Skip to content

কৃচ্ছ্রসাধক

মাথায় জট পাকাইয়া গিয়াছে। সন্ধ্যার বাতাস নাকি খারাপ। খারাপ বাতাস লাগিলে নাকি মনুষ্যের মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া যায়। ইহার সত্যতা যাচাই করিয়া দেখিবার মতো অবসর তখন নাই। এই মুহূর্তে যে গৃহত্যাগী কৃচ্ছ্রসাধক হইবার সাধ জাগিয়াছে তাহা পূরণ করিবার জন্য অতীব ব্যগ্র হইয়া শহরের দিকে ছুটিলাম। কৃচ্ছ্রসাধকগণের আদৌ টাকা কড়ি লাগে না ভাবিয়া তাহা আর সংগ্রহ না করিয়াই ব্যস্ততম নগরীতে পদচারণ করিয়া বুঝিতে পারিলাম – কৃচ্ছ্রসাধকেরও অর্থের প্রয়োজন বৈ কি! পকেট হাতড়াইয়া অনেক দিনের সঙ্গী যান্ত্রিকবার্তাবাহকটাকে বাহির করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া থুতু লাগাইয়া তাহার কল্পিক মস্তকে চুম্বন করিয়া তাহাকে জল্লাদের হাতে সোপার্দ করিয়া বিনিময়ে কিছু অর্থ লইয়া টিকিট কাউণ্টারের দিকে অগ্রসর হইলাম।
কাউণ্টারের জঙে ধরা আরামকেদারায় দুলিতে দুলিতে এক মধ্যবয়স্ক মনুষ্যরূপধারী শেয়াল আমার দিকে নিতান্ত অবহেলায় দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল – কী চাই?
আমার তখন মনে হইলো স্বয়ং আরব্যরজনীর প্রদীপের দৈত্য দৈবক্রমে সম্মুখে আসিয়া সুধাইতেছে – কী চাই?
আমি মনে মনে অংক কষিয়ে দেখিলাম আমার এখন নিতান্ত কয়েকশত পদের চাওয়া রহিয়াছে। আমি খানিক ভাবিয়া উত্তর দিলাম-
হে গোলাম, আমায় এখখনি উত্তর মেরুতে লইয়া চলো। কী করিয়া বরফ গলিয়া যায়, আমি তাহার বিহিত করিয়া ছাড়িবো। আমার মতো মহাসাধক থাকিতে পৃথিবীটা সমুদ্রে নিমজ্জিত হইবে ইহা কীরূপে আমি গ্রহণ করিবো?
আমার উদ্ভট উচ্চারণে বিব্রত হইয়া দৈত্য একখান কাগজে কীসব লিখিয়া আমার হস্তে সমর্পণ করিয়া গোটা তিনশত টাকা দাবী করিয়া বসিল। আমার তখন মাথায় পৃথিবীর মতো বিশাল চিন্তাধারা চলিতাছে বলিয়া তিনশত টাকার মতো তুচ্ছ বিষয় অনতিবিলম্বে দান করিয়া দৈত্যের কাউন্টারের এক সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলাম। আমার কাছে তখন হাতলভাঙা কেদারাও সিংহাসনই বটে। কিছুকাল ব্যাপিয়া জটিল বরফগলা নিয়া ভাবিয়া তাহার সহিত আধ্যাত্মিক যোগ সূত্র মিলাইয়া পার করিবার পর একটা চক্রযান কানের কাছে আসিয়া গতিহীন হইয়া পড়িলো। কিন্তু আমি যে তখন গতিশীল চিন্তায় নিমজ্জিত হইয়া ছিলাম। চিন্তার সাপেক্ষে চক্রযান গতিশীল। দৈত্য তখন তটস্থ হইয়া কহিল –
আপনার বাহন আসিয়া পৌছিয়াছে, মালিক।
। কয়েকবার শূন্যে পাক খাইয়া চক্রযানের সাপেক্ষে নিজেকে স্থির করিয়া উঠিয়া পড়িলাম পৃথিবী জয় করিবার নিমিত্তে।
কিন্তু হায় জনাবিশেক মনুষ্য তাহাতে দিব্বি আয়েশে নিদ্রিত। কেউ বা মুদিত চক্ষু পরম আলস্যে খুলিয়া দেখিলো তাহাদের অভাগা নবাগত এই কৃচ্ছ্রসাধককে। দেখিয়া সন্তুষ্ট চিত্তে পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িলো পরম নিশ্চয়তায়। নরম গদীতে পরম নিঃশ্চিন্তে বসিয়া জানলা দিয়া ব্যগ্রতার সহিত চাহিয়া রহিলাম। চক্রযানের কী করিয়া ডানা গজাইয়া উধ্ধাকাশে পাড়ি জমায়। ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া পরম ক্লান্তিতে চক্ষুযুগল মুদিয়া আসিলে আর পরম দুর্ভাগ্যের কারণে চক্রযানের ডানা দেখিতে পারি নাই।

কতকাল ঘুমাইয়াছি তাহা স্বরণে নাই। চক্রযান হইতে আমাকে কে যেনো ফেলিয়া দিয়া গেছে ব্যস্ততম রাস্তায়। আহা! উত্তরের বরফের স্তূপ দেখিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া ইতিউতি তাকাইয়া যখন নিজের দিকে চক্ষুযুগল পড়িল বিস্মিত হইয়া দেখিলাম – মহেশ্বর আমাকে সত্যিকারের কৃচ্ছ্রসাধক বানাইয়া দিয়াছেন। আমার পরিধেয় বস্ত্রাদি তিনি সযত্নে উধ্ধাকাশে নিয়া গিয়াছেন। ভোরের আলো ফুটিবার পর লগ্নে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া মানুষ আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া ধরিলো। মুসলমান আসিয়া পানি পড়া নিয়া যায়, সনাতন আসিয়া পদধূলি নিয়া যায়। পদতলে জমিতে থাকে অর্থের স্তূপ । এমতাবস্থায় কয়েকজন কানের কাছে আসিয়া জানিতে চায় – তোমার ধর্ম কি হে গুরু?
এতদিন তো মনুষ্যই ছিলাম। ভণ্ডামির মুখোশ পরিয়া যখন তাহাদিগকে ঠকাইবার নিমিত্তে নিজেকে জাহির করিতে বাধ্য হইলাম- তখন ধর্ম আসিয়া কাঁধে ভর করিতেই পারে।

মন্তব্য করুন