলো আমার মাথায় আসবে না।মন্টু ঠিকই বলেছে,আমি সত্যিই গবেট সাইজের হয়ে যাচ্ছি আজকাল।

রুহিনুরের দিকে তাকালে তার মধ্যে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তার চাপ দেখতে পেলাম না।

রুহিনুর মন্টুকে তার মোবাইলে ডাউনলোডকৃত কোরআন দেখিয়ে বললো তুই সূরা আল আহজাবের ৪০ নং আয়াতটা পড়ে শোনা তো।

‘তাজ্জব ব্যাপার! আমি কোরআন পড়তে জানি নাকি?’ মন্টু বললো।

রুহিনুর বললো,sorry।তাহলে মহিবুর পড়?

মহিবুর ইংরেজিতে সূরা আল আহজাবের ৪০ নম্বর আয়াত পড়ে সবাইকে শুনালো।সেই সাথে সে দেখে দেখে অনুবাদও বললো।মহিবুর বললো–

‘ Muhammad is not the father of any of your men; But Allah’s Messenger and the Last Prophet.And Allah is All-Knowing ’

‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী।* আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’

দেখ্ তো মন্টু এই আয়াতে কার কথা বলা হয়েছে?

কেন,মুহাম্মদের।এটাতে তো স্পষ্ট দেখা’ই যাচ্ছে মুহাম্মদের কথা এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই তো। এখন বুঝতে পেরেছিস কোরআনের আয়াতে শুধু আল্লাহর কথা, নাকি – না?

বুঝলাম। কোরআনে মুহাম্মদের কথাও উল্লেখ করা আছে।

শুধু তাই না।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনে শুধু নিজের কথা’ই বলেননি।তিনি ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ের দিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মুহাম্মদ, কণ্যা সন্তান সংক্রান্ত,হালাল – হারাম সংক্রান্ত, কিয়ামত সংক্রান্ত, ক্ষমা সংক্রান্ত,খাদ্য সংক্রান্ত , চাঁদ সংক্রান্ত ,কোরআন সংক্রান্ত, ইলম বা জ্ঞান, জ্বীনজাতি, জীববিদ্যা,জ্যোতির্বিদ্যা, দান সদকা,দায়িত্ব, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি সংক্রান্ত কথাও কোরআনে বলা হয়েছে।অনেকে মনে করে কোরআন আল্লাহ তায়ালা নাজিল করেছেন বলে কোরআনে কেবল আল্লাহর কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহর ইবাদতের জন্য মানবতার কল্যানে অনেক দিক নির্দেশনা এবং অনেক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।সো দেটস্ দি অ্যানসার।

সবাই রুহিনুরের দেওয়া সু্ন্দর উপস্থাপনা শুনলো।কিন্তু রাগীবের মনটা দেখলাম কেন জানি খারাপ।তাকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম তার মনটা খারাপ কেন? সে বললো;– তোদের এই ধর্মীয় গোঁড়ামি আমার একদম ভালো লাগতেছে না।

একেকজন একেকরকম আজগুবি হয়ে গেছে।এদিকে নাস্তিক রাগীবের ধর্মীয় গোঁড়ামি পছন্দ হয় না,ওদিকে রুহিনুরের স্পষ্ট উপস্থাপন ছাড়া কিছু শুনতেই ভালো লাগে না।রুহিনুর রাগীবকে জিজ্ঞেস করলো, তার ধর্মীয় গোঁড়ামি কোন দিক দিয়ে খারাপ লাগে।আর ধর্ম বা ইসলামিক বিষয় নিয়ে কথা বললে কেন তার ধর্মীয় গোঁড়ামি বলে মনে হয়।রাগীব এমনিতে ও কড়া মেজাজি। সে বললো– কোন দিক দিয়ে খারাপ লাগে এটাও বলতে হবে? তোদের ধর্ম নিয়ে যেকোনো কথা’ই আমার সহ্য হয় না।

রাগীবকে আজকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে।অন্যদিন তার সামনে ধর্ম নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও সে কিচ্ছু বলে না।

রাগীব বললো,তোরা যে ধর্মে বিশ্বাস করিস এটার ভিত্তি কী? ইশ্বর বা স্রষ্টা বলতে আদৌ কেউ আছে কি-না সেটার নিশ্চয়তাই তোরা কেউ দিতে পারবি না।

রুহিনুর হাসলো।এ কোন অকস্মাৎ কথা।না হাসলে পারা যায় না।আমরা কেউই তার হাসিকে সমর্থন করলাম না।আজকে সবারই রাগীবের কথা শুনে গায়ে লাগতেছে, কারন প্রসঙ্গটা যে যার যার ধর্ম কিংবা ইশ্বরে বিশ্বাসের প্রতি।রাগীব কোরআনের ঐশীকতায় এবং অলৌকিকতায় বিশ্বাসী না।সে বিশ্বাস করে এ গ্রন্থ মানুষ থেকেই এসেছে।আর বৈজ্ঞানিক ধারণায় বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।তাহলে এখানে ঐশ্বরিক কোনো হাত আছে বলে মনে হয় না।

রাগীব যদিও তা মনে মনে ভাবছিলো, কিন্তু অবশেষে সে বলেই দিল কথাটি।সকলের সঙ্গমে সে বলে উঠলো ;– যদি ইশ্বর বলতে কেউ থাকতো তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে তার কোনো অবদান নেই কেন? বিজ্ঞান তো বলেছে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। আমাদের ফ্রেন্ড তো ভালোই থিওরীটিক্যাল হয়ে গেছে দ্যাখি।জাস্ট ফানি ইটস।আই মিন, Can you give some analysis?রুহিনুর এ বলে একটু মুচকি হাসলো।

তাজ্জব ব্যাপার! আমি আর কী বলবো বিশ্লেষণ করে? যা বলার তো সব সরাসরি বলেই দিলাম।রাগীব বললো।

কেন, বিগ ব্যাং রহস্য। হা-হা-হা-হা।

আবরার তুই ও হাসতেছিস? রাগীব বললো।

আমরা সবাই নিরব হয়ে গেলাম।রুহিনুর তখন রাগীবকে বুঝানোর চেষ্টা করছে।একজন নাস্তিক, আরেকজন আস্তিক।দেখতে মনে হচ্ছে যেন কোনো এক টেলিভিশন চ্যানেলে তারা কোনো মোটিভেশনাল কথা বলছে।

রুহিনুর রাগীবকে একটা বলপ্যান দিল।সে জিজ্ঞেস করলো এটা কীভাবে আসলো।কেউ কী বানিয়েছে? হ্যাঁ,অবশ্যই।এটার কোম্পানি আছে।তারাই সেটা কে বানায় এবং বিক্রীপযোগী করে তুলে।রাগীব বললো।

– তাহলে তুই বলছিস এটার কোনো স্রষ্টা আছে?

‘শিওরলি, এটা তো আর নিজ থেকে তৈরী হতে পারে না।সবকিছুর ই একজন না একজন স্রষ্টা আছে।’

– বল্ তো তোকে কে সৃষ্টি করেছে?

‘ আমাদের আবার কে সৃষ্টি করেছে, আমরা মা বাবা থেকে এসেছি।’

– না,আমাদের কে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। ওনিই আমাদের স্রষ্টা।

আবার ইশ্বর,ইশ্বর। যাকে দেখা যায় না তাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো?রাগীব বললো।

– তাহলে এবার তো তোর জন্ম সম্পর্কে আমার খুব দ্বিধা হচ্ছে। ডন্ট মাইন্ড প্লিজ,আমি শুধু তর্কের খাতিরে একটা সত্য যুক্তি তোকে দেখাব।

বলতে পারিস,বল্।

রুহিনুর বলতে লাগলো–
তোর জন্ম হয়েছে তোর মা বাবার থেকে তুই এটাই বলেছিস।তার মানে তোর জন্ম কোনো ইশ্বরিক শক্তির মাধ্যমে হয়নি।আমি যদি বলি তোর বাবার কোনো অস্তিত্বই নেই।আর যদিও থেকে তাকে সে যে শিওরলি আঙ্কেল নাকি অন্য বাহ্যিক কোনো পুরুষ তা কী তুই জানিস? আশা করি জানিস না।আর এটা জানার কথাও নয়।রাতে তোর মায়ের সাথে তোর বাবার নিষেক প্রক্রিয়াতেই তোর জন্ম হয়েছে এটা তো তুই দেখিসনি।শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেছিস।তেমনিভাবে ইশ্বর বা স্রষ্টার প্রতি ও বিশ্বাস রাখতে হয়।

রাগীব বললো,এটা না হয় বিশ্বাস করলাম স্রষ্টা আছে।ধরে নিলাম তিনিই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। মহাবিশ্ব, পৃথিবী, অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ, গ্যালাক্সি ইত্যাদি সবই ধরে নিলাম আল্লাহর সৃষ্টি। এখন আমার প্রশ্নটা হচ্ছে-“ মহাবিশ্ব বা সবকিছু সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা কী করতেন? ” প্রশ্নটা আমি না হয় আবারো ক্লিয়ার করে দিচ্ছি।প্রশ্নটা হলো- “ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা কী করতেন? ”

আমি একটু প্রশ্নটাকে ঘেঁটে দেখলাম,এটার অ্যানসার পারি কি-না।ক্রিটিক্যালি কোয়শ্চান, আই ডন্ট নৌ। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য তো জানি।এখন স্রষ্টা কোথায় আছেন তাও জানি।কিন্তু মহাবিশ্ব বা সবকিছু সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? ইটস্ ডিফিকাল্ট কোয়েশ্চান।সত্যিই এই প্রশ্নের সমাধান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

আমি রুহিনুরের দিকে তাকালাম। এতো ডিফিকাল্ট একটা প্রশ্নের ক্যাজরায় পড়েছে ছেলেটা, তবুও দেখি তার মাঝে কোনোপ্রকার বিষন্নতার ছাপ নেই।রুহিনুর বোধহয় মনে মনে এক্ষুণি এটার সমাধান বের করে ফেলেছে।আমি রুহিনুরের দিকে যতই তাকাই ততোই বিস্ময়ে বুকটা ফুলে ফেঁপে উঠছে, ততোই যেন অহংকার হচ্ছে। এই ছেলেটার ওভার ব্রিলিয়ান্টারি নিয়ে মনে মনে খুব অহংকার হয় আমার।এ যেন দেখি সাক্ষাত জ্ঞানময় কোনো ঐশ্বলীলা।

রুহিনুর ব্যাখ্যা দিতে লাগলো। ব্যাখ্যাটা এরকম ..………

“তোর প্রশ্নটা হলো- “মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা কী করতেন?প্রসঙ্গটা এসেছে প্রাক্তন থেকে।যেহেতু পূর্ব / প্রাক্তন তথা বলা হয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বের কথা, সেহেতু এটা অতীত হয়ে গেছে।এখন প্রশ্নটা হচ্ছে অতীতে স্রষ্টা কী করতেন/ মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে স্রষ্টা কী করতেন? সরল ভাষায় বলতে গেলে কিংবা ধরতে গেলে এটির সমাধান দেওয়া খুবই কঠিন ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।

অবশ্যই আমাদের গতির দিকে লক্ষ্য করতে হবে।কারণ গতিভেদে আমাদের মহাবিশ্বের চলমান অবস্থা জানতে হবে।আগে না হয় সময়ের কথাই বলা হোক।সাধারণ দৃষ্টিতে সময় কিন্তু সবার কাছেই একরকম।যদি ঘড়ির কাটা চলতে থাকে সবার কাছে চলমান,আর যদি ঘড়ির কাটা থেমে যায় তাহলে সবার কাছে চলমানহীন।কিন্তু ব্যাপারটা একদম এরকম নয়।তবে এটা সাধারণ দৃষ্টির দিক দিয়ে বলা যেতে পারে, সময়ের স্থান ও গতিভেদ অনুসারে। সময় স্থান এবং গতিভেদে আপেক্ষিক। আর তা গতিভেদে একেক জনের কাছে একেকরকম মনে হয়।

আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের কথা ধরা যাক।আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রমান করে এটাই যে– ‘সময় এবং স্থানের মাঝে পার্থক্য রয়েছে।’ টাইম এন্ড প্লেইস পার্থক্য না হয় ছেড়েই দিলাম। আরও খোলাশা দিক ধরলেও বলা যেতে পারে গতি কখন কেমন।

– “না ভাই, আর বলতে হবে না।এরকম ইচরে পাকা ব্যাখ্যার কোনো মাথামুণ্ডুই নেই।” রাগীব বললো।

রুহিনুর বললো-“আগে তো পুরোটা শুন,তবেই বুঝতে পারবি।আমি কোথায় যেন এসেছি,হ্যাঁ।বলছিলাম যে,গতি বুঝানোর জন্য আরেকটা পদক্ষেপ নিতে হবে। ধরে নিই আমরা হেটে হেটে প্রায় দু আড়াই কিলোমিটার জায়গা ক্রশ করলাম।কতক্ষণ সময় লাগলো,আনুমানিক ১ ঘন্টা বা দশ মিনিট বেশী হবে।যদি বাই সাইকেলে যাই- আধঘন্টা, আর যদি প্লেনে করে যাই নিশ্চয়ই তিন চার সেকেন্ডের বেশী লাগবে না।কারন একেকটার চেয়ে একেকটা আরো গতিশীল।যার কারণে সময়ও স্থানের পরিবর্তন গতির উপরই নির্ভর করছে।

যে পথটি প্রথমে হেটে,বাই সাইকেলে তারপর উড়োপ্লেনের মাধ্যমে পাড়ি দেওয়ার কথা বলা হলো।এখন যদি সেই পথটিতে আলোর মাধ্যমে পাড়ি দেওয়া হয়,তাহলে কেমন হবে? আমরা জানি,এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে গতিতম হচ্ছে আলো।

আলো প্রতি ১ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়।যা হেটে যাওয়ার চেয়ে কোটি গুণ দ্রততম।সুতরাং, এতে এটাই বুঝতে হবে আলো হচ্ছে সবচেয়ে দ্রততম মাধ্যম, যার ফলে যেকোনো জায়গা অতিক্রম সহজ হয়ে যায়।

তাহলে মাত্র দু আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আলোর কতক্ষণ সময় লাগবে?

যদি আলো প্রতি ১ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়, তাহলে প্রতি সেকেন্ডে দুই বা আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ১ লক্ষ ৫০ হাজার ভাগের এক ভাগ।

এটা তো কেবল আলো।আর এই আলো তুলনামূলকভাবে দু আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কোনো সময়ের মধ্যেই পড়ে না।এর ফল কেবল প্রায় জিরো হয়।

এবার এটা বুঝতে হবে,যদি আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে,তাহলে স্রষ্টার কতক্ষণ সময় লাগবে?

নিশ্চয়ই আলোর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। যদি আলোর গতিভেদে সময়ের মান জিরো তথা এটা তো কোনো মানই না হয় তাহলে আলোর ক্ষেত্রে কোনো সময়ের প্রশ্নই উঠে না।যদি আলোর ক্ষেত্রে সময় কিছু না ‘ই হয় তবে আলোর স্রষ্টার কাছে সময় বলতে তো কোনো কথা হবেই না।আল্লাহ তায়ালার কাছে অতিত ভবিষ্যত বা বর্তমানের কোনো জায়গা নেই।

বরং সময়ের মান আল্লাহর কাছে জিরো বা সময় আল্লাহর নিকট স্থীর।কারন সময়কে আল্লাহ তায়ালা’ই সৃষ্টি করেছেন। আর অবশ্যই তিনি সময়ের চেয়ে দ্রুত বা দ্রুততম।যেহেতু সময় মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি বা সময় আল্লাহ তায়ালার নিকট স্থির, তাই আল্লাহর কাছে এখন তখন বা পরে বলতে কোনো প্রশ্নই আসে না।অতএব মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট যেহেতু বর্তমান, ভবিষ্যত,কিংবা অতীতের কোনো ভ্যেলু নেই – “ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তায়ালা বা স্রষ্টা কী করতেন? ” এরকম কোনো প্রশ্ন অবান্তর।

তবে আমাদের কাছে সময়ের ভ্যেলু রয়েছে।আমরা যদিও ভবিষ্যতে কী হবে বলতে পারি না,অনিশ্চয়তা নীতি অমান্য করতে পারি না,তবে আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আন্দাজ করতে পারি।

“এখন আমরা বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছি ” এটা বর্তমান। আর এটা কিন্তু আমাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে। “আমরা গতকাল কলেজে গিয়েছিলাম ” এটা অতীত।দুটোই কিন্তু আমাদের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়েছে।সুতরাং আমাদের মাধ্যমে বর্তমান ভবিষ্যৎ কিংবা অতীত ঘটে যাওয়া সম্ভব হলেও আমরা স্রষ্টার মতন সময়কে স্থীর মনে করতে পারি না।কেবলমাত্র স্রষ্টার ক্ষেত্রেই সময়কে স্থীর মনে করা প্রযোজ্য।আমরা সময়কে স্থীর মনে করতে পারি না।তাই আমি এটাই শেষে বলতে পারি “মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা কী করতেন? ” প্রশ্নটা অবান্তর। ”

রাগীব মাথা নুইয়ে রাখলো।রুহিনুর তাকে জিজ্ঞেস করলো আর কোনো প্রশ্ন আছে কি-না।সে না বোধক মাথা নাড়লো।

মন্তব্য করুন